| 29 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: সাতটা নদী দুইটা মাছ । শা হ্ না জ মু ন্নী

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

একটা স্রোতস্বিনী নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে দুইটা মাছ। একটা পুরুষ অন্যটা নারী। কোনো এক উদাসি পূর্ণিমায় জোয়ারের ভরা সময় নদীর উত্তঙ্গু স্রোতের মৃদু মন্দ দুলুনীতে এই যুগল মীনের মিলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাদের সেই আকাঙ্খিত মিলন আর হয় নাই। আসলে হইতে দেওয়া হয় নাই। জোর করে জোড়া ভেঙে দেয়া হইছে। তাদের দুইজনকে দুই জালে বন্দী করে প্রথমে তুলে আনা হয়েছে ডাঙায়। তারপর কুফরি কালাম পড়ে, ফু দিয়ে, শুকনায় খাবি খেতে থাকা দুইটা মাছকে তুলে ফেলে দেওয়া হয়েছে দুই ভিন্ন নদীতে, বিপরীতমুখী দুই স্রোতে। এরা দুজন এখন রূপালী পাখা নাড়িয়ে দুই নদীতে সাঁতার কাটে, দুই স্রোতে ভেসে বেড়ায় কিন্তু একজনের সাথে অন্যজনের আর সাক্ষাত হয় না।

যতদিন না ওই দুই মাছের মিলন হবে ততদিন শ্যামলীর’ও জোড়া মিলবে না। তোমরা যত চেষ্টাই করো না কেনো, শ্যামলীরে বিয়া দিতে পারবা না। ওর উপরে কালো যাদু করা হইছে। ডার্ক ম্যাজিক।

ফকির সাহেব প্রায় ঘন্টাব্যাপী উঠানে নানা রকম হিজিবিজি দাগ কেটে তার গণনা শেষ করে জোর গলায় ঘোষণা দিলেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ফকির তার আসর শুরু করেছিল এখন আলোর তেজ আর তাপ দুটোই কমে সন্ধ্যা ঘনায়মান। আমি সারাটা সময় ধরে ফকিরকে লক্ষ্য করছি, দেখছি তার মাথা ভর্তি লম্বা কাচাপাকা চুলের মধ্যে গাছের শেকড়ের মতো প্যাঁচানো একটা জট, রক্তজবার মতো বড় বড় লাল দুইটা চোখ সে একবার বন্ধ করে আবার খোলে। শরীর দুলিয়ে কথা বলার সময় গেরুয়া রঙের ফতুয়ার উপরে তার গলায় ঝোলানো খয়েরি রঙের চার লহরী রুদ্রাক্ষের মালা ডানে বায়ে দোল খায়।

শ্যামলি খালা অপরাধির মত নীরবে উঠানের এক কোণায় উবু হয়ে বসে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে গর্ত খোঁড়ার চেষ্টা করছে। আমি ওর প্রায় গা ঘেষে বসে আছি, নাকের মধ্যে ওর দুই বেণী বাধা চুলের গোছা থেকে মেথি কালজিরা মাখা নারকেল তেলের সুগন্ধ ঝাপটা দিচ্ছে।

‘তুই এখানে কি করিস? যা ভাগ্! খেলতে যা!’

শ্যামলি খালা চাপা স্বরে চোখ পাকিয়ে কয়েকবার আমাকে এখান থেকে তাড়াতে চেয়েছে। কিন্তু আমি কি আর সরি? গ্যাট হয়ে বসে আছি সকাল থেকেই। ফকিরের বিড়বিড় করে পড়া মন্ত্র ঘুরে ঘুরে মাথায় বাজছে- কথাগুলি ঠিক কি ছিল বলতে পারবো না, তবে আমার কানে রেলগাড়ির ঝমঝম শব্দের মত ছন্দ তুলে বাজছে- ‘পিয়ারাপ্পা পিয়ারাপ্পা দেবেরও আছর, পিয়ারাপ্পা পিয়ারাপ্পা কিঙ্কাশু কহর, পিয়ারাপ্পা পিয়ারাপ্পা জলেরও নহর ..’

মা আর নানী প্রায় আর্তনাদের সুরে জানতে চাইল এই কালো যাদু বা কুফরি কালাম কাটানোর কি কোন ব্যবস্থাই নাই?

‘আছে। আছে। বিধান আছে।’ ফকির ঢুলু ঢুলু চোখ মেলে তাদের আশ্বস্ত করে। ফতুয়ার পকেট থেকে কাগজে প্যাঁচানো পানের খিলি বের করে, ধীরে সুস্থে কাগজটা খুলে তর্জনীতে চুন লাগায়, বাকি চার আঙ্গুলে পানটা মুখে পুরে দেয়। চোখ বন্ধ করে চিবায়। খয়েরি জিভ বের করে তর্জনী থেকে চুন চেটে নেয়।

‘উল্টা কালাম পড়ব আমি। তাবিজ চালান দিব। সেই সাথে সাত নদীর সাত ঘটি পানি একসাথে করে সাত রাস্তার মাথায় কন্যাকে হলদি গিলা মেখে গোসল দিতে হবে। তারপরের সাতদিন কন্যা শুধু ফলমূল খেয়ে থাকবে। সাতটা তাবিজ দিব, সেইসব অঙ্গের সাত জায়গাতে ধারণ করতে হবে। তাইলে ওই অভিশাপ কাটান যাবে।’

আমি ফট করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘তখন কি দুইটা মাছের দেখা হবে? তাদের মিলন ঘটবে?’

‘এই নাবালক শিশু এইখানে কেনো?’

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফকির সাহেব হুংকার দিয়ে উঠেন। আর যায় কোথায়, মা রান্নাঘরের পাশে উঠানে স্তুপ করে রাখা চ্যালা কাঠ তুলে নিয়ে আমায় তাড়া করলেন। মায়ের বরাবরই খুব হাত চলে। স্কুলে পড়া না পারলে ছাত্র-ছাত্রীদের বেদম পিটানোর অভ্যাস আছে তার। সেজন্য ছেলে মেয়েরা আড়ালে তাকে ‘ডাইনী সুমাইয়া’ ডাকে। বাড়িতে আমি আর শ্যমলী খালা তার সহজ শিকার। বেশির ভাগ সময় আমি ছুটে পালিয়ে যাই, শ্যামলী খালা পালাতে পারে না, মা খপ্ করে তার লম্বা চুলের ঝুটি ধরে ফেলে তারপর হাতের কাছে পাখার ডাটি, রুটি বেলার বেলুন, বাঁশ কঞ্চি লাঠি যাই পাওয়া যাক না কেনো, তা দিয়েই শুরু করেন বেধড়ক পিটুনি।

বাবা বা নানী গিয়ে না ছুটানো পর্যন্ত মার হাত থেকে নিস্তার মিলে না। আসলে আমাদের বাসার সবাই মাকে ভয় পায় কারণ উনি সারাক্ষণই রেগে থাকেন। যতক্ষণ মা বাইরে থাকেন ততক্ষণ আমাদের স্বস্তি, আমাদের বলতে শ্যামলী খালা, নানী, বাবা আর আমি। মায়ের অনুপস্থিতি মানেই সবাই মিলে হৈ হৈ করে লুডু খেলা, ক্যারাম খেলা, সাউন্ড বাড়িয়ে টিভি দেখা, ভাতের থালা হাতে খাটের উপর উঠে বসা, গলা খুলে ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে ..’ । মা বাইরে থাকলেই আমাদের স্বতস্ফ’র্ত হাসি গান আনন্দ ..

মা বাড়ি ফিরল তো সব কিছু ঠান্ডা, সব মিয়ানো মুড়ির মত চুপসে যাওয়া, ন্যাতানো, ভেজা ভেজা। স্কুল শেষে দুই ব্যাচ ছাত্র পড়িয়ে খিটখিটে মেজাজে ক্ষুধার্ত হয়ে সন্ধ্যা বেলা মা বাসায় ফিরত। হাত মুখ ধুয়ে নাকে মুখে ভাত খেয়ে নাকে চশমা এটে মা বসতো পরীক্ষার খাতা দেখতে। মায়ের পাশে আমাকে আর শ্যামলী খালাকেও বসতে হত নিজেদের পাঠ্যপুস্তক মেলে। আমি ক্লাস সেভেন আর শ্যামলী দুইবার আইএ ফেল করে তৃতীবারের মত পরীক্ষার্থী। মায়ের অগোচরে কলম দিয়ে খোঁচাখুঁচি, কাগজ জড়ো করে গোল্লা পাকানো, ছোট ছোট কাগজে গানের কলি লিখে চিরকুট পাঠানো সবই চলত আমাদের, তবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে। ধরা পড়লেই বেদম মার, সঙ্গে বকাবকি ফ্রি।

প্রথমবার ম্যাট্রিক ফেল করার পর থেকেই শ্যামলীকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু অনেকদূর আগানোর পরও শ্যমলী খালার বিয়ে হচ্ছিল না। পাত্র পক্ষ আসে, শ্যমলী হাতে চা মিষ্টির ট্রে নিয়ে সিল্কের শাড়ি পড়ে সেজেগুজে মাথা নিচু করে তাদের সামনে গিয়ে বসে। সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সূরা ইখলাস মুখস্ত বলার পরীক্ষা দেয়। পাত্রপক্ষের ডিমান্ড অনুযায়ী হেঁটে দেখায় পায়ে খুঁত নেই। খোপা খুলে বোঝায় চুল কোমর ছাড়িয়ে পড়ে। ছানার পোলাও, মুরগির কোর্মা বা পটলের দোলমা রান্নার পুঙ্খানুপুঙ্খ রেসেপি বলে- কিন্তু শেষমেষ কেন যেন তার বিয়ে আর হয় না।

একবার তো রংপুর থেকে এসে শ্যামলীকে দেখে ছেলের বাবা মা খুশি হয়ে আংটি পর্যন্ত পড়িয়ে গেল, দু পক্ষই রাজি, শুধু বিয়ের তারিখ ঠিক করা বাকি, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে, অল্পসল্প কেনাকাটা চলছে, এমন অবস্থায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হুট করে বিয়েটা ভেঙে গেল।

মা তো ভয়ানক রেগে গেল। রাগ হলে তার আচার আচরণ আর ভাষার ব্যবহারে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। শ্যামলীকে ‘কুফা’ ‘গাধী’ ‘কালামুখী’ ‘কালী’ ‘পোড়া কপালী’ এমন যা নয় তা বলে গালিগালাজ করলো মা। নানী আর আমার চোখ ভিজে গেল সেসব শুনে। শুধু শ্যমলী যেন কিছই হয় এমন ভাব করে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে বারান্দা মুছতে লাগলো। হয়তো এইসব রূঢ় ব্যবহার তিক্ত কটু কথা বার বার শুনতে শুনতে শ্যামলীর আর কিছুই গায়ে লাগতো না, সহ্য হয়ে গিয়েছিল।

অথচ শ্যামলী খালা কিন্তু মোটেই কালো নয়, বরং নামের মতই স্নিগ্ধ শ্যাম বর্ণ ওর। ওরকম মায়া কাড়া চেহারা, ঘন পাপড়ি ঘেরা দিঘীর মত টলটলে চোখ, পাতলা খাড়া নাক, চিকন ঠোট, পিঠ ভর্তি ঘন কালো চুল আমাদের পাড়ায় আর কোন মেয়েরই আছে কি না সন্দেহ।

পড়া লেখায় একটু কাঁচা হলে কি হবে শ্যামলী খালা ঘরবাড়ি পরিপাটি করে গুছাতে পারে, খুব ভালো রান্না করে, অসাধারণ সেলাই করে। আমাদের বাড়িতে বিছানার চাদর, বালিশের কভার, টেবিল ক্লথ, টিপয় সব জায়গাতে শ্যামলী খালার হাতের কাজ জ¦লজ¦ল করে।

শ্যামলী খালাকে আমি খুব ভালবাসি। শুধু আমি না, আমার যারা বন্ধু জিকো, রবি, নয়ন, খালেক, মাসুদ ওরা সবাই শ্যামলী খালাকে ভালবাসে। ঘুড়ির সুতায় মাঞ্জা লাগাতে, পাতার বাঁশি নয়তো চরকি বানাতে অথবা বিজ্ঞান মেলায় প্রজেক্ট জমা দিতে শ্যামলী খালার সাহায্য আমাদের লাগেই লাগে। আরেকজন মানুষও শ্যামলি খালাকে ভালবাসে, আমি জানি, সেই ভালবাসাটা অবশ্য আমাদের চেয়ে একটু অন্যরকম। আমরা তো আর শ্যামলী খালাকে ভালবাসলেও বিয়ে করতে পারবো না। উনি কিন্তু পারবেন। বার বার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছিলো বলে শ্যামলী খালার যখন খুব মন খারাপ তখন আমি মরিয়া হয়ে একদিন বলেই ফেললাম,

‘আচ্ছা, তুমি ফরহাদ ভাইকে বিয়ে করলেই পারো। সে তো তোমাকে আই লাভ ইউ বলছে। আমি জানি।’

‘রাতুল, খুব পেকে গেছিস তো তুই ! আমার বিয়ে নিয়ে তোকে কে চিন্তা করতে বলেছে? আরেকবার এইসব নিয়ে কথা বললো এমন মাইর দিবো না। ’

শ্যামলী খালা কেনো এত রেগে গেল বুঝলাম না। ফরহাদ ভাই দেখতে সেই রকম সুন্দর, মাথায় বাবরি চুল, ফর্সা মুখে লালচে রঙের পাতলা দাড়ি, খুব সুন্দর গানের গলা, গিটার বাজিয়ে চোখ বন্ধ করে এত দারুণ গান করে না, আমার অবাক লাগে। আমাদের কেমন যেন দূর সম্পর্কের আত্মীয় হতো ফরহাদ ভাইয়ের মা, সেই সূত্র ধরে আমাদের বাড়িতে উনি আসেন মাঝে মাঝে। মাকে ‘সুমাইয়া খালা’ ডাকলেও বয়সে ছোট হওয়ায় শ্যামলী খালাকে নাম ধরেই ডাকে ফরহাদ ভাই। আমি দেখেছি একদিন দরজার আড়ালে শ্যামলী খালার হাত ধরে সে মিনতি করে বলছে, আই লাভ ইউ। শ্যামলী খালা তখন হাত ছাড়িয়ে নেয় নাই আবার মুখে কিছু বলেও নাই।

আরেকদিন বাড়িতে বাবা মা ছিল না, নানী বোধহয় ঘুমাচ্ছিল। আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখি ফরহাদ ভাইয়ের বুকের সাথে শ্যমলী খালা লেপ্টে আছে, আমাকে দেখে সরাৎ করে দুজন দুদিকে সরে গেল। এমনকি রান্নাঘরের পেছনে ঝাঁকড়া লেবুগাছটার আড়ালে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ওদেরকে জাপ্টে ধরে চুমু খেতেও দেখেছি আমি। (সব কিছু আমার চোখের সামনেই ঘটতে হবে কেনো বুঝি না)। মানুষ যাকে ভালবাসে তাকেই তো চুমু খায়। বিয়েও তো তাকেই করে। তাহলে আমি বিয়ের কথা বলাতে কি এমন দোষ হলো কে জানে ?
অবশ্য অনেকদিন ধরে ফরহাদ ভাই আমাদের বাড়িতে আসছে না। ঝগড়া হয়েছে নাকি দুইজনের? নাকি উনি তার দলের সঙ্গে ঢাকায় গান গাইতে গেছেন? কিন্তু ফিরে তো আসবেন, নাকি ঢাকাতেই থেকে যাবেন?
ওদিকে ফকির সাহেবের মৌখিক প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সাত নদীর পানি সংগ্রহের দায়িত্ব পড়েছে বাবার ওপর। আমার বেকার বাবা মনে হল কাজটা পেয়ে খুব খুশি। বাজার থেকে সাতটা স্বচ্ছ কাঁচের বৈয়ম কিনে আনা হলো। বাবা বড় একটা মানচিত্র আর সাধারণ জ্ঞানের বই নিয়ে প্রবল উৎসাহ নিয়ে বসলেন, নদীর অবস্থান ও নাম ঠিক করতে।

রাতুল, বলতো বাবা, বাংলাদেশে কয়টা নদী?

জানিস না? আমিও জানতাম না। এই দেখ সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে লেখা আছে- শাখা প্রশাখাসহ বাংলাদেশে আছে তিনশ দশ টা নদ এবং নদী । এখন এর মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে সাতটা নদীর পানি যোগাড় করতে হবে আমাদের।

শ্যামলীকে ডাক। ওই ঠিক করুক কোন সাতটা নদীর পানি দিয়ে ও গোসল করবে।

নদ নদীর পানি সংগ্রহ নিয়ে শ্যামলী খালার কোন আগ্রহই দেখা গেল না। আমি কয়েকবার ডাকতে গেলাম কিন্তু ও পাত্তাই দিল না, যেমন ঘাড় গোঁজ করে রান্নাঘরে বসে সবজি কুটছিল তেমনি কুচি কুচি করে আলু পেপে বরবটি কুটতেই থাকলো।

আমি স্কুলের পাঠ্যবই থেকে মুখস্ত করা সাতটা নদীর নাম বলে দিলাম বাবাকে। পদ্মা, মেঘনা, সুরমা, যমুনা, কর্ণফুলি, বুড়িগঙ্গা আর ব্র²পুত্র- ব্যাস !

বাবা বললো, আরে ব্বাস তাহলে তো সারা দেশ ঘুরতে হবে। অনেক সময়ের ব্যাপার! তাছাড়া খরচও লাগবে! আমার যেতে হবে আশে পাশের জেলায়, কাছে পিঠে যেসব নদী আছে সেইগুলিতে।

সপ্তাহখানেক ঘোরাঘুরি করে বাবা ঠিকই সাত বৈয়ম ভর্তি করে সাত নদীর পানি যোগাড় করে ফেলল। বৈয়মের গায়ে সাদা কাগজ লাগিয়ে নদীগুলোর নামও লেখা হলো। আত্রাই, ইছামতি,করতোয়া, পদ্মা, টাঙ্গন, তিস্তা আর দুধকুমার নদীর পানি। কোন পানির রং হাল্কা সবুজ যেন শৈবাল গুড়ো করে মেশানো, কোনটি শুকনা খড়ের মতো ম্লান হলদেটে, কোনটা মাটিগোলা পানির মত ঘোলা, কোনটা আবার স্ফটিকের মতো ঝকঝকে সাদা।

ফকির সাহেব শ্যমলী খালাকে সাতটা তাবিজও দিয়েছে। দুই হাতে, দুই পায়ে, গলায়, কোমরে আর মাথার চুলে সেই সাত তাবিজ বাধা হয়েছে।

আমরা ছোটরা অধীর হয়ে অপেক্ষায় আছি সাত রাস্তার মাথায় সাত নদীর পানি দিয়ে শ্যমলী খালাকে গোসল করানোর ঘটনাটা দেখবার জন্য।

জিকোর ধারণা এই গোসলের পর যখন অভিশাপ কেটে যাবে তখন রাতের অন্ধকারে পুরুষ মাছটা উড়ে উড়ে মেয়ে মাছটার কাছে অন্য নদীতে চলে যাবে। সেখানে সিনেমার নায়ক নায়িকাদের মতো তাদের দুইজনের দেখা হবে। মিলন হবে। মেয়ে মাছটা তখন অনেক অনেক ডিম পাড়বে। স্বর্নরেণুর মতো ছোট্ট ছোট্ট ডিম। আর তখন শ্যামলী খালার বিয়ে হতেও আর কোন বাধা থাকবে না।

কিন্তু কোনো গোঁফঅলা টাক মাথা পেটমোটা জাম্বু টাইপের লোকের সঙ্গে শ্যামলী খালার বিয়ে হলে আমাদের খুব মন খারাপ হবে। আমাদের পছন্দ ফরহাদ ভাইয়ের মতো হাসিখুশি লম্বা ছিপছিপে মানুষ। কিন্তু তিনি তো লাপাত্তা। শহরের শেষ মাথায় গোরস্থানের পেছনে খালের উপর একটা নড়বড়ে কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ফরহাদ ভাইদের বাড়িতে যেতে হয়। আমি আর জিকো মিলে একদিন গেলাম সেই বাড়িতে। ঢোকার পথেই দেখি খুটির সাথে দুইটা গরু বাধা। ঘাস বিচালি, গোবর আর কাদায় মাখামাখি বাড়ির সদর দরজা।

ফরহাদ ভাইয়ের লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরা দাড়িঅলা বাবার সাথে দেখা হলো।

‘ও, তুমি সুমাইয়ার ছেলে? আসো, বসো। তা তোমার বাবা কি এখন কাজ কাম কিছু করে, নাকি আগের মতোই বেকার ঘুইরা বেড়ায়? আহ্্হারে কি ভুল করলো সুমাইয়া, এখন সারা জীবন সেই ভুলের খেসারত দিতেছে ..’
‘ফরহাদ? ওই কুলাঙ্গারের কথা আর বইলো না, গান বাজনা ছাড়া তো আর কিছু করলো না, এখন কই আছে খোঁজ খবরও জানি না। জানাইলে না জানমু ! ফোন করলে ধরে না, নিজেও ফোন দেয় না, হইছে একটা বাউন্ডুইল্যা। তা তোমার নানী কেমন আছে? শ্যামলীর কি বিয়া হইছে?’

আমরা এরপর আর বসি না। উস্খুশ করে দ্রুত বেরিয়ে আসি। আমি শুনেছি ফরহাদ ভাইয়ের মা ছোটবেলায় মারা গেছে। তারপর তার বাবা আবার বিয়ে করেছেন, সেই মা মানে সৎ মার সঙ্গে ফরহাদ ভাইয়ের তেমন বনিবনা নেই। মা নেই বলে বাড়ির প্রতি তার টানও নেই। উনি বাড়িতে থাকলেন কি না থাকলেন তা নিয়েও মনে হয় বাসার কেউ মাথা ঘামায় না।

ওই বাসায় গিয়ে লাভের মধ্যে একটা লাভ হয়েছে ফরহাদ ভাইয়ের একটা ফোন নম্বর যোগাড় করা গেছে। উনার বাবাকে মিথ্যা করে বলেছি, মা চেয়েছে। কোনদিন যদি মা টের প্য়া তবেই হয়েছে, পিঠের উপর পড়বে গুড়ুম গুড়ুম। তবে সেটা নিয়ে আপাতত ভাবছি না। শ্যামলী খালা খুশি হলেই আমাদের মিথ্যা বলা সার্থক। সমস্যা হলো, আমাদের বাসায় মোবাইল ফোন একটাই, আর সেটা স্বাভাবিকভাবেই মায়ের। মা আবার সহজে ফোনটা আমাদের হাতে দিতে চান না। অবশ্য গনি চাচার দোকানে টাকা দিয়ে ফোন করা যায়। ফরহাদ ভাইয়ের ফোন নম্বরটা একটা কাগজে লিখে শ্যামলী খালার হাতে এমন ভাবে দিলাম যেন মহামূল্যবান হীরার টুকরা দিচ্ছি।

‘কিরে এইটা?’

‘ফরহাদ ভাইয়ের নম্বর, তুমি ফোন কইরা তারে আসতে বলো !’ আমি ফিসফিস করে বলি। শ্যামলী খালা খুব তাচ্ছিল্য ভরে কাগজটা নিয়ে একবার চোখ বুলায় তারপর দলামোচা করে ছুড়ে ফেলে।

‘বেশি মাতব্বর হইছস! তোর কাছে ফোন নম্বর চাইছি? ’

কি আশ্চর্য ! চাইতে হবে কেনো? আমি কি কিছুই বুঝি না? শিশু? তোমার জন্য চুরি করে নিজেই হলাম চোর। অভিমান হয় আমার। ছুড়ে ফেলা কাগজের টুকরাটা কুড়িয়ে নিয়ে জিকোর কাছে যাই।

‘মনে হয় ওদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে! চিরদিনের মতো..’

জিকো বিজ্ঞের মতো বলে। ব্রেক আপ শব্দটার সঙ্গে তখনো আমাদের পরিচয় হয়নি কিন্তু ভাঙ্গনটা বুঝি। ভাঙাভাঙি বিষয়টা ভাল নয় জানি। একটা গ্লাস ভাঙলেও মা রেগে গিয়ে পিঠে দুদ্দাড় কয়েক ঘা বসিয়ে দেয়। আর সম্পর্ক কি কাঁচের বাসন বা মাটির হাড়ির মতো ঠুনকো কিছু, যে এত সহজে ভেঙে ফেলা যাবে? খুব কষ্ট হয় আমার। গনি চাচার দোকানে গিয়ে ফরহাদ ভাইয়ের নম্বরে ফোন দেই। ওই পাশে ফোন বেজে বেজে থেমে যায়, কেউ ধরে না।

কিন্তু এত সহজে হাল ছেড়ে দেবো? আবার ফোন করি। আবার। শেষ পর্যন্ত প্রচÐ হৈ হট্টগোলের ভেতরে ফরহাদ ভাইয়ের গলা শোনা যায়।

‘কে? রাতুল? কিরে? কি হয়েছে?’

আমি সেই উচ্চশব্দ উপেক্ষা করে হড়বড় করে বলে যাই, শ্যামলী খালার বড় বিপদ, সাত নদীর পানি দিয়ে গোসল করিয়ে তাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তুমি যেখানেই থাকো, তাড়াতাড়ি চলে আসো।

ওপাশ থেকে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে, কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে, কেউ টিরিং টিরিং গিটার, এর মধ্যে কারো অস্পষ্ট সুরেলা গলা শোনা যাচ্ছে। ফরহাদ ভাই চিৎকার করে বললেন, ‘রাতুল, আমাদের তো এখন প্র্যাক্টিস চলছে। পরে কথা বলবো। এখন রাখছিরে। ভাল থাকিস।’

শ্যামলী খালাকে গোসল করানোর জন্য ঠিক সাত না, পাঁচ রাস্তার একটা মোড় খুঁজে পাওয়া গেছে। ফকির সাহেবের কথা মত বাজার থেকে সাদা রঙের নতুন কড়কড়ে সুতি শাড়ি কেনা হয়েছে। ওটা পরিয়ে কালকে দ্বিপ্রহরে শ্যামলীকে হলুদ গিলা দিয়ে গোসল দেয়া হবে। কিন্তু শ্যামলীর চোখ মুখ ভাবলেশহীন। সে আগে যেমন করতো তেমনি ভাবে নীরবে নিত্যকর্ম করে যায় যেন তার কিছুতেই কিছু আসে যায় না, যা হবার হোক।
আমি মনে মনে ভাবি নিশ্চয়ই ফরহাদ ভাই ঘোড়া ছুটিয়ে না হোক রাতের বাসে চড়ে বাড়ি ফিরে আসবে শ্যামলী খালাকে উদ্ধার করতে। রাতটা আমার নানারকম হিজিবিজি স্বপ্ন দেখে কাটে। দেখি শ্যামলী খালা একটা আলমারির কপাট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে, তার পেছন পেছন যাচ্ছি আমিও একদম ‘দি ক্রনিকলস অফ নার্নিয়া’ সিনেমার মতো তারপর একটা বরফে ছাওয়া প্রান্তর ধরে আমরা ছুটে যাচ্ছি , দেখি মাও আসছে আমাদের তাড়া করে একটা লাঠি হাতে সাদা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে, তারপর দেখি একটা নদী তারপর দেখি আমাদের স্কুলের মাঠ দপ্তরি চাচা ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজাচ্ছেন, আমার মনে হলো আজ অংক পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিলো আর আমি সেটা বেমালুম ভুলে গেছি..

আমার ঘুম ভাঙল মায়ের চেঁচামেচিতে। অযথাই চিল্লানো মায়ের চিরকালীন স্বভাব। তাই আমি তেমন গা করি না। ধীরে সুস্থে বাইরে এসে বাবার কাছে জানতে চাইলাম, কি হয়েছে?

কী আর হবে, সকাল থেকে শ্যামলীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

‘রাতুল, তুই জানিস কিছু?’ মা আমাকে জেরা করতে শুরু করেন। কিন্তু আমি কি করে জানবো শ্যামলী খালা কোথায় ? নানী বিন বিন করে কাঁদছেন ঘরের কোনায় বসে। একেকবার অভিযোগহীন সুরে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শ্যামলী খালা মায়ের সৎ বোন আর তিনিও মায়ের সৎ মা।

‘শ্যামলী যদি তোমার আপন বইন হইত, তাইলে কি পারতা …’

বাবা চাপা স্বরে মায়ের উপর দোষ চাপাচ্ছেন,

‘তোমার জন্যই.. তুমিই মেয়েটাকে বাড়ি ছাড়া করলে.. ‘

মাকে দেখাচ্ছে আহত বাঘিনীর মতো, একেকবার গর্জন করছেন আবার নেতিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভব অসম্ভব কোনো জায়গাতেই মা খুঁজতে বাকি রাখলেন না। পুলিশকেও জানালেন। কিন্তু আমাদের ছোট্ট শহরে শ্যামলী খালাকে কোথাও আর পাওয়া গেল না। শ্যামলী খালা কি তবে ঢাকায় চলে গেল ফরহাদ ভাইয়ের কাছে? জানি না। গনি চাচার দোকানে গিয়ে ফরহাদ ভাইয়ের নম্বরে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু বার বার একটা যান্ত্রিক নারী কন্ঠ বলতে থাকলো, এই নাম্বারটি এখন বন্ধ আছে।

আমাদের ঘরে সাতটা স্বচ্ছ বৈয়মে সাতটা নদীর পনি বন্দী হয়ে স্তব্ধতায় জমে রইল। দুই নদীতে পথ হারিয়ে ঘুরতে থাকা দুইটা দুঃখিত দিশেহারা মাছ দুটির জন্য আমার খুব মন খারাপ হলো। আহা, তাদের বুঝি আর মিলন হলো না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত