| 29 মার্চ 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: আমি ও তিনজন প্রেমিক । যশোধরা রায়চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

একটা প্রেমের গল্প এসে আছড়ে পড়েছে আমার ভেতরে।

এই আছড়ে পড়ার ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন ভাঙাচোরা হয়ে উঠি আমি। কোথায় যে সততা থেকে ছুটি নেয় মানুষ, আর কোথায় আমি হেরে যাই বার বার সততার বিপুল ভারের কাছে, আর তারপর আমার পথ আর অন্যদের পথ আলাদা হয়ে যায়, আরো , আরো কীভাবে একা হয়ে যাই আমি, সবটা বুঝেই, আরো বিধ্বস্ত জলাভূমির মত থাকি আমি, নিরঞ্জনা আর শৌমিক আর শুভ্রার ভাঙা প্রেমের গল্পটার জেট প্লেনের ধ্বংসাবশেষ বুকে করে।

ঘাসজমি থেঁৎলে যায়, মুখের মধ্যে মাটি নিয়ে পড়ে থাকে সাদা ধবধবে জেট

আমি জানি, আমার মধ্যে এসে সর্ব অর্থেই মুখ থুবড়ে পড়ে সব প্রেমের গল্পেরা। এটাই আমার ভবিতব্য। আমি, চান্দ্রেয়ী।

আমি শ্রোতা হিসেবে দারুণ, কারণ গসিপ করিনা আমি। যারা বলে, কারুকে বোলোনা কিন্তু এবং তারপর বলে তাদের গোপন কথা, তাদের প্রেমের গল্পগুলো, তারাও ঠকে যায় আমার কাছে, কারণ আমি সত্যিই কাউকে বলিনা। আমার দগ্ধভাল মরুসদৃশ বুকের মধ্যে এসে তাদের প্রেমের গল্পগুলো সত্যি সত্যিই মরে যায়। একা একা, বোরডমে। তারা যতই বলেছিল, বোলোনা কাউকে, ততই তারা ভয় পেয়েছিল, অর্থাৎ কিনা আশা করেছিল, অর্থাৎ কিনা আকাঙ্ক্ষা করেছিল, যে,  আমি জনে জনে বলে বেড়াব, কাউকে কাউকে  বলে, তারপর, আবার, কারুকে বলিস্‌ না যেন, বলে,  মুখ মুছে ফেলব, অথবা অন্য কিছু একটা কোন, বদমায়েশি, করবই।

 কিন্তু আমি কিছুই করিনি। আমি সত্যিই কাউকে বলিনি।

নিজেও ভুলে গেছি।

এটা কি কম কথা? এটা কি কম অসভ্যতা? বন্ধুদের কল্পনার অতীত অসভ্যতা।

দ্বিতীয়, আরো বড় সমস্যাটা হল, আমি নিজে, এই প্রেমের গল্প শুনে শুনে, কত যে বন্ধু বান্ধবীর প্রেম ভাঙতে সাহায্য করেছি। বলা ভাল, ভাঙিয়ে দিয়েছি। কত বার যে আমার আয়নায় ছিটকে যাবার পর প্রেমের গল্পের ছায়া বা প্রতিবিম্বগুলো এত খারাপ হয়ে গেছে ওদের কাছে যে ওরা নিজেরাই প্রেম ভেঙে দিয়েছে।

আমি যে এক্স রে চোখ দিয়ে ওদের দেখে ফেলেছি, আমি যে ওদের প্রেমের হাড় মজ্জা অব্দি পড়ে ফেলেছি, আমি  যে ওদের প্রেমের ভেতরের অবিশ্বাস ছেনালি এবং জঘন্য আত্মকেন্দ্রিকতার অপরাধ অন্যায়গুলো দেখে ফেলেছি, এটাতেই ওরা যেন কেমন একটা হয়ে যায়। তখনই ওরা প্রেম থেকে খসে পড়ে। বা বিঁধে থাকা কাঁটার মত প্রেমটা ওদের শিথিল হৃদয় থেকে খসে পড়ে যায়।

যাক এসব অ্যাবস্ট্র্যাক্ট কথা থাকুক। কী হল বলি এই বার। এই ঘটনাটায়।

নিরঞ্জনা একটি বেচারা বেচারা মেয়ে। আপাত দৃষ্টিতে স্টেবল বিবাহ আছে। বিবাহিতার যেমন জীবন হয়, ছোট একটা ছেলে আছে, মেয়ে হয়েছে সদ্য ওর, আর বরের সঙ্গে নিজের ছবিও প্রায়ই পোস্ট করে ফেসবুকে, এমন একটি মেয়ে। খুব সুখের বিবাহ কিনা জানি না, কিন্তু অসুখেরও কিছু নয়। অনেক দিন আগে, আলাপ হবার পর পরই , আমাকে এসে প্রণাম করেছিল দুটিতে মিলে। তখন ওদের মেয়ে একেবারে ছোট টোট হবে।

সেই থেকে ওদের চিনি। নিরঞ্জনা একটি পত্রিকা সম্পাদনা করত, আমি সেই পত্রিকায় লিখতাম। কখনো ছোট গল্প, কখনো কবিতা। কখনো বা প্রবন্ধ।

নিরঞ্জনার সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল শৌমিক।

শৌমিকের একটি নাতিবৃহৎ পরিচয় দিতেই হবে। ছেলেটি বহুদিন ধরে আমার পরিচিত। প্রায় দুধে দাঁত অবস্থায় ও আমার বাড়িতে আসে, আমার বাড়ির কাছেই এক কলেজ হোস্টেলে ও থাকত। হোস্টেল থেকে ও আর ওর এক বন্ধু সঞ্জয় আসত আমার বাড়িতে, নিছক আড্ডা দিতে।

আজন্ম চিনলে যা হয়, শান্ত, পড়াশুনোয় ভাল, সেনসিটিভ, লেখে ভাল, বই পড়ে, এমন একটি ছেলেকে, আমার কখনো ওর বিষয়ে কোন খারাপ কথা মনে হয়নি। আমি ওকে বিশ্বাস করতাম। যেভাবে মেয়েরা তাদের ভাইকে বিশ্বাস করে। যেভাবে মেয়েরা তাদের বাল্যবন্ধুদের বিশ্বাস করে। যৌনতাগন্ধহীন অপর্যাপ্ত বিশ্বাস ছিল আমার, শৌমিকের ওপরে।

শৌমিক, সঞ্জয় এই দুটি বন্ধু, হরিহর আত্মা, আমার বাড়িতে যেমন আসত, আমাকে যে শৌমিক সঞ্জয় একেবারেই দিদির মত করে দেখে, ভালবাসে, বিপদে পড়লে আমাদের থেকে টাকাও ধারটার নেয়, এসব আমার বেশ গর্বের বিষয় ছিল বৈকি।

অন্যদিকে , বছরের পর বছর কেটে যেতে থাকে, আমিও বিয়ে শাদি করি। বেশ কয়েকটা ব্যর্থ প্রেমের পর সেই বিয়ে। ব্যর্থ প্রেমগুলো আমাকে অনেক শিখিয়েছে ,অনেক দিয়েছে।

অথচ আমার বিয়ের পর, পরমেশ আর আমার সম্পর্কে কখনো চিড় ধরেনি। আমরা সেই স্বামীস্ত্রী, যারা বিয়ের সতেরো বছর পরেও পরস্পরকে বুঝতে পারিনি, আর পরস্পরকে ছাড়াও আর কিছু বুঝতে পারিনি, আর কারুর দিকে তাকাতে পারিনি।

আমাদের পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝিও বোঝাবুঝির মতই গাঢ় ও অবিচ্ছেদ্য, কামড়াকামড়িও তেজালো এবং ভীষণ। অর্থাৎ আমাদের দাম্পত্য বছরের পর বছর এক জায়গায় সতেজ ও স্পষ্ট থেকে গেছে।  কোথায় যেন পরমেশ আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করেনি, আমিও পরমেশকে নিয়ে করিনি। আমাদের মনেই হয়নি অন্য কেউ ঢুকতে পারে আমাদের গল্পে। হুশ করে কেটে গেছে বছরগুলো।

কিন্তু কে না জানে, যে আমার যেটা ঘটে সেটা অন্যদের যে ঘটবেই তা না ধরে নেওয়াই ভাল। ইতিমধ্যে শৌমিক সঞ্জয়ের মধ্যে সঞ্জয় বিয়ে করে, তার গিন্নিকে নিয়ে আমাদের কাছে বেড়াতেও আসে। শৌমিক থেকে যায় যে কে সেই। অবিবাহিত, স্বপ্নালু, শিল্পচর্চায় রত, অফিস একটা যেমন তেমন আছে বটে, কাজও করে, কিন্তু সেটার চেয়েও ওর লেখালেখি-সমন্বিত জীবনই বেশি পছন্দ তা বোঝাই যায়।

ন মাসে ছ মাসে শৌমিক আসত আমার কাছে। মজা করে জিগ্যেস করতাম কী খবর, বিয়ে কেন করছে না শৌমিক। শৌমিক একটা একটা করে অনেক গুলো দুঃখের প্রেমের গল্প বলে পার পেয়ে যেত।  বোঝা যেত কোন এক অজ্ঞাত কারণে, ওর সব প্রেমিকারাই অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়। ও থেকে যায় যে কে সেই, একা।

শৌমিকই যে আমাকে নিরঞ্জনার সঙ্গে আলাপ করিয়েছিল, তা ভুলে গেছিলাম। আসলে নিরঞ্জনা যে পত্রিকাটা সম্পাদনা করত, মাটির গন্ধ, নামে, সেই নাম দেওয়া, শুরুর দিকের লেখক তালিকা তৈরি, সবটাই শৌমিকই করেছিল।

এর পর পর, নিরঞ্জনার সঙ্গে শৌমিকের যে আদৌ কোন সম্পর্ক থাকতে পারে, সে কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, শৌমিকের গোটা জীবন অফিসের কাজ, রাত করে বাড়ি এসে কোন মতে কিছুটা পড়া, লেখা, আর সেসব ভাবাতেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ শৌমিকই আমাকে এরকম একটা আইডিয়া দিয়েছিল।  ইতিমধ্যে শৌমিক পাত্রীও দেখছে শুনেছিলাম। ওর বাবা অসুস্থ, তাই, বাড়িতে, বাড়ির দেখভাল করার মত একটা কাউকে দরকার, এরকম একটা অছিলা ও বার করেছিল বিয়ে করার। আর সেই বিয়ে নিয়েও আমি ওকে কথা শোনাতে কসুর করিনি, দিদি হিসেবে। একটা মেয়েকে শুধু ব্যবহার করবি তুই? বিয়ে করে বাবার দাসী করে আনবি, অষ্টাদশ শতাব্দীর মত?

এর পর বিয়ে করল শৌমিক। ওর বিয়েতে ঠেঙিয়ে গেলাম বারাসাত, খেলাম অসামান্য একটা খাসির মাংস। আর অনেক অনেক তুলতুলে সন্দেশ আর চমৎকার রসগোল্লা সাঁটাল আমার বর পরমেশ। 

তারপর ভুলে গেলাম। শৌমিক আমার চোখে হয়ে গেল পৃথিবীর অন্য সব বিবাহিতদের মতই এক অতি ভেজা বেড়াল ছাপোষা লোক। একে অফিস তায় ওর নিভু নিভু শিল্পচেতনা। তারপর আবার নতুন বউ। যে বউকে রাখাই হয়েছে অসুস্থ বাবার সেবার জন্য। তবে কিছুদিন পার সে আর সেবা করতে পারল না বিশেষ, বাবাকে। কারণ,  কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন বউয়ের পেটে নতুন বাচ্চার আমদানি হল, খবর পেলাম। কংগো, আহা, দুর্দান্ত, আরেকটা খ্যাঁটন পাচ্ছি, পিশি হলাম তাহলে – এই এই মর্মে খান কয়েক মেসেজ লিখলাম শৌমিককে। তারপর আমি নিশ্চিন্ত হয়ে  ওদের সবার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।

কিন্তু ভবি ভুললেন না। হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে বিদ্যুল্লতার মত একটা ঘটনা ঘটল… আমাদের সকলের চেনা কবি শুভ্রা চক্রবর্তী হঠাৎ আত্মহত্যা করে বসল।

আর কেন সেই আত্মহত্যা? তা নিয়ে বাংলা বাজারে বিস্তর জলঘোলা হতে লাগল।

আর সেই আত্মহত্যার পর পরই, যে শুভ্রা চক্রবর্তীকে যারা প্রায় সবাই ভুলতে বসেছিল তাদের সবার মনে ব্যথা উথলে উঠল। কবিতায় যিনি কিছুই নিজস্ব কারিকুরি দেখাতে পারছিলেন না, হঠাৎ তিনি এক তারকা, মানে,   স্টার হয়ে উঠলেন। অর্থাৎ আত্মহত্যাটি তাঁর কিছু উপকারই করেছিল। ব্যক্তি শুভ্রা চলে যেতেই কবি শুভ্রা বিশাল হয়ে দেখা দিলেন। তাঁর প্রতিটি লেখা বার বার শেয়ার হতে থাকল ফেসবুকে। প্রায় ভাইরাল হয়ে উঠল।

ইতিমধ্যে ইদানীং নিরঞ্জনার সঙ্গে আমার সখ্য বেড়েছে। ওর সেই মাটির গন্ধ পত্রিকায় একটা লেখার জন্য বার বার করে পাল্টাচ্ছিলাম  নানা লাইন। ওর পত্রিকা প্রকাশের সময় কম, শেষ স্তরে কাজ চলছে, জেনেও। আর ও ক্রমশ আমাকে তাগাদা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। ইতিমধ্যে দু বার বলেছিল , দু দুটো মেলা নাকি ও ধরতে পারল না আমার দেরির জন্য। ওর কন্ঠ থেকে অধীরতা ঝরে পড়েছিল কিন্তু আমি ছিলাম পর্বতের মত অবিচল। কারণ লেখাটা আমার পছন্দ না হলে আমি কিছুতেই ছাড়ব না। সে তুমি যাই কর আর তাই কর। দরকার হলে আমার লেখা বাদ দিয়ে কাগজ ছাপ না! পারবে চান্দ্রেয়ী গুপ্তকে বাদ দিয়ে এখন? পারবে?

একদিন শেষ বিকেলে আমার বাড়িতে এল নিরঞ্জনা। আমার কারেক্ট করা প্রুফ নিয়ে যাবেই যাবে আজ। ওকে বসিয়ে কাজ শেষ করছি। ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছি এক কাপ ধূমায়িত গ্রিন টি। এমন সময়ে হঠাত আমার টেবিলে দুটো বই পর পর দেখে ও ফিক করে হেসে ফেলল।

 আমি ওর হাসি দেখলাম। তারপর ওর চোখ অনুসরণ করে দেখলাম ও তাকিয়ে আছে শুভ্রা চক্রবর্তীর একটি বই এবং শৌমিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থের দিকে।

আমি বললাম, এই নাও নিরঞ্জনা , অ্যাট লাস্ট শেষ করতে পারলাম।

এগিয়ে দিলাম প্রুফের গোছা। হেসে বল্লাম তুমি ত হাল ছেড়েই দিয়েছিলে, তাই না?

না না দিদি, হাল যদি ছাড়ব তবে আর আপনার বাড়িতে হানা দেব কেন?

আচ্ছা, তুমি শুভ্রার বই দেখে হাসলে কেন?

না না সেজন্যে হাসিনি। সত্যি , শুভ্রার ডেথ খুব স্যাড কেস।

হ্যাঁ অবশ্যই। কী অভাব ছিল ওর? জীবনে? ডিপ্রেশনের কারণ কী ছিল? তুমি জান?

একাকিত্ব অবশ্যই। তাছাড়া ওর মা টার্মিনালি ইল। আর, আর একটা কারণ আছে। ভয়ে বলি না নির্ভয়ে বলি।

নির্ভয়ে… ভয়ে… মানে?

না, মানে শৌমিক তো আবার আপনার ভাইয়ের মত, তাই ভাবছিলাম…।

কী করেছে শৌমিক?

আপনার মনে পড়ে , আমাদের এ পত্রিকার জন্ম বছর পাঁচেক মত আগে? আর এটাও ত জানেন যে শৌমিকই হাত ধরে আমাকে পত্র পত্রিকার লাইনে এনেছিল।  আমার প্রিয় কবি সাহিত্যিক শুভ্রা চক্রবর্তীর সঙ্গে  তখন একটা আধা খ্যাঁচড়া ফ্লার্ট করার সম্পর্ক ছিল শৌমিকের। সেটা আমি ধরে ফেলি হঠাৎই। কেননা, শৌমিক যখন এই কান্ডটা শুরু করেছিল, আমি তখন কিছুই জানতে পারিনি। শুভ্রাদির মধ্যে শৌমিকের সম্বন্ধে একটা গুপচুপ গুপচুপ ভাব দেখে প্রথম আমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। হঠাৎ শৌমিকের শুভ্রাদিকে পাঠানো দশটা কবিতা সহ একটা মেল ও, শুভ্রাদি হঠাৎ ভুল করে আমাকে ফরওয়ার্ড করে বসে। হয়ত ভুল করে না। হয়ত শুভ্রাদি আমাকে বিশ্বাস করত ভাল বাসত বলেই এটা ঘটে । ত, শুভ্রাদির সেই মেল থেকেই জানতে পারি, শৌমিক শুভ্রাদিকে কবিতা পড়ায় । তারপর একদিন সারাদিন শুভ্রাদি আমার এস এম এসের উত্তর দেয়না, জানায় ব্যস্ত, বাড়িতে আত্মীয়রা খাবে।

বিকেলে শৌমিককে কোন কারণে ফোন করি। সে তৃপ্ত গলায় জানায়, শুভ্রাদির বাড়িতে সারাদিন ছিল। শুভ্রাদি ওকে পঞ্চপদে রেঁধেবেড়ে খাইয়েছে। এখন সে শুভ্রাদির সঙ্গেই নাটক দেখে ফিরছে। 

আমি দুইয়ে দুইয়ে চার করে হেভি রেগে যাই। হিংসেও হয়। শুভ্রাদিকে অভিযোগ করি, আমাকে না ডেকে, না জানিয়ে কেন শৌমিককে একলা একলা নেমন্তন্ন করে রান্না করে খাওয়ালো ও। আরো বলি, আমার কাছে শৌমিকের আসার কথাটা চেপে গেলে কেন। তখনই মাথার মধ্যে একটা অনুরণন, ও শৌমিকের প্রেমে পড়েনি ত?

হুঁ! তারপর?

আমি , মানে এই আমি, চান্দ্রেয়ী, ক্রমশ ক্লান্ত হই। কেননা, শৌমিককে আমি ভাই ভাবতাম। তাই ওর অযৌন দিকখানাই আমার মনের মধ্যে আছে। এবার ওর যৌন জীবন যেন না পড়া বইয়ের মত খুলে যেতে থাকে আমার সামনে… আর তত আমি  একটা নতুন গল্পের গন্ধ পাই। 

শুভ্রাদি এখন মৃত কিন্তু তাকে ত আমি সহলেখক হিসেবে চিনতাম। মৃত শুভ্রাদির প্রতি সহানুভূতির পাশাপাশি জীবিত শুভ্রাদির প্রতি ঈর্ষা ও খানিক ক্রোধ ছিল আমার । একদা আমার একটা লেখা ফেলে দিয়ে এক পত্রিকার সম্পাদক শুভ্রাদির লেখা নেয়। শুভ্রাদিকে পত্রিকা প্রকাশের য়াগেই বোকার মত আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম যে ওই পত্রিকা আমার থেকে উপন্যাস চেয়েছে এবার আর সেটা জেনেই ও ফোন করে ওই সম্পাদককে ধমক দেয়, আমি সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও কেন আমার লেখা ছাপছ না ছাপছ ওই সেদিনের পুঁচকে চান্দ্রেয়ীর লেখা! 

সব মিলিয়ে শুভ্রাদির প্রতি এবার আমার জুগুপ্সা জেগে ওঠে… অদ্ভুত একটা বিভ্রান্তিকর অনুভূতি জেগে ওঠে আমার… আমি অল্প অল্প ঘামতে থাকি… বিষণ্ণ হই।

তারপর আবার নিরঞ্জনার দিকে তাকাই আর ওর চোখেমুখে কিছু একটা দেখে আরো ঘাবড়ে যাই। 

আসলে শুভ্রা শৌমিকের প্রেমের কথা জানানর সঙ্গে সঙ্গে নিরঞ্জনা নিজের প্রেমটাও বলে ফেলে আমার কাছে। অন্যের প্রেম বিবৃত করার সময়ে তাকে বিচলিত দেখায় , খুব লাল হয়ে যায় তার মুখ। সে কয়েকবার কাশে ও জল চেয়ে খায়। 

ক্রমশ বিবাহিত নিরঞ্জনা, বিবাহিত শৌমিক এবং একাকী শুভ্রার ট্র্যাঙ্গেল নিয়ে আমি কেমন যেন কৌতূহলী হয়ে পড়ি। বলি, নিরঞ্জনা, তোমার শৌমিকের সঙ্গে প্রেম কবে হল? আদৌ ছিল?

থাকবে না কেন? আমরা এক সঙ্গে পত্রিকার কথা ভেবেছি। এটা আমাদের দুজনের স্বপ্ন। আর এটাই ত  প্রেম। পরকীয়া প্রেম। এটা তো আমার বার্থরাইট। আমার বরের ত এর মধ্যে মাথা গলানোর কোন জায়গা নেই। আমরা দুইজন সৃষ্টিশীল মানুষ। ও কবি ও শিল্পী, আমি কবি ও সম্পাদক। আমাদের প্রেমে কার কী বলার আছে?

তাহলে শুভ্রাদির সঙ্গে শৌমিকের প্রেমেও ত কিছু বলার নেই। তাছাড়া যে সময়ে ভাব ভালবাসা ঘটে বলছ, সে সময়ে ত শুভ্রাদি  বা শৌমিক কেউই বিবাহিত ছিল না।

না, তা বললে কী হবে। শুভ্রা ত আসলে নিম্ফোম্যানিয়াক। এমনি এমনি কি ওর বিয়ের ছ মাসের মধ্যে বর পালাল? ওর আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী না।  আসলে ইদানীঙ ওর যে তিন চারজন ছেলেবন্ধু ছিল, তাদের মধ্যে ব্যালেন্স করতে পারার অক্ষমতার ফলেই এই দশা ওর।  জানেন, শুভ্রাদি নিশ্চয়ি শৌমিকের সঙ্গে শুয়েছিল।  

কে বলেছে।

শৌমিক বলেনি, কিন্তু ওর শুভ্রাদি বিষয়ক মন্তব্য থেকেই আমি বুঝে নিতে পেরেছি।  ওই যে একদিন ফেসবুকে একটা ছবি দিল শুভ্রাদি, দেখেই শৌমিক বলেছিল ওর জামার ভেতরে… যাহ এসব অসভ্য কথা তোমাকে বলে কী হবে। … ছিঃ শুভ্রাদি  পাঁচ বছরের ছোট একটা ছেলের সঙ্গে ও শুল কী করে? ওর লজ্জা করল না? শুভ্রাদি এত নীচে নামতে পারল?

সে কি! তুমিও  তো শৌমিকের সঙ্গে  বিবাহবহির্ভূত প্রেম করেছিলে। দুজনের একজন কী করে সতীলক্ষ্মী হয় আর অন্যজন দোষাবহ?

না, আমার টা তো সমবয়সী প্রেম ছিল, ওদেরটা অসমবয়সী! তাছাড়া যতদিন আমি প্রেম করেছি ততদিন আমার বরের সঙ্গে কোন বিছানার সম্পর্ক ছিল না। তাছাড়া , শৌমিক ত আমাকে সর্বদা কনট্রাসেপ্টিভ নিতে বলত। একবার ৭২ ঘন্টার ট্যাবলেটও খাইয়েছি।

তাতেই সাত খুন মাপ?

না, আসলে দুজন ক্রিয়েটিভ লোকের ভেতরে প্রেম ত হতেই পারে।  বিয়ে আর প্রেম তো এক নয়, দুটো আলাদা ডাইমেনশন।

মনে মনে বলি, ওহে নিরঞ্জনা , তোমার মাথার মধযে এই যে সব ভাষা জাগছে, এগুলোও তো আসলে শৌমিকেরই শিখিয়ে দেওয়া। শৌমিক তোমাকে কাদার তাল থেকে মানুষ করেছে। সংস্কৃতি জগতে ইনট্রোডিউস করেছে, সংস্কৃতি জগতে নিজের  বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়েছে , আমার সঙ্গেও শৌমিক ই তোমাকে আলাপ করিয়েছিল। শৌমিক তোমাকে বুঝিয়েছে, কবিতা লেখার পাশাপাশি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক করাটাও একটা কাজ।

সেরকম পাঁচ বছরের বড় শুভ্রাদিকেও ও বুঝিয়েছিল নিশ্চয়, যে বয়স কোন ফ্যাক্টর নয়। যে কোন বয়সে যে কোন বয়সীর সংগে প্রেম হতে পারে? কী, বুঝিয়েছিল কিনা? শুভ্রাদি যে ক্রিয়েটিভ মানুষ ছিল,  তা কি তুমি অস্বীকার কর? 

নাঃ আমি এসব মেনে নিতে পারিনি। শুভ্রাদির সব লেখা টুকলি। আমি ধরে ধরে দেখিয়ে দেব কোন কোন বিদেশি কবির থেকে ও টুকেছে। আজকাল গুগুলে সব পাওয়া যায়। 

তা ত যায়। 

আর শুনুন,  শৌমিকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ। সেজন্যেই এবার বেঁচে গেলেন আপনি।  যা দেরি করিয়েছেন আমায়! শৌমিক আগে যে সময়ে নিজের অংশের কাজ করে দিত সেগুলো ত এবার কিসসু করেনি। ফলে আমাকে ত অন্য প্রিন্টারের কাছে যেতে হল। টাকা দিয়ে প্রুফরিডার রাখতে হল। একটা মেলা ধরতেও পারলাম না। 

বুঝলাম। তাহলে আমার জন্য শুধু দু দুটো মেলা মিস করনি । শুনে খুশি হলাম । 

না, আমার সময় খারাপ যাচ্ছে। বরের আবার চাকরি নেই এ মুহূর্তে। আপনি ত আর জানেন না গৃহবধূ হয়ে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে কাগজ বের করা কী চাপ!

হুঁ। আচ্ছে তুমি আমাকে এতকিছু বললে , এগুলো যদি আমি শৌমিককে বলে দিই?

ও ত স্বীকারই করবে না কিছু। কারণ মৃতেরা কথা বলেনা তাই শুভ্রাদির পার্টটা আপনি ভেরিফাই করতে পারবেন না। আর আমি ত আমার বরের ভয়ে এসব কথা কারুকে সর্বসমক্ষে বলতেই পারব না। যদিও বললে বলতাম ব্যাটা মলেস্টার… গতবার আমাকে কী তাড়নাটা না করেছিল যদি কনসিভ করে ফেলি এই ভয়ে… বাহাত্তর ঘন্টার ট্যাবলেট আমি ফেলে দিয়েছিলাম কিনা জানালা গলিয়ে… কেন দেব না বলুন। ওর সন্তান গর্ভে ধারণ করতে পারলে ত পরে ওকে ফাঁসাতে পারতাম… আর সেটাই শৌমিকের ভয়। 

হ্যাঁ শৌমিক ত বাবা হয়েছে সদ্য। জান ত?

হ্যাঁ লোককে হোয়াটস্যাপে ছেলের ছবি পাঠিয়ে পাঠিয়ে ছয়লাপ করছে শুনেছি। তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে… যাইহোক, যা শুনলেন কাউকে বলবেন না প্লিজ।

আমি ত বলি না কখনো। এটাই আমার ইউ এস পি। আমি হলাম মঙ্গলগ্রহের ক্রেটার। উপগ্রহ পাঠিয়ে দেখ। আর ফিরবে না। 

ওহ। তাই? বেশ। এ নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলুন না। 

আচ্ছা তা হবে । তবে নিরঞ্জনা,  এখন তো আমার মনে হচ্ছে শুভ্রার মৃত্যুর জন্য ওই শৌমিকও দায়ী হতে পারে।

তা হতেই পারে। ও আমাকে আর শুভ্রাদি দুজনকে গাড্ডায় ফেলে নিজে সতীলক্ষ্মী মহিলা নিয়ে ঘর করছে। এ কতবড় অন্যায় বলুন তো।

কেন , কেন, এ ত হর হামেশাই হচ্ছে। মেয়েরা অসতী হয়। পতিতা হয়। ক্যারেকটার লেস হয়। ছেলেরা তো কিছুই হয়না।

কেন হবে না, কেন হবে না। চলুন আমরা ওকে এক্সপোজ করে দিই।

উত্তেজনায় ফুটছিল নিরঞ্জনা। 

চলি চান্দ্রেয়ীদি। ও আচ্ছা, পরশু কিন্তু আমাদের মাটির গন্ধের পক্ষ থেকে শুভ্রাদির স্মরণ সভা…। কলেজ স্ট্রিটে অতনুদের স্পেসটায় হবে। আপনি আসবেন। 

গেছিলাম শুভ্রাদির স্মরণ সভায়… সাদা শাড়ি পরে… নিরঞ্জনাও হেব্বি সেজেছিল ওইদিন। কেরালা কটন। 

শৌমিক এসেছিল । খুব ভাল বলেছিল শুভ্রাদির কবিতায় অ্যাংস্ট আর আত্যন্তিক বিষাদ নিয়ে। 

ফেরার সময়ে মাথা বিজবিজ করছিল… চা খেতে খেতে দেখেছিলাম শুভ্রাকে যথোচিত বেদনা জানিয়ে ভারমুক্ত হয়ে আবার শৌমিক আর নিরঞ্জনার কেমিস্ট্রি ঘনিয়ে উঠছে যেন… আর এই  তিনজনের প্রেমের গল্পকে হজম করতে না পেরে, কাতর, বিষণ্ণ, ভাবছিলাম, কেন আমাকেই হতে হবে সেই মাঠ, যার মধ্যে এসে আছড়ে পড়ে অন্যদের ব্যররথ প্রেমের এরোপ্লেন!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত