| 29 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৩) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।

অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


 

 

তার যখন ঘুম ভাঙল তখন চারপাশে ফটফটে আলো। মাথার পাশের জানালা দিয়ে সকালের আলো এসে প্রবেশ করেছে। শ্রীমান ধড়ফঢ় করে উঠে বসল। অবাক হয়ে প্রথমে সে তার শোবার ঘরের চারপাশে চোখ পিটপিট করে তাকাল। তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে দরজা খুলে বাইরে এল। সোজা গিয়ে খবরের কাগজটা দিয়েছে কিনা দেখল। দিয়েছেদিয়েছে। সে লাফ মেরে সিঁড়িতেপড়ে থাকা খবরের কাগজটা তুলে নিল। তার বুকটা ধপধপ করতে শুরু করেছে।

‘ ব্রহ্মপুত্রের বালিতে মৃতদহ’– কালো বড়ো অক্ষরের শিরোনামটা দেখার জন্য সে কাগজটা মেলে  নিল। বুকের মধ্যে ধপধপ শব্দ নিয়ে সে কাগজটা দেখতে লাগল। মানুষটা কে ছিল সেই বিষয়ে তার ভীষণ কৌতূহল হল। মুখটা  পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল। জানা যাবে। খবরটা পড়লেই এখন জানতে পারবে।

সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  খবরের কাগজের হেডিংগুলি পড়তে লাগল।

কোথায়, নেই তো! কোথাও নেই। কোথাও কোনো মৃতদেহের কথা নেই । আশ্চর্যের কথা । কী হল? এই খবরের কাগজটা কোনো খোঁজ খবরই পেল না কি?

সে এদিকে- ওদিকে তাকাল। অবাক হয়ে আবার খবরের কাগজটা দেখল। তারপরে সে তখনই ভেতরে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে  নিল। মায়েরদেওয়া চা খেয়েনিয়ে সে অনায়াসে ফাঁকি মারল।

‘আমাদের সঙ্গের যে অনাদি,তোর মনে পড়ছে মা?অনাদির বাবাকে কাল হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। তাই রাতে ফিরতে দেরি হয়ে গেল। দশটা টাকা দে তো। এখনই মেডিকেল কলেজে যাব।’

মা তাড়াতাড়ি করে দুটো পাঁচ টাকার নোট বের করে দিল ।ইস। রাতে যে কী সব দুশ্চিন্তা করছিল। শ্রীমান মেডিকেল কলেজে রোগীর সঙ্গে ছিল!

‘চা খেয়েযা।এখনই রুটি হয়ে যাবে।’

‘ না না পরে খাব। এখন দরকার নেই।’ শ্রীমান ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সিটি বাস স্টপেজের কাছে বই-ম্যাগাজিন বিক্রি করা ঘুমটিটার কাছে সে দ্রুত এগিয়ে গেল।পরিচিত দোকানটিতে গিয়ে সে এক এক করে প্রত্যেকটি খবরের কাগজ পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।ইস। কী আশ্চর্য! কোথাও দেখছি ঘটনাটির খবর নেই। ঘটনাটা কেউ জানতেই পারল না নাকি! কী আশ্চর্য। সন্ধেবেলা ঘটা ঘটনাটির খবর কোনো কাগজে নেই।

একটা সিটি বাস এসে যাওয়ায় কাগজ দেখা ছেড়েদিয়ে সে হঠাৎ বাসটিতে লাফ মেরে উঠল। কী এক বোঝাতে না পারা দুর্বার আকর্ষণে সে রামচাপাহাড়ের নিচের সেই বালুচরটার দিকে এগিয়ে গেল। কী একটা যেন তাকে টানছে– নিজের অজান্তে তাকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে চলেছে রামচাপাহাড়ের নিচের খাদানটার দিকে, তার ভয় করতে লাগল, চিন্তা হল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল, জায়গাটিতে আরও একবার ফিরে যাওয়া যে খুব একটা ভালো কথা হবে না,বড়ো নিরাপদ হবে না, সেকথাও সে উপলব্ধি করল। কিন্তু সে নিজেকে বাধা দিতে পারল না।না,বাধা দিতে পারেনা। খাদানের পাপড়ের মতো মুচমুচে বালিগুলি তাকে চুম্বকের মতো টানছে।


আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-২) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


উজান বাজারে বাস থেকে নেমে এসে একটা ট্রাক জোর করে থামিয়েখারগুলিতে গেল। এটাও বালি টানা ট্রাকই। ড্রাইভারটা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ভাবে তাকে উঠিয়েনিল। সে তার হাবভাব দেখে ভয়ও পেয়েছিল।

খাদানের রাস্তাটা দিয়ে ট্রাকটা দ্রুত নেমে যেতে লাগল।

শ্রীমান লাফ দিয়ে ট্রাক থেকে নামল।

খাদানের বালির গর্ত গুলির কাছে সে দৌড়ে গেল।

মাত্র দুটি ট্রাক খাদানে রয়েছে। দুটি লেবার বালি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ।

পাগলের মতো সে গর্তটা খুঁজতে লাগল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই সেই গর্তটা হবে। সে দৌড়ে গর্তটার পারে গিয়ে দাঁড়াল।

খালি! গর্তটা খালি? তাতে কেউ নেই। কী হল, কোথায় গেল! সেই মানুষটা কোথায় গেল?এটাই সেই গর্তটা। মানুষ উঠা–নামা করার চিহ্ন আছে।ভেতরের বালির ওপরে মুগা রঙের একটা দাগ আছে।হ্যাঁ,হ্যাঁ,সেটা রক্তের দাগই হবে। কাঁচা রক্তে বালি ভিজে উঠেছে। সিদ্ধচা পাতার স্তরের মতো একটা দাগ!

কিন্তু মানুষটা?মানুষটা কোথায়?মানুষটা কোথায় গেল? এটাই সেই গর্তটা তো ? শ্রীমান উদভ্রান্তেরমতো একের পর এক খাদানের গর্তগুলি দেখে যেতে লাগল। খালি প্রতিটি খালি।

‘কী হল বাবু?’– খাদানের বালি তুলতে আসা লেবার জিজ্ঞেস করল ।

বাকরুদ্ধ শ্রীমান তার দিকে কেবল ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হল না।

কোথায় গেল? মানুষটা কোথায় গেল?

শ্রীমানেরহঠাৎ মনে হল সে কি ভুল করছে নাকি? গত রাতের ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছিল তো? কী আশ্চর্যের কথা ভাবছিআমি?সে পুনরায় নিজেকে প্রশ্ন করল। আমি নিজে দেখা, নিজে শোনা কথার ওপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি। কী আশ্চর্য!

সে নিজের মাথাটা একবার নাড়িয়ে দিল।

তারপর সে গর্তটার দিকে তাকাল।

হ্যাঁ।এটাই সেই গর্ত! এটাই। তার ভুল হয়নি। গত রাতের গর্ত এটাই। এই যে তীরের বিলি খসে পড়ার চিহ্ন আছে। হ্যাঁ– এই যে বালি খসে যাওয়ার চিহ্ন রয়েছে। গৰ্তের নিচে কিছুই নেই– কোনো চিহ্ন নেই। আশ্চর্য, পায়ের ছাপও নেই। তার নিজের পায়ের দাগটাও নেই। রাতের বাতাস বালি উড়িয়ে এনে পুঁতে ফেলেছে। নিশ্চিহ্ন  করে দিয়েছে সমস্ত চিহ্ন।

খাদানের গর্ত গুলির ওপর দিয়ে সে ব্রহ্মপুত্রের সমগ্র বালিচরটার দিকে তাকাল।

ব্যস্ততা বেড়ে চলেছে। খাদানে ব্যস্ততা বেড়ে চলেছে। বালি টানতে আসা ট্রাকের গর্জন আরম্ভ হয়েছে।বালিকাটা শ্রমিকদের চিৎকার- চেঁচামেচি, হাসি-স্ফুর্তির শব্দ বেড়ে চলেছে। দিনটির ব্যস্ততা আরম্ভ হয়ে গেছে পুরোদমে।

পাতলা বেগুনি রঙের বাতাস বইছে কোমল সবুজ রঙের আকাশ থেকে। আজ মেঘ নেই। আকাশ ফটফটে হয়ে আছে। ব্রহ্মপুত্র পারের মুচমুচে বালি গুলি মুহূর্ত মুহূর্তে গোলাপি, নীল ,হলুদ হয়ে পড়ছে।

সম্মোহিতহওয়ারমতো শ্রীমান গর্তটার দিকে তাকিয়েরইল।

কত সময় পার হয়ে গেল সে বুঝতেই পারল না।

গর্তটার সামনে তার পায় যেন শিকড় গজাল। নড়াচড়া না করে সে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়েরইল। হ্যাঁ ,একই জায়গায় সে পাথরের মূর্তির মতোদাঁড়িয়েরইল।

কেউ তার কাঁধে হাত রাখায় তাঁর সম্বিত ফিরে এল।

সে চমকে উঠল। ফিরে তাকিয়ে দেখে একজন মানুষ তার দিকে একদৃষ্টেতাকিয়ে রয়েছে। তার হঠাৎ ভয় লেগে গেল। কে এই মানুষটা?কে এই মানুষটা যে একদৃষ্টে তার দিকে এভাবে তাকিয়ে রয়েছে– চোখের পলক না ফেলে।

শ্রীমানের সমস্ত শরীরটা সিরসির করে উঠল।

কে?কে এই মানুষটা!

‘ আপনার কিছু চাই নাকি?’ মানুষটা বেশ শান্তভাবেজিজ্ঞেস করল।

‘ না, না এমনিতেই’ শ্রীমান একবার মানুষটার দিকে একবার গর্তের দিকে তাকাল।

‘ আপনার বালি চাই নাকি?’– আমি খুব ভালো পলিমাটি দেব, শুকনো ঝুরঝুরেবালি নয়, একেবারে খাস পলিমাটি দেব। পলিমাটি ফেলে শাকসব্জির চাষ করতে পারবেন।’

শ্রীমান ঢোক গিলল।

‘ সমগ্র গুয়াহাটিতে আমার মতো ভালো মাটি কেউ দিতে পারবেনা। কত মাটি লাগবে বলুন’, মানুষটা বলে গেল।’ উনিশটা ট্রাক আমার একটা খাদানে চলে। তিন দিনে যদি দীঘলি পুকুরটা পুঁতে দেবার প্রয়োজন হয় আমি পুঁতেদেব।হেঃহেঃহেঃ।’ মানুষটা  একটাদিলখোলা হাসি হাসল। তার হাসিটা বাতাসের পিঠে উঠে বালুচরের ওপর দিয়ে যেন বহু দূরে ছড়িয়েপড়ল।’ এক ট্রাক মাটি লাগে, এক হাজার  ট্রাক লাগে আমি সাপ্লাই দেব। ট্রাক হিসেবে লাগে,কিউবিক মিটার হিসেবে লাগে, আপনি কেবল আমাকে বলে দিন। কোনো চিন্তা নেই।’

শ্রীমান মানুষটার দিকে তাকাল। মানুষের মুখটা দেখছি পরিচিত পরিচিত বলে মনে হচ্ছে।আঃ এটাই কালকের মানুষটা নয় তো? দেখতে একেবারে অবিকল এক! শ্রীমান একবার মানুষটার মুখের দিকে, একবার গর্তটার দিকে তাকাল।হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ এই গর্তে পড়ে থাকা মানুষটা– হাঁ করে থাকা মানুষটা–এক,একই দেখতে! সত্যিই এক!

শ্রীমানের শরীরে যেন কম্পন উঠল। সিরসির করে সমস্ত শরীরে কম্পন ছড়িয়েপড়ল– সমস্ত শরীরের লোমগুলিখাড়া হয়ে উঠল। খালি গর্তটার দিকে তাকিয়ে সে পুনরায় মানুষটার দিকে তাকাল।

‘ এই গর্তটা…’– শ্রীমান হঠাৎ বলে উঠল।

‘ না না, এটার মাটি আরও ভালো নয়। নিচের বালি উঠানো কষ্ট। এই গর্তটার মাটি আপনার চাই? এই গর্তটার মাটি আপনার চাই!কেন?’

‘ না না–মাটি, মাটি আমার চাইনা! এই গর্তটা…’

‘ এই গর্তটা কি?’

‘ এই গর্তটাতে কিছু ছিল নাকি?’

‘ গর্তটিতে, এই গর্তটিতে?কী, কী জিনিস থাকার কথা বলছেন।’

মানুষটা অবাক হল। তিনি শ্রীমানকে খুব তীক্ষ্ণভাবে দেখতে লাগলেন।

‘ একটা মানুষ।’

‘ মানুষ? মানুষ ?কী মানুষ?’ মানুষটার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। অবাক হওয়ারমতো তিনি শ্রীমানের দিকে তাকালেন।

‘ মরা মানুষ।’- বলব না বলব না করে শ্রীমান বলল।

‘মরা মানুষ!’ মানুষটা আরও অবাক হল। সন্দেহের চোখে একবার শ্রীমানের মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাকাল। তার চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে শ্রীমান যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ে গেল। তার ভয় হল। বুকটা একবার দুরুদুরু কেঁপে উঠল।

‘কী মরা মানুষের কথা বলছেন আপনি?’- মানুষটাকঠিনভাবেজিজ্ঞেস করল।

‘না, হাতটা সরিয়ে শ্রীমান মানুষটার মুখের থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়েনিল। তারপরে সে আর সেখানে দাঁড়াল না। রাতে পালিয়ে আসার মতো সকালেও সে গর্তটির কাছ থেকে পালিয়ে এল।

‘ সকাল সকাল কোথাকার সব পাগল এসে জুটে’, মানুষটাকে পেছনে বিড়বিড় করতে শুনল সে। আজ সকাল সকাল দিনটিই বরবাদ।’

শ্ৰীমান আর সেখানে দাঁড়াল না। হন হন করে সে হেঁটে এসে রাস্তায় উঠল। কোনো দিকে না তাকিয়ে সে পাকা রাস্তা দিয়েখারগুলির দিকে আসতে লাগল। কিছুক্ষণ আসার পরে তার চেষ্টা পেল। আসলে আগেই তার পিপাসা পেয়েছিল। কিন্তু চিন্তা‐ভাবনার  মাঝে সে কথাটাকে খুব একটা বুঝতে পারেনি। বাড়িতেসকালবেলা এক কাপ চা খেয়েইবেরিয়ে এসেছিল– শুধু এক কাপ চা। তার এক কাপ চা খেতে খুব ইচ্ছা করল। পকেটটা হাতড়ে দেখল। নেই, কোথায় থাকবে‐তারপকেটেতোটাকাথাকবারকথাইনয়।কোথাথেকেথাকবে! মায়েরকাছথেকেনেওয়াটাকাদশটাওসেবাড়িতেইফেলে এসেছে। ইস! শোবার ঘরের টেবিলের ওপরে কিছু খুচরো পয়সা পড়েছিল। বহুদিন থেকেই সেই পয়সা গুলি পড়ে আছে। কয়েক টাকা হবে। আসার সময় হাতে করে নিয়ে এলেও কাজে লাগত। তবু সে শার্ট এবং প্যান্টের পকেট গুলি আবার হাতড়ে দেখল। শার্টের পকেটের ভেতরে কিছু একটা কাগজ তার হাতে লাগল।কী? কী কাগজ এটা?সে তাড়াতাড়ি করে কাগজটা বের করে আনল। একটি পুরোনো হয়ে যাওয়া দু টাকার নোট। কবে হয়তো সে রেখেছিল।ইস, সকালে সে অন্য একটা শার্ট পরে এসেছে। কাল রাতে পরা কাপড়গুলি তো সে ধুয়ে দেবার জন্য রেখে এসেছে।আগে পরা শার্টটাদেওয়ালের হুকে ঝুলিয়ে রাখা থেকে সে প্রায় না দেখেই পরে চলে এসেছে। ভাগ্য ভালো তার পকেটে দু’টাকা ছিল।

রাস্তার পাশে তৈরি একটা চালাতে সে ঢুকল। এখানে চা পাওয়াযায়। বাঁশের ফ্রেমের ওপরে দুটো তক্তা পেতে দিয়ে বাইরে একটা বেঞ্চ বানিয়ে রাখা আছে। বেঞ্চে বসে চা বানাতে  থাকা মানুষটাকে সে এক গ্লাস লাল চা এবং এক টাকার কাটা নিমকি দিতে বলল। ব্যস, সুন্দর করে সকালের চা খাওয়া হয়ে যাবে।

‘ কাটা নিমকি প্লেট দু টাকা’- মানুষটা  উত্তর দিল।

‘এক টাকায় হাফ প্লেট দাও’- সে গম্ভীর ভাবে বলল।

মানুষটাঅসন্তুষ্ট মনে এক গ্লাস লাল চা আর দু একটা কাটা নিমকি একটা প্লেটে এনে তার সামনে ধপাশ করে রাখল।

আরামে লাল চায়ে চুমুক দিয়ে সে কাটা নিমকি চিবোতে লাগল।

মানুষটা কেন এভাবে তার দিকে তাকাল, শ্রীমান ভাবল। সে কিছু জানে নাকি? মানুষটাকে সে দেখেছিল নাকি? কথাটা সে জানে নাকি? না হলে কেন সে এভাবে তাকাবে? নিশ্চয়ই সে কিছু জানে।আর, আর সে আমাকেও কোনো সন্দেহ করছে নাকি? আমার মুখ থেকে মরা মানুষের কথাটা বের হওয়ার কি দরকার ছিল? এখন কথাটা বলে আমি বিপদে পড়লাম না তো?

শ্রীমান কাটা নিমকি চিবোতে ভুলে গেল।

কাল আমার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটল। আর আমি মরা মানুষের কথা বলতেই মানুষটা জেনে গেল যে আমি কথাটার বিষয়ে জানি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার মানে ওরাভাববে যে আমি ঘটনাটার আই উইটনেস। প্রত্যক্ষদর্শী! হ্যাঁ ভাববেই তো, নিশ্চয়ভাববে। জানতে পেরে গেছে যে আমি নিশ্চয়ঘটনাটার বিষয়ে জানি। আর আজ, সেখানে মৃতদেহটি নেই! নাই হয়ে গেল। আশ্চর্য ভাবে সেই সবুজ মুখের মানুষটারমৃতদেহটা নেই। কেউ হয়তো রাতের মধ্যেই সরিয়ে ফেলেছে। আর আজ সকালে আমি মূর্খের মতোমৃতদেহটির কথা মানুষটাকে বলে ফেললাম। জানতে তো পেরেই গেল! এখন,এখন  যদি তারা আমার খোঁজে আসে…। শ্রীমান এবার জ্বরে ঘামারমতোঘামতে লাগল।

সে চোখের সামনে দেখল সে রাতে অন্ধকার রাস্তা দিয়েবাড়িতে যাচ্ছে।

চারপাশে অন্ধকার। দূরে কোথাও একটা-দুটো রাস্তার লাইটের হালকা হলুদ আলো। কোনোটা ঘরের জানালায়নিয়ন, কোনোটারজানালায় সাধারণ লাইটের বাল্বেরঅনুজ্জল আভা। ঘরের ভেতরের লাইট রাস্তায় এসে পড়ছে না। রাস্তাগুলি ঘুটঘুটে অন্ধকার।

ওদেরবাড়িতে যাওয়া রাস্তাটাতে অন্ধকারে একটা মারুতি ভ্যান অপেক্ষা করছে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ একটা বাড়িতে ভ্যান অন্ধকারে অপেক্ষা করছে। একেবারে কাছাকাছি চলে আসায় সে গাড়িটা দেখতে পেয়েছে। সে কিছু ভাবার আগেই ভ্যানের দরজাটা খুলে গেল। দুটো ছায়া মূর্তি ভ্যান থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং তারা তাকে তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলেছে। সে কিছু বলার, কিছুকরার আগেই ওরা তাকে জাপটে ধরে ফেলেছে।

আঃ সে মুখ দিয়ে একটা শব্দও করতে পারল না। বাধা দিতে পারল না। ওরা তাকে   অবলীলা ক্রমে ভ্যানেউঠিয়ে  নিল। দুটো মানুষ তাকে মুখে চাপা দিয়েভ্যানেবসিয়ে দিল। তার মুখে ওরা নোংরা, তেল মবিলেরছিটে লাগা গাড়ি মোছা কাপড়টা তার মুখের মধ্যে গুঁজে দিল। মুখটা তার গোল হয়ে হাঁ করে রইল। হাত দুটো পেছনে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। চোখে রুমাল জাতীয় কিছু একটা বেঁধে দিল।

সেনাড়াচড়া করতে পারে না, মুখ দিয়ে কথা বলতে পারছে না, চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার মাথার কাছে কেউ কিছু একটা ধরল। শক্ত লোহার মতো। বন্দুকের নল নাকি? বন্দুকের নলই হবে।তার কানের ওপরে ব্যথা করছে।

‘ নাড়াচাড়া করবি না। গন্ডগোল করলেই গুলি করে দেব’-কেউ একজন কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল।’ চুপ করে বসে থাক।’

মারুতি ভ‍্যানটা চলছে। কোনো একটি জনবহুল অঞ্চল দিয়েগাড়িটা যাচ্ছে। ব্যস্ত রাজপথের কোলাহল এসে তার কানে পড়ছে। গাড়িটাটার্নিংনিয়েছে। সাইরেন  বাজিয়ে কোনো ভিআইপিরগাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে। ভ্যানেরস্পিডটা একটু কমে গেছে।

একটা উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়েগাড়িটা চলেছে– এইবার নিচের দিকে নামছে। কোথায় নামছে? বালির খাদানে? ব্রহ্মপুত্রের তীরে? ভ্যানের খোলা জানালা দিয়ে নদীর তীরের জল জল, বালি বালি গন্ধ ভেসে আসছে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা ব্রহ্মপুত্রের তীর!বালিরখাদান!

শব্দ করে গাড়িটাথেমে গেছে। দরজা খোলা হয়েছে। তাকে কেউ ধরে ঠেলে নামিয়ে দিচ্ছে। সে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। পারছে না। বাধা দিতে পারছে না! ওরা তাকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়েছে। সে নড়বড়েপায়েকোনোরকমেদাঁড়িয়েছে। কেউ হঠাৎ হাঁটুর পেছনদিকে লাথি বসিয়েদিয়েছে। তার পা দুটো ভাঁজ খেয়েপড়েছে। দু বাহুতে ধরে ওরা তাকে হাঁটু মোড়ে  বসিয়েদিয়েছে। লোহার নলের খোঁচাটা মাথার পেছন থেকে সরে গেছে।

আঃ একটা বিস্ফোরণ–একটা বিস্ফোরণ…।

কাটা নিমকি খেতে খেতে শ্রীমান দাঁড়িয়েপড়েছে।তাঁর সমস্ত শরীরটা দরদর করে ঘামছে। হাত পা গুলি কাঁপছে। জিভ শুকিয়ে তালুতে লেগে যাচ্ছে।

তার মাথা ঘোরাচ্ছে।

সে এখন পড়ে যাবে নাকি? পড়ে যাবে সে?

‘কী করছ এখানে?’

কারও কণ্ঠস্বর শুনে সে ধড়মড় করে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। সেই বালির খাদানে দেখা হওয়ালোকটাস্কুটারএকটাতে বসে তার দিকে চোখ বড়োবড়ো করে তাকিয়ে রয়েছে।

আঃ সেই বালি খাদানেরমানুষটা–শ্রীমানের  যেন কোটর থেকে চোখ জোড়াবিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসবে।

‘ সকাল সকাল মরা মানুষ খুঁজে বেড়াবেন না’, মানুষটাঠান্ডা সুরে তার দিকে তাকিয়ে বলল। তার চোখ দুটি থেকে যেন বেগুনি আলো বেরিয়ে আসছে।’ না হলে বিপদে পড়বেন।’

কথাটা বলেই মানুষটাস্কুটার চালিয়ে চলে গেল। শ্রীমান মানুষটা টলমল করে উঠল। তার চারপাশের পৃথিবীটাও যেন টলমল করে ঘুরে উঠল। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে সে বেঞ্চটাতে বসে পড়ল। দুই হাতে সে তাড়াতাড়ি করে ডেক্সের তক্তাটা খামচে ধরল। তার হাত লেগে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া লাল চায়ের গ্লাসটা মাটিতে ছিটকে পড়ল।

‘ ক‍্যায়াহুয়াবাবু  ক‍্যায়াহুয়া’ শশব‍্যস্তদোকানি উঠে এল। মাটিতে পড়ে যাওয়ার গ্লাসটা  সে তুলে নিল।

শ্রীমান অবাক হয়ে দোকানির দিকে তাকাল–কে? কোন মানুষ এটা! কোথা থেকে আসল সে? কেন এসেছে এখানে!

‘ আপকামৃগী রোগ হ্যায়ক্যায়া?’– দোকানি তাকে জিজ্ঞেস করল। সে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস লাল চা এবং একটা জগে একজগ জল এনে দিল।

‘ মুখ-হাত ধোলিজিয়ে।’

সেজল ঢেলে দিল। শ্রীমান যান্ত্রিকভাবে মুখে জলের ছিঁটে দিল।

তার একটু ভালো লাগল। বেঞ্চটাতে বসে মানুষটাএগিয়েদেওয়া লাল চা খেল।আঃ, দিনের বেলাতেইআমি কী দুঃস্বপ্ন দেখলাম। সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি তাকে পুনরায় একবার নাড়িয়েদিয়ে গেল।

আঃ দাঁড়িয়ে থাকা মারুতি ভ্যানটা।

মাথার পেছন থেকে ধাতব নলের স্পর্শটা।

সে নড়বড়েপায়ে উঠে দাঁড়াল।

‘ আপ খাদান মে গিয়া থাক‍্যায়া?’ দোকানি তাকে জিজ্ঞেস করল।

‘ওহ জায়গা ঠিক নেহি হ‍্যাঁয়।’

শ্রীমানের মাথাটা হঠাৎ ঘুরে যাওয়ার মতো মনে হল।

মাতাল মানুষের মতোনড়বড়েপায়ে সে বেঞ্চ থেকে উঠে রাস্তায় চলতে শুরু করল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত