| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: রিমঝিম । সালমা বাণী

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

শূন্যের ওপর নাচছে রিমঝিম! আর দর্শক সারির সামনে বসে আছে রায়ান। বিস্ময়ে অপলক রায়ান মোহগ্রস্তের মতো রিমঝিমের নূপুর বাঁধা পায়ের ওপর দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে ভাবছে এও কী সম্ভব! মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যেন পলকে পলকে ঘুরে যাচ্ছে ছন্দের তালে তালে।একি রায়ানের চোখের ভুল? রিমঝিমের পা জোড়া মঞ্চের ওপরে নয়, সে যেন নাচছে শূন্যের ওপর। তাইতো মনে হচ্ছে রায়ানের। সে তার চোখ দুটোর দেখার ভুল মনে করে আরও গভীর দৃষ্টি আটকে রাখে রিমঝিমের পায়ের ওপর। দুচোখের দৃষ্টি রিমঝিমের পায়ের ওপর আটকে রেখে চেষ্টা করছে নিশ্চিত হবার। না রিমঝিম মঞ্চের ওপর নয়, সে তো নাচছে শূন্যের ওপর! রিমঝিমের নাচ দেখতে দেখতে হয়ত রায়ান যেন ভুলে যায় নিয়মিত নিঃশ্বাস নিতেও।আর ক্রমাগত বাড়তে থাকে তার হৃৎপিন্ডের স্পন্দন!


আরো পড়ুন: অমাবস্যায় পূর্ণিমার ছায়া । অঞ্জন আচার্য


এমনই বিভোর হয়ে থাকে রায়ান যখন রিমঝিম নাচে মঞ্চের ওপর। যেখানেই রিমঝিমের নাচের অনুষ্ঠান সেখানেই মঞ্চের সামনে এমনই অপলক হয়ে বসে থাকে রায়ান। এই অপলক চেয়ে থাকা শুরু হয়েছে প্রথম যেদিন সে দেখেছিল রিমঝিমকে টিএসসির মঞ্চে নাচতে। এমনও চমৎকার হতে পারে কোনও মেয়ের নাচ সে ধারণাও যেন ছিল না রায়ানের । এ যেন হতেই পারে না কোনও মানবীর নাচ! এ যেন রূপকাহিনীর কোন এক ময়ূরীর নাচ!

দিনটা ছিল টিএসসিতে বসে ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে বেহিসেবি আড্ডার। হঠাৎই বন্ধুরা বললো চল গীতিনাট্য দেখিগে। আজকের রিমঝিমের একক গীতিনাট্য। চল, চল, যাই, নাচ দেখবো রিমঝিমের। রিমঝিমের জনপ্রিয়তা এখন যেন আকাশ ছোঁয়া। টেলিভিশন, মঞ্চ যেখানেই নাচের অনুষ্ঠান সেখানেই সকলের প্রিয় শিল্পী রিমঝিমের নাচ। সেদিন, সেই প্রথম পরিচয়ের সন্ধ্যাতেই রায়ান জানিয়েছিল তার মুগ্ধতার কথা। ওর বন্ধু আকাশের সাথে রিমঝিমের বন্ধুত্ব। রিমঝিম আর আকাশ ওরা দুজন ক্লাস ফ্রেন্ড। গীতিনাট্য শেষ হওয়ার পর মঞ্চ থেকে রিমঝিম যখন নেমে এলো তখন আকাশ এগিয়ে গেল মঞ্চের কাছে, সাথে নিয়ে রায়ানকে। অনেক কথা, অনেক গল্প পরিচয়ের সেই প্রথম সন্ধ্যায়। সেদিনের সেই পরিচয় থেকে বিয়ে পর্যন্ত এভাবেই দেখেছে রিমঝিমের নাচ দুচোখে অপলক মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে।

দিন যায় বাড়তে থাকে রিমঝিমের জনপ্রিয়তা। যেখানেই রিমঝিমের নাচ সেখানেই উপচে পড়া ভিড়।শুধু রায়ান নয়, রিমঝিমের নাচ দেখে দর্শকের চোখেও যেন লাগে বিস্ময়ের ঘোর। নাচে শেষে মঞ্চ থেকে নেমে এলে লম্বা লাইন পড়ে যায় ভক্ত অনুরাগীদের,তার অটোগ্রাফ নেয়ার। শুধু মঞ্চ থেকে নেমে আসার পরই বা কেন, ইনিভাসির্টি, শপিং মল থেকে শুরু করে যেখানেই যায় সেখানেই ভক্তদের নজরে পড়ে যায়। রোজই রিমঝিমের নাচের অনুষ্ঠান আছে কোথাও না কোথাও। ভীষণ ব্যস্ততায় কেটে যায় রিমঝিমের প্রতিটা দিন। যেটুকু সময় বাড়ীতে সেটুকু সময়ও সে ব্যস্ত থাকে তার নাচের রিহার্সেল, পোশাক ডিজাইনিং অথবা বাছাই, অনুষ্ঠানের বুকিং নেয়া অথবা এ্যাডভান্স পেমেন্টে নেয়া ইত্যাদি সবই তার নাচ বিষয়ক।

রায়ান পাগল হলো রিমঝিমকে বিয়ে করার জন্য। রিমঝিম বুঝালো রায়ানকে, দেখো রায়ান, আমি নাচের শিল্পী, আমার জীবনের একমাত্র সাধনা আমার নাচ। নাচ ছাড়া আমি আর কিছু বুঝি না, আমার জীবনের সকল আনন্দ নাচে। একদিন প্রাকটিস না করলে কেমন যেন বিষন্ন হয়ে যায় দিনটাই আমার । তারপরও রায়ান নাছোড়। ঠিক আছে তুমি নাচবে, তুমি তোমার নাচ নিয়েই থাকবে, আমি তো তোমার নাচের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না। রায়ান হয়ত সুর করে তখন গায়, তুমি নাচবে…নাচবে, নাচবে…আমি দেখবো, দেখবো…দেখবো…দেখবো… অনবদ্য সেই ভালবাসার প্রকাশ!

রায়ানের অতিরিক্ত আহ্লাদ আর জেদের কারণে দুই পক্ষের ধুমধামে বিয়ে হলো রিমঝিম আর রায়ানের। বিয়ের অনুষ্ঠানও ছিল নাচে গানে ভরপুর। টেলিভিশন মঞ্চের নাচের জনপ্রিয় শিল্পী চেনামুখ, প্রিয়মুখ তাদের সকলেই এসেছে রিমঝিমের বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়ে। তাদের সকলেই রিমঝিমের বন্ধু সহযাত্রী, এসেছে রায়ানের বন্ধুরাও। রিমঝিমের নাচের সঙ্গী বন্ধুরা অনেক যতনে, অনেক রিহার্সল দিয়ে রচনা করেছে স্পেশাল গীতিনাট্য শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। শুধু তাই নয় বিয়ে বাড়ির অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য বাংলা হিন্দি আর ইংলিশ গানের মিশেল দিয়ে বন্ধুরা সাজিয়েছে নতুন অনেকগুলো নাচ। বিয়ের অনুষ্ঠান ঝলমলিয়ে ওঠে নাচে গানে।

বিয়ের পর রায়ান আর রিমঝিম গেল হানিমুনে ব্যাংকক। পাতাইয়া সেই সমুদ্র তীরে রায়ানের সেকি পাগলামি। শোনও রিমঝিম তুমি সাগরের পানিতে দাঁড়িয়ে একটু নাচো না, আমি তোমার অনেক ছবি তুলি। তুমি সাগরের বুকে নাচছো! ধুত রায়ান, তুমি না একটা ক্রেজি, এই সমুদ্রের পাড়ে নাচবো কী করে? কত মানুষ দেখছো?

তাতে কী হয়েছে? তোমার নাচ তো সবাই দেখে, লজ্জা পাচ্ছো কেন? প্লিজ তুমি একটু নাচের পোজ দাও আমি অনেকগুলো ভিডিও আর ছবি তুলে নিই। প্লিজ, রিমঝিম…। ব্যাংকক থেকে ফিরে কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার রায়ানের শখ হলো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কটা দিন কাটাতে। রায়ানের ঘুরে বেড়ানোর বাতিক আছে সেটা প্রেম করার সময়ই রায়ান জানিয়েছে। রিমঝিমেরও ভাল লাগে এই বাতিক। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতেও রায়ানের সেই একই আবদার। সূর্য উঠার আগেই রিমঝিমকে ঘুম ভাঙ্গায়। চলো ভোরের সূর্যের সামনে তুমি নাচবে। তোমার পেছনে সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে, তুমি নাচছো, উহু, কী দারুন লাগবে সেই দৃশ্যে তোমাকে! ভোরের সূর্য উঠছে সমুদ্রের বুকের ভেতর থেকে, রিমঝিম নাচের মুদ্রা দিল আর রায়ান সেটা ধারণ করে নিল ভিডিওতে। সত্যিই অপূর্ব এসেছে সেই সব ভিডিওতে, নাচের মুদ্রার ছবিতে রিমঝিম।

কিন্তু এমন মধুর দিনগুলো খুউব দ্রুতই বদলে যেতে লাগলো। কেমন যেন বদলে যাচ্ছে বিয়ের আগের সেই রায়ান। ইদানিং প্রায়ই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, নিষেধ করে রিমঝিমকে নাচের অনুষ্ঠানে যেতে অথবা বলে, ফোন করে ক্যান্সেল করে দাও আজকের অনুষ্ঠান।

অবাক হয়ে রিমঝিম জিজ্ঞেস করে কেন? আমি আমার অনুষ্ঠান ক্যান্সেল করবো কেন?

রায়ান আবদারে সুরে বলে আমি আজ তোমাকে খুউব কাছে পেতে চাইছি, কাটাতে চাচ্ছি সারাদিন একান্ত নিবিড় রোমান্টিক সময়। সাপের শংখ লাগা দেখেছো? সারা দিন আমরা শংখ লাগা সাপের মতো জড়িয়ে জড়িয়ে থাকবো।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, সেটা হবে, আমার প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যাবে আটটার মধ্যেই, তুমিও চলো আমার সাথে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই চলে আসবো বাসায়, যত খুশি রোমান্স করো তখন। রায়ান জেদ ধরে না ক্যান্সেল করে দাও। অবাক বিস্ময়ে রিমঝিম বলে, আমার নাচ ক্যান্সেল করে দেবো, এটা হতেই পারে না, এত বড় অনুষ্ঠান সব একেবারে পন্ড হয়ে যাবে আমি না গেলে। কতদিনের রিহার্সেল তুমি ভেবে দেখো, তা ছাড়া কত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। আর আমিই থাকছি লিডে। এই ধরনের যুক্তি দিয়ে শুরু হয় দুজনার তর্ক বিতর্ক,বাকবিতন্ডা।

ছেড়ে দাও এই সব নাচ, কয় টাকা পাও তুমি নেচে? আমি তোমাকে প্রতিমাসে দশগুন বেশি দিয়ে দেবো।

আমিতো শুধু টাকার জন্য নাচি না রায়ান, নাচ আমার আনন্দ, নাচ আমার ভাললাগা, নাচ আমার সাধনা।

ফালতু কথা বলো না, নাচ তোমার সাধনা, আসলে তোমার নাচের উদ্দেশ্য কী সেটা আমি জানি!

কী বলছো তুমি এসব? কী? আমার নাচের উদ্দেশ্য কী?

ইয়েস,ইয়েস, তোমার নাচের উদ্দেশ্য হলো জাষ্ট নেচে নেচে নিজেকে শো করা, বডি শো করা আই মিন দেহ প্রদর্শন করা। তুমি কী মনে করো আমি বুঝি না? এখন বন্ধ করো এইসব নাচানাচি, দুনিয়ার পুরুষদের সামনে দেহ দেখায়ে এত কোমর না দুলালেও চলবে। অনেক তো নেচেছো বুক পাছা নাচায়ে, আর কেন? কোনও না কোনও একটা সময়ে এসে তো থামাতে হবে তোমার এইসব নাচানাচি!

রিমঝিম অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে রায়ানের দিকে। একেবারেই অচেনা লাগে এই রায়ানকে। রায়ানের মা বাবা পছন্দ করে না রিমঝিমের নাচ করে বেড়ানো। কয়েকদিন রিমঝিমকে বলেছে, এবার না হয় নাচটা ছেড়ে দাও। আমাদের বাড়ির বৌ এভাবে নেচে বেড়ানোটা ঠিক মানায় না। রিমঝিম তখন নীরব থেকেছে, কোনও উত্তর দেয়নি। ভেবেছে মা বাবা অনেক সময় কনজারভেটিভ হয়! রায়ান ঠিক থাকলেই হলো।কিন্তু খুউব সহসাই রায়ানও যেন বদলে গেল। কঠিন সুরে অনেকটা রায়ানের মা বাবার মতো করেই রায়ান বলে, নাচটা এবার ছেড়ে দাও রিমি।

অবাক বিস্ময়ে রিমঝিম প্রশ্ন করে কেন? আমি নাচ ছেড়ে দেবো কেন?

কারণ আমার মা বাবা পছন্দ করে না তুমি এভাবে নেচে বেড়াও। তাদের ভীষণ আপত্তি। আমাদের ফ্যামিলির ট্রেডিশনে নেই মেয়ে বৌ এভাবে নেচে বেড়ানো!

রিমঝিমের সোজা সাপটা উত্তর, না, আমি নাচ ছাড়ার জন্য শিখিনি। তুমি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারো, তুমি খুউব ভাল করেই জানো, তাছাড়া তুমি বিয়ের আগে তোমার এই মুখোশটাও খোলোনি। তখন একবারের জন্যও তো উচ্চারণ করনি তোমার এই গোপন ইচ্ছা। তোমার মা বাবা নাচ পছন্দ করেন না সেটাও জানাওনি! তুমি কী মনে করেছো বিয়ের পর ট্রিক করে আমার নাচ ছাড়াবে? কোনও দিনও নয়, নাচ আমার এক জীবনের সাধনা।

প্রায়ই রায়ানের সাথে নাচ নিয়ে শুরু হয়ে যায় তুমুল ঝগড়া। সেদিনও এমন এক বিতন্ডার সময় ক্ষ্যাপাটে হয়ে ওঠে রায়ান। রায়ান টেনে ধরে রিমঝিমের চুলের মুঠি । চিৎ করে বিছানার ওপর ফেলে বুকের ওপর বসে ক্রমাগত থাপড়াতে থাকে রিমঝিমের চোখে মুখে। তারপর লাফিয়ে নেমে চোখের পলকে ওয়ারড্রবের ওপর রাখা কেচিটা তুলে নেয় শক্ত হাতে, রিমঝিমকে বিছানার সাথে ঠেসে ধরে খ্যাচখ্যাচ করে কেটে দেয় ওর চুলের গোড়া থেকে।

একমাথা ভরা ঘন কালো চুল রিমঝিমের। ঘন কালো চুলের মোটা একখানা বেণী বেঁধে ছেড়ে দিলে নাগিনীর মতো দুলতে থাকে ওর পিঠের ওপর। তার সহকর্মী নাচের শিল্পীরা প্রায়ই বলতো রিমঝিম, কী সুন্দর চুল তোমার, শুধু সহকর্মী বন্ধুরাই নয়, কত কত জনের মুগ্ধ দৃষ্টি আটকে থেকেছে রিমঝিমের সেই বেণীর ওপর । শুধু কী মাথার ওপরেই? মায়াবী মিষ্টি মুখ আর সাপের মতোই ছিপছিপে সুন্দর ফিগার ঠিক যেন নাচের জন্যই তৈরি করেছেন সৃষ্টিকর্তা রিমঝিমকে। মা বাবা দুজনের শখ আর আনন্দে রিমঝিমের নাচের তালিম শুরু। তার জন্মের আগেই মা বাবা ঠিক করে রেখেছিল যদি আমাদের একটা মেয়ে হয় তাহলে নাচ শেখাবো। মা ও বাবা দুজনের মনের আশা পূর্ণ করে মেয়ে এলো কোল জুড়ে। সেই শখেই মা ও বাবা দুজনে মেয়ের নাম রেখেছে রিমঝিম। মাত্র ছয় বছর বয়সে তাকে ভর্তি করে দিল নাচের স্কুলে। প্রথমে বাড়িতেই নাচের শিক্ষক, তারপর বাড়ির কাছে নাচের স্কুল, বুলবুল ললিত কলা, তারপর কলেজ শেষ করলে তিনবছর শান্তিনিকেতনে। সে সবই কী সে আর্বজনার স্তুপে ফেলে দেবে? অথবা রায়ানের ও তার মা বাবার খেয়ালের জন্য নষ্ট করবে?

একি বলে রায়ান? তাকে নাচ ছেড়ে দিতে হবে!

গোছা ধরে কেটে ফেলা চুলের দিকে তাকিয়ে হুহু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রিমঝিম। সে যে বেণী দুলিয়ে নাচে তার প্রিয় ভারতনাট্যম, কত্থক, কথাকলি, মণিপুরী, এসব নাচ যে তার প্রাণের মতো প্রিয়। নাচের সময় সে তার অস্তিত্বের ভেতর অনুভব করে তার বেণীর নাচন। রায়ান কতদিন তার চোখের ওপর বেণীর আবেশ নিতে নিতে বলেছে, জানো রিমি তোমার এই বেণীটা আমার দারুন প্রিয়। কী অপূর্ব লাগে যখন তোমার বেণীটা দোলে তোমার পিঠের ওপর, আর নাচের সময় সেটা ঘুরে আসে তোমার বুকের ওপর, আবার ঘুরে যায় তোমার পিঠে। ওটা দেখতে দেখতে আমি মরতেও পারি। প্রেমের সময় চুলের যে বেণী রায়ানকে মুগ্ধ করতো সেই বেণীই আজ রায়ান কেটে লুটিয়ে দিল! না, এ যে বিশ্বাস করতেও নিজেকেই অচেনা লাগছে রিমঝিমের!

আর এ কষ্টের কথা, এ যন্ত্রণার কথা সে কেমন করে বলবে তার মা বাবাকে! কেমন করে মা বাবাকে বোঝাবে সেই রায়ান আর এই রায়ান এক মানুষ নয়! রায়ান তার কাছে এখন বদলে যাওয়া এক ভয়ের নাম, এক হিংস্র আঘাতের নাম, এক নির্মম কষ্টের নাম! কয়েকদিন ঘরে বসে কেঁদেকেটে শান্ত হয়ে ফোন করলো প্রিয় বান্ধবী প্রিয়তিকে। প্রিয়তি সেই ছোটবেলা থেকে এক সাথে নাচের সাথী। নাচতে নাচতে বড় হয়েছে দুজন একসাথে। সব শুনে প্রিয়তি ফুঁসে ওঠে। কেন নাচ ছাড়বি কেন তুই? তুই নাচ ছাড়বি না। শোন, তুই উইগ কিনে নে, উইগ মাথায় দিয়ে নাচবি, কেউ বুঝবে না। আর খুউব বেশি বাড়াবাড়ি করলে তুই চলে যা তোর মা বাবার কাছে। একমাত্র সন্তান তুই, তোর সাথে এই রকম বাড়াবাড়ি করছে শুনলে উনারা নিশ্চয় তোকে রেখে দেবেন তাদের কাছে। তোকে আর ওর সংসার করতে দেবে না।

কয়েকদিন ঘরে বসে বিষন্নতায় কাটানোর পর রিমঝিম এলো ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরে জয়িতা আহমেদের কাছে। বিদেশি কসমেটিকস, ব্রা, পেন্টি থেকে মাথার উইগ সব কিছু নিজের বাড়ির নীচতলা ও দোতলার সবটা জুড়ে সাজিয়ে বিক্রি করে জয়িতা আহমেদ। আর কাষ্টমারের চাওয়া কোন পণ্য না থাকলে প্রাইভেট অর্ডার নিয়ে সেটা এনে দেয় । রিমঝিম তার কাছে এসে হাসি মুখে বললো লম্বা চুল ম্যানেজ করা ঝামেলা। শুধু নাচের প্রোগামে বেণী বাঁধার জন্য একটা উইগ ব্যবহার করবো, আর রেগুলার ইজি লাইফ লিড করার জন্য এখন থেকে চুল ছোটই রাখবো। লম্বা চুল ম্যানেজ করা অনেক ঝামেলা। এই মিথ্যে সাজানো ছাড়া রিমঝিম যেন আর কোনও পথ দেখে না লম্বা চুল হারিয়ে বাবরি হয়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা দিতে। নাচের জনপ্রিয় শিল্পী রিমঝিম সহজেই যখন তখন নিউজ হয়ে যায় পত্রিকার। চলে আসে মিডিয়ার প্রধান মুখোরোচক সংবাদ হয়ে। এখন যদি কোনও ভাবে টের পায় সে স্বামীর আক্রমণের শিকার তাহলে তো পত্রিকার আনন্দ বিনোদনের পাতাগুলো ভরে যাবে সেই সংবাদে আর সারাদিন জন্য হবে মিডিয়ার আলোচনার হেড লাইন!

সেদিন কোমর পর্যন্ত লম্বা গোছা চুলের একখানা উইগ কিনে নিয়ে এলো রিমঝিম। শিল্পকলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন, সেখানে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, গীতিনাট্যে আজ নাচবে রিমঝিমের দল। মেকআপ সাজগোজ সব প্রায় সম্পূর্ণ, তখন বাড়ি ফিরে এলো রায়ান। রিমঝিমকে সাজগোজ করা অবস্থায় দেখে ক্ষ্যাপা সুরে জিজ্ঞাস করলো কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম? কোমর দুলাতে? বুক পাছা নাচাতে? স্বামীর কথায় কোনও উত্তর না দিয়ে রিমঝিম হাতের ব্যাগ তুলে নিয়ে বের হতে উদ্যত হতেই রায়ান চেঁচিয়ে ওঠে- আমি যে কথা বলছি কানে যাচ্ছে না তোমার? উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছো না? কোথায় যাচ্ছো?

কানে যাবে না কেন? অবশ্যই কানে যাচ্ছে, বেশিই যাচ্ছে! কিন্তু তোমার এই কথার কোন উত্তর দিতে চাচ্ছি না আমি? তুমি তো কথা বলছো না আমার সাথে, এসে পর্যন্ত কনটিনিউআসলি টিজ করে যাচ্ছে, মুখ খারাপ করে আজেবাজে কমেন্ট করেই যাচ্ছো। আমার উত্তর দেয়ার কিছু নেই।

রিমঝিম ঘরে থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পথ আগলে ধরে রায়ান। তুমি আজ নাচতে যাচ্ছো না।

মানে? কী বলছো তুমি?

খুউব সহজ, সিম্পল কথা, ইজি টু আন্ডারষ্ট্যান্ড, তুমি আর নাচতে যাবে না।

তুমি বললে আর হয়ে গেল? আমি যাবো, অবশ্যই যাবো, তুমি অন্য কোনও কথা থাকলে বলো, আমার নাচ নিয়ে কোনও কমেন্ট করবে না, অথবা স্বামীগিরি দেখাবে না, আমি তোমাকে বার বার এই একটা কথাই বলছি, বলতে পারো অনুরোধ করছি।

সাট আপ, তোর নাচের গুষ্টি মারি।

আমি বলছি রায়ান তুমি নিজেকে সামলাও। যথেষ্ট হয়েছে, গালাগালি করে কথা বলা বন্ধ করো। এই কথাগুলো বলতে বলতে রিমঝিম বেড রুম থেকে বের হতে যায়।

অমনি রায়ান পথ আগলে ধরে। তুমি যাবে না আজ নাচতে। খানকি বেশ্যার মতো নাচানাচি তোমাকে বন্ধ করতেই হবে।

ফুঁসে ওঠে রিমঝিম, মুখ সামলে কথা বলো রায়ান, খবরদার আমি তোমাকে নিষেধ করে দিচ্ছি, অসভ্য জানোয়ারের মতো আমাকে গালাগালি দিয়ে, আজেবাজে নোংরা ভাষায় কথা বলবে না।

কি করবি তুই? আমাকে ডর দেখাস? যা, বাইর হঅ, বাইর হইয়া যা…

না, না, ডর দেখাবো কেন? তুমি কী মনে করেছো? তুমি যা ইচ্ছা তাই ব্যবহার করবে, আর আমি সব মুখ বুজে সহ্য করবো? কখনো না, আমি থাকবো না তোমার সাথে। রিমঝিম ওয়ারড্রবের পাশে গিয়ে ড্রয়ার খুলে ধরে। বেডরুমের সাথে ক্লোজেট থেকে হড়হড়িয়ে টেনে নিয়ে আসে খালি লাগেজখানা।বিছানার পাশে লাগেজটা চিৎ করে ফেলে ড্রয়ার থেকে কাপড় নিয়ে ফেলতে থাকে লাগেজে।

এবার রায়ান ঝাপিয়ে পড়ে লাগেজের ওপর। লাথি মেরে লাগেজ ছুড়ে ফেলে ঘরের এক কোণায়। তারপর বলে, কান খুলে শোনও, তুমি যাবে না আজ নাচতে। ঘরের বাইরে এক পা ফেলতে তুমি এ্যালাউড না।

আমি যাচ্ছি, এবং যাবো, আর মনে রেখো যতক্ষন না পর্যন্ত তুমি না আগের মতো বদলাচ্ছো, আমার নাচে বাঁধা হয়ে না দাড়াচ্ছো ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আর এখানে থাকছি না।

কোথায় যাবি তুই? কোথাও যাবি না তুই, একদম বাধ্য বৌয়ের মতো ঘরে থাকবি।

তুমি বললেই হলো? আমি এতিম না, আমার মা বাবা আছে, মনে রেখো, আমি আজই চলে যাবো।

রাখ তোর যাওয়াচ্ছি, ছুটে বের হয়ে যায় রায়ান ঘর থেকে। রিমঝিম ওয়ারড্রব থেকে তার প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় ফেলতে থাকে লাগেজে। ততক্ষণে রায়ান ছুটে গেছে রান্না ঘরে। চুলার নীচের পাল্লায় রাখা আছে দা, বটির স্তুপ। সেখান থেকে টান দিয়ে বের করে নেয় দা খানা। এই দা দিয়ে বেশির ভাগ সময়ই বুয়া নারকেল ভাঙ্গে, অথবা মাংশের বড় হাড্ডি কেটে ছোট ছোট টুকরা বানায়। কয়েক মুহুর্ত মাত্র। ফিরে আসে বেড রুমে রায়ান। ধাক্কা মেরে দ্বিতীয় বারের মতো রিমঝিমকে ফেলে দেয় মেঝের ওপর। মেঝেয় ফেলেই আবার চেপে বসে রিমঝিমের বুকের ওপর। এলোপাথারি কোপ মারতে থাকে রিমঝিমের দেহের নানা জায়গায়। আর্তনাদ করে ওঠে রিমঝিম প্রাণের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাঁচাও…। আর ঠিক তখনই একখানা কোপ ঘাড়ের কাছে পড়তেই সে জ্ঞান হারায় । তখনও ক্রমাগত কোপাতে থাকে রায়ান। কোপাতে থাকে রিমঝিমের হাটুর গোড়ায় আর ক্রুদ্ধ ক্ষ্যাপা কন্ঠে বলতে থাকে রাখ তুই, তোর নাচের পা আমি চিরদিনের মতো কেটে ফেলে দেবো, যে পা দিয়ে নাচিস, নাচের দেমাগ দ্যাখাস, তর মতো নাচনেওয়ালিরে কী করে ঠিক করতে হয় আমি জানি, তর নাচানির পা আমি আলগা করে দিচ্ছি তোকে আর নাচতে লাগবে না। ক্রমাগত কোপাতে থাকে রায়ান রিমঝিমের দুই হাঁটুর গোড়ায়।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত