| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: মায়াজাল । লুনা রাহনুমা

আনুমানিক পঠনকাল: 21 মিনিট

 

(এক)

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে আনুমানিক দেড়শ’ গজ দূরে একটি রেললাইন পার হয়ে আরো মিনিট বিশেক রিক্সায় যেতে হয়। রেললাইনের পরের এই রাস্তাটিতে বছরের এগারো মাসই ভাঙা, গর্ত, ময়লা, কাদা জমে থাকে। অনেক সময় একেকটা গর্ত কোথাও এত বড় থাকে যে রিক্সা প্রায় ৮০ডিগ্রি পরিমান কাত হয়ে যায়। অভস্ত্য যাত্রীরা শক্ত করে একে অপরের হাত জাপ্টে রিক্সার হুড ধরে সিটের সাথে শরীরে নিম্নাংশ ঠেসে বসে থাকেন। লবন আর মরিচের গুঁড়ো দিয়ে দুটি বাটির ভেতর যেমন করে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে জাম ভর্তা বানানো হয়, সারাদিন এই রাস্তায় তেমন করে প্যাসেঞ্জারদের দুমড়ে মুচড়ে কাহিল বানিয়ে তারপর তাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয় কোনো রকমে, প্রাণসহ। 

গত বিশ বছর ধরে মোজাম্মেল হোসেন থাকেন এই এলাকায়, দক্ষিণখানে। প্রথমে চার কাঠার একটি প্লট কিনে টিনের ঘর তুলেছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে লাগোয়া ছয়কাঠা ও তারপর আরো চার কাঠা জমি কিনে বেশ লম্বা একটি প্লট বানিয়ে ফেলেছেন। তারো কয়েক বছর পর টিনের ঘর ভেঙে প্রথমে একতলা, তারপর আড়াইতলা, তারপর পাঁচতলার দালান তুলেছেন সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা মনে করে।

আঠারো বছর আগে মোজাম্মেল হোসেনের স্ত্রীর প্রথম সন্তান কন্যা হওয়ায় তিনি মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে তখন মনে করেছিলেন যে পরেরবার ছেলে সন্তান আসবে ঘরে। তাই কষ্টের পরিমান সহনীয় পর্যায়ে ছিল। এবং বাইরের লোকের কাছে তার মনোকষ্ট প্রকাশ হয়নি বিশেষ। মোজাম্মেল হোসেন স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। কিন্তু দুটি বছরের মাথায় তার স্ত্রী আবারো কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ায় তিনি সত্যি মুষড়ে পড়েন। সবার মতে দ্বিতীয় কন্যাটি বাবার প্রতীক হয়ে জন্মেছে। অর্থাৎ দেখতে মোজ্জাম্মেল হোসেনের মতো: কৃষ্ণবর্ণের শরীর, ছোট চোখ আর মোটা নাক। মনের দুঃখ মোজ্জাম্মেল হোসেন এইবার আর লুকানোর কোনোই প্রয়োজন বোধ করলেন না। সন্তান জন্ম দিতে গ্রামে শাশুড়ির কাছে যাওয়া স্ত্রীকে ঢাকায় নিয়ে আসার বিশেষ তাড়াও অনুভব করলেন না। থাকুক আরো কিছুদিন নিজের মায়ের কাছে। একটু সুখ দুঃখের আলাপ করুক মন ভরে।

স্ত্রীকে গ্রামে ফেলে রেখে তিনি ঢাকায় অফিসের ফিক্সড আওয়ার আর ওভারটাইম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বেমালুম ভুলে যান শ্বশুর বাড়িতে অপেক্ষা করতে থাকা স্ত্রী এবং দুই কন্যা সন্তানের কথা। ঠিক চৌদ্দ দিনের দিন, অর্থাৎ দুই সপ্তাহ পর মন কিছুটা শান্ত হবার পর তিনি গ্রামে গিয়ে পরিবারকে নিয়ে আসলেন নিজের কাছে। সকল দুঃখই যেমন একদিন সয়ে যায়, মোজাম্মেল হোসেনের দুঃখভারও অনেকটা সহজ হয়ে আসে একসময়। তবে সময়ের পরিক্রমায় এরপর তাদের ঘরে জন্ম নিয়েছে পরপর তিনটি পুত্র সন্তান। কাঙ্খিত বস্তুটি পেয়ে যাবার পর প্রত্যাশা যেমন আগের মতো তীব্র থাকে না, তেমনি মোজাম্মেল হোসেনও মনে করলেন এ তেমন বিশেষ কিছুই না। বরং পিতা হিসেবে সব সন্তানের প্রতি সমান স্নেহের দৃষ্টি দেখানোর চেষ্টা করলেও ধীরে ধীরে যেন দ্বিতীয় কন্যাটির প্রতি তার মায়া সহস্রগুণ বেশিই প্রকাশিত হতে থাকে। অনেকটা অপ্রতিরোধ্যভাবে। এই পরিবারে পাঁচটি বাচ্চা যত বড় হতে থাকল, ততই তারা সবাই একটি ব্যাপারে একমত হলো, তাদের আব্বা মোজাম্মেল হোসেনের চোখের মনি একমাত্র মেঝো মেয়ে, লাবণ্য হোসেন।

লাবণ্যও বাপের খুব নেওটা। বাবা অফিস থেকে ফিরলে দৌড়ে গিয়ে সবার আগে কোলে চড়তে হয় তার। ছোট ভাই তিনটির চেয়ে ওর দাবী যেন বেশি। বাইরে থেকে ফেরার সময় প্রতিদিন মেয়ের জন্য হাতে করে কিছু নিয়ে আসেন মোজাম্মেল হোসেন। চুপচাপ লুকিয়ে খাইয়ে দেন মেয়েকে বাতাসা, কদমা, খুরমা খেজুর দুটি, হজমি, না হয় আট আনার চকলেট।

লাবণ্যর মুখের পটর পটর কথা শুনে সবাই যখন খুব বিরক্ত, ধমকে দেয় ওদের মা, তখন শুধু মোজাম্মেল হোসেন হাসিমুখে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনেন মেয়ের সব গল্প। শিশু চোখের দুটি মনির উজ্জ্বলতায় তিনি খুঁজে পান নিজের হারিয়ে যাওয়া শৈশব। বলেন, তুই আমার মা। এক্কেবারে আমার মা হইসিস একটা। লোকে এই কথাও বলে, লাবণ্য হুবহু ওর দাদির চেহারা পেয়েছে।

পাঁচ বছর বয়সে লাবণ্য স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করল। এলাকার আরো বাচ্চাদের সাথে সকালে দল বেঁধে হেঁটে স্কুলে যায়। স্কুল শেষে আবার বাড়ি ফিরে আসে সবার সাথে দল বেঁধে। বাড়ি থেকে স্কুল মাত্র পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। দক্ষিণখান বাজার পেরিয়ে ডানদিকে মিনিট সাতেক হাঁটলেই দক্ষিণখান প্রাইমারি স্কুল। এখানে শুধু স্থানীয় বাচ্চারাই পড়তে যায়। একদিন দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল লাবণ্য। তার হাতে ছিল একটা আইসক্রিম। পাশ দিয়ে যাওয়া একটি রিকশা লাবণ্যকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। ফলাফল হিসেবে, স্কার্টের নিচে খোলা হাঁটুতে কিছুটা চামড়া ছিলে গেল। রিকশাওয়ালা থামেনি, যাত্রী নিয়ে পইপই ছুঁটে চলে গেছে এয়ারপোর্টের দিকে। আর লাবণ্য পুরোটা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে। মোজাম্মেল হোসেন সেদিন অফিস থেকে লাঞ্চে বাড়ি এসেছিলেন গরম ভাত খাবেন বলে। কিন্তু খাবার মুখে দেবার আগেই হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করে মেঝ কন্যাটি। ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। মেয়েকে কাঁদতে দেখে তিনিও কাঁদতে আরম্ভ করেন। লাবণ্যর চোখে পানি। মোজাম্মেল হোসেনের চোখে পানি। অনেকক্ষণ হাতে ধরে রাখা আইসক্রীমটিও পানি হয়ে গলে পড়েছে অশ্রুর মতো অবিরল ধারায়। শুধু মুচকি হাসছিল মোজাম্মেল হোসেনের স্ত্রী। বাপ বেটির এমন সব আহ্লাদ দেখে অভ্যস্ত তিনি। অবশ্য তার ভালোই লাগে এসব দেখতে।

যে মেয়ের জন্মের পর মোজাম্মেল হোসেনের স্ত্রীর মনে হয়েছিল সংসার বুঝি ভেঙেই যাবে এবার, সেই মেয়েটিই পরিণত হয়েছে তাদের সংসারের প্রাণ হিসেবে। ওর ছেলেমানুষী সরলতা আর পাকা পাকা কথা সবার মন কেড়ে নেয়। সেটি ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়কার একটি ঘটনা। স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হবে, লাবণ্য মোটামোটি সবগুলো খেলায় নাম দিয়েছে এবং সব খেলাতেই সে যথারীতি ডাব্বা মেরেছে। একটিতেও তৃতীয় পর্যন্ত হতে পারেনি। জামা কাপড়ে ময়লা কাদা মেখে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে খালি হাতে। মানে তার হাতে পুরস্কার নামক কিছু দেখা গেল না। নাজমা বেগম মেয়েকে বলেন, কিরে লাবু, এবারেও কোনো প্রাইজ পেলি না?

লাবণ্য মায়ের কথা না শোনার ভান করে নিজের ঘরে গিয়ে স্কুল ড্রেস বদলায়। তারপর বাথরুমে ধুপধাপ আওয়াজ শোনা যায়। পানির কল ছেড়ে নিজের হাত মুখ ধুচ্ছে সে। এরপর ডাইনিং টেবিলে বসে বলল, মা খেতে দাও। খিদে পেয়েছে।

নাজমা বেগম বলেন, এতগুলো খেলায় নাম দিলাম তোর, একটাতেও কিছু পেলি না? এটা কেমন হলো?

লাবণ্য মুখ ভেংচায়, এতগুলো কই? বিস্কুট দৌড়, একশো মিটার দৌড় আর মোরগের লড়াই। কয়টা হলো, গুনো দেখি! পারো তুমি গুনতে? কিচ্ছুই তো পারো না।

লাবণ্যর কথায় মুখ টিপে হাসেন নাজমা বেগম। বলেন, হুম, আমরা গুনতে পারি না। খেলতে পারি না। পড়তে পারি না। কিছুই পারি না। সবকিছু উনিই পারেন। তাহলে প্রাইজ পেলি না কেন?

লাবণ্য তাচ্ছিল্যের ভাব ফোটানোর চেষ্টা করে মুখে। বলে, প্রাইজ ইচ্ছা করেই নেই নাই আমি। প্রাইজ রাখার জায়গা কই এই বাড়িতে?

মেয়ের সাথে কথার খেলায় মজা পাচ্ছিলেন নাজমা বেগম। ক্ষেপানোর জন্য বলেন, আমি তো ভেবেছিলাম আজকে তুই অনেক প্রাইজ এনে ঘর ভরে ফেলবি। আলমারি খালি করে রেখেছি তোর প্রাইজ রাখার জন্য।

ভ্রূকুটি, তিরস্কার, খোঁচাখুঁচির কথা একটুও গায়ে মাখে না লাবণ্য। খুশি মনে একটি মিষ্টির বাক্স খুলে ফ্লোরে বসে পড়লো। এই মিষ্টির বাক্সের ভেতরে ওর পুতুলের সংসার। আনন্দ হাসির খেলার জগৎ। মায়ের বানিয়ে দেওয়া কাপড়ের পুতুল দুটি দিয়ে বাবা ও মায়ের চরিত্রে সংলাপ দিতে আরম্ভ করে সে। মেয়ে পুতুলের নাম সুমা আর ছেলে পুতুলটির নাম রতন। খেলাঘরের সোফায় বসিয়ে সুমা আর রতনকে সিগারেটের রাংতা দিয়ে বানানো মিথ্যা টিভি দেখতে বসায়। সামনে বাটিতে পুতুলের জন্য কিছু সত্যিকার মুড়ি।

কলমি শাক আর ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত মেখে নাজমা বেগম ফ্লোরে বসে লাবণ্যকে খাওয়াতে শুরু করেন। ভাতের একটা দলা মুখে ঠেলে দিয়ে বলেন, অন্তত দৌড়ে তো একটা প্রাইজ আনতে পারতি! তোকে যে প্রতিদিন একটা করে ডিম খাওয়াই সেগুলো কই যায়? জোরে দৌড়াতে পারিস না!

ছোট মুখের ভেতর বড় ভাতের দলটিকে নেড়ে চেড়ে কায়দা করে মুখ ভেংচায় লাবণ্য। বলে, প্রতিদিন ডিম খেলে কী হয়! ডিম কি আমার সাথে দৌড়াবে?

এভাবে কথার পিঠে সারাদিন কথা বলে যেতে পারত লাবণ্য। যুক্তির অভাব হতো না কখনো। শুধু তর্ক আর কথা কাটাকাটি। শিশুমনে সাবলীলভাবে দেখা জগৎটাকে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করত সামাজিক যুক্তিপূর্ণ বয়স্ক মানুষদের সামনে। সেদিন অফিস থেকে ফিরে মোজাম্মেল হোসেন শুনলেন তার মেঝমেয়ে স্কুলের স্পোর্টসডেতে কোনো পুরস্কার পায়নি বলে মন খারাপ করে আছে। লাবণ্য বাবার কাছে নালিশ জানায়, মা আমাকে আজ যা খুশি তাই বলে বকেছে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুখের হাসি লুকান মোজাম্মেল হোসেন। লাবণ্য তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে সত্যি করে কাঁদতে শুরু করেছে।

বিকেলে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার সময় মোজ্জামেল হোসেন মেয়ের জন্য একটি খেলনা মাছ আর একটি মেডেল কিনে আনেন দক্ষিণখান বাজার থেকে। প্লাস্টিকের খেলনা মাছের লেজের দিকটায় লাইট লাগানো। সুইচ অন করলে প্লাস্টিকের মাছটি গান বাজিয়ে হেঁটে বেড়ায় আর ঘুরতে থাকা লেজে রঙিন আলো জ্বলে ওঠে। পাঁচ ভাই বোন সারা বিকাল এই মাছটিকে নিয়ে আমোদ করল। কিন্তু মাছের কন্ট্রোল ছিল লাবণ্যর হাতে। ওর কথা  ছাড়া কেউ সেটিকে স্পর্শ করার অনুমতি নেই। মাছের সাথে কিনে আনা মেডেলটি নিয়ে কি করবে তা বুঝে পাচ্ছিল না সে। জীবনে কয়েকবার স্কুলের মাঠে অন্যদের গলায় মেডেল গ্রহণ করতে দেখেছে কিন্তু নিজে কোনোদিন পরে দেখেনি। তামার একটা ছোট্ট পাতের উপর শাপলা ফুলের ছাপ দেওয়া মেডেলটি লাল রঙের ফিতায় ঝোলানো। সব খেলায় লাড্ডু গুড্ডু হবার পরেও বাবা তার জন্য এতকিছু কিনে এনেছে বলে সে মহাখুশি। আর কপট রাগ দেখান ওর মা। স্বামীকে বলেন, তোমার তো মেয়ে শুধু একটাই আছে। বাকি চারটা আমার একারই।    

মোজাম্মেল হোসেন স্ত্রীর কথার প্রতিবাদ করেন না। শুধু মুচকি হাসেন। তিনি নিজেও জানেন কথাটি খুব মিথ্যে নয়। লাবণ্যর প্রতি তার স্নেহ বাড়াবাড়ি রকমের পক্ষপাতিত্ব করে। হাসি মুখে তিনি নিজের হাতে মেডেলটি পরিয়ে দেন মেয়ের গলায়। মেডেলের প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখায় না কন্যা। যদিও একসময় মনে হলো মালা হিসেবে মেডেলটি বিশেষ খারাপ বস্তু না। লাল সুতার মাথায় একটা সোনার লকেটও আছে। ওটিকে গলায় পরে সে ঘুমুতে গেল রাতে।

এই গল্পের প্রধান চরিত্র লাবণ্য, এভাবেই মা ও বাবার স্নেহ-ভালোবাসা, আদর আর প্রশ্রয় পেয়ে বেড়ে উঠছিল প্রতিদিন একটু একটু করে। পরিবারটিতে সবার ভেতর চমৎকার এক সুখী সুখী ভাব বিরাজ করত সব সময়। বাড়ির অন্যান্যরা প্রকাশ্যে লাবণ্যকে এটা সেটা বলে খেপালেও, তাদের সবার কাছেই সে খুব প্রিয় মানুষ, আদরের লাবণ্য লতা। মাঝারি আয়ের বেতনে পাঁচটি ছেলে মেয়ের সবাইকে মনের মত কেনাকাটা করে দিতে পারেন না নাজমা বেগম। কিন্তু মেঝ মেয়ের জন্য তিনি চেষ্টা করেন ওর পছন্দের জিনিসটা কিনে দিতে। তাই ঈদের শপিং করতে গেলে বাকি ভাই বোনেরা নিজেদের ইচ্ছে মতন জামা কাপড় না পেলেও লাবণ্য ঠিকই ওর যা পছন্দ, তা পেয়ে যেত। লোকে বলে, অতি আদরে বাচ্চা বেয়াড়া হয়ে ওঠে। কিন্তু লাবণ্যের চরিত্রে সেটা দেখা গেল না। বরং সে প্রখর বুদ্ধিমত্তার সাথে আশ্চর্য কোমলতার উদাহরণ হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। টিনেজ বয়সের দিশেহারা অধ্যায়ে পা রেখেও বাবা কিংবা মা মতের বাইরে কিছু বললে, সেকথাও সে খুব সহজে মেনে নিতে পারত। পরিবারের প্রতি ভীষণ এক টান ছিল ওর ভেতর। আর একটু একটু করে ষোলো বছরে পা দিয়েও ওর চরিত্রে কোথাও শিশু মনের সারল্য রয়ে গিয়েছিল, বেশ অনেকখানি।

(দুই)

মোজাম্মেল হোসেনের প্রাণের চেয়ে প্রিয় এই নরম মনের মেয়েটির জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্টের আঘাতটি আসে মোজাম্মেল হোসেনের কারণেই। না তিনি নিজে দায়ী ছিলেন না তার জন্য। কিন্তু ব্যাপারটি ঘটে গেল।

দিনটি ছিল শুক্রবার। মোজাম্মেল হোসেন আর সব অফিস দিনের মত সকালে নাস্তা খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান সকাল আটটায়। দুপুর বারোটার দিকে অফিস থেকে একটা ফোন আসে। ফোনের অপরপাশের কণ্ঠস্বরটি গভীর দুঃখ নিয়ে জানায়, একটু আগে মোজাম্মেল হোসেন স্ট্রোক করেছেন। অফিসের লোকজন তৎক্ষণাৎ তাকে উত্তরা মহিলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেছে। হাসপাতালের ফর্মালিটিজ শেষ করে বেলা তিনটায় মোজাম্মেল হোসেন ফিরে আসেন নিজের বাড়ি। প্রাণহীন মৃতদেহ হয়ে।

একটি মৃত্যু মানে মৃতের নিজের বাড়ি ও তার চারপাশের আত্মীয় পরিজনসহ অনেকগুলো পরিবারের শোকের সময়। মৃত বাড়িটিকে কেন্দ্র করে চারপাশের অনেকখানি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে থমথমে ফিসফাস কান্নার ঢেউ। মোজাম্মেল হেসেনের বাড়ির চারপাশেও সেদিন তেমনি বুক ভারী করা নীরবতা। শব্দ করে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করছে লোকজন। মোজাম্মেল হোসেনের লাশটি যখন হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হয়, স্বাভাবিকভাবেই তার মুখ এবং সমস্ত শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল। সব মৃতদেহই সাদা কাপড়ে মুড়ে রাখার নিয়ম। অথবা হাসপাতালগুলোতে শুধুই সাদা রঙের চাদর কেনা হয়। আত্মীয়দের একজন এগিয়ে গিয়ে লাশের মুখের উপর থেকে সাদা চাদরটি নামিয়ে দিল মুখটি দেখার জন্য। চারপাশে উপস্থিত অনেকগুলো জীবিত মানুষ একসাথে হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়লো মোজাম্মেল হোসেনের মুখটি শেষবারের মতো দেখার জন্য। ডেডবডির দুই চোখের পাতা হা করে খোলা। ঘোলা চোখের বল দুটি নিষ্প্রাণ। কয়েকজন হাতের আঙুলে চোখের পাতা দুটি বন্ধ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। টেনে নামিয়ে দিলেও আবার খুলে যায়। নাজমা বেগম স্বামীর শীতল গায়ে হাত রেখে বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন সেই তখন থেকেই। চিরকালের হাসিখুশি মহিলাটির মুখে মনে হলো বেদনার আঁচড় স্থায়ী ক্ষত রেখে যাবে এবার। পাগলের মত নাজমা বেগম বলেন, চোখ খুলে থাকো তুমি। চোখ বন্ধ করবে না একদম। তোমার লাবণ্যকে দেখে যাও শেষবারের মতো। চোখ বন্ধ করে ফেললে তুমি তাকে দেখবে কেমন করে? কে জানে হয়ত বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডের রক্তসঞ্চালনকারী শিরাগুলো যখন পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাচ্ছিল না, প্রচন্ড ব্যথায় মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন মেজাম্মেল হোসেন, তখন হয়ত তার মেঝো কন্যার কথাই মনে হয়েছিল সবার আগে! চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল খুব প্রিয় মুখটি। কানে বেজেছিল প্রিয় ডাক- আব্বা! হয়ত ভেবেছিলেন, আর যদি দেখা না হয় এই জন্মে, পরের জন্মে চিনতে পারবে তো মেয়ে বাবাকে!

লাবণ্য তখন কলেজ থেকে ফিরেছে। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে দিতে দেখে ওদের বাড়িতে অনেক মানুষজন ঢুকছে আর বের হচ্ছে। পুরো এলাকা ভেঙে পড়বে নাকি আজ তাদের বাড়িতে? কী এমন বিশেষ ঘটনা ঘটেছে আজকে? একসাথে এত মানুষ দেখে বুকের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় লাবণ্যর। ভয়ে পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোতের নেমে যাওয়া টের পায়। তবুও মনে সাহস জাগানোর চেষ্টা করে আপ্রাণ। নিজেকে বলে, হয়ত দারুণ ভালো কিছু ঘটেছে আজ! লটারি জিতেছে নাকি এই বাড়ির কেউ?

কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। কারো চোখের দিকে তাকাতে সাহস হয় না। ঘরের ভেতর একটি পা রাখতেই চোখ গেল ডাইনিংরুমের মাঝখানটায়। ডাইনিং টেবিলের জায়গায় একটা চিকন খাট রাখা। তার উপর শোয়ানো আছে সাদা চাদরে ঢাকা মানুষটাকে। ঘরের ভেতর আগরবাতি জ্বালিয়েছে কেউ। মাঝার আর মৃত্যুর গন্ধ বহন করা আগরবাতির সৌরভ ওর কোমল বুকটাকে কাঁপিয়ে দিলো ভয়ংকরভাবে। চারপাশের সবাই লাবণ্যকেই দেখছে এখন। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে ধীর পায়ে হেঁটে যায় খাটটির দিকে। সাদা চাদরে পুরোটা শরীর ঢেকে মুখ বের করে শুয়ে আছেন বাবা। এই বাড়ির গৃহকর্তা। লাবণ্য হতবিহবল চোখে বাবাকে দেখে। মনে হলো তার বুকের ভেতরটা যেন আকাশ হয়ে গিয়েছে, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ যেমন করে বাতাসে ভেসে যায় এক পাশ থেকে আরেক পাশে, লাবণ্যর বুকের ভেতরটা তেমন করে খালি হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। এটা কী হলো? বাবা আজ ওকে দেখে একটিও কথা বলল না। ময়না, সোনা, টুনটুনি বলে কাছে ডাকল না। মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করল না, কিরে মা, তোর লেখাপড়ার খবর কী? সবকিছু ঠিক আছে তো!

থম ধরে অনেক্ষন বসে রইল বাবার পাশে। অথবা আরো সঠিকভাবে বললে বলতে হবে, বাবার লাশের পাশে। পেছন থেকে মহিলাদের একজন কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে, সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে গো মা! আরেকজন ওর হাত ধরে থাকে শক্ত করে। ঘরের এক মাথা থেকে নারীকণ্ঠে কেউ বলে ওঠে, সবই আল্লার ইচ্ছা, খোদার আসরে যখন যার ডাক পড়ে, তখনই তার যাওন লাগে। নারীকন্ঠের এই কথা শেষ না হতেই ভিড়ের ভেতর কান্নার রোল ওঠে। মৃতের বাড়িতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয় যে আত্মীয় অনাত্মীয় সবাইকেই চোখের পানি ফেলতে হয়। সবাই নিজের মৃত্যুর কথা মনে করে একবার করে। উঁচু গলায় মাওলানা ধরণের একজন লোক ধমকে ওঠে এবার, আপনারা সবাই কান্না থামান, লাশের সামনে কানলে কবরে লাশের আজাব বেশি হইবো।

 লাবণ্য একটিও কথা বলে না। কাউকে কোনো প্রশ্ন করে না। জানতে চায় না মৃত্যু কখন হলো? কিভাবে হলো? কেনই না হতে হলো এমনটা? এতো জলদি। বন্ধুদের সবার বাবার এখনো বেঁচে আছেন চমৎকার সুস্থ আছেন। তাহলে ওর বাবাকে চলে যেতে হবে কেন! শুধু অকম্পিত হাতে আদর করে বাবার গাল দুটিতে। চুমু খায় কপালে, ঠিক যেন ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট ছেলেটি খেলার ফাঁকে। বাবা যেমন করে আদর করে আঙ্গুল বুলাত ওর চুলে, তেমন করেই দুই হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে বিলি কাটে বাবার মাথার চুলে। এক বিন্দু অশ্রু গড়ালো না চোখ থেকে। এরপর ভারী পা দুটিকে টেনে নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। ঘাড় থেকে কলেজের ব্যাগটিকে নামিয়ে ঝুলিয়ে রাখল পড়ার টেবিলে চেয়ারের পেছনে। নারকেল গাছের শলা দিয়ে বানানো বিছানার ঝাড়ুটি হাতে নিয়ে বিছানা ঝাড় দিলো এলোমেলো হাতে। পড়ার টেবিলটি গোছায়, আবার। বুকের ভেতরে উছলে ওঠা কান্নার প্রবল ঢেউগুলোকে কিছুতেই নিজের আচরণে প্লাবিত হতে দেয় না সে। লাবণ্য জানে, বাবা এই মেয়েটির কান্না একদম সহ্য করতে পারে না। তাই লাবণ্য পণ করছে, কিছুতেই সে কাঁদবে না। বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে অনেকদূর পর্যন্ত ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্ষেতের ধানগুলো এখন পেকে হলুদ হয়ে গিয়েছে। বাতাসে কেমন মনোরমভাবে দুলে উঠছে তারা একসাথে। পুরো ক্ষেতে যেন হলুদ সাগরের ঢেউ উঠেছে। লাবণ্য তাকিয়ে থাকে সেদিকে, আর ভুলে যায় সে এখন কোথায় আছে। মনে হয় এই দৃশ্য এই পৃথিবীর নয়। শরীর আর মন দুটোই তুলোর মতন হালকা হয়ে মিশে গিয়েছে যেন অনন্তের শূন্যতার মাঝে। বাড়ি ভর্তি লোকের পদচারণা, কথাবার্তা, কান্না আর গোঙানির শব্দ- কিন্তু কিছুই স্পর্শ করছে না লাবণ্যকে।


আরো পড়ুন: নিগড় শ্লথ অনুষঙ্গ । লুনা রাহনুমা


পরের কয়েকটি ঘন্টায় মোজাম্মেল হোসেনকে গোসল করিয়ে এহরামের সাদা কাফন কাপড় জড়িয়ে খাটিয়ায় তোলা হলো। তারপর মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয় জানাজার নামাজের জন্য। সেখান থেকে তিনি সরাসরি চলে যাবেন হলানে, তার নিজের কিনে রাখা কবরের মাটিতে সমাহিত হতে। মোজাম্মেল হোসেনকে লাশবাহী ঠান্ডা গাড়িতে তোলার আগে সবাই লাবণ্যকে ডাকে। শেষ দেখাটি দেখে নিতে বলে। এরপর তো আর কোনোদিন সচক্ষে দেখতে পারবে না এই মুখ। কিন্তু লাবণ্য গেল না বাবার মুখ দেখতে। বাবাকে বিদায় জানাতে। নিজের মনেই বসে রইল সে নিজের ঘরে। নিজের ঘরে জানালার গ্রিলটি ধরে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। আর মোজাম্মেল হোসেন চলে গেলেন প্রিয় সন্তান, প্রিয় পরিবার আর খুব পরিশ্রমের অর্থে বানানো পাঁচতলা বিল্ডিংটি থেকে একেবারে মাটির তলায় সাড়ে তিন হাত মাপের এক মানুষের গৃহে। স্নেহ, মায়া, প্রেম, আজন্মের সকল বন্ধন ছিন্ন করে যেভাবে একদিন সবাইকে যেতে হয়, একাই।

(তিন)

পরদিন সকাল থেকে লাবণ্য যেন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছে। স্বভাব মতো হৈ-হুল্লোড় দেখা যাচ্ছে না আচরণে। বাড়ির কারো সাথে নিজ থেকে কথা বলছে না। শুধু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় খুব সংক্ষেপে। বাবাকে নিয়ে একটিও কথা বলছে না। মোজাম্মেল হোসেনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে গ্রাম থেকে আসা কিছু আত্মীয় স্বজন রাতে থেকে গিয়েছিল। তারা খুব চেষ্টা করল লাবণ্যর মুখ থেকে বাবা প্রসঙ্গে কিছু বলাতে। তাতে যদি মেয়েটার বুকের কষ্ট কান্না হয়ে গলে পড়ে। জিজ্ঞেস করল বাবার কথা মনে পড়ে কিনা, বাবার জন্য মন খারাপ লাগছে কিনা। কিন্তু লাবণ্য বাবা প্রসঙ্গে কথা বলে না। বাবা সংক্রান্ত সকল ব্যাপারে সে হয় চুপ করে থাকে, নয়ত সেখান থেকে উঠে অন্য কোথাও চলে যায়। অনেক চেষ্টা করেও বাবাকে নিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারল না কেউ। একসময় সবাই সংসারের অন্যান্য নৈমিত্তিক কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি লাবণ্য চলতে থাকে নিজের পরিবর্তিত, কিছুটা সংকুচিত আর নিমীলিত নিস্তব্ধতায়, সবার মাঝে নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে রেখে।

মোজাম্মেল হোসেনের মৃত্যুর ঠিক সাতদিন পর, এক ভোরে, লাবণ্য ওর মায়ের ঘরে গিয়ে খাটের কোনে বসে। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি ভালো করে। মসজিদে ফজরের আজান হয়েছে একটু আগে। খাটের যে পাশটিতে আগে মোজাম্মেল হোসেন ঘুমাতেন সেই পাশে এখন ওর মা ঘুমান। লাবণ্য খাটে বসলে নাজমা বেগমের ঘুম ভেঙে গেল। এতো ভোরবেলা মেয়েকে নিজের খাতের পাশে বসে থাকতে দেখে স্বভাবতই তিনি খুব অবাক হলেন। পাশ ফিরে কাত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঘুমঘুম গলায় বলেন, কীরে তুই এত সকালে উঠে গেছিস? কিছু বলবি?

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে লাবণ্য। তারপর হালকা অন্ধকারে মাথা নাড়ে। তার কিছু বলার আছে।

নাজমা বেগম শোয়া থেকে উঠে বসেন। মশারির বাইরে শরীরের অর্ধেকটা বের করে মেয়ের কপালে হাত রাখেন। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখ দুটি মোছেন। বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে খুব অল্প করে। আবছায়া আলোয় বিষণ্ণ মা তাকিয়ে থাকেন কুঁজো হয়ে বসে থাকা মেয়ের অস্পষ্ট ছায়ার দিকে। মাথা নিচু করে মেয়ে নিজের পায়ের আঙ্গুল অথবা পায়ের কাছে জমে থাকা ঘোলা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে নিস্পলক। প্রাণচঞ্চল মেয়ের এমন শ্রান্তভাব চোখে সহ্য হয় না। শাড়ির আঁচলে বারবার চোখ মোছেন মা।

-কী হয়েছে লাবণ্য? বল আমাকে মা।

-আম্মা, আব্বা এসেছিল কাল রাতে। লাবণ্য বলে।

কান্না থেমে যায় নাজমা বেগমের। বললেন, কিছু বলেছে তোকে?

-হুম। বলেছে। আব্বা আমার বালিশে একটু ঘুমাতে চায় কয়দিন। আব্বার নাকি খুব ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে কয়েকদিন থেকে।

নাজমা বেগম ছটফট করে ওঠেন। মেয়ের হাতের উপর একটি হাত রেখে বলেন, তোর আব্বাকে কেমন দেখলি? মনটা খারাপ মনে হলো?

-না। খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। একটু চিন্তিত মনে হলো যদিও।

গা ছমছমে অনুভূতি নিয়ে দুইজন চুপ করে থাকল কয়েক মিনিট। নাজমা বেগম কাঁপা গলায় আবার প্রশ্ন করেন, তোর আব্বার শরীরটা কেমন দেখলি? অনেক শুকিয়ে গেছে নাকি?

-না, স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে আগের চেয়ে। টকটকে খয়েরি সুতি কাপড়ের একটা পাঞ্জাবি পরা ছিল আব্বা। গজ কাপড় কিনে দর্জির দোকানে বানানো নতুন পাঞ্জাবি গায়ে। সেই আগের মতো হাত দুটি পিছনে। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ছোট আঙুলের গোড়ায় খোটাচ্ছেন আর দোয়া পড়ছেন।

নাজমা বেগম আর বসে থাকতে পারছেন না। নিঃশব্দে মশারির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে মেয়ের দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়েন। একটু পর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেন। লাবণ্য আর কিছু বলল না। বিছানার পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। তাদের ঘরে দুই বোনের জন্য একটি খাট। বড়বোন আশা লতা তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। লাবণ্য সাবধানে মশারির ভেতর ঢুকে নিজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় কাত হয়ে শুয়ে পড়ল আবার। শুয়ে শুয়ে আরেকটু সকাল হবার অপেক্ষায় চোখ বুজে থাকা আরকি।

নাজমা বেগম কয়েকজনের সাথে কথা বলেছেন লাবণ্যর স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটি নিয়ে। মোজাম্মেল হোসেনকে কবরে শুইয়েছিল যে কয়জন মানুষ তাদের একজন নুরু মিয়া। মোজাম্মেল হোসেনের চাচাতো ভাই। তিনি জানান, কবরে মোজাম্মেল হোসেনের মাথার নিচে একটি আধলা বা অর্ধেক ইট দেওয়া হয়েছিল তার মাথাকে সোজা রাখার জন্য। হয়ত মাথার নিচে ইট থাকার কারণেই মিয়াভাইয়ের অসুবিধা হচ্ছে কবরের ভেতর, নুরু মিয়া তার বিবেচনা প্রকাশ করে। বলে, নিশ্চয়ই এই কারণে মিয়া ভাই স্বপ্নে এসে লাবণ্যকে জানিয়েছেন যে তার ঘুমাতে অসুবিধা হচ্ছে। নুরু মিয়া মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথেও আলাপ করলেন। স্বপ্নের ব্যাপারটি জানান। ইমাম সাহেব বলেন, মৃতব্যক্তিরা স্বপ্নে এসে তাদের কবরের সংবাদ জানানো খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কয়েক বছর আগে তার পরিচিত একজনের মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর পর তিনি ছেলের সাথে দেখা করতেন। পরপর তিনরাত স্বপ্নে এসে ছেলেকে জানান যে তিনি বন্যায় ডুবে যাচ্ছেন। নাকে মুখে পানি প্রবেশ করে মারা যাচ্ছেন তিনি। বিশেষ অনুমুতি নিয়ে সেই লোকের কবর খুঁড়ে দেখা গেল কবরের ভেতরটা সত্যি পানিতে ভরে গিয়েছিল। নতুন করে কবর খুঁড়ে তাকে আবার দাফন করা হয়। এরপর সেই ছেলে আর স্বপ্নে দেখেনি বাবাকে।

মোজাম্মেল হোসেনের ঘুমের অসুবিধার ব্যাপারে ইমাম সাহেব পরামর্শ দিলেন একটি মিলাদ পড়িয়ে এতিমখানায় কিছু অর্থ দান করতে। মিলাদের পর কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। মোজাম্মেল হোসেন যদি আবার স্বপ্নে কাউকে কিছু জানান, তাহলে উনার কবর খুঁড়ে দেখতে হবে। লাবণ্য অবশ্য আবার বাবাকে স্বপ্নে দেখার কথা কিছু বলল না আর। নাজমা বেগম অনেকবার জিজ্ঞেস করেছেন নিজ থেকে। কিন্তু মেয়ে আবার জবান বন্ধ করে চুপটি মেরে গেছে। জং ধরা লোহার তালার মত কুলুপ আঁটা মুখের ভাঁজ। যেহেতু বাবার ব্যাপারে লাবণ্য আর কিছু জানায়নি, তাই তাই সবাই ধরে নিল, হয়ত মিলাদের দোয়ায় কাজ হয়েছে। এতিম বাচ্চাদের মোনাজাতে শান্তি পেয়েছে মৃতের আত্মা।

মোজাম্মেল হোসেনের মৃত্যুর পর কয়েক মাসে বাড়ির কাজকর্ম একাই সামলাতে শিখে গিয়েছেন নাজমা বেগম। ছেলেরা মোটামোটি বড় হয়েছে এখন। বাইরের কাজগুলো বলে দিলে ঠিকঠাক করে আসতে পারে। বড়মেয়ে আশা অনার্স শুরু করেছে। বিল্ডিঙের ঘর ভাড়া দিয়ে হিসেব করে সংসার চালাচ্ছেন নাজমা। তিনমাস হয়ে গেছে, কিন্তু মানুষটার অভাব এখনো প্রকট পরিবারে। অর্থনৈতিক প্রয়োজন ছাড়াও জলজ্যান্ত একটা মানুষ পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না, এটা মেনে নেওয়া খুব সহজ কাজ না।

মানসিক কষ্টের এমন দিনে, নাজমা বেগম একটা গুরুতর ঝামেলায় পড়লেন। উত্তরখান হাইস্কুলের পাশে মোজাম্মেল হোসেনের কিনে রাখা দুই বিঘা জমি বেহাত হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। নাজমা বেগমের নিজের চাচাতো ভাই নজরুল, দুলা ভাইয়ের অকস্মাৎ মৃত্যু হয়েছে দেখে জমিটি মেরে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছিল না। স্থানীয় কিছু নেতা আর চেয়ারম্যানকে সাথে করে জমিটিতে সে ওয়াল টিনশেড ঘর তুলতে আরম্ভ করেছে। জুগালি, লেবার, মিস্ত্রি নানা মানুষে ধুমধাম আয়োজন লেগে গিয়েছে সেই জমির ওপর। মাটির আসল মালিক যখন আর বেঁচে নেই, তখন জোর যার মুল্লুক তার, এমন হিসেবে কষেছে চতুর নজরুল। 

নাজমা বেগম অসহায় বোধ করেন। নজরুল এমন একটা কাজ করতে পারে এটা তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। তাছাড়া স্বামীর মৃত্যুর আঘাতটি তিনি এখনো সামলে উঠতে পারেননি। তার উপর আবার এমন বৈষয়িক যন্ত্রণার ভেতরে পড়তে হবে এটা যেন মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। রাগে, দুঃখে যুক্তিহীনভাবেই অভিমান করেন মৃত মানুষটির উপর। ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেন, কেন তুমি আমার আগে চলে গেলে, এসব কাজ কি আমি করেছি কোনোদিন? 

নাজমা বেগম কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলেছেন। সবাই নজরুলের বাড়ি গিয়ে সরাসরি কথা বলার পরামর্শ দিলো। দুই দিন পর একটি পারিবারিক মিটিঙে উপস্থিত হয়ে নজরুল জোর গলায় বলল, ওই জমি এখন তারই। নাজমার সামনে গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করল, কেন দুলাভাই আপনেকে কিছু বলে নাই আফা? উনি তো এই জমি আমার কাছে বিক্রি করে দিছেন কয়েক বছর আগেই। এই যে দলিল দেখেন। দুলাভাইয়ের নিজের হাতে সাইন করা।

নজরুলের দেখানো দলিলটি হাতে করে শূন্য দৃষ্টিতে বসে থাকেন নাজমা বেগম অনেকক্ষণ। স্বামী বেঁচে থাকতেই পাঁচটি সন্তানকে নিয়ে ভরা সংসার সামলাতে হিমশিম খেতে হতো তার। জায়গা জমি, টাকা পয়সা, ধার দেনা, এসব কিছুর দিকেই নজর করতে পারেননি কখনো। আসলে মোজাম্মেল হোসেন নিজেই সামলাতেন এই দিকগুলো। তাই নজরুলের সামনে নাজমা বেগম জোর গলায় জানান যে তার স্বামী জমি বিক্রি করে থাকলে সেই কথা অবশ্যই তাকে জানাতেন। কিন্তু নিজের কথার প্রমাণ স্বরূপ জমির আসল দলিলটি যে কোথায় আছে, এটা তিনি জানেন না বলে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কী উপায় আছে? মিটিঙে সবাই অনেকক্ষণ নানান বিষয়ে কথা বলল। মোজাম্মেল হোসেন কত ভালো মানুষ ছিলেন, সবার কত উপকার করেছেন সেসব নিয়ে কথাবার্তা হলো। কিন্তু জমিটি তিনি সত্যি নজরুলের কাছে বিক্রি করে গেছেন কিনা, এই প্রসঙ্গে কেউই কিছু শুনেছেন বলে মনে করতে পারল না। দলিলে স্বামীর স্বাক্ষরটি স্পষ্ট দেখতে পেলেও নাজমা বেগম জানেন নজরুল মিথ্যে কথা বলছে। কিন্তু তিনি বাড়িতে জমিটির আসল দলিল খুঁজে পাচ্ছেন না কোথাও। পুরো বাড়ির আলমারি, বিছানা, তোষক সবকিছু উল্টে পাল্টে ঘাটাঘাঁটি করেও পাওয়া গেল না উত্তরখানের জমির দলিল। এলাকার ক্ষমতাবানদের কাছে দেন-দরবার করেও লাভ হলো না। কারণ চেয়ারম্যান এবং মেম্বার সবাইকে নজরুল আগেই কিনে নিয়েছে।

দুঃসময়ে আশেপাশের অনেক প্রিয়জনের বদলে যাওয়া চেহারার দেখা পাওয়া যায়। দুষ্টু মানুষের লোভী মন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তখন। শুধু নিজের লাভের চিন্তায় কাছের মানুষ শত্রু হয়ে যায় আজীবনের জন্য। এইরকম বদ চরিত্রের একজন নজরুল। যার কারণে স্বামী হারানোর কষ্টের উপর নাজমা বেগম জমির শোকেও কাতর হয়ে পড়েছেন। বারো কাঠার জমিটি বিক্রি করলে কম করেও পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পাওয়া যেত। ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ার খরচের কথা ভেবেই মোজাম্মেল হোসেন জমিটি কিনে রেখেছিলেন। এখন সেটিও হাত ছাড়া হবার উপক্রম হয়েছে।

দুশ্চিন্তায় নাজমা বেগম যখন পাগল প্রায়, তখন এক সন্ধ্যায় ঘটল আশ্চর্যজনক ঘটনাটি। চুপ করে যাওয়া লাবণ্য এসে বসেছে মায়ের পাশে। দুপুরের ভাত খেয়ে পান মুখে দিয়ে নাজমা বেগম যখন বিছানা ঝাড়ু দিচ্ছিলেন, একটু পর প্রতিদিনের মত গড়িয়ে নেবেন ঘন্টাখানেক, সেই সময় তার ঘরে ঢোকে লাবণ্য। হঠাৎ করে মেয়েকে দেখে বলেন, কিরে, কিছু বলবি?

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আলতো মাথা নাড়ে লাবণ্য। একটু যেন আমতা আমতা করছে।

নাজমা বেগম মেয়েকে হাত ধরে খাটের কিনারায় বসান। কাঁধের কাছে একটি হাত রেখে নরম সুরে বলে, কী বলবি বল না। ইতস্তত করছিস কেন?

-আম্মা, আমি জানি উত্তরখানের জমির আসল দলিলটি কোথায় আছে। গলার স্বর খুব নামিয়ে ফিসফিস করে কথাগুলো বলল লাবণ্য।

লাবণ্যর কথায় নাজমা বেগমের শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে যেন। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলেন, কই আছে দলিলটা?

লাবণ্য আবারো রহস্যভরা কণ্ঠে বলল, তোমাদের এই কাঠের আলমারিতে একটা পুরোনো কাগজের ফাইল আছে। দলিলটা ওর ভেতরেই আছে।

খাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের আলমারিটির দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় লাবণ্য। এই আলমারিটা এই বাড়ির সিন্দুকের মত। এর ভেতর মূল্যবান জিনিসপত্র এবং সব দরকারি কাগজপত্র রাখতেন মোজাম্মেল হোসেন।

নাজমা বেগম বলেন, একটা কাগজের ফাইল আছে এই আলমারিতে। কিন্তু ওই ফাইলে তো তোর আব্বা তোদের স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট আর সনদপত্রগুলো রাখত শুধু! জমির দলিল দেখি নাই তো!

নাজমা বেগম তক্ষুণি উঠে আলমারি খুলে কাগজের ফাইলটি বের করে আনলেন। বেশ ওজন আছে ফাইলটির। ভেতরে এলোমেলো কিছু কাগজপত্র, কিছু ফার্নিচার কেনার রশিদ, পাঁচ ছেলে মেয়ের স্কুলের সার্টিফিকেট পাওয়া গেল। এবং সেই সাথে জমির দলিলটিও পাওয়া গেল। কাঙ্খিত দলিলটি হাতে করে ঝিমঝিম শরীরে চুপ করে থাকেন নাজমা বেগম। ফিসফিস করে মেয়েকে বলেন, এইটা যদি আসল দলিল হয় তাহলে নজরুলের কাছে তোর আব্বার সাইন করা দলিল আসলো কোথা থেকে?

লাবণ্য বলে, আব্বা নজরুল মামারে এই দলিলের একটা ফটোকপি দিয়েছিল। আব্বা বলেছিলেন, উত্তরখানের জমিটা বিক্রি করে উত্তরায় একটা বাড়ি কিনার ইচ্ছা। তাই নজরুল মামাকে জমি বিক্রির দালাল দেখতে বলেছেন। নজরুল মামা আব্বার কাছে দলিলের একটা ফটোকপি চেয়েছিল, তাই আব্বা উনাকে ফটোকপি দিয়েছিল। এখন আব্বা মারা যাওয়াতে তিনি পুরো জমিটার মালিক হবার চেষ্টা করছেন। স্বপ্নে দেখলাম আব্বা খুব রাগ করেছেন নজরুল মামার উপর।

নাজমা বেগমের মনটা খারাপ হয়ে যায়। গত কয়েক বছর ধরে তিনি আর তার স্বামী প্রায় প্রতি রাতেই আলাপ করতেন উত্তরায় একটি বাড়ি কেনার বিষয়ে। চোখের সামনে দক্ষিণখানের পাশেই গড়ে উঠেছে উত্তরা আবাসিক এলাকা। পাশাপাশি দুটো এলাকা, রেললাইনের এপাশ আর ওপাশ, অথচ জীবনধারণের মান, সুযোগ সুবিধায় আকাশ পাতাল তফাৎ। ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই মোজাম্মেল হোসেনের খুব ইচ্ছা ছিল উত্তরায় একটা বাড়ি কেনার। কিন্তু এই চিন্তার কথা তারা দুজন ছাড়া আর কেউই জানত না।

-আচ্ছা লাবণ্য, একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোকে। তোর আব্বা কি তোর সাথে প্রায়ই দেখা করে? নাজমা বেগম জিজ্ঞেস করেন মেয়েকে।

মায়ের চেপে ধরা হাতের ভেতর থেকে নিজের হাতটিকে টেনে বের করে নেয় লাবণ্য। প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বলল না। নিঃশব্দে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। শত প্রশ্ন করলেও আর কোনো কথা বলবে না এখন এই মেয়ে। অন্তত তার বাবাকে নিয়ে তো নয়ই।

বেঁচে থাকার লড়াইয়ে লতানো গাছটিও শিকড় আর লতাপাতা শক্ত করে নিজেকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকিয়ে রাখার যোগ্য করে তোলে। নাজমা বেগম জমির মূল দলিল হাতে করে, মণ কে মণ কাঠ খড় পুড়িয়ে, অনেক লোককে হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে অবশেষে নিজের জমি নিজের করে বুঝে পেয়েছেন। শোকের সাথে শকুনের সঙ্গেও লড়াই করা শিখে গেলেন অনেকটা। লাবণ্যকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় তার। লাবণ্যকে দেখলে মনে হয় জীবনচিত্রের পট থেকে ফিকে হয়ে যাওয়া তুলির আঁচড়ের মত ওর বাবার সব স্মৃতি মুছে গিয়েছে ওর মন থেকে। সব কিছুই যেন আগের মত আছে ওর জন্য। কোনো ফরিয়াদ নেই। হাহাকার নেই বাবার অভাবে। কিন্তু মেয়েটার এই স্বাভাবিক আচরণকে কেউই স্বাভাবিকভাবে দেখছে না। কারো সাথে সে বাবাকে নিয়ে একটি কথাও বলে না। অন্যরা কেউ বাবার প্রসঙ্গ তুললে লাবণ্য সরে যায় সেখান থেকে। বোঝায়, সে এই প্রসঙ্গে একটিও কথা শুনতে আগ্রহী নয়, শুনতে চায় না বাবা সম্পর্কে কোনো কথা। রাতে একই খাটে ঘুমায় বড় বোন আশা, বাবার মৃত্যুর পর ছোট বোনকে এখনো কাঁদতে দেখেনি সেও। আশা লুকিয়ে জানার চেষ্টা করেছে বাবার সাথে লাবণ্যর যোগাযোগ হয় কখন, কীভাবে! কিন্তু লাভ হয়নি। কিছুই জানতে পারেনি কেউ, কখনো।

তবু নাজমা বেগমের মত আশাও নিশ্চিত যে বাবার সাথে লাবণ্যর যোগাযোগ হয়। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ সিক্রেট যদিও। আশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বাবা যখন বেঁচে ছিল তখন যেমন সাত সদস্যের পরিবারের ভেতর আব্বা আর লাবণ্য ছিল একটি আলাদা দল, এখনো তেমনই দলীয়করণ চলছে ওদের দুজনের ভিতর। পরিচিত সবাই খুব চেষ্টা করেছে লাবণ্যকে একটি বার কাঁদাতে। কেঁদে যদি মনটা হালকা করত মেয়েটা তাহলে ওর মানসিক অসুস্থতার ব্যাপারে ভয়টা কাটত। কিন্তু লাবণ্য কাঁদবে না বলে পণ করেছে যেন। সবার মাঝখানে থেকেও অন্য কোন জগতে চলে যায় সে হঠাৎ হঠাৎ। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে চোখ বুজে স্পর্শ করে অদৃশ্য কারো হাত। মমতার ছোঁয়া মাখা সেই স্পর্শে আশীর্বাদের মত স্নেহধারা গলে পড়ে করতলে। নির্ভরতার পরশ বুলিয়ে দেন বুঝি মৃত মোজাম্মেল হোসেন তার সবচেয়ে প্রিয় কন্যাটির বাড়িয়ে ধরা হাতে। বাবার জন্য মায়ায় ভরে থাকে লাবণ্যর বুক।

(চার)

মোজাম্মেল হোসেন মারা যাবার নয় মাস পরের কথা। অমীমাংসিত কিছু রহস্যের মতো লাবণ্য খুঁজে বের করেছে মোজাম্মেল হোসেনের একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি। ডায়েরীটাকে তিনি তার পুরনো কাগজপত্রের সাথে একটি গোপন খামের ভেতর লুকিয়ে রাখতেন। নাজমা বেগম নিজেও জানতেন না স্বামীর এই ডায়েরির কথা।

আরেকটি নিরুপদ্রব দুপুরে, বাড়িতে যখন সবাই নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত, তখন লাবণ্য আর নাজমা বেগম দুজন একসাথে ডায়েরির পাতা উল্টান। অনেক রকম হিসাব, সন্তানদের জন্মের দিন, তারিখ, সময়, লেখা ডায়েরিতে। কোথাও তার নিজের শৈশবের খুব কষ্টের দিনগুলোর কথাও লেখা আছে অল্প কথায়। ডায়েরির মাঝখানে একটি পাতা ভাঁজ করা। সেখানে মোজাম্মেল হোসেন পরিষ্কার অক্ষরে বড় করে লিখে রেখেছেন তিনটি নাম। তারপরের কয়েকটি পাতায় অনেকগুলো তারিখ আর টাকার সংখ্যা লেখা। বোঝা যাচ্ছে, গত পঁচিশ বছর ধরে এই তিনটি মানুষ কিংবা তিনটি পরিবারকে তিনি নিয়মিত মাসোহারা দিতেন। নাজমা বেগম চিনতে পারেন, এরা মোজাম্মেল হোসেনের গ্রামের বাড়ির বাসিন্দা। স্বামীর মুখে অনেকবার তাদের নাম শুনেছেন তিনি। বাল্যবয়সে মোজাম্মেল হোসেনের বাবা মারা যাবার পর তার মাও মারা যায় পেটের অসুখে ভুগে। গ্রামের দরিদ্র এই পরিবারগুলো সেসময় এতিম মোজাম্মেলকে মায়া করে পাশে জায়গা দিয়েছিল। নিজের সন্তানের মুখের খাবার থেকে একটি দুটি গ্রাস কেড়ে নিয়ে তুলে দিয়েছিল অসহায় বালকটির মুখে। পরবর্তীতে ভাগ্যদেবী মোজাম্মেলের প্রতি সুপ্রসন্ন হলে তিনি তাদের উপকার মনে রেখেছেন। দরিদ্র পরিবারগুলোকে প্রতিদান দিতে চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব। নিজের সঞ্চয়ের ভান্ডার অপূর্ণ রেখে ভরণপোষণ চালিয়েছেন এদের সন্তান সন্ততিদের জীবন আর ভবিষ্যতের।

লাল মলাটের ডাইরির পাতায় বাবার হাতের লেখার উপর আঙ্গুল বুলাতে থাকে লাবণ্য। ফিসফিস করে বলল, মা, তুমি কি এদেরকে আগের মতো মাসোহারা পাঠাতে পারো না?

নাজমা বেগম চুপ করে থাকেন। কাজটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছেন না। বলেন, তোর বড় চাচার সাথে কথা বলে দেখি আগে। দেখি ভাই কী বলেন!

লাবণ্য ক্ষীণস্বরে বলে, আব্বা মনে হয় চাইছে তুমি তাদেরকে টাকাটা পাঠাও। সেজন্যই এই ডায়েরির খোঁজ দিয়েছেন আমাকে।

নাজমা বেগম তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর দেন না। ব্যাপারটা তার কাছে সম্পূর্ণ অজানা ছিল এতদিন। মোজাম্মেল হোসেন স্ত্রীর কাছে কোনো কথা লুকাতেন না। তাহলে তিনটি পরিবারকে নিয়মিত সাহায্য করার বিষয়টি কেন লুকিয়ে গেলেন? নাজমা বেগম ভেবে কুল কিনারা পান না। একবার মনে হলো, হয়ত দান করার গৌরব থেকে নিষ্কৃতি দিতে চেয়েছেন স্ত্রীকে। আবার মনে হলো, হয়ত পরিবারগুলোকে মোজাম্মেল হোসেন নিজের পরিবারের কাছে লজ্জায় ফেলতে চাননি। অনেক ভাবনা চিন্তার পর অবশেষে নাজমা বেগম মনস্থির করলেন তিনি স্বামীর ইচ্ছা পালন করবেন। এই তিনটি পরিবারকে পাঁচ হাজার করে মাসে পনেরো হাজার টাকা দেয়া খুব কঠিন হবে না তার জন্য। হয়তো এই টাকা পরিবারগুলোর জন্য খুব দরকার।

    

-মা, তুমি খুব ভালো। লাবণ্যকে অনেক দিন পর হাসতে দেখলেন নাজমা বেগম।

মেয়েটি অনেক রোগা হয়ে গিয়েছে। লাবণ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর জন্মের সময়ের কথা মনে করেন নাজমা বেগম। কী ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল সেদিন! টিনের চালের উপর আম গাছের পাতার দ্রুম দ্রুম আছড়ে পড়া। বাতাসের গা কাঁপানো গোঙানি। দরজার ফাঁক দিয়ে জোর করে ঢুকে পড়ছে বৃষ্টি জলের ছাট। মাটির মেঝেতে খেজুর পাতার পাটি আর কয়েকটি কাঁথার উপর শুয়ে প্রসব যন্ত্রণার শেষ কয়েকটি আর্তনাদ থেমে গেল যখন, একটি শিশুর কান্না আর দাইয়ের গলা শোনা গেল, মাইয়া অইছে আবার। কালা মাইয়া। এমন ফর্সা মায়ের পেট থিকা এমন কালা মাইয়া কেমনে বাইর অইল, কিছুই বুঝলাম না।

মেয়ে হয়েছে শুনে বিরক্তিতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছিলেন নাজমা বেগম। আশা লতার পর তিনি একটি ছেলে সন্তান চেয়েছিলেন। আবার মেয়ে হওয়ায় স্বামীর কাছে তার দাম কমে গেল ভেবে সদ্যজাত মেয়েটির জন্য কোনো মমতা বোধ করেননি অনেকদিন। সেই কারণে এখনো মনে মনে অনুতপ্ত হন নাজমা। অবশ্য, পরে, হাতে সেলাই করা কাঁথায় মোড়ানো শিশুটিকে কোলে নেবার পর গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকা কালো মুখটি দেখে খুব মায়া লেগেছিল তার মাতৃ হৃদয়ে। নিজেই মেয়ের নাম রেখেছিলেন, লাবণ্য লতা।

দেখতে দেখতে মোজাম্মেল হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী চলে এসেছে। একজন পরিবার প্রধানের মৃত্যুর পর তাকে ছাড়াই পরিবারটি একটি বছর পার করেছে। এই একটি বছর চলে গেছে কত দ্রুত! কিছুই তো থেমে থাকেনি। জীবিতদের জীবনে প্রিয় সংসারে প্রতিটি মানুষের হাসি, ঠাট্টা, কৌতুক, আড্ডা সবই চলছে ঠিক সেই আগেরই মতন। তপ্ত রোদে মানুষের মাথার উপর যে বটগাছটির ছায়া প্রীতির শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়াতো, আচমকা সেই মহীরুহ মাটি থেকে উপড়ে তুলে নিলে, শূণ্যে বিলীন হলে তার মায়ার ছায়া, নিচের মানুষগুলোর গায়ে খুব উত্তাপ লাগে। চামড়া পুড়ে যায় একেবারে। কিন্তু তারা কেউ মরে যায় না। নিজেদের জন্য আরেকটি প্রশান্তির আশ্রয় খুঁজে বের করে নেয় ঠিক সময়ের সাথে সাথে। আসলে নিতে পাড়তে হয়। অভ্যন্তরে শোকে তাপে ক্ষয়ে যেতে থাকলেও বাহ্যিকভাবে ঠিকই মানিয়ে নিয়ে চলতে শিখে যায় সবাই নিজের মত করে। নাজমা বেগম ঠিক করেছেন পাঁচ ছেলে মেয়েকে নিয়ে গ্রামে যাবেন। স্বামীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ তিনি গ্রামের বাড়িতে করবেন।

মোজাম্মেল হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদের দিন শত মানুষ ভিড় করেছে তাদের বাড়িতে। গ্রামের মানুষের নরম মন মৃতের নাম আর গল্প বলে চোখের পানি ফেলতে লাগল। দূরের আত্মীয়রাও এসে বিলাপ করে কাঁদতে শুরু করেছে সেই সকাল থেকে। অশ্রুশূন্য কান্নার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে আশেপাশে অনেকটা এলাকা জুড়ে। মোজাম্মেল হোসেনের মাসোহারার উপর ভরসা করে চলা পরিবার তিনটি একসাথে এসে উপস্থিত হয়েছে দুপুরের আগে আগে। উঠানের এক কোনে বসে তারাও কাঁদছে গুঙ্গিয়ে গুঁজিয়ে। তাদের কান্নার ভেতর নিজেদের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথাও প্রকাশ হতে থাকে। কান্নার তোড়ে হেঁচকি তুলে বলে এখন তারা সবাই ছাওয়াল পাওয়াল নিয়ে না খেয়ে মরবে নিশ্চিত। মরার এই দেশে কেউ কাউকে এক মুঠো চাল ভিক্ষা দেয় না, আর তাদের ঘরে এতগুলো মুখ হা করে থাকে সমস্তটা দিন!

মাটির ঘরের ভেতর ছোট্ট জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে লাবণ্য পরিবার তিনটির দিয়ে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। এদের সবার মুখে অভাবের ছোবল স্পষ্ট। গায়ে ছেঁড়া কাপড়। রুগ্ন শীর্ণ বয়স্ক মানুষ এবং শিশুগুলোর মুখ দেখে খুব মায়া হচ্ছে লাবণ্যর। নিজের মনে ভাবে, কিছু মানুষের এত অভাব থাকে কেন? মানুষের এই দলটির ভেতর লাবণ্য বিশেষ একজনকে খুঁজছে। মোজাম্মেল হোসেনের বিবরণ অনুযায়ী লম্বা নাক, উঁচু কপাল আর ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বরের মকবুলকে খুঁজে পেতে বেশিক্ষণ লাগল না। ধীর পায়ে উঠানের মাঝে গিয়ে লাবণ্য লোকটির পাশে বসে। ম্লান স্বরে বলে, আপনার বাপজান আমার আব্বাকে ছোটবেলায় ভাত খেতে দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সেইদিন যদি আপনার বাপজান আমার আব্বাকে খেতে না দিতেন, তাহলে আমার আব্বা দশ বছর বয়সেই ক্ষুধায় মরে যেত।

মকবুল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে লাবণ্যর মুখের দিকে। বোবা হয়ে গেছে যেন। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তারপর গলার গামছায় চোখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ওঠেছে। বলল, মাগো, এতগুলা বছর আপনার আব্বা যদি আমাদেরকে সাহায্য না করতেন, আমাদের সবাইর গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকত না গো আম্মা। খুব ভালো মানুষ আছিলেন আপনার আব্বায়।

মকবুল হোসেনের কথা শেষ হতেই সবগুলো মানুষ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। তাদের সম্মিলিত কান্নায় বাড়িটি প্রকৃতই মরা বাড়িতে পরিণত হয়েছে এখন। মৃত্যুবার্ষিকী নয়, মোজাম্মেল হোসেন বুঝি এইমাত্র মারা গিয়েছেন হার্ট এট্যাক করে। হৃদযন্ত্রের ক্রীড়া বন্ধ হয়েছে কয়েক মুহূর্ত আগেই। গ্রামবাসীর কান্নার সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরেকটি কণ্ঠের কান্না। মোজাম্মেলের মেয়ে লাবণ্য, কাঁদছে। মাটিতে পা বিছিয়ে বসে আকাশের দিকে গলা উঁচু করে চিৎকার করে কাঁদছে। আরশের মালিকের কাছে দুই হাত পেতে বুক খালি করে হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলে চলেছে অনেক কথা। এতদিন বাবাকে হারিয়ে চুপ হয়ে যাওয়া মেয়েটি আজ সব কথা বলে ফেলতে চায়। বলে, আমার আব্বা সবার জন্য কত কিছু করেছে, আর আমি তার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। মৃত্যুর সময় একটু পাশেও থাকতে পারলাম না। আব্বার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি কত আমি, আব্বা তো আমার কোলে মাথা রেখে মরতে পারল না চাচা। আমার আব্বা আমাকে খুব ভালোবাসত। আমি কোথায় খুঁজে পাব তাকে আর! কই গেলে একবার দেখা যায়! একটুখানি কথা বলা যায়! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে গো আমার আব্বার জন্য!

গ্রামের পাখি ডাকা শান্ত পরিবেশ কান্নার ভারে মুষড়ে পড়েছে। মানুষগুলো এইভাবে প্রাণপাখির ডানায় ভর করে উড়ে চলে যায় কোন অজানায়, কার ডাকে? প্রশ্নের উত্তর আছে অনেক বইয়ের পাতায়। কিন্তু হৃদয়ের গভীর ক্ষতে প্রলেপ পড়ে না খুব একটা তাতে। লাবণ্য আরো যতদিন বেঁচে থাকবে এই পৃথিবীতে, ওর জীবনে পিতার অভাব ঘুঁচবে না কিছুতে। জগতের সব পিতাহারা সন্তানের মতো এখন থেকে তারো মাথার উপর শুধুই খোলা আকাশ। গত একটি বছর একবারের জন্যও মুখে আনেনি যে কথা, আজ বলছে লাবণ্য সেই বুক ভাঙা হৃদয় বিদারক কথাটি, আমার আব্বা মারা গেছেন!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত