| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে প্রবন্ধ সাহিত্য

শওকত আলী: সৃষ্টি ও ব্যক্তিগত যাপন । সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট
সৃষ্টিতে নিজেকেই অতিক্রম করেন স্রষ্টা। তেমনি স্বনির্মিত চরিত্রের কাছে খর্বকায় হয়ে লেখক বিজয়ী হন বলেই বিশ্বসাহিত্যের ঈদিপাস, হ্যামলেট, ললিতা বা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনদের কাছে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে লেখকের ব্যক্তি পরিচিতি। বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়েও কপালকুণ্ডলা, তিলোত্তমা অথবা নিমচাঁদ বা গোরারা বেশি আপন হয় বাংলা সাহিত্য পাঠকের কাছে। কালজয়ী বা ব্যর্থ, জনপ্রিয় বা বিস্মৃত সেসব চরিত্র আবার লেখকের যাপনেও সে ছাপ রাখে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। কোনো মুগ্ধ পাঠক তা আবিস্কার করে বসলে, স্বয়ং লেখকই হয়ে যান একটি বিশেষ চরিত্র। তখন পাঠকের কাছে কোনো প্রভেদ থাকে না বাংলা সাহিত্যে অন্ত্যজজনের ইতিহাস ‘খোয়াবনামা’র তমিজের সাথে সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অথবা প্রাকৃতজনের আখ্যান ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর শ্যামাঙ্গ ও বসন্তদাসের সাথে ঔপন্যাসিক শওকত আলী-র।

বাংলা সাহিত্যের অমৃতপুত্র শওকত আলীর সাথে প্রথম দেখা মৃত্যুর মাত্র বছর দুই আগে। বাংলা একাডেমিতে একটি সাহিত্য পুরস্কার আয়োজনে ওই আশ্চর্যজনক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলে সেদিন হয়তো শুধু দৃষ্টির স্মৃতি নিয়েই ফিরতাম। একই মঞ্চে তার সাথে নবীন শাখায় পুরস্কার গ্রহণের পর শওকত আলীর পায়ে হাত দিয়ে দোয়া চাইতে হাঁটু গেড়ে সবে বসেছি; হাত ধরে থামিয়ে দিলেন, মাথায় হাত রাখলেন এবং নীচু স্বরে আদেশের সুরে বললেন, ‘লেখার জন্য আশীর্বাদ চাইতে পায়ে হাত রেখো না।’ কঠোরতা বিস্মিত করলেও ওই মুহূর্তে মনে হলো, এই তো বলার কথা ছিল তার। এই লেখক তার তৈরি চরিত্র থেকে ভিন্ন কেউ নন। হাজার বছর আগে আত্রেয়ী তীরের যে মৃৎশিল্পী গুরুর আদেশ অমান্য করে দেবপীঠে সুষমাময়ী শবর কন্যা, প্রণয়দীপ্ত ব্যাধ রমণী, মমতাময়ী ধীবর জননী তৈরি করেছিলেন, সেই ‘শ্যামাঙ্গ’ এই অশীতিপর শব্দশিল্পীরই অংশজাত। শ্যামাঙ্গ তার রাজ অনুগ্রহপ্রাপ্ত গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করেছিল, ব্রাত্য মুখচ্ছবির অপরাধ কী? ঔপন্যাসিক শওকত আলীর তৈরি অন্যতম প্রধান চরিত্রটি মৃত্যুর মুখেও নিজের বিশ্বাসে দৃঢ় থাকা মানুষ। প্রদোষে প্রাকৃতজনের দুস্কালের দিবানিশি পরিচ্ছেদের শেষ অংশে স্বধর্মী ও প্রাকৃতজনেরা যখন দলে দলে যবনদের ধর্মের কাছে নিরাপত্তার আশ্রয় গ্রহণ করছিল, শ্যামাঙ্গ তখন ‘মৃত্তিকাশ্রয়ী ধর্ম ত্যাগ করার অর্থ নিজেকেই ত্যাগ করা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল সে নিরাপত্তা।

উপন্যাসের শুরুতে রয়েছে গুরুগৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েও শ্যামাঙ্গ ব্রাত্যজনের মুখচ্ছবির বন্দনা করেই পাঠককে জানিয়ে দিয়েছিল, নতজানু হওয়া শিল্পীর ধর্ম নয়। সেই শিল্প বন্দনাই ছিল শিল্পের ভেতর দিয়ে শ্যামাঙ্গের বিশ্বরূপের সাথে সংযোগ তৈরি এবং রাজশাসনে নিগৃহীত প্রাকৃতজনদের জন্য প্রতিবাদ। শিল্পসত্তা বিকিয়ে না দেওয়ার সেই প্রতিশ্রুতি সব লেখকের যাপনে থাকে না; ব্যক্তি শওকত আলী যে বহু লেখকের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির ছিলেন, তা নিজের যাপন দিয়েই প্রমাণ রেখেছেন। বছর দেড় বাদে এ অনুভব আরও স্পষ্ট হয়েছিল তার বিরতি ভিলার বাড়িতে।

টিকাটুলীর হাটখোলা রোডের বাড়ির নিচতলার ওই কুঠুরিতে বহুকাল আগে থাকতেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক ইলিয়াস জগন্নাথ কলেজে পড়ানো শুরু করে ভাড়া নিয়েছিলেন এ ঘর। এখন সেখানেই থাকেন শওকত আলী। আশির দশকে চারপাশ খোলামেলা ছিল, আলো-হাওয়ার খেলা ছিল। এখন সে সবই কল্পনাতীত। আমার দ্বিতীয় বইয়ের উৎসর্গপত্রে দু’জনের মধ্যে শওকত আলীর নাম উল্লেখ করেছিলাম বলে বইটি হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল। বেল বাজানোর দীর্ঘ সময় পর দরজা খুললেন তিনি। সেই কঠোর কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন- কে এবং আগমনের হেতু কী। আমার সাথে ছিলেন অন্যপ্রকাশের মোমেন ভাই। মোমেন ভাইয়ের সরাসরি শিক্ষক শওকত আলী। তিনি জানালেন, স্যার বহু বছর ধরে এখানে একাই থাকেন। ঘরে প্রবেশ করেই মনে হলো… এ আসলে তার এক আড়াল তৈরি করে নেওয়া। চারতলা বাড়ির উপরের মেঝেতেই পরিবার সন্তান নিয়ে থাকেন এক ছেলে। অথচ নিচতলায় এই ভ্যাপসা ঘরে বইপত্র আর অতীতের স্মৃতির ভেতর নিজেকে আটকে রেখেছেন শওকত আলী। বাইরের জীবন নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই এখন। অপরিচ্ছন্ন ছোট একটি বারান্দা, পা আটকে যাওয়া ঘরে গুমোট হাওয়া। গাদাগাদি করে আছে বইসমেত দুটো বুকশেলফ। সেখানে গর্ডন চাইল্ডের ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড ইন হিস্ট্রি’ থেকে রোডি ডোয়েলের ‘দ্য ডেড রিপাবলিক’। রবীন্দ্র রচনাবলী ও জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র বইগুলোতে দু’স্তরের ধুলোর পরত। দেওয়ালে একুশে পদক থেকে ফিলিপস পুরস্কারের সনদপত্র, মেডেল আর মৃত স্ত্রীর ছবি। এমনকি ধুলোয় ঢেকে থাকা চিমনি ভাঙা বহু বছরের পুরনো একটা হারিকেনও রয়েছে জানালার কাছে। তিন সন্তান বা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কোনো ছবি নেই। দেখা গেল না নিজের সাম্প্রতিক সময়ের একটি চিত্রও। একটা টেলিভিশন আর কিছু ওষুধপত্র ছাড়া এ ঘরে সমকালীন কিছু বিশেষ চোখে পড়ল না। নতুন সৃষ্টি হোক বা না হোক, জীবনের প্রক্রিয়ায় পুরাতন ধ্বংস হওয়ার যে রীতি, তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন শওকত আলী। টি-টেবিলের ওপর কয়েকটি দিনলিপি। পাতা উল্টে চমকাতে হলো, ১৯৬৯ সালের লেখাও আছে। কয়েকটি পাতা পড়া সম্ভব হয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যে। ব্যক্তিগত যাপনের কোনো বাক্য তাতে নেই। সমস্তটাই রাজনৈতিক ঘটনা ও সামাজিক নানা সংকটের কথা দ্রুত হাতের লেখায় লিপিবদ্ধ।

হাতের কাছে রাখা দিনলিপিই তুলে আনল শওকত আলীর পুরনোকে আঁকড়ে রাখার অভ্যাসের প্রমাণ। এই সত্তায় আছে প্রদোষে প্রাকৃতজনের বৌদ্ধ ভিক্ষু মিত্রানন্দের শিষ্য, মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাসের চরিত্র। বসন্তদাস শিল্পের ভেতর দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে চাওয়া শ্যামাঙ্গ নয়; সেই উপন্যাসে লড়াই করা মানুষ। বারবার গৃহ ও নারী, মায়া ও লীলা সঙ্গের জন্য তাকে হাতছানি দিলেও সে যোগ দিয়েছে স্বধর্মী বৌদ্ধদের গোপন কার্যক্রমে। রাজনৈতিক অনুষঙ্গ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি বসন্দদাস। উপন্যাসে মানুষকে স্বপরিচয়ে উঠে দাঁড়াতে বলেছিলেন মিত্রানন্দ, নতজানু দাসত্ব থেকে সে মুক্ত হতে বলে। এর বেশি সে জানে না; জানার আবশ্যকতাও বোধ করে না। মিত্রানন্দের শিষ্য বসন্তদাসও চায় প্রচলিত ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করতে। কিন্তু সে আরও জানতে চায়, এর পরিবর্তে কী পাবে সবাই? শওকত আলীর দিনিলিপিগুলো শিক্ষকতাকালে, সাহিত্যসঙ্গ সময়ে, পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সময় অতিক্রমের যাত্রাপথে, প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের খসড়া প্রস্তুতকালে সর্বোপরি ব্যক্তিজীবনের নানা স্তর অতিক্রম করেছে এই দিনিলিপি। তবুও সেখানে ঠাঁই পেয়েছে শুধু রাজনৈতিক তথ্য-ভাবনা, অন্ত্যজজনদের কথা, শ্রেণি সংগ্রাম, অসঙ্গতির গল্প ও চিন্তা। সমকালীন সাহিত্য নিয়ে তার কাছ থেকে জানার আগ্রহ ছিল। এ প্রশ্নে মুখটা অপ্রসন্ন হলো শওকত আলীর। বললেন, ‘ইউরোপ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্য- সবখানেই একটা পরিবর্তন এসেছে। মোটা দাগে বলতে গেলে এই সাহিত্য যত না মানুষের জীবননির্ভর, তার চেয়ে বেশি কল্পনানির্ভর। ইউরোপের সাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে সেখানকার সাহিত্য থেকে গণমানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে; এখানেও তাই।’

এখন আর নিজের লেখা নিয়ে বিশেষ কথা বলেন না তিনি। প্রদোষে প্রাকৃতজন লেখার ইতিহাস নিয়েও নানা আলোচনায় স্থান পেয়েছে সেই একই ব্যাখ্যা, এদিকে কেন মুসলমান বেশি, সে কারণ অনুসন্ধান থেকে উপন্যাস। শওকত আলী পুরোপুরি সুস্থ সময়েও যে খুব আমুদে মিশুক ছিলেন না, সে বিষয়ে আশা করি সমকালীনরা একমতই হবেন। তথ্য আর হিসেবের অমন আতিশয্যে ভারাক্রান্ত হয়ে দিনলিপি লেখা মানুষ কোন দরদে লীলাবতী, ছায়াবতী বা শ্যামাঙ্গদের মতো মানবিক চরিত্র তৈরি করে; তা বরাবরই লেখকসত্তার এক রহস্য। সব সময় হয়তো তিনি তাই নিজের আবেগকে সুসংহত করে রেখেছেন শুধু লিখবেন বলে। তাই লেখার বাইরে তা নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। নিজের শব্দ-বাক্যের কাছে যে লেখক আত্মসমর্পণ করেন, এমনই হওয়ার কথা তার। ভি.এস. নাইপল তার নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘ভাষণ দেওয়ার মতো মূল্যবান কিছু নেই তার কাছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে কথা, নানা আবেগ এবং ধারণা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা একজন মানুষের কাছ থেকে ক’টা কথা পাওয়া যাবে না- এ আশ্চর্যজনক বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু তার তরফে যা কিছু মূল্যবান ছিল, সবই তিনি রেখেছেন বইয়ে। এর অতিরিক্তি যেটুকু কোনো এক ক্ষণে তার কাছ থেকে পাওয়া গেলেও যেতে পারত সে সম্পর্কে নাকি সুস্পষ্ট ধারণা নিজেরই নেই। কিছু থাকলেও সেটা নাকি পরের বইতে প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করে।’

শওকত আলীর কাছেও লেখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঘুরেফিরে তিনি রায়গঞ্জ, উন্মূল মানুষের কথায় চলে যান। প্রসঙ্গান্তর ঘটে তবুও লেখা নিয়ে বিশেষ কিছু বলার আগ্রহ আর নেই শওকত আলীর। পাঠাভ্যাস এখনও আছে কি-না জানতে চাইলে বললেন, আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। রাতে ঘুম হয় না, পড়তে চেষ্টা করলে চোখে কষ্ট হয়। ঘর থেকে এখন আর কোথাও যাওয়া হয় না। কয়েক পা’র বেশি হাঁটতেও পারেন না একা, পায়ে পানি জমেছে। সাহিত্য জগতের কেউ তেমন আসে না জানিয়ে নিজেই বললেন, এ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। আর ওতেই টের পাওয়া গেল লেখকের অভিমানের উত্তাপ। চলৎশক্তিহীন, বিস্মৃতি ও সময়ের সব ভারাক্রান্ততা নিয়ে এ ঘরে লেখক শওকত আলীর একার জীবন। বাইরের জীবন উপেক্ষা করে এই গ্রহণ করেছেন তিনি। প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের ‘ভীতি মানুষকে অন্তরাল শেখায় আর সেটুকু অবলম্বন করেই মানুষ বাঁচতে শিখে’ বক্তব্যের যেন যথার্থ প্রমাণ দিচ্ছেন নিজের যাপন দিয়ে। অনভ্যস্ত শব্দ কথা গ্রহণের, অন্যের উপেক্ষায় নিজস্ব শক্তি ভেঙে যাওয়া অথবা অপরিচিতজনের কাছে নিজেকে প্রকাশের সংকোচের ভয়, নাকি আরও বেশি কিছু- জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে। বিস্মৃতির ঘোরের ভেতর থেকে বর্তমান ও অতীত মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলেন এখন, তবুও  স্পষ্ট করেই জানালেন, নিঃসঙ্গতার অন্যতম কারণ মানুষের ভেতর অসঙ্গতি বেড়েছে, আর তাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন- ‘আধুনিকতা নিয়ে আক্ষেপ নেই কিন্তু অসঙ্গতি আমাকে কষ্ট দেয়। আজকে স্কুল-কলেজে যে সিলেবাস তৈরি হয়েছে, তাতে কত ভালো লেখকদের পেছনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এটা দেখলেই সঙ্গতির অভাবটা বোঝা যায়। মানুষের প্রতি যে কর্তব্য, সেগুলো এখন লেখকরা করছেন না। মানুষের সংগ্রাম কি থেমে গিয়েছে? সমাজের অবহেলিত অন্ত্যজ শ্রেণি মুছে গিয়েছে? কেন তারা সাহিত্যে অনুপস্থিত? কারণ, সাহিত্যিকদের সঙ্গে সমাজের এই শ্রেণির বিচ্ছেদ ঘটছে, দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কি জানো, সাহিত্যে সব থাকতে হবে। গণআন্দোলনের প্রয়োজন নেই বলে সাহিত্যে প্রাকৃতজনরা অনুপস্থিত হবে? তাহলে সেই সাহিত্যকর্ম কি সত্যি গোটা সমাজকে উপস্থাপন করে? এসব অসঙ্গতির সাথে মানুষের ব্যক্তিগত আচরণও আমাকে বিরক্ত করে। তাই আরও গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে। চলাফেরার সমস্যা একটা বড় বিষয়। এক সময় নারী-পুরুষ অনেকের সঙ্গেই পরিচয় ছিল। এখন এদের কেউ হয়তো চাকরি-টাকরি করছেন। তবে একটা পর্যায়ে মনে হয়েছে, গার্হস্থ্য জীবন এরা নিজেরাই ভালো করে বুঝতে পারেন না। জীবন সম্পর্কে তাদের বোধটা অস্পষ্ট। আর ধর, কোথাও একটু গিয়ে বসে থাকলাম, আমার মনে হতো, একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। একই রকম দোকান, রাস্তাঘাট। মানুষজনও একই নিয়মে জীবনযাপন করে চলেছে। ফলে আমার ক্লান্তি চলে এলো এক সময়।’

সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী এই লেখকের জীবনবিচ্ছিন্ন সাহিত্য পাঠে এবং আড্ডায়, জীবন সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত মানুষের স্পর্শে ক্লান্তিই আসার কথা। সমকালীন সাহিত্য পাঠে পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে যে রোমান্টিক ধারণা তৈরি করে তাতে শওকত আলীর মতো জীবনমুখী লেখকের বিরক্তির উদ্রেক হতেই পারে। সাহিত্যের পূর্বপুরুষদের চরিত্র তৈরি নিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় গল্পের উৎসভূমি :ভারতবর্ষ প্রবন্ধে বলেছিলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা মাত্র তপস্বীই ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় দিবারাত্র ‘জীবাত্মায় শাণ দিয়ে সূক্ষ্ণ থেকে সূক্ষ্ণতর করাই’ তাঁদের একমাত্র ব্রত ছিল না। যে জীবন পরিপূর্ণ- ভোগে বাসনায় কর্মে বিজ্ঞানে যা ‘শালপ্রাংশুর্মহাভুজ :’- তাঁরা তার সর্বাঙ্গীণ সাধনাই করে গেছেন। তার নিদর্শন আছে মহাভারতে, আছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে, আছে বাৎস্যায়নের কামসূত্রে। রামায়ণ-মহাভারত সেই পূর্ণাঙ্গ জীবন-সম্ভোগের অকুণ্ঠ ইতিবৃত্ত, সংহিতায়, গৃহ্যসূত্রে তার নির্দেশিকা। ভারতীয় কথা-সাহিত্যও তার সমুজ্জ্বল নিদর্শন। সমাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব, সাংসারিক বিবিধ জ্ঞান, প্রলয়ঙ্করী স্ত্রী চরিত্র- সবই তাঁরা তাঁদের সাহিত্যে পরিবেশন করে গেছেন।”

গার্হস্থ্য জীবনের গুরুত্ব কতখানি, সে ছাপ শওকত আলীর বাড়ির বাইরের লাল চিঠির বাক্সে লেখা মৃত স্ত্রীর নাম ও ঘরের ভেতর তার প্রমাণ সমান ছবি দেখেই টের পাওয়া যায়। এই একই আদর্শ তিনি প্রদোষে প্রাকৃতজন-এ শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতীর ভেতরেও তুলে এনেছেন। জীবনের আশ্রয় খুঁজতে লীলাবতীর কাছে যখন নিজের জন্মগত ধর্ম ও যবনদের ধর্ম একাকার হয়ে গিয়েছিল তখন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছিল শ্যামাঙ্গ। লীলাবতী জানিয়েছিল, তার গৃহ চাই, সন্তান চাই। আর সেই হবে তার জীবনের ধর্ম। শ্যামাঙ্গ বিল্ক্বগ্রাম থেকে পুনর্ভবার মুক্ত প্রান্তরে এসেও বারবার স্মৃতিকাতর হয়েছেন। কেননা, শিল্পসত্তার স্বাধীনতা হরণ হয়েছিল তার। যে শিল্পের পরাধীনতা নিয়ে আত্রেয়ীর মাটি ছেড়েছিল সেই ব্রাত্যজনের মুখ তৈরির বাসনাই বারবার স্থান পেয়েছিল লীলাবতীর অবয়ব তৈরিতে। যত মৃৎ পুত্তলিকা তৈরি করেছিল, সবটাতে স্পষ্ট হয়েছিল প্রিয়তমা নারীর মুখ।

শওকত আলীর জীবনে তার মৃত স্ত্রী শওকত আরা ছিলেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিছুটা সুস্থ থাকতে স্ত্রীর কবরের পাশে প্রতিদিন কিছুক্ষণ দাঁড়াতেন। শুনেছি, জ্যেষ্ঠ সন্তান বাবাকে কয়েকবার নিজের কাছে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। শওকত আলী নাকি জানিয়েছিলেন, বিরতি ভিলার এ ঘরে না থাকলে, স্ত্রীর কবরের পাশে না দাঁড়ালে তার কষ্ট হয়। জোর করে চলে এসেছেন বারবার। এই গৃহী মানুষ যে নিজের তৈরি চরিত্রের সাথে বিশ্বরূপের সংযোগ তৈরি করতে চেয়েছেন সে প্রমাণ একই আদর্শ ধারণ করে ভিন্নমুখী চরিত্র শ্যামাঙ্গ ও বসন্তদাসে স্পষ্ট। এই দুই চরিত্রে জীবন ও বিশ্বরূপ প্রত্যক্ষ করার ধর্ম যে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, তা-ই দেখিয়েছেন লেখক। একজন বিশ্বের সাথে মিলতে চেয়েছেন শিল্পসত্তার ভেতর দিয়ে; অন্যজন পূর্ণতা খুঁজেছেন বর্তমান ক্রিয়ায় নিজের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্ম অর্থে পাঠকের চেতনায় বিশ্বরূপ দর্শনের সেই বক্তব্যই তো পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন ‘এই বড়ো শরীরটির সঙ্গে পূর্ণভাবে মিলিবে ইহাই ছোটো শরীরের একান্ত সাধন-অথচ আপনার ভেদটুকু যদি না রাখে তাহা হইলে সে মিলনের কোনো অর্থই থাকে না। আমার চোখ আলো হইবে না, চোখরূপে থাকিয়া আলো পাইবে, দেহ পৃথিবী হইবে না দেহরূপে থাকিয়া পৃথিবীকে উপলব্ধি করিবে, ইহাই তাহার সাধনা। বিরাট বিশ্বদেহের সঙ্গে আমাদের ছোটো শরীরটি সকল দিক দিয়া এই যে আপনার যোগ অনুভব করিবার চেষ্টা করিতেছে এ কি তাহার প্রয়োজনের চেষ্টা?… প্রয়োজনের চেয়ে বেশি একটা জিনিস আছে- প্রয়োজন তাহার অন্তর্ভুক্ত, সেটা আর কিছু নহে, পূর্ণতার আনন্দ। চোখ আলোর মধ্যেই পূর্ণ হয়, কান অনুভূতিতেই সার্থক হয়।’ ধর্মের অর্থ ( ১৩১৮ :৩৫৬-৫৭)।

সোমপুর মহাবিহারের গায়ে উৎকীর্ণ যোগী ভিক্ষু, মৃগয়া প্রত্যাগতা ব্যাধ রমণী, শৃঙ্গার মগ্ন মানব-মানবী, ঢাল-তরবারি হাতে বীর ধটিকা পরিহিতা বীরাঙ্গনার গল্প শুনে শুনে ব্রাত্যজনের মূর্তি তৈরির সাহস দেখানো শ্যামাঙ্গ শওকত আলী-রই সত্তা। আবার সূর্য মন্দিরের সেবাদাসী কৃষ্ণার শয্যাসঙ্গী অথবা উজবুট গ্রামে রেখে আসা মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাস যে সামন্ত শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা যোগী ভিক্ষু মিত্রানন্দের সঙ্গী হয়ে পদব্রজে গিয়েছিল, সেও শওকত আলীরই অংশজাত। এসব চরিত্রের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সাথে সংযোগ তৈরি করে লেখক পাঠকের চেতনায় আঘাত দেওয়ার পাশাপাশি পূর্ণতা খোঁজেন নিজের। সব সাহিত্যিকই কোনো না কোনো অপূর্ণতা থেকে চরিত্র নির্মাণ করেন, তবে যাপন তো সবাই করেন না। ঔপন্যাসিক শওকত আলী একটা সময়ের পর যা সংশয় তৈরি করে, যা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত তাকে বর্জন করে নিজের ঘোরে যাপনের মানসিক দৃঢ়তা রেখেছিলেন।

প্রথম দিন চলে আসার সময় বলেছিলেন পরেরবার খাবার নিয়ে যেতে। দ্বিতীয়বার পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল বলে প্রথমে গৃহপ্রবেশের অনুমতিই পাচ্ছিলাম না। তবুও তা সম্ভব হয়েছিল বলে শওকত আলীর কাছ থেকে কিছু কথা শোনার অভিজ্ঞতা হলো। শুধু দেখা হওয়ার স্মৃতি নয়, তার সৃষ্টি চরিত্রদের মতো নানা অভিব্যক্তিতে তিনিও ভাস্বর হয়ে রইলেন আমার কাছে। ইতিহাসের দুস্কালের গল্প দিয়ে মহত্তম মানবপ্রীতির অভিমুখে যে যাত্রা শওকত আলী করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়েছে বহুদূর। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের শুরুতে কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো লেখককে। হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ঘরে প্রতিবারই অচেতন শওকত আলী-কে দেখে মনে হয়েছে, জগতের নিয়মের কাছে সমর্পিত হয়ে যাওয়া জীবনও কত সমৃদ্ধ হয়! সেই বিপুল সম্পদ ও সমৃদ্ধি তারা তুলে দিয়ে যান পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। তবে বাংলা সাহিত্য পাঠকের পাঠ তালিকায় অগুনতি কাল উপস্থিত থাকবে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত