| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

বিশেষ রচনা: নরমে গরমে । শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

শশাদা তখন খ্যাতির মধ্য গগনে। আমদের জীবন তখন ‘হস্টাইল’, অর্থাৎ হস্টেলনিবাসী! শহরের নানা প্রান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা তখন শশাদার কাছে ফিজিক্স শিখতে আসত। ‘ছেলেমেয়ে’ লিখলাম বটে, তবে সেই দলে মেয়েরাই ছিল সংখ্যাগুরু। আসলে শশাদার কাছে মেয়েরা ছিল জলের মতো। সেই যে ভূগোলে আছে না, পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল! কিংবদন্তী আছে, শশাদার পৃথিবীতে এই ‘জল’ আর জীবনের রসায়নটা শিখিয়েছিলেন এক ভূগোলের দিদিমণি। শশাদা তখন হাইস্কুলে, দশম শ্রেণী। ওই ছাত্র কাঁপানো দিদিমণিই শশাকে পাকিয়ে হলুদ করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে মেয়েরা যেখানে, শশাদা সেখানে ‘বাই ডিফল্ট’ হাজির। শশাদার জীবনে তিন ভাগ মেয়ে আর এক ভাগ ছেলে।

তো সেদিন আমাদের একটা কলেজ ভোটের মিছিল ছিল, জমায়েত চন্দ্রদের ঠাকুরবাড়িতে। বললাম, শশাদাকে এবং জানিয়ে দিলাম যে, প্রচুর মেয়ে থাকবে। বিড়িতে একটা বসন্তবাতাসের মতো হু হু টান দিয়ে, বাঁ চোখটা ছোট করে শশাদা জানতে চাইল,‘গরম হবে তো’? বললাম, গরম মানে! একেবারে হাতে গরম, পুরো লক্ষ্মী নারায়ণ সাউয়ের তেলেভাজা! শশাদা জানিয়ে দিল, যাব বৈকি, একশ’ বার যাব। না গেলে পাপ হবে রে ভাই! কোন কুক্ষণে কেজানে, এই বড়দের কথোপকথন শুনে ফেলেছিল হস্টেলে নবাগত বিজন। তার তখন গোঁফ গজানো তো দূরের কথা, নাকের নীচে চাষবাসেরই কোনও লক্ষণ নেই।

পরদিন প্রত্যুষে, শশাদা তখন স্নানরত।বিজন তার সামনে দাঁড়িয়ে নত মস্তকে জানতে চাইল, ‘স্যর, মেয়েরা গরম হয় কিভাবে’? শশাদা গা মুছতে মুছতে বলল, ‘ওটা থারমোডিনামিক্স ভাই। একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে এসো, বুঝিয়ে দেবো’! এ হেন জবাব শুনে গণ্ডগ্রাম থেকে আসা বিজন মুখ তুলে চেয়ে দেখল, শশাদা হেঁটে চলেছে নিজের ঘরের দিকে। বিজন শধু আলট্রাসোনিক সাউন্ডে এটুকু বলল যে, আমার তো কমার্স স্যর! ঘরে ফিরে শশাদা আমাকে নির্দেশ দিল, বিজনটাকে একটু কোলেপিঠে করে মানুষ করে দে। এই ‘কোলেপিঠে করে মানুষ করা’-টাকেই এখন সবাই ‘গ্রুমিং’ বলে! মডেল মডেলা গায়ক গায়িকা, সবার এখন গ্রুমিং হয়! পরমাত্মার নির্দেশ পেয়ে আমি কাজে লেগে পড়লাম। আমি বিজনকে বিড়ি খাওয়া, সিনেমা দেখা, নাটক দেখা, মেয়ে দেখা, প্রভৃতি যত্ন সহকারে শেখাতে শুরু করে দিলাম। দীক্ষা আমার, দক্ষিণা বিজনের। প্রসঙ্গত, শশাদার তত্ত্বানুসারে, মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘গরম’ মানে এক্কেবারে টাটকা, মানে নতুন বা নবাগতা!

বিজন সেটা বুঝেছিল কিনা জানিনা, তবে আমি তখনই টের পেয়েছিলাম, ওই ‘গরম হবে তো’ ব্যাপারটা বিজনের মনে গভীর দাগ কেটেছে। গল্পটা লিখি। সেবার অকাদেমিতে নিয়ে গেছি বিজনকে। থিয়েটার ওয়ার্কশপের ‘বেলা অবেলার গল্প’ নাটকটা দেখাতে। আমার মতে, ওটা বাংলা রাজনৈতিক নাটকের মধ্যে অন্যতম সেরা। শুধু ওই একটা সংলাপের জন্য এই নাটকটা আমি দেখেছি বহুবার,‘একটা লক্ষ্যের জন্য লড়াই, লড়াইটা আমাদের লক্ষ্য নয়’! বিজনের মাথা মুড়নোর জন্য তাই এই নাটকটা আমি সিলেবাসে রেখেছিলাম। তা নাটকের টিকিট-ফিকিট কেটে বিজন বলল, একঘর খিদে পেয়েছে। ওকে নিয়ে গেলাম অকাদেমির পিছনের সেই আঁতেল ফুড স্টলটায়। বিজন এগরোল খাওয়াল। এগরোলমেন্টের পর আমার প্রাণটা কফি কফি করছে। বললাম, বিজনকে। আমার জন্য কফির অর্ডার দিয়ে বিজন সুধল, ‘আমি কী খাবো’? বিজনকে তখনও আমি কফি-টফি খাওয়া শেখাইনি। তাই আমি ওকে বললাম, তুই কোল্ডড্রিঙ্ক খা। বিজন সমবেত আঁতেলদের হতবাক করে দিয়ে বলল, ‘কোল্ডড্রিঙ্ক! গরম হবে তো’? এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা সামাজিক স্লোগান!

বিজনের থারমোডিনামিক্সে অবশ্য গরম মানে গরমই। সেটা আমি বুঝেছিলাম কয়েকদিন পরে, পঁচিশে বৈশাখের সকালে। বিজনকে সেদিন রবীন্দ্রসদনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতে নিয়ে গেছিলাম। রাজ্যেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ শুনে বিজন মুগ্ধ হয়ে গেল। ফেরার পথে বিজন আমাকে বলল, ‘চল, আমাদের গ্রামে যাবি চল’। এবার আমি জানতে চাইলাম, ‘গরম হবে তো’? উল্লেখ্য, আমার থারমোডিনামিক্সে গরম মানে গরমই! বিজন ততদিনে অনেকটাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। একটু মিচকি হেসে সে বলল, ‘একেবারে হাতে গরম। একটু ঠাণ্ডা হলে পয়সা ফেরত’! তা গেলাম বিজনদের গ্রামে, নাম রামনগর। কাছেই দীঘার সমুদ্দুর। ব্যাস, গরমের ওপর বিষফোঁড়া! বিজনের বাবা নিদান দিলেন, বিকেলের আগে বাড়ি থেকে বেরনো যাবে না। বেরলেই একদম তেলেভাজা।

দুপুরে খাওয়ার পরে বিজনদের মাটির দোতলার বাড়ির দাওয়ায় বসলাম। বাঁ দিকে একটা শান্ত পুকুর। আর একটু দূরে, নিকনো উঠোন পেরিয়ে জংলি বাগান। সেখানে ওই জ্বলন্ত চুল্লির মতো রোদে ঠায় বসে আছে এক যুবক। একটা ছাতা টাঙানো, তার মাথায় নয়, পাশে রাখা। গরমে আমরা বারান্দাবন্দি, অথচ ওই ছেলেটা এমন রোদে পুড়ছে কেন? বিজন বোধ হয় আমার মন পড়তে পারল, বলল, ‘আমার দাদা, সুজন, কলেজে ইংলিশ নিয়ে পড়ত, হঠাৎ পাগল হয়ে গেল। সারাদিন আপন মনে কী সব বকবক করে’! পাগল! আমি আঙিনা পেরিয়ে তার কাছে গেলাম। গলগল করে ঘামছে ছেলেটা, আর আপন মনে বকে চলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কার সাথে কথা বলছ? সে বলল, গাছের সাথে। আমি বললাম, ছাতা মাথায় না দিয়ে পাশে রেখেছ কেন?‘ ওর জন্য’, বলে বিজনের দাদা ছাতাটা সরাল। দেখলাম, একটা দেড় ফুট হাইটের চারাগাছ, যেন সারা শরীর দিয়ে সে একটু ছায়া চাইছে। আমি অপলক চেয়ে রইলাম সেদিকে, মনে পড়ল রবি ঠাকুরের বলাইয়ের কথা! সুজন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই গাছটা আমার সাথে বড় হবে। অনেক বড়। ব্রাউনিং পড়েছ, রবার্ট ব্রাউনিং, ‘গ্রো ওল্ড অ্যালং উইথ মি, দি বেস্ট ইজ ইয়েট টু বি’! এই ছেলেটা পাগল, নাকি অবন ঠাকুরের কুটুম কাটাম!

অনেক অনেকদিন আগে, এরকম উদ্ভিদের ডালপালা মেলা একটা বাড়ি ছিল আমাদের, টালিগঞ্জে। গরমের ছুটিতে আমাদের বাইরে চাকরি করা মা-বাবার সঙ্গে আমরা তিন ভাইবোন ওই বাড়িটায় আসতাম কয়েকদিনের জন্য। কর্মসূত্রে এবং সাংসারিক কারণে নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া আমাদের জেঠু পিসি কাকুরাও আসত, আমাদের তুতো ভাইবোনদের নিয়ে। এই বাড়িটায় একা একা থাকা ঠাকুমার মুখটা তখন দুর্গা প্রতিমার মতো হাসিভরা হয়ে উঠত। দুই গাল ফোকলা হাসি হেসে আমাদের স্বশিক্ষিত ঠাকুমা বলত, ‘এহন আমাগো গ্যাট টুগেদার’! তিন ঘরের একটা বাড়ি! তাতে ওই ক’টা দিন বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে তেত্রিশ জন মানুষ। কী করে থাকতো! এখন তো দুই ঘরের বাড়িতে দুই জন মানুষও একসঙ্গে থাকতে পারে না! ঠাকুমা বলত, ‘মাথার উপর ছাদ হইলেই বাড়ি হয় না, গাদা মানুষ একলগে থাকলেই হেইটা বাড়ি’!

ওই বাড়িটার লাল সিমেন্টের একটা উঁচু বারান্দা ছিল। একটু বেলার দিকে ওই বারান্দায় বসে সোনালি ফ্রেমের চশমা পরে ঠাকুমা ‘দৈনিক বসুমতী’ পড়ত। তারপর এক খিলি ছাচাপান মুখে পুড়ে ঠাকুমা কাঁপা কাঁপা হাঁতে শব্দছক মেলাত, পাশে খোলা থাকতো হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শব্দকোষ। গরমের ছুটির দুপুরে এই বারান্দাটাই হয়ে যেত ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড! সেথায় শীতলপাটি বিছিয়ে হাতপাখার হাওয়া খেতে খেতে ঠাকুমা তার অগুনতি নাতি-নাতনিদের নিয়ে আড্ডায় বসত। চরকা কাটা চাঁদের বুড়ির মতো বকবক করেই যেত ঠাকুমা। রূপকথা, কমিকস, শুকতারা, সন্দেশ। কখনও বা গান,‘উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী, উঠ আদি-জগত-জন-পূজ্যা’! গানের দোলায় দুই চোখ বুজে আসত আমার। কখনও সখনও ঘুমের মধ্যে বৈশাখী ঝড় নেমে আসত। তারপর আকাশ থেকে ঝরে পড়ত ভিয়েস্তাপ বালসারার পিয়ানোর মতো বৃষ্টি। ওঁর আত্মজীবনীর নাম‘ জেগে থাকি সপ্তসুরে’! সেই বইয়ের পাতায় পাতায় নাকি অমলতাস ফুটে থাকে। গরমকালে এখনও এমন সপ্তসুরের বৃষ্টি নামলে, আমার মনে ভেসে আসে একটা অনেক পুরনো বাড়ি! অনেকগুলো হারিয়ে যাওয়া মানুষ। চোখের জলে ভেজা বারান্দা। একটা সোঁদা গন্ধ জীবনের, আজীবন!

সে হয়ত আজ চল্লিশ বৎসরের কথা। এক গ্রীষ্মের দুপুরে এক পুষ্পিত চাঁপাতলার ঘাটে বসেছিলাম আমি আর সেই মেয়েটি। সহসা এল বাউল বাতাস। আর সেই বালসারার বৃষ্টি। এমন সিক্ত সমীরণে মেয়েদের শাড়ির আঁচল পড়ে খসে, ছুঁয়ে ফেলে সে সোঁদা মাটির বুক। আমি সেই অমলতাসের আঁচল কুড়িয়ে নিতে যাব যেই, মেয়েটি বলল, থাক। আমি অপলক চেয়ে দেখলাম বাতাসি বৃষ্টিতে জেগে ওঠা ময়ূরাক্ষীর ঢেউ! হঠাৎ আকাশপাটে নেচে গেয়ে উঠল বজ্রবিদ্যুৎ। ‘এ সব কিন্তু সত্যি নয়, শুধুই রূপকথা’, এইটুকু বলে আমায় একা ফেলে চলে গেল মেয়েটি। আর এল না কোনদিন।

এরপর বৃষ্টি থামল। বিগত বরিষণের চরণচিহ্ন হয়ে আকাশে জমে রইল এক দুপুর মেঘ। ‘মেঘলাদিনে দুপুরবেলা যেই পড়েছে মনে, চিরকালীন ভালবাসার বাঘ বেরুলো বনে’!

 

 

 

 

One thought on “বিশেষ রচনা: নরমে গরমে । শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

  1. নিদাঘ দিনে বিজন বনে একলা ছিলেম বসে,
    এলোমেলো বইলো বাতাস পড়ছে পাতা খসে।
    এমনি সময় বনবালিকা বসলো এসে পাশে,
    মলয় পবন আকূল করা চক্ষু মুদে আসে।।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত