| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: লাথথিখোর । হামিদ কায়সার

আনুমানিক পঠনকাল: 17 মিনিট

আমি ভেবেছিলাম ঠাট্টা। মশকরার ছলে তো এ ওকে গুঁতো মারে, চিমটি কাটে, লাথি দেয়। আমাদের দেশে হরহামেশাই এমনটা ঘটে, ঘটে থাকে, ঘটতেই পারে! এসব ছাড়া বুঝি বন্ধুত্ব জমে না। বিশেষ করে পথেঘাটে যারা থাকে ছেলেপুলে তরুণের দল, কোনো কোনো সময় একটু বয়স্করাও- পাড়ার মোড়ে কিংবা দোকানের সামনে, প্রায়ই দেখা যায় পথচারীকে ভড়কে দিয়ে একজন আরেকজনকে সমানে দৌড়াচ্ছে, তাড়া করে বেড়াচ্ছে, কিলগুঁতো মারছে দমাদম। তাই এক না-শীত না-উষ্ণ নভেম্বরের পড়তি সকালবেলা যখন আমার ঠিক চোখের সামনে সদ্য তরুণ বয়সে পৌঁছানো এক কিশোর এসে সিমেন্টের বেঞ্চিতে শোয়া ওই বয়সেরই আরেক ঘুমন্ত কিশোরকে লাথি মারল, তেমন গা করলাম না, বন্ধু বন্ধুর সঙ্গে ইয়ার্কি ফাজলামো করছে আমার কি! বরঞ্চ অনেক সময় এসব দৃশ্য দেখেও না দেখার ভান করাটাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু যখন দেখলাম যে, ব্যাপারটা আদৌ তা নয়, লাথির পর লাথি চলতেই থাকল- ঘুমন্ত ছেলেটার পিঠে, নিতম্বে, পায়ে, এমনকি মাথায়ও; তা আবার বেধড়ক ধুন্ধুমার! তখন আর আমার পক্ষে স্থির বসে থাকা সম্ভব হলো না। কেননা, লাথি আমার অসহ্য! লাথি আমি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারি না! আপনি আমাকে যেভাবে খুশি মারুন- নাকে ঘুষি দিন, ড্যাগার দিয়ে পেটের নাড়িভুড়ি বের করে ফেলুন, কিন্তু দয়া করে লাথি মারতে আসবেন না। লাথি আমার ছেলেবেলার সব শ্যামল রঙ শুষে নিয়েছে। আমাকে ফেলে রেখেছে আজন্ম এক অস্থিরতার গাড্ডায়।

সত্যি, জীবনে আমি একাই এত লাথি হজম করেছি যে, আমার মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত মানুষও কখনো সে-পরিমাণ লাথি খায়নি বা খাওয়া সম্ভবও হবে না। সকালে লাথি, বিকালে লাথি, উঠতে লাথি, বসতে লাথি- দিনদুপুরে লাথি, লাথি রাতগভীরে। বলতে দ্বিধা নেই লাথির মাধ্যমেই আমার জন্ম হয়েছিল। লাথি খেতে খেতেই বেড়ে ওঠা। হ্যাঁ, কথাটা হেঁয়ালি নয়, সত্যি, কঠিন হলেও সত্যি। লাথি খেয়েই আমার জন্ম হয়েছিল চৈত্রের এক নিদাঘ দুপুরবেলা।

আমার বাবা আমার মাকে খুব মারতেন। ভীষণ ভীষণভাবে মারতেন। কোনো কারণ ছাড়া। বউ মারাটা ছিল তার মজ্জাগত, বউ মারাটা ছিল তাদের বংশধারা। বাবার বংশের সবাই কথায় কথায় বউ পেটাতেন। আমার সেজোচাচা তো বউ পেটানোর জন্য গরুর লাঠিই রাখতেন ঘরে। বড়চাচা ব্যবহার করতেন মুষ্টিবদ্ধ হাত! আমার বাবা কখনো গরুর লাঠি কিংবা হাত ব্যবহার করেননি। তিনি ছিলেন বংশের প্রথম এবং সারা গ্রামের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত লোক। রাখালের লাঠি ব্যবহার করাটা বুঝি ছিল তার কাছে প্রেস্টিজ ইস্যু! তিনি একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন বলে কথা! সব সময়ই সঙ্গে রাখতেন আগুনের সেঁকা দেওয়া চক্রাপাক্রা ছিপছিপে বেত। কিন্তু বেত দিয়ে মারার অভ্যাস তার মোটেই রপ্ত হয়নি। বেতটা হাতেই থাকতো, তার ছিল লাথি মারার রোগ। ছাত্রদের যেমন মারতেন, বাড়িতেও তার সফল প্রয়োগ ঘটাতেন। তবে স্কুলে ছাত্রদের যে বসার ব্যবস্থা ছিল, বেঞ্চের পর বেঞ্চির সারি, সেখানে লাথি মারায় খুব একটা সুবিধা করতে পারতেন না। সেটা না পারার সমস্ত রাগ এসে ঢালতেন আমার মায়ের ওপর, পরে আমার ওপরও।

মায়ের ওপর প্রথম কবে লাথি বর্ষণ করেছিলেন, জানেন? বিয়ের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই। বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার মা এখনো জীবিত, চাইলে জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন, বাবার প্রতি খুব বেশি বিরক্ত হলে রাগে-অভিমানে পুরনো ইতিহাস সব ঢেলে দেন। আর সে লাথি মারার কারণটা জানলে তো আরো অবাক হবেন। গোসলের পর লুঙ্গিটা গোসলখানায় দিতে দেরি হয়েছিল! হ্যাঁ, লুঙ্গিটা দেরিতে দেওয়ায় বাবার শীতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, যদিও গরম পানি দিয়েই গোসল সেরেছেন এবং সে গরম পানি মায়েরই করে দেওয়া, তবু লুঙ্গিটা দেরিতে দেওয়ার অপরাধ বরদাস্ত করতে পারেননি, তখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে গোসলখানাটা ছিল থাকার ঘর থেকে বেশ খানিকটা দূরে, বাবা সেই গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে, সবার সামনে মায়ের নিতম্ব বরাবর কষিয়েছিলেন লাথি। মায়ের নিতম্বই ছিল লাথি মারার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। 

এই যে প্রথম লাথি খাওয়ার ঘটনা, মা হয়তো ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন সারাজীবন, কিন্তু আমার বাবা সে দুঃসহ অভিজ্ঞতা ভোলার কোনো সুযোগই দেননি মাকে। বরঞ্চ এই প্রথম লাথি মেরে ফেলতে পারায় যেন তার প্রাথমিক সংকোচটুকুও ঘুচে গিয়েছিল। এবং তিনি ধীরে ধীরে মাকে লাথি খাওয়ায় অভ্যস্ত করে তোললেন, হুম, রীতিমতো অভ্যস্ত! এরপর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই মারতেন লাথি। লাথি মারার জন্য তো আর অজুহাতের অভাব ছিল না। দরোজা খুলতে দেরি হলো কেন, গামছাটা হাতের কাছে খুঁজে পাচ্ছেন না কেন, মুরগিটা বারান্দায় হেগে বাড়ি নোংরা করেছে কেন, খুঁত ধরাটা ছিল নেশা। আর সে-নেশার বাহ্যিক বিস্ফোরণ ছিল লাথি। খুঁত ধরো আর লাথি মারো! লাথি মারতে মারতে তিনি ক্রিয়াটার এতই গভীরে পৌঁছে যেতেন যে, সব হুশজ্ঞান হারিয়ে যেত। যৌনতার সুগভীর মগ্নতা নিয়ে লাথি মারতেন, আহারের সবটুকু মনোযোগ নিয়ে লাথি মারতেন। লাথি মারার সময় তার কোনো চেতনা থাকত না।

এভাবে লাথির মচ্ছবে একবার তিনি আমার পোয়াতি মায়ের পেটেও লাথি মেরেছিলেন। সে-লাথির আঘাতেই জন্ম হয়েছিল আমার। সেটা ছিল প্রচণ্ড এক কিক শট। যার এক আঘাতেই মা ছিটকে পড়ে গিয়েছিলেন মেঝেতে, রক্তস্রোতে ভেসে গিয়েছিল মেঝ। সে রক্তনদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে আমার অবতরণ ঘটেছিল পৃথিবীর বুকে! সেদিন সেই চৈত্রের নিদাঘ দুপুরে আমার ভূমিষ্ঠ হওয়ার এক মিনিট বা পাঁচ মিনিট আগে বাবা কী কারণে মাকে লাথি মেরেছিলেন, জানি না, কারণটা মা আমাকে জানাতে পারেননি, তবে লাথি খেয়েই হারিয়ে ফেলেছিলেন জ্ঞান।

আমার বড়জ্যাঠি, মেজোজ্যাঠি, দাদিমা এসে মায়ের মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং মাকে শুইয়ে দিয়েছিলেন রান্নাঘরে। আমার দাদাবাড়িতে তখন অদ্ভুত এক চল ছিল। বাচ্চা প্রসবের ঘটনাটা ঘটানো হতো রান্নাঘরে। তখন সে ঘরটাকে বলা হতো ছটিঘর।

আমরা সব কটা চাচাতো-জ্যাঠাতো ভাইবোন রান্নাঘরে জন্মেছি। শুধু তাই নয়, প্রথম চল্লিশদিন আমাদেরকে সে-ছটিঘরেই কাটাতে হতো। তারপর যখন একটু বড় হলাম, লাথি খাওয়ার মতো শরীর যথেষ্ট নাদুসনুদুস হলো, আমার বাবা আমাকেও শুরু করলেন লাথি মারা। ও ঘর থেকে হয়তো এ-ঘরে ডেকেছেন, যেতে দেরি হলো কেন, মারো লাথি! চাচাতো কোনো ভাইবোন ঝগড়াঝাটির কারণে এসে আমার বিরুদ্ধে নালিশ দিল- মারো লাথি! সূর্য ডুবেছে, তবু কেন পড়তে বসছি না, মারো লাথি! পড়াতে বসিয়েছেন, পড়া কেন মুখস্থ হচ্ছে না, মারো লাথি। এভাবেই, হ্যাঁ হ্যাঁ এভাবেই- সূর্য উঠেছে আমি কেন উঠছি না, মারো লাথি! পড়তে বসলেই আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করে ফেলতো। আমার সারা শরীর থরথরিয়ে কাঁপতো। আর লাথির সঙ্গে ধুমিয়ে চলতো গালিগালাজ। গালি যাতে না শুনতে হয়, তার জন্য আমি দু-কানে আঙুল ঢুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু লাথি যাতে না খেতে হয়, তা ঠেকানোর কোনো উপায় আমার জানা ছিল না।

লাথি চলতো, ক্রমাগতই চলতো লাথি! অব্যাহত গতিতে। প্রতিদিন দুইবেলা তো ছিল অবধারিত- সকালে আর সন্ধ্যায়। সকালে বাবা আমাকে অংক করাতেন, সন্ধ্যায় পড়াতেন ইংরেজি। এই অংক আর ইংরেজির কারণে আমার জীবন হয়ে উঠেছিল চরম আতঙ্কময় আর বিভীষিকায় ভরা। অংকের জন্য বাবা আমাকে উড়ন্ত লাথি মারতেন, বেদম লাথি মারতেন, ইংরেজির জন্যও বাবা আমাকে লাথি মারতেন ততোধিক তত জোরে জ্ঞানগম্যি হারিয়ে। অংককে তাই কখনোই আমি গ্রহণ করতে পারিনি। ইংরেজিকেও পারিনি সামান্য আত্মস্থ করতে! অংকের কথা মনে পড়লেই আমার কেবল লাথির কথা মনে পড়ে যায়, ইংরেজির কথা মনে পড়লেই আমার কেবল চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাথির উদ্যত ফনা। অবসাদে আমার শরীর মন দুই-ই ভেঙে আসতে চায়, বিষ-জর্জরিত হয়। নিজের ওপর নিজে ক্রদ্ধ হই নতজানু। কেননা অংক না জানলে এ-সমাজ ঠিক গ্রহণ করতে চায় না, বোকা মনে করে! ইংরেজি না জানলেও বড় করুণার চোখে দেখে। এড়িয়ে তো চলেই, নিচু চোখে তাকায়, জিভ নাড়ায়। আর চাকরি পেতেও কষ্ট হয়। অথবা চাকরি পেলেও সেখানে থাকতে হয় চরম উপেক্ষিত। শিকার হতে হয় সীমাহীন অবহেলার! কোনো কোনো সময় তো আবার সে-চাকরিটাই হয় চট করে হারাতে।

হ্যাঁ, আজ প্রায় এক সপ্তাহ হলো আমার চাকরি নেই। আমি এখন বেকার। ফুল বেকার। পার্কের ভাসমান মানুষ। বিনা নোটিশে আমার সদ্য প্রাক্তন হয়ে যাওয়া এমডি মোজাম্মেল বাশারুল হক আমাকে প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছেন অফিস থেকে। ব্যাপারটা এতটাই আকস্মিকভাবে ঘটেছে যে, আমি ঠিক কী করবো এখন- দিশেহারা! বাসায় মা বা বউ কাউকেই এখনো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। বিমূঢ়ের মতো একদিন একরাত শুয়েবসে কাটিয়ে ফন্দিটা আটি আমি। রোজ অফিসদিনের রুটিনটা বজায় রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে যাব। ফিরে আসব আগের মতোই সন্ধ্যাবেলা কখনো বা বেশ রাত করে। অফিস-ক্লান্ত আমাকে মা এবং স্ত্রী যত্নআত্তির করবেন, মনোযোগী চোখে তাকাবেন, আমার যা খেতে ভালো লাগে খাওয়াবেন! কোনো টেনশন নেবেন না!

সেই থেকে অফিস যাওয়ার নাম করে সন্ধ্যাতক ধানমণ্ডির এই লেক পারে হেঁটে বসে গুলতানি মেরে কাটিয়ে দিই। আমার আশঙ্কা মা এবং বউ- দুজনের একজনও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে না আমার এই চাকরি হারানোর খবরটা। মায়ের মাথা ঘুরানোর পুরনো অসুখটা ফিরে আসতে পারে। মা কোনো দুশ্চিন্তাই সহজে হজম করতে পারেন না। তার ওপর এখন ভুগছেন ডায়াবেটিস প্রেসারসহ নানা জটিলতায়।

বউয়ের সমস্যাটা অন্য রকম। মানসিক রোগও বলা যায়। ও কোনো মৃত্যুর খবর নিতে পারে না, কোনো প্যানিক খবরও! যে-কোনো অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনলেই অস্থির হয়ে পড়ে, মেজাজ হারিয়ে ফেলে! কখনো কখনো নার্ভাসব্রেকডাউনের শিকার হয়। এর জন্য ওকে মনোচিকিৎসকও দেখিয়েছি কয়েকবার। লাভ হয়নি। এ হেন রিনি সংসার চলার একমাত্র আয়ের পথ বন্ধ হওয়ার খবরটা কীভাবে সামলাবে ঠিক ভেবে পাচ্ছি না। জীবনের কোনো রকম অনিশ্চয়তাকে ও মানসিকভাবে মেনে নিতে রাজি নয়। কেবল খোঁজে নিশ্চিন্ততা! অবশ্য সব মেয়েরাই তা খোঁজে। সেটাই স্বাভাবিক। আমি রিনির কোনো দোষ দেখছি না। তাছাড়া আমাদের দুটো মেয়ে আছে, ছুটি আর ফুটফুটি- ছুটি চার বছরে পড়লো, এবার ওকে একটা স্কুলে ভর্তি করানোর কথা ভাবছিলাম, সেটা আর কীভাবে সম্ভব হবে কে জানে? ফুটফুটির দেড় বছর- ওর পেছনেও খরচ আছে দেদার! কোথা থেকে যোগাড় হবে এত টাকা?

মেয়েদুটোর কথা ভাবলে নিজেকে আরো বেশি অপরাধী লাগে। এতগুলো বছর চাকরি করলাম, প্রায় দশ বছর তো হবেই, তাও আবার একটা নামিদামি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়! ছিঁড়লামটা কি? হ্যাঁ হ্যাঁ কি ছিঁড়লাম? নিজের মুখোমুখি হলেই আমার নাকেমুখে বাবার লাথিগুলো সব আছড়ে পড়ে। না জমাতে পেরেছি টাকা, না তৈরি করতে পেরেছি আরেকটা যে চাকরি নেব তার প্ল্যাটফরম। অথচ সুযোগ ছিল! মিডিয়া ডিপার্টমেন্টে কাজ করে কতজনে পার্সেন্টেজ খেয়ে-খেয়ে ভুঁড়ি ভাগালো, ঢাকায় দুটা-তিনটা ফ্ল্যাট কিনলো, দেশের বাড়িতে পুকুর কাটালো আর আমি শালা ব্যাংকে একটা নধর অ্যাকাউন্টই খুলতে পারলাম না! যে টাকা জমাতে পেরেছি, তিনচার মাস হয়তো চলা যাবে, তারপর চাকরিবাকরি আরেকটা না পেলে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে ঘুরতে হবে দ্বারে দ্বারে!

সময়মতো টাকা জমাওনি, অন্য কোনো ধান্দা খুঁজোনি- চারুঅ্যাড অফিসে দিনরাত মাথা গুঁজে কাটিয়ে দিলে! এখন তো দ্যাখো অ্যাডভার্টাইজিং ব্যাপারটাই থাকবে কি থাকবে না নড়োবড়ো। থাকলেও অন্যভাবে থাকবে অন্য কোনো ফর্মে। আজকাল লোকে টিভি দেখে না, পেপার রাখে না। সব দেখা সব পড়া ফেসবুক আর অনলাইনেই সেরে নেয়! কোনো অ্যাডফার্মেই আর চাকরি হবে না, আমি একরকম নিশ্চিত। তাছাড়া এমডি মোজাম্মেল বাশারুল হকের হাতটাও অনেকদূর লম্বা, বিস্তৃত! তিনি অ্যাড মালিকদের প্রতিষ্ঠানের জেনারেল সেক্রেটারি!

আসলে এভাবে যে আমার চাকরিটা কখনো যাবে বা যেতে পারে, সে ভাবনাটা মাথায় একবারও আসেনি। কীভাবে আসবে, আমি তো বেশ ব্যালান্স করেই চলছিলাম। তোষামোদিতে অভ্যস্ত না হলে কী হবে, আমার অফিসের দুই মালিকের প্রতিই আমার আনুগত্য ও বিনয়ের পরাকাষ্ঠা যথারীতি দেখিয়ে গিয়েছি। সন্ধ্যে ছটায় অফিসের ছুটি থাকলেও কোনোদিনও বোধহয় রাত দশটা-এগারোটার আগে বাসায় ফিরিনি। আমার দুর্বলতার মধ্যে ছিল একটাই, অফিসে নতুন আসা মেয়েগুলোর মাতাব্বরিকে কোনোভাবেই গ্রহণ করতে না পারা। নতুন কোনো মেয়ে অফিসে জয়েন করামাত্র এমডি মোজাম্মেল বাশারুল হক তাকে এমনভাবে সুপ্রিম পাওয়ার দিয়ে বসেন যে, আমার কাছে তা ভারি অসহ্য  লাগে। ‘মনে করো অফিসটাই তোমার!’ এমনতরো কথা বললে তো যে কোনো মেয়েই মাথায় উঠবে! মাথায় উঠবে কি, চাইবে মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আকাশ ছুঁতে!

মেয়ে-পুরুষের যদি সমান অধিকারই হয়, মেয়েদের প্রতি কেন এমন সীমাহীন পক্ষপাতিত্ব! কী যে অযৌক্তিক আস্পর্ধা দেখাতো দাম্ভিক মেয়েগুলো! আমি হয়তো কৌশলে ওদেরকে যথার্থভাবে এড়িয়ে যেতে পেরেছি কিন্তু রিফাত শাহীন নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আমার এমনভাবে ঠোকাঠুকি লেগে গেল, ও যে আসলেই একটা কালিনাগিনী, সেটা বুঝতে পারলাম চাকরি চলে যাওয়ার পরপর! কিন্তু ওর হাতপা ধরে যে চাকরিটা ফেরাব, তাও আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। তাহলে আর গর্দানের ওপর মাথা থাকার দরকার কি? তাছাড়া আমার চাকরি চলে যাওয়ার পিছনে আরো চার-পাঁচটি রিজন আছে বলে মনে করি।

আমি আসলে আমার ডিপার্টমেন্টে একটু গা হাতপা ঝাড়া দিয়ে বসতে চাইছিলাম। মিডিয়া স্ট্র্যাটেজির পাশাপাশি চাইছিলাম নিজের আয়-রোজগার আরো বাড়াতে। কেননা ভিতরে ভিতরে টের পাচ্ছিলাম, আমার ডিপার্টমেন্টে যারা বুকিংয়ের দায়িত্বে, প্ল্যানিং করে, ডিপার্টমেন্টের হেড, সবাই মিলেমিশে খাচ্ছে, যে যেভাবে পারে টাকা বানাচ্ছে, আমিই শুধু খাচ্ছিলাম ভোগের বাতাসা। তাই ডিপার্টমেন্টের হেডের সঙ্গে বাজিয়ে দিলাম খিটিমিটি! তিক্ততা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, আমাকে অফিস থেকে বের করে দিতে এমডি মোজাম্মেল বাশারুল হকের বিশেষ বেগ পেতে হলো না। কেননা, ডিপার্টমেন্টাল হেড আলী আমজাদ প্রতি নিয়ত আমার বিরুদ্ধে সত্যমিথ্যা অভিযোগ তোলে তার কান ঝালাপালা করছিল!

এখন জানি না কী গতিক হবে আমার! আজ সাতদিন ধরে শুধু ভাবছি আর ভাবছি, ভেবেই চলেছি কী করা যায়! কোথায় যাব! কোথায় গেলে এ-মুহূর্তেই জুটে যাবে একটা চাকরি। নধর না হোক, পোষা বেড়ালের মতো চাকরি!

কোনো সম্ভাবনাই ভেসে ওঠে না চোখের সামনে! উলটো স্বপ্ন দেখার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলছি দিনদিন! অহৈতুকী সময় পার করছি ধানমণ্ডির এই লেক পারের পার্কে এসে!

তা, এখানে আমার অলস সময়গুলো ঠিক স্থবিরও কাটে না। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ আসে। নানান বরণ মানুষ। বিচিত্র প্রকৃতির মানুষ। সবাই মুভমেন্ট করছে, নড়াচড়া। সেই সচলতা আমাকেও ছোঁয়। দয়াময়ী পার্কটা যেন সবাইকেই ঠাঁই দেয়, আশ্রয় দেয়!

সকালবেলা আসে কর্মজীবী মানুষ। তারা কেউ দৌড়োয় কেউ হাঁটে। কেউ হালকা ব্যায়াম সেরে নেয়। এদের সঙ্গে আমার অবশ্য কমই দেখা হয়। কেননা আমি যখন আসি, তারা ফিরে যায় ঘরে কর্মস্থলের টানে। আমিও তো অফিসের সময় অনুসরণ করে পার্কে আসি।

আমার সঙ্গে মূলত দেখা হয় অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সঙ্গে। তারা আসেন ধীরে-সুস্থে। যতটুকু হাঁটেন, তারচেয়ে বেশি জিরান। সম বয়স্ক কারো সঙ্গে অতীত স্মৃতিতে জাবর কাটেন! তারপর আসে নারীর দল, দুজন বা দল বেঁধে। স্কুলে বাচ্চাকে রেখে পার্কে ছুটির অপেক্ষার প্রহরগুলো কাটিয়ে দেয়! একটু পর রোদ গাঢ় হলে দেখা যায় আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েদের। ওরা লেকের পাশে বসে জলরঙ মকশো করে। তারপর আসে ফকির ফেরিওয়ালা- এদের কোনো সময়-অসময় নেই। কাকভোর থেকে কালিসন্ধ্যা আনাগোনা চলতেই থাকে! ফুটবল হাতে আসে পাড়ার ছেলেপেলে। আর সব শেষে নীরবে চুপিসারে গাঁজাখোরের দল। যত সময় গড়ায়, এদের আড্ডা জমে। লালন ফকিরের গানের আওয়াজ বাড়ে। আর হাতপা কাঁপতে থাকে। উড়নমুখী হয়। দেখে দেখে আমার হাসি পায়, ভীষণ হাসি পায় আমার।

হ্যাঁ, এই গাঁজাখোরের দলকে দেখলেই হাসি পায়। কেননা আমি যেদিন এ-পার্কে আশ্রয় নিতে প্রথম এলাম, অবসাদেই হোক আর বিষণ্ণতায়, পার্কের ঢালাই পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম বেশ জুত করে। এক পা দু-পা এগোতে না এগোতেই দেখি অভিজাত চেহারার মধ্যবয়স্ক দুজন মানুষ আমার দিকে ক্রুর চোখে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কী-সব সিভিলাইজেশন নিয়ে বাতচিৎ করছে। তারপর তারা যেন আমার সঙ্গে কথা বলতেও উৎসাহী নয়, হাতের ইশারায় সিগারেট নিয়ে সরে যেতে বললো পার্ক থেকে। তাদের দুজনেরই চোখেমুখে এতটা রাগ বা ঘৃণার উলঙ্গ প্রকাশ ঘটেছিল যে, এটাকে আমার কাছে গলাধাক্কার মতোই মনে হয়েছিল। আমি সেদিন সত্যি সত্যি পার্ক থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। সিগারেটটা শেষ হতেই পরপর আরো দুটো সিগারেট টেনে তারপর আবার অনেক-অনেকক্ষণ পর ঢুকেছিলাম পার্কে।

সেদিন সিগারেট খাওয়াটা আমার কাছে খুবই আবশ্যকীয় হয়ে উঠেছিল। কারণ সিগারেট খাওয়ার জন্য যেমন পার্ক থেকে বহিষ্কার হয়েছিলাম, তেমনি পার্কে ঢোকার আগে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যে, সিগারেট খেতে এক রকম বলা যায় বাধ্যই হয়েছি। মাঝে মধ্যে এ-রকম হয় না স্ট্রেস থেকে রিলিফ পেতে আমরা কোনো একটা অবলম্বন খুঁজি? সেদিন আমি খুঁজে নিয়েছিলাম সিগারেট!

হয়েছিল কি, চাকরিহারা হওয়ার পর বাসায় একরাত একদিন তীব্র অবসাদে কাটানোর আড়ামোড়া ভেঙে যেদিন প্রথম বাসা থেকে বেরিয়ে পার্কে এলাম, সেদিন আমি আসলে প্রথমেই পার্কে যেতে চাইনি, পার্কে যাওয়ার কথাটা মাথায়ও ছিল না, ঢুকে পড়েছিলাম ধানমণ্ডির লেক পারের মসজিদ বায়তুল আমান-এ। কারণ একতলা মসজিদটা বিশাল বড় এবং বেশ খোলামেলা। এর পেছনের দিকে সুপরিসর একটি বারান্দা রয়েছে। সেখানেও বসা যায়। আমি ভেবেছিলাম, সারাটা দিন এ মসজিদেই কাটিয়ে দেব, মসজিদের নির্জনতায় বসে নিজেকে নিয়ে নতুন করে উপলব্ধি করব, হতাশার চাঙর ভেঙে তা থেকে বেরিয়ে মনে কীভাবে শুদ্ধি প্রশান্তি আনা যায় তারই চেষ্টা আর কি!

বলতে দ্বিধা নেই, আমি মানুষটা ছোটবেলা থেকেই মানসিকভাবে দুর্বল। সম্ভবত আমার বাবা আমাকে লাথি মারতে মারতে হাওয়া-ছাড়া তুলতুলে বল বানিয়ে ছেড়েছিলেন… কী বলবো! আমি বোধহয় এক ধরনের মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়েছিলাম। মন সব সময়ই নীল বিষাদে জর্জরিত থাকত। এমনকি তার হুলে আমার যৌবনও ছিল বোবা, কানা, স্থবির! মাঝখানে বিয়ে আর মেয়ে দুটো হওয়ার পর অনেকটাই সুস্থ এবং স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হচ্ছিলাম। চাকরি যাওয়ার পর শুকিয়ে যাওয়া সেই পুরনো ঘা যেন নতুন করে জেগে উঠলো! আবার অস্থিরতা, তীব্র নীল বিষাদ! তাই অকুল পাথারে হাবুডুবুকালে চাইছিলাম কোনো একটা খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে!

সত্যি বলতে কি জীবনীশক্তি বলতে আমার ভেতরে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, হেঁটে চলার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে পড়েছিল, অফিস থেকে শেষবারের মতো বাসায় ফিরে একদিন একরাত শুধু অসাড় হয়ে পড়েছিলাম বিছানায়! তারপর সেই ক্লেদ মা আর বউয়ের কাছ থেকে ঢাকার জন্যই পরের দিন উপরওয়ালার আশীর্বাদের ওপর নির্ভরশীল হতেই অস্থির হয়ে ছুটে এসেছিলাম এ মসজিদে। কিন্তু সে-মসজিদ আমাকে নেয়নি, সে-মসজিদে আমার জায়গা হলো না। জায়গা তো হলোই না, বলা যায় আমাকে এক রকম অপমান করেই বের করে দেওয়া হলো!

আগে জানতাম, মসজিদ মানে খোদার ঘর, সেখানে সবার জন্যই আশ্রয় আছে, সবারই সমান প্রবেশাধিকার; শুধু জানা ছিল না, মসজিদে আশ্রয় লাভটাও আজকাল এতটা দুর্লভ হয়ে উঠেছে। এও জানা ছিল না মসজিদকে ঘিরেও থাকতে পারে একদল স্বার্থান্ধ মানুষ। তখন বেলা দশটা কি সাড়ে দশটা, আমি মসজিদে ঢুকতে চাইলে গেটমুখেই একজন খাদেম টাইপের হুজুর ইন্টারভিউ নেওয়ার মতো জানতে চাইল, এখন আমি কোন ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য ঢুকতে চাইছি। মসজিদের গেটে এসে এমন একটা বেমক্কা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে কল্পনাই করিনি। তাই উত্তরও ছিল অজানা। হঠাৎ কী বলব বুঝে উঠতে পারিনি। চট করেই মুখ থেকে উত্তর এলো, চাশতের নামাজ পড়ব। লোকটি আর আটকালো না। কিন্তু তার চোখ যেন পিছন থেকে আমার পিঠের ঝোলানো রুকস্যাকসমেত আমাকে কাবাবের আগুনের মতো ঝলসে দিতে লাগলো।

ব্যাগটা আমাকে রাখতে হয়, সব সময়ই সঙ্গে রাখতে হয়। চাকরির সময় যেমন রাখতাম, এখনো! এখন তো আরো বেশি। কেননা আমার বউ জানে আমার মা জানে আমি এখনো চাকরি করি, অফিসে যাই- ও যত্ন করে ব্যাগের ভিতর খাবারের টিফিন ক্যারিয়র ভরে দেয়। আরো কিছু টুকটাক খাবার। যেমন একটা লেক্সাস বিস্কুটের প্যাকেট কিংবা একটা আপেল বা নাশপাতি। তার সঙ্গে যোগ করে আমি এখন একটা পাতলা গামছাও রাখি আর একটা বই। সবই সময় কাটানোর সুবিধার জন্য। তাই ব্যাগটা আমাকে সযত্নেই আগলিয়ে রাখতে হয়। পাছে খাবার না আবার পড়ে যায়! তাতে তো পানিরও বোতল থাকে। সেই ব্যাগের শরীরে খাদেম সাহেবের স্যাঁতসেতে চোখের বেষ্টনী নিয়েই আমি পাশের ওজুখানায় ঢুকে ওজু সেরে নিই, তারপর প্রবেশ করি মসজিদে।

মসজিদে ঢুকতেই চরম এক বিচ্ছৃংখলতা চোখে পড়ল। বিশাল আয়তনের মেঝের লম্বা সারি সারি কার্পেটগুলোর প্রায় সবই গোটানো মোড়ানো। শুধু সামনের দুটো কার্পেটই বিছানো রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে ধোয়ামোছার কাজ চলছে। পিছন দিক থেকে স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা দুজন মুসুল্লি টাইপের মানুষকে দেখলাম, ফুলঝাড়ু দিয়ে মুছে মুছে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি এগোব কি এগোব না ভাবতে ভাবতে একেবারে সামনের সারির দিকেই চলে যাই। বস্তুত আমাকে আমার মনের অশান্ত সত্তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সে প্রান্তে। আমার যেন মনের স্বস্তি ফিরে পাওয়াটা খুবই জরুরি। বিশেষ করে আমার ছোটো ছোটো মেয়েদুটোর কথা মনে পড়ছিল। ওদের জন্য অন্তত কোনো না কোনো একটা অবলম্বন খুঁজে পেতে হবে যে কোনো মূল্যে। নইলে যে কী বিপন্নতায় পড়ব, তা ভাবতে ভাবতে দুশ্চিন্তায় দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসতে চাইছিল! তাই আমি যেতে যেতে মসজিদের একেবারে সামনের দেয়ালের প্রান্তে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। পশ্চিমের সে-দেয়াল লাগোয়া তাক জুড়ে শুধু বই আর বই, অজস্র কিতাব, অগণন! মসজিদের ভিতর এত বই আগে কখনো চোখে পড়েনি। ধানমণ্ডিতে অভিজাত ধনাঢ্যরা বাস করেন এ যেন তারই জ্বলন্ত নমুনা। কী এক দুর্নিবার কৌতূহল আমাকে সে বইগুলোর দিকে টেনে নিয়েছিল। তেমন কোনো বইয়ের সন্ধান কি মিলবে যা আমার মনের শান্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে!

বইগুলো হাতড়ে হাতড়ে নিরাশই হলাম। আমি পড়তে পারব বা বুঝব এমন কোনো বই দৃশ্যগোচর হলো না সহসা। সবই প্রায় আরবি নয় তো উর্দু ভাষার। বেশ কয়েকটি কোরআন শরীফও রয়েছে। শৈশবে শিখেছিলাম বটে কোরআন, এখন বোধহয় ভুলে গিয়েছি। অনেকদিন হাতে নিইনি। তবু একটা কোরআন আর রেহাল নিয়ে আমি রুকস্যাকটা পাশে রেখে কার্পেটের ওপর বসে পড়লাম।

কোরআনটা নিজের কাছে টেনে আনি বটে, খোলার আর সাহস হয় না। রেহালের ভাঁজে সেভাবেই পড়ে থাকে। আমি জানি আমি পড়তে পারব না, ভুলে যেতে বাধ্য। ত্রিশ কি তারো বেশি বছর আগে শেখা। আমার এখন প্রায় চল্লিশ চলছে! বুড়ো হওয়ার যোগাড়! অহেতুক সময় নষ্ট করে লাভ কি! আমি গা ঝাড়া দিয়ে নিজেকে সচল রাখার চেষ্টা করি। ঝটপট ব্যাগ থেকে তসবিহ বের করে আমার জন্য যা সহজ তাইই শুরু করলাম-জিকির জপা।

জিকির জপতে জপতে অনুধাবন করি যে চাশতের নামাজও আমার পড়া উচিত, অবশ্যই উচিত! চাশতের নামাজ যারা নিয়মিত পড়ে, অভাব নাকি তাদের স্পর্শ করতে পারে না! আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রিজিকের ব্যবস্থা করে দেন! অবস্থাপন্নদের অবস্থার আরো উন্নয়ন ঘটান। আমিও চাশত পড়ব, তাহাজ্জুদ পড়ব- নফল যত নামাজ আছে- নফল, ওয়াজিব, সুন্নত, ফরজ সব নামাজই পড়ব, এই মুহূর্ত চাশতের সময়- চাশত দিয়েই না হয় শুরু করা যাক! কিন্তু শুরু যে করব, চাশতের নামাজ কত রাকাত, হঠাৎ মনে করতে পারি না! এক ধরনের অসহায়ত্ব বোধ আমাকে কুরে কুরে খায়। অসাড় করে তোলে আমার সত্তাকে। আসলে মনের নিভৃত কোণে যদি হতাশার ঘুণপোকা বাসা বাঁধে, স্বতপ্রণোদিত হয়ে তখন কোনো কিছু করাটা মুশকিল হয়ে ওঠে। এমনকি জিকির জপতেও মন বসানো কষ্টকর! তীব্র অসহায়ত্ব বোধে যখন চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আরেক খাদেম আমার পাশে এসে আমার উদ্দেশে রূঢ়ভাবে বলে উঠল, আপনে পেছনে গিয়ে বসেন।

রীতিমতো হুকুম।

লোকটার কথার মধ্যে এমন একটা ঔদ্ধত্য ছিল যে, অপমানে গায়ে আগুন ধরে উঠল। মসজিদের ভিতর এভাবে কেউ রূঢ়স্বরে কথা বলে, বলতে পারে? পিছনে আমি কোথায় গিয়ে বসব, তাকিয়ে দেখি সব কার্পেটই গোটানো। মেঝেতে ধুলি। লোকটিকে সেই ধুলোময় মেঝে দেখিয়ে বললাম, পিছনে দেখছেন না কি অবস্থা?

লোকটার গলা চড়ে গেল, বাইরে যান। বাইরে গিয়ে বসেন।

কেন? আমি সরোষে জানতে চাই।

লোকটি যেন আমার কথার উত্তর দিতে রাজি নয়। হিমশীতল নিস্পৃহতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু পাশেই যে ঝাড়ু হাতে ধুলি ঝাড়ছিল সে এগিয়ে এসে চড়া গলায় প্রায় হুকুম দিয়ে বসল, সমস্যা কি. আপনি বাইরে যাচ্ছেন না কেন?

দেখলাম অবস্থা বিশেষ সুবিধার নয়। দু-দুজন মানুষ এসে আমাকে ঠেলছে! বেশি কিছু বললে হয়তো আরো বেশি অপমান হওয়ার ভয় আছে, দুজনের হাতেই ফুলঝাড়ু–। তাই অপমানটুকু তখনকার মতো হজম করে রুকস্যাকটা কাঁধে নিয়ে মসজিদ থেকে বাইরে এসে দাঁড়াই। খোলা বিশাল সুপরিসর বারান্দায় বসে আবারো চেষ্টা করি জিকিরের ভিতর মনকে নিমগ্ন রাখতে। কিন্তু না, অপমানের গা দেখছি কিছুতেই হজম হচ্ছে না। বুদবুদের মতো মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে শরীরের কণায় কণায় ছড়িয়ে পড়েছে। তখনই লক্ষ্য করি আরো দুজন আলেম টাইপের লোক বারান্দার এক কোণে বসে-বসে গল্প করছে। এর মধ্যে একজনকে মসজিদে ঢোকার সময়ই দেখেছিলাম, যে আমাকে জেরা করেছিল। তার মানে এরা দুজনই মসজিদের মানুষ। তাদের মধ্যে হয়তো একজন ইমাম হবেন আরেকজন মোয়াজ্জিন। পোশাক-আষাক আচরণ দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছিল। দুজনেরই পরনে ধবধবে পরিষ্কার পায়জামা-পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, গাল-গলাভর্তি দাড়ি।

আমাকে যেহেতু সেই অপমান বোধটুকু তাড়া করছিল, তাই আমি হুজুর দুজনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। যদি কোনো প্রতিকার মেলে বা নিছক প্রতিবাদটুকু পৌঁছে দিয়ে নিজের কাছেই নিজের খানিকটা হালকা হওয়া।

দুজনের কাছে মসজিদের ভিতর যা যা ঘটেছে সবিস্তারে খুলে বললাম। তারপর খেদোক্তি, মসজিদ হলো খোদার ঘর। সেখানেও যদি এ ধরনের আচরণ করা হয়, তাহলে মানুষ কোথায় যাবে?

আমি হতবাক নাকি বিমূঢ় হব! হুজুর দুজনও সেই ভিতরের লোকদুটোর পক্ষেই ওকালতিতে মেতে উঠল। ভাই, লোকজন তো আপনার মতোই নামাজ পরার কথা বলে মসজিদে ঢুকে! তারপর দেখা যায় কোরআন শরীফ বা কিতাব কয়খান ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে চলে যায়। কমিটির লোকজন এসে ধরে তখন আমাদেরকে, মিয়া তোমরা মসজিদে বসে কি ঘাস কাটো?

হতবিহ্বল হয়ে জানতে চাইলাম, আমাকেও কি সেরকম মনে করছেন নাকি?

ভাই, কিছু মনে করবেন না, আপনে তো চাশতের নামাজ পড়বেন বলে ঢুকছিলেন, পড়ছেন সেই নামাজ, পড়ছেন?

হতবাক হয়ে যাই। নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি। লোকটা কি তাহলে সব খেয়াল করেছে নাকি? মসজিদে আমার সব গতিবিধি? কী আশ্চর্য!

আপনে তো আউলিয়া হইয়া যান নাই যে চাশতের নামাজ পড়বেন. ওইটা তো পড়ে অলি আউলিয়ারা। মিয়া বড় বড় লেকচার দেওয়ার আর জায়গা পান না।

আর একটা কথাও বলিনি, বলার রুচি হয়নি অথবা প্রবৃত্তি। মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে সোজা ধানমণ্ডি লেক পারের পূর্বমূখী এক গেট দিয়ে পার্কে ঢুকে সিগারেট ধরিয়েছিলাম। আর তখনই সেই অভিজাত দুজন ভদ্রলোকের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ি। কিন্তু ওরা দুজন কি জানেন, সিগারেট খেলাম বলে যে ওরা আমাকে যে পার্ক থেকে বের করে দিল, সে পার্কেই রীতিমতো গাঁজার হাট বসে? গাঁজা টানার মহোৎসব হয়! হায় রে দুনিয়া…

তার পরের দিনই নিরিবিলি জায়গার খোঁজ করতে করতে আমি পার্কের পশ্চিম প্রান্তের মাঝামাঝি জায়গায় নিজের অজান্তেই ভর্তি হয়ে গেলাম সেই গাঁজার আসরে। আসলে ইচ্ছে করে হইনি। মসজিদে তো ঠাঁই পেলাম না! কোথায় পার্কের নির্জন কোণে বসে বসে একান্ত মনে তসবিহ জপব, যাবতীয় ভুল আর যত অপরাধ করেছি তার জন্য খোদার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করব- তার বদলে এখন আমার স্টিকারের পুটকি টেনে টেনে দিন যায়! তবে কি আমি চল্লিশ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে অবশেষে গাঁজার নৌকায় বসতে যাচ্ছি?

মনে আছে অতি শৈশবে বাবা আমাকে পড়া এলোমেলো হয়ে গেলেই গাল পেড়ে ওঠতেন, গাঁজা খাইছস নাকি?

গাঁজা! গাঁজা কি ভাবতে ভাবতে আবারও পড়ার খেই হারিয়ে ফেলতাম। আবার বাবার লাথি তেড়ে উঠতো আমার দিকে। সেই আমি এখন সত্যি সত্যি গাঁজা খাই। আগে জানা ছিল না কী এক ভিন্ন জগতের মোহচ্ছন্নতা আছে! স্বপ্নাচ্ছন্নতায় ঘেরা আবার স্বপ্ন ভাঙার বেদনাবিধুরতা সম্পন্নও।   স্টিলের তসবিহটা হাতের তালুয় লুকিয়ে লুকিয়ে জিকিরের ভিতর মশহুর ছিলাম, তখনই একজন এসে হঠাৎ জানতে চাইল, ম্যাচ হবে গুরু? পরে জেনেছি মানুষটার নাম- ইব্রাহিম, জিগাতলার দিকে বাসা। বাপের হোস্টেলে খায়। পিওর গাঁজাখোর। বয়স ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশের মতো হলে কী হবে, গাঁজার ঠেলায় শুটকো হয়ে গেছে, মনে হয় ষাট-সত্তরের বুড়ো! কুঁজো হয়ে হাঁটে, গাঁজার ধোঁয়া পেটে জমে উঠলেই দার্শনিকতা কপচায়। মোবাইলে ইউটিউবে ঢুকে ছেড়ে দেয় লালনের গান, আর সে গানের ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে।

ইয়ারগুলোও জুটেছে ভালো, ইব্রাহিমকে সবাই গুরুর মতো মানে। চারপাঁচজন রেগুলার আছে ইয়ার। একজন ছাত্র, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, দুজন ফুল বেকার, বাকিরা কেউ ড্রাইভার, কেউ দোকানদার। একজন দোকান ফেলেই কোথা থেকে ছুটে আসে রোজ রোজ গাঁজার টানে। আরেকজন আসে হুইল চেয়ারে একজন বুড়োকে নিয়ে। হুইল চেয়ারে বুড়োকে লেকের দিকে মুখ করে বসিয়ে রেখে এসে, আলগোছে গাঁজা টেনে যায়, নেশা চড়ে গেলে লালনের গানের সুরে সুরে নেচে ওঠে। আর মহা তৃপ্তিতে বলে ওঠে, আমি জীবনে যা পাইছি কোনো এমএবিএ পাশ করা মানুষও পায় নাই। কি পাইছে তা মোটেও বলে না। সবাইকে ধোয়ার কুজ্ঝটিকায় রাখে।

প্রথমদিন আমার সঙ্গে শুধু ওই ম্যাচ চাওয়া চাওয়া-ই। পরের দিন আবারো তাদের আখড়ার পাশে বসে থাকতে দেখে ইব্রাহিম নিজে নিজেই এগিয়ে আসে, জানতে চায় পরিচয়। হয়তো গতকাল সারাক্ষণ দেখার পর হঠাৎ পরের দিনও দেখে কৌতূহলি হয়ে থাকবে, বলা তো যায় না আইনশৃংখলা বাহিনির মানুষ কিনা। পুলিশের লোক হলে তো মুশকিল। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দুহাতের ঢলায় গাঁজা বাটে, সিগারেটের স্টিকারের ভিতর সেই শুকা ঢোকায়, তারপর ধরিয়ে নিজে টেনে ইয়ারদের উদ্দেশে দেয়, দিতে দিতে আমাকেও সাধে, ভাইজান বেয়াদবি না নিলে ট্রাই করতে পারেন।

কী মনে করে নিই। মনে হয় যে, টানটুন দিলে মনের কষ্ট হয়তো কিছুটা লাঘব হতে পারে, এই যে নিলাম, তারপর নিজের অজান্তেই কীভাবে কীভাবে যেন এ চার-পাঁচদিনেই ওদের গোত্রভুক্ত হয়ে গেলাম। প্রতিদিন ওরা সকাল সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে চলে আসে। তারপর জোরসে তিরচারঘণ্টা গাঁজার আড্ডা জমিয়ে তারপর আবার যে যার জায়গায় ফিরে যায়। আমিই কেবল থাকি,- পার্কে যেমন খুশি হাঁটাহাঁটি করি, ধীর-স্থির বসে থাকি। রিনির দেওয়া খাবার খাই, তসবিহ জপি, একে ওকে মোবাইলে কল দিয়ে কাজের হদিস জানি। হ্যাঁ, এখানে বসে-বসেই পরিচিত বন্ধুবান্ধব যারা আছে, বলি যে আমার একটা চাকরি দরকার।

আজ অবশ্য আমাদের গাঁজার আড্ডাটা মোটেও জমতে পারেনি। কোথা থেকে উটকো ঝামেলার মতো হাজির হলো মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন। তারা পার্কে ঢুকেই দৌড়ে দৌড়ে যত কুকুর আছে, সব কিনা, আমাদের আড্ডার কাছেই জালে ফেলে ধরে ধরে এনে ইনজেকশন দিতে লাগলো। কুকুরের কামড়ে যেন কোনো মানুষ না মরে, পাগল হয়ে না যায়, তার জন্যই এই ভ্যাকসিন দেওয়া। এইসব গভর্নমেন্টের লোকজনের সামনে কি আর গাঁজা টানা সম্ভব? এর মধ্যেই অবশ্য সবার পেটে পেটে ভালোই ধোঁয়া ঢুকে পড়েছিল। তারই ক্রিয়াতে কিনা গুরু ইব্রাহিমের মাথার মধ্যে হঠাৎ আছর হলো, দেশের মানুষের স্বার্থে কুকুরগুলোর ভ্যাকসিন দেওয়ায় হেলপ করা উচিত। সে আমাকেসহ সবাইকে উদ্ধুদ্ধ করে কুকুর ধরার কাজে মেতে উঠলো। সেই থেকে আমরা আজ গাঁজা টানা বাদ দিয়ে কুকুর ধরায় লেগে আছি, যে যেভাবে পারছি দৌড়াচ্ছি কুকুরের পিছনে। আমিও একটা কুকুর সাফল্যের সঙ্গে ধরার পর, আরেকটা কুকুর ধরার জন্য মিউনিসিপ্যালের দুই লোকের পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছিলাম তাকওয়া মসজিদের প্রান্তের দিকে, যেখানে একটা বিশাল ঘাটলার মতো জায়গা আছে। লেকের পার ঘেঁষে বসার সিমেন্টের বেঞ্চি। সেখান থেকে সরকারি কর্মচারি দুজন পাজাকোলা করে কুকুরটাকে ধরে নিয়ে যায় সেই ভ্যাকসিনওয়ালাদের কাছে।

আমি আর ওদের সঙ্গে জুটি না। একটু দাঁড়াই, অনেকদিন দৌড়াদৌড়ির অভ্যাস নাই বলে বেশ হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। ভাবলাম যে, এই সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে খানিকক্ষণ জিরাই, রেস্ট নিই, তারপর না হয় আবার ফেরা যাবে সেই গাঁজার আসরে। আজ কি আর আসর জমবে?

বেঞ্চিতে বসে কেবল থিতু হয়েছি কি হইনি, তখনই ঘটনাটা ঘটতে লাগলো আমার চোখের সামনে! কোথা থেকে হুট করে এক রোগা পলকা কিশোর আবির্ভূত হয়েই আমার উলটোদিকের সামনের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকা আরেক ঘুমন্ত কিশোরকে লাথির পর লাথি মারতে থাকে। অনবরত লাথি, জোরে জোরে লাথি সে মেরেই চলেছে। এভাবে গভীর সুপ্তির ঘুমন্ত মানুষকে কেউ লাথি মারে? কী জোরে জোরে মারছে লাথি। লাথি মারতে মারতে পাকা সিমেন্টের বেঞ্চ থেকে কিশোরটিকে ফেলে দিল মাটিতে এবং তারপরও লাথির পর লাথি সে চালিয়ে যেতেই লাগলো, আমি আর শেষে নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। দৌড়ে ছুটে লাথি মারা-রত কিশোরকে জাপটে ধরলাম। কী করছো তুমি? ওকে এভাবে মারছো কেন?

      লাথি মারতে থাকা ছেলেটা আমাকে পাত্তা দেয় না। নিজেকে বেপরোয়া ভঙ্গিতে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুমন্ত ছেলেটার মুখে মাথায় আরো জোরে জোরে মারতে থাকে লাথি। আরো দুর্দমনীয় ক্রোধে যেন জ্বলেপুড়ে, আরো জোরে এতো জোরে যে, শেষ পর্যন্ত ঘুমন্ত ছেলেটা পিটপিটে চোখে তাকায়। আর ওকে তাকাতে দেখেই কিনা লাথিমারা ছেলেটা লাথি মারা থামিয়ে গাল পেড়ে ওঠে, ওই হুমুন্দির পো! খিচুড়ি খাইতে যাবি না?

এই এতক্ষণে খিচুড়ির কথা কানে যেতেই কিনা লাথি-খাওয়া ছেলেটা চোখজোড়া দু-হাতে ডলতে ডলতে ঝটিতি বেগে উঠে বসে। সে লাথিধারীর দিকে নয়, আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, কয়টা বাজে মামা?

আমি ওদের কাণ্ড দেখে অবাক বিস্ময়ে একটু বিমূঢ়ই হয়েছিলাম। মোবাইলের ঘড়ি দেখে উত্তর দিলাম, সাড়ে এগারোটা।

টাইমের কথা শুনে বসা থেকে ছেলেটা লাফিয়ে দাঁড়ায়। তারপর লেকের দিকে যেতে যেতে আরেক কিশোরের উদ্দেশে তাড়া দিয়ে উঠলো, ল নাহাই।

লাথিমারা কিশোরটিকে আমি যেতে দিই না। ওর হাতটা খপ করে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ওকে এভাবে মারলে কেন? আসলে একটা দুর্নিবার কৌতূহল আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, এই যে চোখের সামনে যা যা ঘটলো, ঘুমন্ত ছেলেটাকে লাথি মারা, ঘুমবীরের কোনো উল্টাপাল্টা প্রতিক্রিয়া না দেখা- এর সবকিছুই মনে হচ্ছিল বড়ই দুর্বোধ্য। আমাকে কৌতূহল তাড়া করছিল। কিশোরটি উত্তর দেবে কি, উলটো আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, লাথি না মারলে ও উডতো? অরে উডান যায়?

অরে উঠাইবা কেন, আরেকটু ঘুমাইতো!

হ ব্যাডারা তো আমগো দুইজনের লইগা খিচুড়ি লইয়া বইয়া থাকতো!

কোন ব্যাডারা?

ওই যে শংকরের মোড়ে পত্তেকদিন দুইপর বেলা খিচুড়ি খাওয়ায়। আগে আগে না গেলে তো শ্যাষ অইয়া যায়। পাওন যায় না।

খিঁচুড়ি খাওয়ায় মানে? এমনিই খাওয়ায়!

হ। এমনেই খাওয়ায়। মাগনা। দানখয়রাতি।

তোমরা কই থাকো? কই কাজ করো?

থাকার কোনো ঠিক নাই, পার্কে ঘুমাই, স্টেশনে ফুটপাতে, যেইখানে সুযোগ পাই

কি করো বললা না তো?

ছেলেটা যেন আমার হাত থেকে ছোটার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ওদিকে ওর পার্টনার সেই লাথি-খাওয়া ছেলেটা লেকের কিনার থেকে বারবার ওকে ডেকেই চলেছে! ছেলেটা গায়ের নোংরা ময়লা ছেঁড়া শার্ট খুলে শুধু গামছা জড়িয়ে আছে কোমরে। লাথিমারা ছেলে সেদিকে যেতে যেতে উত্তর দিয়ে যায়, মুট বাই, কাগজ টুকাই, আরো কত কাম করি! কামের কোনো ঠিক আছে?

লাথিমারা ছেলেটাও তাড়াহুড়ো লেকের পারে পৌঁছে গায়ের প্যান্ট-শার্ট খুলে গামছা পরে নেমে পড়লো লেকের পানিতে। ঝপাঝপ দুজন চারপাঁচটে ডুব মেরে শরীর কচলিয়ে গোসল শেষ করে উঠে এলো টানে। আবারো দ্রুততার সাথে প্যান্ট-শার্ট পরে গামছাকে ভালোমতো রগড়ে ঝেড়ে কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে উঠে এলো ঘাটলায়! তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে চুল ঠিক করতে করতে পার্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ ধরলো। আর, ওরা আমার দৃষ্টির সীমানা থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতেই আমি লাথথিখোর ছেলেটা যেখানে যে-ভঙ্গিতে শুয়েছিল, অবিকল সে-ভঙ্গিতেই সেখানে সেভাবেই শুয়ে পড়ি।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত