| 29 মার্চ 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: হেমন্তের অবিরল পাতার মতন । শাহ্‌নাজ মুন্নী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

‘ভাবতে ইচ্ছা করে যে এখনও পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও ”ট্রু লাভ বা প্রকৃত ভালবাসা” বলে কিছু একটা আছে যা চিরন্তন, একগামী, একনিষ্ঠ। ভাবতে ভাল লাগে যে মনের মধ্যে কোনো একটা অবিরত অবচেতন চর্চা চলতে থাকার কথা যে, ‘আমি তোমার, শুধুই তোমার।” -ফেসবুকে জনৈক ব্যক্তির মন্তব্য

‘রবিন ফোন করেছিল।’
অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলা, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খুবই ক্যাজুয়াল ভঙ্গীতে, যেন খুব সাধারণ একটি তথ্য দিচ্ছে এমন ভাবে কথাটা বলল তারেক। বুকটা হঠাৎ ছ্যাত করে উঠলো দীপার। গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে সে জানতে চাইল,
‘ফোন করেছিল কেন?’
‘জানি না। বললো অনেক দিন দেখা হয় না। …তাই দেখা করতে চায়। সামনা সামনি কী যেন বলবে…’
তারেক চা শেষ করে উঠে পড়ে। এখন সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে, হয়তো কোন একটা হালকা মিউজিক শুনতে শুনতে মেডিটেশন করবে। তারপর উঠে টিভির খবর দেখবে। সবশেষে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমুতে যাবে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে এই তার বাঁধা-ধরা রুটিন, দীপা জানে। তারেকের ফেলে যাওয়া চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে দীপার বুক ধরফর করতে থাকে। রবিন কেন হঠাৎ ফোন করলো ওকে? এতদিন পর? সামনা-সামনি কি বলতে চায় সে? অস্বস্তির একটা সুক্ষ্ন কাঁটা খচ্ খচ্ করে বিঁধতে থাকলো মনের কোণায়। দাঁতের ফাঁকে অদেখা কাঁটা বিধে থাকলে যেমন অস্বস্তি হয়, তেমন।

রবিন যদি এখন তারেক’কে সব বলে দেয়, তবে সে কিভাবে নেবে বিষয়টা, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে দীপার। জীবন-যাপনে তারেক সবসময়ই খানিকটা পিউরিটান ধরনের, মূল্যবোধ, বিশুদ্ধতা, সততা, কমিটমেন্ট, কর্তব্যনিষ্ঠা এসবের খুব দাম দেয় সে। নিজে সেসব পালন করে আর অন্যদের কাছেও একই রকম দায়িত্বশীলতা আশা করে। সেই তারেক কি সব জানতে পারলে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত করবে না দীপাকে?

বিক্ষিপ্ত মনটা শান্ত করতে, নিজের সঙ্গে একা কথা বলতে রান্নাঘরই একান্ত আশ্রয় দীপার। পত্রিকার রেসেপি দেখে কিছু একটা বানাতে ফ্রিজ থেকে মাংশের কিমা নামায় সে। মশলার কৌটা খোঁজে। চুলার পাশের কাঁচের জানালার কার্ণিশে তখন সাদা কালো রঙের বিড়ালটাকে দেখা যায়। জানালা খোলা পেলেই এক লাফে ঢুকে যাবে, চোখে রাজ্যের প্রত্যাশা আর আকুতি নিয়ে স্বচ্ছ পাল্লার ওপাশ থেকে তাকিয়ে আছে। শৈলী এসে উঁকি দেয় রান্না ঘরের দরজায়।
‘কি করো? কেউ আসবে নাকি?’
‘নাহ্ … এমনি… তুই ?’
‘কফি খাব, মা।’
এই এক নতুন অভ্যাস হয়েছে মেয়েটার। যখন তখন কফির তেষ্টা। দীপা একটু সরে গিয়ে চুলার পাশে জায়গা করে দিলে মগ ভর্তি করে নিজেই কফি বানায় শৈলী, তারপর, মগে একটু পর পর লম্বা চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে বলে,
‘বাজিরাও মাস্তানি ফিল্মটা দেখলাম মা … ভাল্ লাগলো না… আচ্ছা… এটা কি সত্যি গল্প?’
দীপা কিমা থেকে পানি ঝরিয়ে, কড়াইয়ে তেল গরম করে।
‘ফালতু একটা গল্প, জানো, বাজিরাও প্রেমে পড়ে মাস্তানীর, মাস্তানীও একেবারে পাগল ওর জন্য। ওর কিন্তু বউ আছে কাশি বাঈ, প্রিয়াংকা চোপড়া রোলটা করেছে …’
দীপা গরম তেলে পিয়াজ ছেড়ে দেয়।
‘মা, বিল্লিটা দেখো, কি কিউট ! কেমন গোল গোল চোখ করে তোমাকে দেখছে।’
‘খবরদার জানালা খুলিস না, ঢুকে পড়বে!’
শৈলী জানালার দিকে এগিয়ে গেলে সাবধান করে দীপা। কাঁচের এপাশ থেকে বিড়ালটার মুখের উপর হাত বুলায় শৈলী। মুখে চুক চুক করে আদরের শব্দ করে।
‘জানো মা , কাশির অনেক কষ্ট। ও বাজিরাওকে কৃষ্ণের কাহিনী শোনায়, কৃষ্ণের বউ নাকি বলেছিল, আমি তোমার স্ত্রী না হয়ে সখী হলে ভাল হতো। কৃষ্ণ বলে, কেন? বউ বলে, সারা জগৎ তোমার নামের সাথে তোমার সখীর নাম বলবে, আমি তো জগতের কাছে কেউ না। তখন কৃষ্ণ বলে, কেন? আমি তো তোমাদের দুজনকেই সমান ভালবাসি। জানো মা বাজিরাও’ ও কিন্তু কাশিকে বলে, আমি তোমাকে আর মাস্তানীকে সমান ভালোবাসি। আচ্ছা দুজনকে কখনো একসাথে একই রকম ভালোবাসা যায়?’
গরম তেলে দীপার পেয়াজগুলো বাদামি হয়ে উঠেছিল। সে তেল থেকে ভাজা পেয়াজ তুলে রেখে মাংশের কিমার সাথে কর্ণফ্লাওয়ার, পেয়াজ কুচি, ডিম, লবণ আরো কিসব মশলা মিশিয়ে মাখতে থাকে।
‘কেউ যদি একসঙ্গে দুজনকে ভালবাসতে পারে, তাহলে তোর অসুবিধা কি?’
দীপা মিশ্রণটা মাখতে মাখতে বলে। শৈলীর কফি খাওয়া শেষ। কিন্তু তার কথা শেষ হয় নি। হয়তো তার ষোল বছরের বোধ বুদ্ধি থেকে প্রেমকে বিবেচনা করছে সে।
‘নাহ, আমি ভাবছি সেটা সম্ভব কি-না?’
দীপার তখন মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে তারেকের সেইসব কথা। যখন সে বলতো,
‘হয় ভালোবাসবো, নয়তো না, হয় পুরোটাই নয়তো একটুও না, হয় একজন আর নয়তো কেউই নয়, মাঝামাঝি কিচ্ছু নেই।’
দীপাও তখন সেরকমই ভাবতো, আসলে ভাবতে ভালোবাসতো। তখন সব ঋতুই ছিল বসন্ত ঋতু। সব বাতাসই ছিল সুশীতল, সব নদীর জল ছিল গাঢ় নীল।
‘আহা সেই দিনগুলি আর নেই’- দীপা মাংসের গোল বল তৈরি করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। শৈলী চলে গেছে। কাঁচের জানালার ওপাশ থেকে কাতর চোখে তাকিয়ে থাকা সাদা কালো বিড়ালটাও নেই।

পরদিন অফিস থেকে ফেরার পর তারেকের মুখভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে দীপা। তারেক আজ বেশ দেরী করে ফিরেছে। চোখ মুখ গম্ভীর। অন্ধকার। কপালটা কেমন কুঁচকে আছে, যেন সব কিছুর উপর বিরক্ত। দীপার বুকের ধুকপুকানি হঠাৎ বেড়ে যায়। তাহলে কি আজ রবীন এসেছিল? বলে গেছে সব? দীপা চোখের কোণা দিয়ে নীরবে তারেকের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে।
‘মাথাটা খুব ধরেছে।’ তারেক কাপড় চেঞ্জ করে বলে, ‘একটা প্যারাসিটামল খেতে হবে।’
যাক্ মাথা ব্যাথা! রবীন তাহলে আসেনি। দীপার বুক থেকে যেন একটা বিশাল ভার নেমে যায়। সে কোমল কন্ঠে বলে, ‘তুমি একটুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি মাথাটা টিপে দিচ্ছি।’

পরদিন অফিস ফেরত তারেকের মুখ আরো অন্ধকার। চেহারা শোকাচ্ছন্ন, বিধ্বস্ত। আজ তাহলে ঠিকই রবিন এসেছিল। তারেকের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার ধাক্কা সইবার জন্য অপেক্ষা করে দীপা। সহজে আবেগ সামলাতে পারে না তারেক। হয়তো মেয়ের সামনেই চিল্লাপাল্লা করে একটা সিন-ক্রিয়েট করে বসবে। হয়তো তাদের সংসারটাই ভেঙে যাবে। যেমন দুম্ করে সিগারেট ছেড়েছিল, তেমনি দুম্ করেই হয়তো সংসার ছেড়ে চলে যাবে তারেক। কি করবে দীপা? কি করা উচিত তার? দীপার কেমন দমবন্ধ লাগে ! রান্নাঘরে এসে আনমনে জানালাটা খুলে দেয় সে। ‘মিঁয়াও’ শব্দে সম্ভবত আনন্দ প্রকাশ করেই লাফ দিয়ে ঘরে ঢোকে সাদা কালো।
‘আরে বিড়ালটা…’ রান্নাঘরের দরজায় তখন তারেকের ছায়া। মুখ দিয়ে ‘হুশ’ ‘হুশ’ শব্দ করে সে। আর সাদা-কালো এক লাফে জানালা দিয়ে পালায়। তারেক ক্লান্ত কন্ঠে বলে,‘আমাকে এক কাপ চা দিতে পারো? খুব ক্লান্ত লাগছে…’

চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় আসে দীপা। তারেকের সামনে নিজেকে দাগি আসামীর মত লাগে তার। মনে হয়, এক্ষুণী হয়তো তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে তারেক। কঠিন কন্ঠে রবিন প্রসঙ্গে জেরা করতে শুরু করবে। ‘বলো দীপা, বলো, কি সম্পর্ক রবিনের সঙ্গে তোমার?’
‘বন্ধুত্ব? হুহ্ ! হাসায়ো না আমারে!’
… তোমাকে বহুবার বলছি না, নারী পুরুষের সম্পর্ক কখনোই নিছক বন্ধুত্বের হয় না। নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের নামে যে ফ্যান্টাসী শুরু হয় তা শেষ পর্যন্ত এক ইমোশনাল অত্যাচার তৈরি করে, ঈর্ষা আর অধিকারবোধ এসে বন্ধুত্বকে হটিয়ে অন্য কোন সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। অস্বীকার করতে পারো সেসব? তুমি তাহলে আমাকে ভালবাসো নাই, রবিনকে ভালবেসেছ। তাহলে কেন অভিনয় করলে আমার সঙ্গে?
তারেক চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, ‘মনটা খুব খারাপ দীপা।’
আহ্! তাহলে এভাবেই ঘটনার শুরু করছে তারেক। ইমোশনাল সংলাপ দিয়ে দীপাকে বিধ্বস্ত করে? তাকে অপরাধবোধের অনিঃশেষ চোরাবালিতে ডুবিয়ে দিয়ে?
‘কেনো?’ অস্ফুটে প্রশ্ন করে দীপা। ‘কিছু হয়েছে?’
(মনে মনে বলে, রবিন কি তাহলে সত্যিই এসেছিল? বলে গেছে সব কিছু? বলে গেছে, তারেকের অগোচরে দীপার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা? কিন্তু সেসব তো কবেই চুকেবুকে গেছে … কবেই নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে দীপা। এতদিন পরে রবিন কেন এসব পুরনো প্রসঙ্গ বলতে এলো? )
‘হুহ্! আমার পাশের রুমের আশরাফ সাহেব… অফিসেই হঠাৎ হার্ট এট্যাক… একদম আমার চোখের সামনে জানো … ইশ্ মানুষের জীবন…’
অনেকক্ষণ ধরে চেপে থাকা শ্বাসটা আস্তে করে ছাড়ে দীপা।
‘আহা, তাই? খুব ভাল লোক ছিল নাগো ! …এই জন্যই তোমার চোখ মুখটা কেমন …’
‘মানতে পারছি না দীপা, কষ্ট লাগছে !’
তারেকের কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। অন্ধকার বারান্দায় নিজের চেয়ার ছেড়ে স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় দীপা। তারেক হাত বাড়িয়ে দীপার কোমর জড়িয়ে ধরে মাথাটা ওর বুকের মধ্যে গুজে দেয়। যে কোন সময় শৈলী এখানে চলে আসতে পারে। আসুক, বাবা-মায়ের ভালবাসা ছেলে-মেয়ের চোখে পড়লে দোষের কিছু নেই।
প্রতিদিন তারেক-কে পর্যবেক্ষণ করার এক নতুন চাকরি যেন পেয়েছে দীপা। তারেকের মুখ দেখে বুঝতে চায় রবিনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কী-না। যে কোন দিন আসতে পারে রবিন। যে কোন দিন তছনচ করে দিতে পারে তাদের সাজানো বাগান। যেন অজান্তেই নিজের জীবনে একটা টাইম বোমা বসিয়ে রেখেছে দীপা। প্রতিদিনই যেন নতুন আশংকার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে তার মনে। যেন এক খেলা, অফিসফেরতা তারেকের মুখচ্ছবিতে প্রতি সন্ধ্যায় মেঘ-বৃষ্টি-বিদ্যুৎ-বজ্র-রাগ-ক্ষোভ বা অন্য কোন অচেনা অভিব্যক্তি খুঁজে ফেরা।


আরো পড়ুন: সুর || শাহ্‌নাজ মুন্নী


রবিন কি এসেছিল? ওই সাদা কালোটার মত অসতর্ক মুহর্তে খোলা জানালার ফাঁক গলে যেমন সে ঢুকে পড়েছিল একদিন। দীপা ভয় পাওয়া গলায় বলেছিল, ‘আমরা না হয় বন্ধুই থাকি রবিন।’
‘বন্ধু? কি বলছো? আমি তো বন্ধুত্ব বুঝি না, প্রেম বুঝি প্রেম…’
দীপার চোখে চোখে তাকিয়ে বলেছিল রবিন। সাথে সাথে এর কোন জবাব দিতে পারেনি দীপা। চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে ভেবেছে কিছুক্ষণ। তারপর মাথা তুলে বলেছে, ‘পাপিয়া… তোমার বউ… যদি জানতে পারে…আর তারেক…এথিক্যালী এটা কি ঠিক হচ্ছে?’
‘ওসব রাখো তো, জাষ্ট এনজয় দ্যা মোমেন্ট…’ রবিন এক কথায় উড়িয়ে দিয়েছিল সব।
রেস্তোরার আলো-আঁধারি কোণায় বসে টেবিলের তলে পায়ে পায়ে ছোঁয়া লাগার খেলা করার ফাঁকে রবিন বলেছিল, ‘এগুলি হচ্ছে মনের ভ্রমণ, বুঝলে, এক জায়গায় থাকতে থাকতে বড্ড একঘেয়ে লেগে যায় না? তখন মনকে ছেড়ে দিতে হয়? যতই বলো, মন হচ্ছে বহুগামী, তুমি রশি দিয়েও এরে বেঁধে রাখতে পারবা না…’
রবিন কি তাকে ভালোবাসতো? কোনওদিন? ভালোবাসতো কি দীপা, রবিনকে? কখনো? নাকি এটা তাদের সময় কাটানোর খেলা ছিল? ছিল অস্থির মনের সাময়িক পর্যটন পিপাসা? শৈলীর প্রশ্নটা মনে পড়ে, এক সাথে কি দুইজনকে ভালোবাসা যায়? মন কি কুমড়ার ফালির মতো কেটে কেটে ভাগ করে বিলানো সম্ভব?
শৈলী বলে,‘মা, ফিল্মটা দেখবা?… বাবাকে নিয়া দেখো …’
‘নাহ্ তোর বাবা হিন্দি বোঝে না, আমিও বুঝিনা, খামোকা …’
‘মা, প্রেমে পড়লে মানুষের নাকি জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায়… ঠিক? বাজিরাও মরে গেল শুনে মাস্তানীও বিষ খেয়ে মরলো .. এটা হইল?’
‘তোর মাথা থেকে এসব বের করতো … কি এক ফিল্ম দেখছে.. সারাক্ষণ ওর মধ্যেই আছে..’
দীপা মেয়েকে মৃদু শাসনের সুরে বলে। শৈলী তবু থামে না, সে মার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আচ্ছা মা তোমাদের জেনারেশনে ছেলে-মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হতো না, তাই না? তোমার কি কোন ছেলে বন্ধু আছে মা?’
‘কি যে সব প্রশ্ন করিস না, বন্ধুত্ব মানে জানিস? তোদের তো সব বিএফ আর জিএফ …’
দীপা ঠোট উল্টে বলে। শৈলীর মুড তখন একদম বদলে যায়, সে খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে বলে,
‘আমার কি মনে হয়, জানো মা, বন্ধু হবে এরকম, যে আসলে পাশে দাঁড়াবে, যাকে বিশ্বাস করা যাবে, ভরসা করা যাবে, যে বন্ধুর অন্য সম্পর্কে জেলাস হবে না, খবরদারি করবে না, শেকল পরাতে চাইবে না, ধরো, আমি দড়ির উপর হাঁটছি, যদি কখনো পা ফসকে পরে যাই তখন সে হবে নিচের নেট, টুপ করে ধরে ফেলবে …’
‘সেরকম বন্ধু পেয়েছিস?’ দীপা জানতে চায়।
শৈলী মুচকি হাসে, বলে, ‘খুঁজছি। তোমার সেরকম কেউ আছে, মা?’
‘কেন তোর বাবাই তো আছে … সেরকম… বন্ধু…’
‘দূর ! বাবা তো তোমার হাজব্যান্ড …’
‘হু.. হাজব্যান্ড প্লাস বন্ধু ..’
শৈলী বলে, ‘উহু সেরকম না, হাজব্যান্ড, প্রেমিক, ভাই … এসবের বাইরে… শুধু বন্ধু …যে এমনকি কিছুই চাইবে না, শুধু চাইবে বন্ধুর মন ভাল থাকুক…’
‘প্রথম কথা, তুমি যা বলছো, তা হলো সোনার পাথরবাটি, মানে যার কোন অস্তিত্ব নেই। চ্যালেঞ্জ! দ্বিতীয়ত, সেরকম যদি মেয়ে বন্ধু হয়, ঠিক আছে, ছেলে বন্ধু হলে, তোমার হাজব্যান্ড, প্রেমিক, ভাই কেউই তা মানবে না…’
শৈলী মাটিতে পা ঠোকে, ‘সেটাই তো সমস্যা ! তবে তোমাদের যুগের … আমাদের না ..’
দীপা অবাক হয়ে শৈলীকে দেখে। মনে হয়, এই কিছুদিন আগেও মেয়েটা ছিলো একটা ছোট্ট তুলতুলে গোলাপী পুতুল, আধো আধো কথা বলতো, অভিমানে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো, আর এখন কি পাকা পাকা কথা বলছে, কী কনফিডেন্ট ! কী গোছানো কথা-বার্তা !
‘…এন্ড মা সিনেমাগুলিতে যে সব শেষে বলে দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার। সেটা কি ঠিক? ’
‘তুই তো দেখি ফিল্মের পোকা হয়েছিস একটা…’ দীপা হাসে আর ভাবে সত্যিই যদি সিনেমার মতো ‘এবং তারা পরম সুখে, পরম ভালবাসায় বাকি জীবন কাটালো’ হতো ! তার মনে করতে ইচ্ছা হয় এই কথা সত্য হোক। পরম সুখে পরম ভালবাসায় সবার জীবন কাটুক। অন্তত শৈলীর জীবনটা, তার নরম মনটা যেন বন্ধু, স্বামী আর প্রেমিকের দ্বন্ধে রক্তাক্ত না হয়। যেন ঘর ফেরতা স্বামীর মন-মেজাজের উঠা-নামা তাকে পর্যবেক্ষণ করতে না হয়, যেমন দীপার এখন করতে হচ্ছে। তবে এর দায় তো তারেকের না, এই দায় হয়তো দীপা নিজেই সৃষ্টি করেছে, হয়তো নিজেই নিজেকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে সে আর অপেক্ষা করছে কখন সেটা কার্যকর হবে। কখন আসবে রবিন? কখন তারেক জানবে সব? আর জেনে গেলে কি করবে তারেক? ত্যাগ করবে দীপাকে? ভেঙে দেবে সংসার? আচ্ছা, দিলে দিবে। কিন্তু এই যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষার শেষ হওয়া প্রয়োজন। যাই হোক, কিছু একটা ঘটুক! কী ঘটবে জানে না দীপা কিন্তু সবকিছুর শেষ দেখতে চায় সে। বুঝতে চায়, রবীন তারেককে ঠিক কতটুকু বলেছে তাদের সম্পর্কের কথা। যে সম্পর্ক অনেক দিন ধরে মৃত, অথচ যা একসময় জীবন্ত ছিল স্পর্শে, গন্ধে আর উন্মত্ততায়।
‘রবিন কি এসেছিল?’
তারেকের হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে খুব নিরীহ ভঙ্গিতে, যেন উত্তর না পেলেও ক্ষতি নেই এভাবে প্রশ্ন করে দীপা। তার ভেতরে তখন প্রবল ঝড়ের তান্ডব, যদিও বাইরে প্রাণপণে শান্ত থাকার চেষ্টা। তারেক অন্যমনস্ক ছিল। দীপার প্রশ্ন প্রথমে শুনতে পায়নি সে। আবার জিজ্ঞেস করে, ‘কি?’
‘না .. মানে, রবিন না বলেছিল আসবে….’
‘হ্যাঁ। এসেছিল তো, তোমাকে বলিনি?’ তারেক চায়ের কাপে চুমুক দেয়। ‘আজকাল কী হয়েছে বলো তো সব ভুলে যাই।’
ভেতরের প্রচন্ড আলোড়ন চেপে রেখে দীপা তারেকের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারেক বলে,
‘রবিন এসে হুড়মুড় করে আমার অফিসে ঢুকলো, বললো, ও কানাডার ইমিগ্রেশন পেয়েছে, পাপিয়া আর বাচ্চাদের নিয়ে চলে যাচ্ছে টরেন্টো। আজকে কি বার? বুধবার না? হ্যাঁ, আজকে সকালেই তো চলে যাওয়ার কথা। এত তাড়াহুড়া করলো এসে, বললো, অনেক কিছু গুছাতে হবে, আমাকে খবরটা দিয়েই চলে গেল। কেন যে বিদেশে যাচ্ছে, ঢাকায় তো ভালই ছিল …’
তারেক আরো কি কি বলছিলো তার কিছুই আর দীপা শুনতে পেলো না। তার জীবনানন্দের লাইন মনে পড়লো, “অনেকেরই উর্ধ¦শ্বাসে যেতে হয়…. বাকিসব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন, কোথাও নদীর পানে উড়ে যেতে চায়, অথবা মাটির দিকে- পৃথিবীর কোন পুনঃপ্রবাহের বীজের ভেতর মিশে গিয়ে ….. ”

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত