| 28 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-১৬) । নিরুপমা বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,রুণী অভিযাত্রী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা নিরুপমা বরগোহাঞি ১৯৩২ সনে গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ এবং ১৯৬৫ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। লেখিকার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘সেই নদী নিরবধি’, ‘এজন বুড়া মানুষ’, ‘এপারর ঘর সিপারর ঘর’ সহ মোট একুশটি উপন্যাস এবং ‘সতী’, ‘নিরুপমা বরগোহাঞির শ্রেষ্ঠ গল্প’ইত্যাদি দশটি গল্প সংকলন রয়েছে।


সেই শৈশবের স্মৃতি এখন রুণী কীভাবে যে তার কঠিন বর্তমান পর্যন্ত টেনে আনল!’ও’ দাদা  কঠিন অংকটা আমাকে করে দে, শৈশবে কী সহজেই না করে দিতি এখনও যদি করে দিতে পারিস তোকে কিন্তু খুব বাহাদুরী দেব।’

বোনের ফাঁদে অপু সঙ্গে সঙ্গে পা দিল। কোথাও যাবার জন্য ছেলেটা চুল আঁচড়ে চিরুনিটা পকেটে ভরে নিয়েছে মাত্র, ঠিক সেই সময়ে হাতে একটা খবরের কাগজ নিয়েরুণী তার কাছে এসে কথাটা বলল।

‘ কী অঙ্কের দরকার পড়ল তোর? আমি এক জায়গায় যাওয়ার জন্য বের হয়েছি, নিয়েআয় দেখি, যদি খুব বেশি শক্ত না হয় মুখে মুখে করে দিচ্ছি।’ বোনের কাছে অঙ্ককরেখাতির লাভ করা ছেলেটিরহারিয়ে যাওয়া সেই গর্বের ভাবটা অপুর মনে যেন ক্ষীণভাবে হলেও পুনরায় ফিরে এল।

রুণীর মুখে রহস্যময় হালকা হাসি ফুটে উঠল, সে বলল–’ প্রথমে অঙ্কটা শুনে নে,তারপরেমুখেমুখেই,হোক, কাগজে-কলমেই হোক আমাকে করে দে। উত্তরটা আমার চাই’– এই বলে রুণী হাতে থাকা খবরের কাগজটা মেলে তার এক জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পড়ে যেতে লাগলঃ

…’ ফরেনার্স এক্ট ‘ নামে একটি আইন আছে। সেই আইন অনুসারে প্রতিটি বিদেশির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে হবে। চল্লিশ লক্ষ মামলার বিচার করার জন্য কত হাজার বিচারককে নিয়োগ করতে হবে,কত হাজার পেশকার,কত হাজার চাপরাশি,কত হাজার উকিল লাগবে? বিচারকের হুকুম না মানলে জেল,চল্লিশ লক্ষের জন্য কত হাজার জেল, তার জন্য কত হাজার কর্মচারী,প্রতিদিনের খাবারের খরচের জন্য কত লক্ষ টাকা– তার হিসেবটাও চাই । জেল থেকে লড়ি বোঝাই করে রেলস্টেশনে চালান দিতে হবে, তাহলে কত হাজার লড়ি, কত গ্যালনপেট্রোল লাগবে? রেলপথে চালান দিতে গেলে কত হাজার ট্রেন লাগবে? এই বিদেশিরা বাংলাদেশ বা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে যদি আশ্রয় না পায় তাহলে আন্দামানে পাঠাতে হবে তখন কত হাজার জাহাজ লাগবে ? কিন্তু সবচেয়ে কঠিন অঙ্ক দুটো হবে এই সব কিছুর সমাধান করার জন্য কত কোটি টাকা লাগবে এবং কত বছর লাগবে?…ও দাদা, তুই অঙ্কে মহা পন্ডিত হলেও এই অঙ্কগুলি কিন্তু মুখে মুখে করতে পারবি না…

অতঃপর অপু এক ধরনের সম্মোহনী দৃষ্টিতে যেন বোনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েরইল, এখন রুণী চুপ করে যাওয়ায় বাচ্চাদের মতোই একটা কাজ করে ফেলল সে, হঠাৎ সে বোনের গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে বলে উঠল–’ এই দুষ্টু মেয়েটি আমাকে পাগল করেই ছাড়বে।’ তারপরে সে ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

অসমে এবার বিহুরউৎসব পালন করা না হলেও বিহুকে উপলক্ষ্য করেই অনিমা বাপের বাড়িতে এসেছিল। তার দুই ছেলে, টিঙ্কু-রিঙ্কু, একজনের সাত বছর, অন্যজনের পাঁচ বছর।

অনিমাটিঙ্কু-রিঙ্কুকেনিয়েমায়ের কাছে এলে বাড়িতে যেন একটা উৎসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়, যে বাড়িতেরুণীমাকনিষ্ঠতম প্রাণী সেখানে টিঙ্কু-রিঙ্কুরমতো দুটো ছোট্ট আদরের শিশুর আগমন’ দেবদূতের মর্ত‍্যে আগমনের মতোই যে হয়ে উঠবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। ওদের দুজনকে ঘিরে বাড়ির প্রতিটি প্রাণী যে আনন্দ উল্লাস আরম্ভ করে দেয় তা দেখে অনিমা কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–’ আজকাল আমার এই বাড়িতে কোনো কদর নেই। টিঙ্কু-রিঙ্কুই এখন আসল ভিআইপি ! কিন্তু কী যে আনন্দ হয়অনিমার, এক মাস পর্যন্ত তার কোনো মাথাব্যথা নেই, ছেলেদুটিকে দেখাশোনা করা,খাওয়া-দাওয়াকরানো,গল্প করা– সমস্ত দায়িত্ব থেকেই সে মুক্ত। ওদের দাদু, দিদিমা, মামা, মাসি অনবরত ওদের সন্তুষ্ট করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে ।


আরো পড়ুন: অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-১৫) । নিরুপমা বরগোহাঞি


টিঙ্কু-রিঙ্কু সহ অনিমার আগমন এবার যেন বাড়ির প্রত্যেকের জন্যই অতিরিক্ত আনন্দের কারণ হয়ে উঠে। এক ধরনের থমথমে ভাব আজ কয়েক মাস ধরে ঘরটার প্রাত্যহিক জীবনকে ঘিরে রেখেছিল- আজ যেন টিঙ্কু রিঙ্কুর আনন্দমুখর কোলাহলে সেই বুড়ো গম্ভীর পরিবেশটা হালকা হয়ে পড়ল। রুণী টিঙ্কু-রিঙ্কু কে নিয়ে প্রায় নাচ গান শুরু করে দিল–

‘ কলেজ নেই, কাজ নেই।
 
      দিন কাটে না সময়যায় না।
 
টিঙ্কু-রিঙ্কু লাই লেছাই।
 
       কী যে রক্ষা করলি।’

রুণী টিঙ্কু-রিঙ্কুকে নিয়ে প্রায় নাচ গান আরম্ভ করে দিল, ওদের আদরে ব্যতিব্যস্ত করে সে একটা গানও রচনা করে ফেলল(তার জীবনের প্রথম গীতি কবিতার অপপ্রয়াস!) এবং তাত্ত্বিক সুর দিয়ে গাইতে লাগল। তার সঙ্গে রিঙ্কু-টিঙ্কুর কণ্ঠস্বর মিলিত হয়ে একটা কোরাসে পরিণত হলঃ

‘ আগের দিনের ঋষি মুনির কথা
 
      ছাত্রদের নাকি অধ্যয়নং তপঃ
 
(কিন্তু) আজকের ভরত- ভৃগু বলে
 
        না ভাই আন্দোলনং তপঃ।
 
(সেই জন্য) স্কুল নেই কলেজ নেই
 
       দিন রাত কাটে না সময়যায় না
 
রিঙ্কু-টিঙ্কু দুটি ভাই
 
      লাই লেছাইসমপ্রায়।
 
বাচালি যে বাচালি 
 
      বাচালি যে এসে পড়ে।’

রুণীর গানে সুর সংযোগ করায় বেশি অসুবিধা হল না, কারণ’ বাচালি যে বাচালি’ যে সে ভূপেন হাজারিকার’ বাজালি যে বাজালিদিসাং মুখের পেঁপাটির সুরে গেয়ে সমগ্র গানটিতে ডঃভুপেন হাজারিকাকে নকল করে ফেলল।

রিঙ্কু-টিঙ্কুর কী আনন্দ! এবার দাদুর বাড়িতে মজাই মজা হবে, এবার মাসির কলেজ নেই, মামার কলেজ নেই, এখন তারা অনবরত বাড়িতে থেকে তাদের গল্প শোনাবে তাদের সঙ্গে লুডু খেলবে,ক‍্যারম খেলবে–কী মজা!

কিন্তু এবার রিঙ্কু-টিঙ্কু এক অভিনব খেলা শিখেছে, সে খেলাটায় যত বেশি সঙ্গী হয় তত বেশি জমে। সেই খেলা দেখিয়ে মামা মাসিকে চমকে দেবার জন্য ওদের আর তর সয় না দুজনকেই হাতে ধরে টেনে নিয়ে এল রিঙ্কু- টিঙ্কু।

‘কী নতুন খেলারে রিঙ্কু- টিঙ্কু?’ রুণী ভাগ্নীদের পেছন পেছন যেতে যেতেজিজ্ঞেস করল।

‘ বাংলাদেশি, বাংলাদেশি, মাসি। তুমি কী হবে? বাংলাদেশি না অসমিয়া? বাংলাদেশি হলে কিন্তু তোমাকে মারধর করে অসম থেকে বের করে দেব, কারণ তুমি বাংলাদেশি হলে আমরা অসমিয়া হব।’

রুণীর মুখের হাসি বন্ধ হয়ে গেল, তার চোখ বিস্তারিত হয়ে উঠল। তারপর সে হাসতে হাসতে স্ফুর্তির ভাব প্রকাশ করে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা অপু এবং অনিমার দিকে মুখ গোমড়া করে তাকাল এবং অনিমাকে সম্বোধন করে গভীরভাবে বলল –’রিঙ্কু-টিঙ্কুকে এই ভয়ঙ্কর খেলা কেন খেলতে দিচ্ছ দিদি ? ওদের দেব শিশুর মতো মনে এই সমস্ত বিষ কেন ঢুকিয়ে দিচ্ছ?’ এবার অনিমার চোখ বিস্তারিত হওয়ার পালা ।

‘রুণী, তুই সিপিএম?অনিমা একটা ভয়ঙ্কর কথা উচ্চারণ করার মতো প্রায় ফিসফিস করে বলল, বোনের এই অভাবনীয়দেশদ্রোহীর রূপআবিষ্কার করে দুশ্চিন্তা এবং শঙ্কায় তার মুখ শুকিয়ে গেল । হঠাৎ রুণী হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল, সেই হাসি অসহায়তার, সেই হাসি মন খারাপের, সেই হাসি এক ধরনের নৈরাশ্যের। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত