| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

বিশেষ রচনা: শহীদুল জহিরকে মনে পড়ল । টোকন ঠাকুর

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
শহীদুল জহিরের সঙ্গে যখন আমার মুখোমুখি দেখা হয়েছিল, হয়তো কথা হবার কথা ছিল প্রধানত তার লেখা্দের নিয়েই। যদিও, লেখা ছাড়িয়ে সহসা কথার ঝাঁপি খুলে গেল, কথা আস্তে আস্তে বেরিয়ে পড়ল কত কী প্রসঙ্গে। এবং সে ছিল এক রাতের আড্ডা। সেই রাত ছিল উৎসবের রাত, ঈদের রাত। শহীদুল জহিরের প্রতি আমারও যে এক আকর্ষণ, সে তো তার গল্প-উপন্যাস ঘিরেই। কিন্তু ব্যক্তি মানুষটার দিকেও আমার যে কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল এতদিন বাইরে থেকে, সেটা মিলিয়ে-ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। নক করার পর যে মানুষটা দরজায় খুলে সামনে দাঁড়ালেন, দেখি তার গোঁফ নেই। কারণ, এর আগে আমি তার বইয়ের ফ্ল্যাপে যে ফটোগ্রাফ দেখেছি, তাতে গোঁফ ছিল। এই গোঁফ থাকা আর না থাকার ব্যত্যয় সাপেক্ষেই আমি তাকে সামনে পেলাম, তখন রাত হয়তো ন’টা। লোকেশন বেইলি রোডের সরকারি আবাসন। আগের থেকে কোনো ফোন করে যাইনি, কাজেই তিনি ঈদের রাতে বাসায় আছেন কিনা, তাও জানা ছিল না। পুরোটাই আন্দাজে যাওয়া, ভেবেছি, ‘যাই, যদি তাকে পাই তো অনেক গল্প করব, কিছুটা জানব শহীদুল জহিরকে।’ 
প্রিয় লেখক শহীদুল জহিরকে তার বাসায়, সেই ছয়তলা কোয়ার্টারে পেয়ে গেলাম, সেই ঈদের রাতে, বাসায় তিনি একা, যেমন, ‘আবদুল করিম সবসময় একা। আবদুল করিম অন্ধকারে কাঁসি দেয়, আবদুল করিম অন্ধকারে কাঁসি দেয় একবার, দুইবার তিনবার। দেওয়াল ঘড়িতে কাঁটা দোল খায়, সময় যায় কিন্তু আবদুল করিমের সময় আর কাটে না।  গলি দিয়ে ফেরিওয়ালা হাঁক দিয়ে যায়, কটকটিওয়ালা যায়, পরিপার্শ্বের মানুষেরা চলাফেরা করে  আর  আবদুল করিম সারাদিন ঘরে তার নিঃসঙ্গতার মধ্যে ডুব মেরে বসে থাকে বছর বছর। নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর কিছু কায়দা করতে দেখা আবদুল করিমকে। সে তার ঘরের সামনে ভাঙা কাচ ফেলে রাখে, মহল্লার খেলাধুলা করা বাচ্চারা সেই কাচ নিয়ে যায়, কটকটিওয়ালার কাছে ভাঙা কাচের বিনিময়ে হয়তো কিছুটা কটকটি পায় বাচ্চারা, তারপর সেই কটকটির ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যে মারামারি হয়, তাদের কেউ রক্তাক্তও হয়। তখন বাচ্চাদের অভিভাবকেরা এই নিয়ে বিচার করতে আসে, তারা আবদুল করিমের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে, বাচ্চারা যে অল্প একটু ভাঙা কাচ দিয়ে অল্প একটু কটকটি পেয়ে মারামারি করে, সে কথা তারা সমস্বরে জানায় আবদুল করিমকে; তারা বলে ‘অল্প ইট্টু ভাঙা কাচে এতটুকু কটকটি হয় আর তাতে করে পোলাপাইন মারামারি কইরা মরে, পারলে ভাঙা কাচ আরেকটু বেশি কইরা রাইখেন।’ আবদুল করিম ভাঙা কাচ আরেকটু বেশি করে রাখে। সেই কাচ নিয়ে যায় উড়ন্ত চিলের মতো মহল্লার বালকেরা। কটকটি কেনে, তারপর সেই একই কায়দায় কটকটি ভাগাভাগি, ভাগাভাগি নিয়ে মারমারি, রক্তপাত, অভিভাবকদের বিচার  চাইতে আগমন এবং আব্দুল করিমকে শাসিয়ে যাওয়া এবং এরপর আবারও ভাঙা কাচ রেখে এক নিঃসঙ্গ মানুষ আবদুল করিম এক ধরনের অপেক্ষায় থাকে এবং যথারীতি গলি দিয়ে ফেরিওয়ালা যায়, কাগজ বিক্রেতা যায়,  বালকেরা আসে বা যায় এবং মহল্লার লোকেরা আসে। নিঃসঙ্গতাকে আবদুল করি হয়তো উদযাপনও করতে থাকে। বাস্তবিক অর্থেই আবদুল করিমের বাসায় শুধু এক ছুটা বুয়া আসে, এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে যায় এবং পরে একদিন জেনেছি, শহীদুল জহিরের বাসাতেও এক বুয়া আসে, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন করে দিয়ে যায়। শহীদুল জহিরকেও এক আবদুল করিম মনে হয় কিম্বা শহীদুল জহির হয়তো সুহাসিনী গ্রামের আবদুল ওয়াহিদ, যে কিনা গাছের সঙ্গে কথা বলে, ময়না পাখিকে বিশেষ এক ট্র্যাজিক বুলি শেখায়। কি বুলি শেখায়? ‘কান্দেন ক্যা?’
‘সুখ নাই জীবনে।’
আবদুল করিম বা আবদুল ওয়াহিদ কিম্বা আবু ইব্রাহিম কে? পাঠক হিসেবে আমি তাদের পেয়েছি শহীদুল জহিরের লেখা চরিত্র হিসেবে। বাস্তবে আমার হয়তো কখনো আবদুল করিম, আবদুল ওয়াহিদ বা আবু ইব্রাহিমের সঙ্গে দেখা হয়নি, দেখা হলো তাদের লেখক শহীদুল জহিরের সঙ্গে, তার বাসায়, বেইলি রোডের সরকারি আবাসনে, সেই ঈদের রাতে। আমি দখলাম, তার নাকের নিচে গোঁফ নেই। বললাম, ‘আপনিই তো শহীদুল জহির?’
তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যা’ জানালেন।’ বললাম, ‘আপনার গোঁফ ছিল না?’

‘ছিল, এখন নেই। আপনি তো টোকন ঠাকুর?’


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,শহীদুল জহির
কাঁটা সিনেমার দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন পরিচালক টোকন ঠাকুর।

আমরা সে রাতে প্রায় ঘণ্টা তিনেক আড্ডায় ছিলাম, সেটা সম্ভবত ২০০১ বা দুই সাল। আমার সঙ্গে ছিল আমার ছোটবেলার বন্ধু, হুমায়ুন, হুমায়ুন এখন মিন্টো রোডে, ডিবি জীবন যাপন করছে। তো শহীদুল জহিরের সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। তার লেখা চরিত্রদের নিয়ে কথা হচ্ছিল, তার লেখা ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ নিয়ে কথা হচ্ছিল, পাবনার সিরাজগঞ্জে যে তার পৈতৃক এলাকা, তা নিয়ে কথা হচ্ছিল। বললাম, ‘সিরাজগঞ্জে থেকেছেন কখনো?’

জনাব শহীদুল জহির বললেন, ‘না, ঠিক সেভাবে থাকা হয়নি। আমার পৈতৃক নিবাস। তবে আমার জন্ম পুরনো ঢাকায়, নারিন্দায়, ভূতের গলিতে। আমার বাবার চাকরি সুত্রেই আমরা ঢাকায় বড় হয়েছি।’
‘সেই জন্যে আপনার চরিত্রদের মুখের ভাষা পুরান ঢাকার?’
‘তা বলতে পারেন, হুম।’
‘কিন্তু ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’তে গ্রাম এসেছে, সেই গ্রামের নাম সুহাসিনী। সুহাসিনীর লোকেরা যমুনা পাড়ের মানুষ, সিরাজগঞ্জের ভাষায় কথা বলে?’
শহীদুল জহিরের বললেন, ‘চা বানাই?’
আমি মাথা ঝাঁকালাম, তিনি চা বানাতে গেলেন। সে রাতে আমি শুধু তার মুগ্ধ পাঠক, তবে আমার কবিতা তার পড়া ছিল পত্র-পত্রিকায়। ‘আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?
 বললেন, ‘পত্রিকায় আপনার ছাপা হওয়া দেখেছি।’ 

তো সেই রাতের কথা যেহেতু আমি আগে একবার খুব সংক্ষিপ্ত করে হলেও লিখেছি, সেটা লিখতে হয়েছিল ২০০৮ এ, জনাব জহির মারা যাওয়ার পর, এখানে লিখব ‘কাঁটা’ প্রসঙ্গে। আমি সেই রাতে জানতামও না যে, একদিন আমি শহীদুল জহিরের ‘মনোজগতের কাঁটা’ বা ‘কাঁটা’ নিয়ে সিনেমা করব! তাই, কত কথাই না হলো প্রিয় লেখকের সঙ্গে, সেই ২০০১ বা ২ সালে, আর এই ২০২২ সালে মুক্তি পেতে যাচ্ছে ‘কাটা’।’  এও এক জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, আমার, আমাদের। ‘কাঁটা’ কয়েকজোড়া সুবোধ ও স্বপ্নার গল্প। সুবোধের বউয়ের নাম স্বপ্না, তারা গ্রাম থেকে এসে ভাড়াটিয়া হিসেবে বাস করে ভূতের গলির আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে এবং শেষ পর্যন্ত ব্যাপারির বাড়ির উঠানের পাতকুয়াটির মধ্যে তারা মরে যায় বা তাদের লাশ পাওয়া যায়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,শহীদুল জহির
শহীদুল জহিরের গল্প ও টোকন ঠাকুরের পরিচালনায় কাঁটা সিনেমার একটি দৃশ্য।

‘কাঁটা’ নির্মাণ যজ্ঞের সার্বক্ষণিক ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও আমি বারবার শহীদুল জহিরকে মনে করতে চেষ্টা করি। আমি নিয়ত অনুধাবন করতে থাকি, শহীদুল জহির ‘কাঁটা’র বাস্তবতাকে কিভাবে বলতে চেয়েছেন কিম্বা আমি সিনেমার ক্যানভাসে ‘কাঁটা’কে কিভাবে চিত্রিত করতে চাইছি। এই গল্পের পটভূমি পুরান ঢাকার নারিন্দার ভূতের গলি, সময়কাল ১৯৮৯-৯০, ১৯৭১ ও ১৯৬৪ সাল। ইতিহাসের তিনটি সময় উপস্থিতি দিয়ে যাবে ‘কাঁটা’। ‘কাটা’র চরিত্র সুবোধ-স্বপ্না আর মহল্লাবাসি। গল্পের লেখক শহীদুল জহিরের জন্মও এই ভূতের গলিতেই।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,শহীদুল জহির
কাঁটা সিনেমার একটি দৃশ্য।

‘কাঁটা’ সেই গল্প, যার মধ্যে উঁকি দিয়ে যায় ছেচল্লিশের ভয়ানক রক্তপাত, উপমহাদেশীয় ধর্মভিত্তিক দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ হত্যা, নিপীড়ণ-উতপীড়ণ-উচ্ছেদের মর্মগাথা। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপট, যেটা তিন জোড়া হিন্দু দম্পতি ও একদল মহল্লাবাসিকে নিয়ে রচিত চিত্রনাট্য। বিস্তারিত গবেষণা সাপেক্ষে ‘কাঁটা’ চিত্রনা্ট্যে খুবই কাটাকুটি হয়েছে। সময় লেগেছে বছর তিনেক, চিত্রনাট্যে।  ১৯৬৪, ১৯৭১ ও ১৯৮৯-৯০ সাল, এই তিন সময়ের আলোকে রচিত  ‘কাঁটা’ গল্পটি লেখক শহীদুল জহির লিখেছেন ১৯৯৫ সালে। ‘কাঁটা’ গল্পের লিড প্রটাগনিস্ট  শ্রী সুবোধ চন্দ্র দাস। সুবোধ। আমরা দেখলাম, ২০১৬ সালের অন্তিমে এসে বা ২০১৭ সাল জুড়েই ঢাকার রাস্তার দেওয়ালে এক গ্রাফিতিচিত্র, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না।’ গণ মানুষ সুবোধের গ্রাফিতি চিত্রের সাথে পরিচিত হয়ে গেল, আমার শহীদুল জহিরকে মনে পড়ল।
সেই শহীদুল জহির, সেই সুবোধকে মানুষ দেখবে সিনেমায়। আপাতত এইটুকুই…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত