| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প:   অনুস্মারক । অর্ণব দে

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

                                                              

গতকালের তুলনায় আজ কলকাতার তাপমাত্রা দু ডিগ্রি বেড়েছে। এদিকে খবরে বলছে, আবহাওয়া দপ্তর থেকে নাকি জানিয়েছে যে বৃষ্টি হবার কোনরূপ সম্ভাবনা নেই।

না! এদের কথায় কোনো বিশ্বাস নেই। যা বলে ঠিক তার বিপরীতটাই হয়। যদি জানায় বৃষ্টি হবে, তাহলে বৃষ্টি একেবারেই হবে না। আর যদি জানায় বৃষ্টি হবার কোনরকম সম্ভাবনা নেই, তাহলে নিশ্চিত হবে, যথাসম্ভব হবে, এবং বাইরে বেরোলে ছাতা সঙ্গে নিয়েই বেরোতে হবে। যাক গে, সন্তু ছাতাটা বার করে দেখল সেটা ঠিক-ঠাক আছে কিনা। বছরের প্রথম বৃষ্টি হলেও ভিজবার  বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। তার আবার সর্দি লাগার ধাঁচ আছে কিনা। মাথায় বৃষ্টির জল লাগলেই হাঁচি হাঁচি ফ্যাঁথ ফ্যাঁথ শুরু। রুমাল ভিজে একাকার হলে, অফিসও কামাই করতে হবে।  

দক্ষিণ কলকাতার একটি ছিমছাম ফ্ল্যাটে সন্তু একা থাকে। মা বাবা থাকেন অন্য জেলায়। চাকরির সূত্রে তার এখানেই বসবাস। বাজার হাট সে আগেই সেরে রাখে। শুধু সকালে রান্নার পাঠ চুকিয়ে, নেয়ে খেয়ে তাকে প্রস্তুত হতে হয়। তারপর অফিসের জন্য বেড়িয়ে পরা। বাড়ি থেকে বেরোলেই সামনে রিক্সার স্ট্যান্ড। রিক্সায় চেপে দেড় দু কিলোমিটার পর বাস স্টপেজ। বাসে চেপে পনে দু ঘন্টার রাস্তা। সেখানে নেমে আবার পায়ে হেঁটে দশ-পনেরো মিনিট সময় লাগে তাকে অফিস পৌঁছতে। অফিসে ঢুকে, গুড মর্নিং-এর মহা পরব সেরে সোজা নিজের ডেস্কের দিকে প্রায় একপ্রকার লং জাম্প মেরে ঝাঁপিয়ে পড়া, আর তারপর কি-বোর্ডে ঝড়ের বেগে ঠাকা ঠাক,-ঠক, ঠক, আওয়াজ করে কাজের শুভারম্ভ। আওয়াজ শুনে মনে হবে যেন বন্দুক থেকে এলোপাথারি গুলি ছুটছে। কাজের বেস্ততায় হয় কখনও দুপুর দুটোয় নয়তো কখনও আড়াইটের সময় মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে ফেলতে হয়। তারপর আবার কাজ। কাজ করতে করতে সূর্যের আলো ক্ষীণ হয়ে আসে। সন্ধ্যে নামে। তারপর বাড়ি ফেরার পালা। রবিবার ছাড়া রোজ এই নিয়মেই চলতে হয় তাকে। আজ শুক্রবার। আটচল্লিশ ঘণ্টা পেরোলেই রবিবারের সকাল সে দেখতে পাবে। তারপর সারাদিন বিছানায় ল্যাধ খেয়ে শুয়ে গত ছয়দিনের হার খাটুনি পরিশ্রমের পুরো প্রতিশোধ তুলবে। শরীর তখন নরবেও না চরবেও না। বিছানা তখন যেন নিরুপায় ভাবে বলে উঠবে, ছেড়ে দে ভাই কেঁদে বাঁচি।

সকাল সাড়ে আঁটটার বাস ধরতে হয় তাকে। তাই দেড়ি না করে রোজকার মতন সন্তু প্রস্তুত হয়ে ঘড়ে তালা চাবি মেরে বেড়িয়ে পরল। গন্তব্য স্থল – অফিস। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রিক্সায় চেপে বসল। সোজা বাস স্টপেজে নেমে ভাঁড়া চুকিয়ে তারপর দিল এক ছুট। বাস ছেড়ে দিয়ে ধীর গতিতে যাচ্ছে। তখন সন্তুর প্রান যায় যায় অবস্থা। এটায় না চরতে পারলে আঁধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফের আরেকটা বাস পাবে। তার অবশ্য দরকার নেই, সে বাসে উঠে দাঁড়িয়েছে। তবে বসবার আর জায়গা নেই। কিচ্ছুক্ষণ বাস ছুটল। সন্তু বাসের ভেতর এক কোণে দাঁড়িয়ে। তারপর হঠাৎ আকাশের দিকে তাকাতেই সে চমকে উঠল। উঁকি মেরে জানলার বাইরে দেখে, উত্তর-পশ্চিম আকাশের কোলে কালো মেঘ। কিছুক্ষণ পর আরেকবার চমকে উঠল যখন ব্যাগের ভেতর হাত  বুলিয়ে দেখে ছাতা নেই। ছাতা কোথায় গেল? নিজেকে প্রশ্ন করতেই মনের ভেতরটা রাগান্বিত শব্দে বলে উঠল, আপনি ছাতাটা বাড়িতে ফেলে রেখেই চলে এসেছেন স্যার। যা! কি হবে এবার? ঘরেও কেউ নেই যে তাকে ফোন করে একবার জানান দিত। এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। নয় হাত ঘড়ি, নয় সান গ্লাস, নয় এটা, নয় সেটা। কিছু না কিছু ভুলে আসতেই হবে। তা না হলে ব্যাচেলার জীবন সার্থক হয় কিভাবে? এসব ঘটনা বারবার মা কে জানানোও সম্ভব নয়। বললেই বিয়ের প্রসঙ্গ উঠে আসবে, আর তারপর ব্যাচেলার জীবন জিন্দাবাদ বলে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ানোও যাবে না। সব দিকেই সমস্যা। আরেকবার ব্যাগে ভালো করে হাত বুলিয়ে বেশ করে খুঁজে টুঁজে শেষবারের মতন নিশ্চিত হল যে ছাতার একটা ছ’ ও সে সঙ্গে নিয়ে আসেনি। যাক গে! কুছ পরোয়া নেহি! বৃষ্টি হবে না। এরকম ভয় দেখানো মেঘ এর আগে অনেক দেখেছি। এক দু ফোটা বৃষ্টি হয়ে শেষে দম ফুঁড়িয়ে যায়। এই কথাটাই সন্তু তখন মনে মনে আওড়াচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঝড়ো হাওয়া দিল, আর তার কিচ্ছুক্ষন বাদেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু।            

ক্রিকেট খেলার শুরুতে প্রথম বলেই শূন্য রানে আউট হলে ব্যাটসম্যানের মগজটা যেমন টনটন করে ওঠে, ঠিক সেরকমই সন্তুর মগজটাও বেশরকম টনটন করে উঠল। ভুরুটা বিধঘুটে ভাবে কুঁচকিয়ে গেল তার। মনে হচ্ছে যেন, বৃষ্টি নামক কোন এক মানুষের ওপর তার কতদিনের কত্ত রাগ। আরেকবার জানলার দিকে তাকাতেই দাঁতটা কিড়মিড় করে উঠল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বেটে মোটা লোক মৃদু স্বরে বলে উঠল, “হালার বৃষ্টি! সময় গময় নাই।“ সত্যিই তো! আর সময় পেল না। বাসে জানালার ধারে বসে থাকা যাত্রীরা একে একে কাঁচ বন্ধ করে দিল। বৃষ্টির জল কাঁচের গায়ে লেগে বাইরের সব দৃশ্য ঝাপসা করে ফেলল। বছরের প্রথম বৃষ্টি একটু হলেও মনটাকে উদাসীন করে দিল সন্তুর। সে ভাবল, বাস থেকে নেমে কোথাও একটু মাথা গোজার ঠাঁই পেলেই হল। না হয় একদিন অফিস দেড়ি করেই পৌঁছলাম। কিছুক্ষণ গেল, তবে বৃষ্টি আর থামে না। খানিকক্ষণ থেমে থেমে মেঘ গর্জন করছে। সন্তু এতক্ষনে বসবার সুযোগ পেয়েছে তবে আর পাঁচ সাত মিনিট পরেই তাকে নামতে হবে। প্রায় কাছেই চলে এসেছে।

বাস থেকে নেমেই ব্যাগ মাথার ওপর তুলে হন্তদন্ত হয়ে সামনে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে পরল সন্তু। ঢুকেই সে হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। পনে দশটা বেজে গেছে। এদিকে তার মোবাইলও সুর তুলে বাজতে আরম্ভ করেছে। সুর শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাটিও তার মুখের দিকে একবার তাকালো। সেও তাকালো। যাক গে, সন্তুর চোখ আবার ফিরে গেল তার মোবাইলের স্ক্রিনে। প্রদীপ দা ফোন করছে। নিশ্চয় দেড়িতে আসার কারণ জানতে চাইবে। যেই না ফোন তুলতে যাওয়া, ঠিক তখনই পাশ থেকে একটা বীভৎস-রকম বিস্ফোরণের শব্দ হল। সন্তুর ডানদিকে প্রায় দশ বারো হাত দূরে আচমকা দুটো ধারালো বিদ্যুতের ঝলকানি পরপর এসে পড়ল একটা বড়সড় গাছের ওপর। অকস্মাৎ এই প্রচণ্ড আওয়াজে সন্তু এবং তার চারপাশের মানুষের চোখ, কান, আর বুক সমান ভাবে কেঁপে উঠল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি দুহাতে দুটো কান চেপে ভয়ার্ত স্বরে ও মা বলে নীচে বসে পড়লেন। আশেপাশে থাকা মানুষদের মুখ থেকেও সেই সময় ক্ষণিকের জন্য ভয়ের আর্তনাদ বেড়িয়ে এল। এই কয়েক সেকেন্ডে যেন মনে হল পৃথিবীটা এবার বুঝি ধ্বংস হতে চলেছে। প্রলয়কাণ্ড বোধহয় আজ এবং এখুনই শুরু হবে। সন্তু নিজেকে ঠিকমতন সামলে নেবার আগেই আরেকটি বড়সড় আওয়াজ তার কানে ভেসে এল। যেই গাছটির উপর বাজ পড়েছিল, সেটির মোটা কাণ্ডটি কড়মড় শব্দ করতে করতে নীচের দিকে ঝুঁকে আসছে। গাছটি মাটিতে একেবারে সোজা আছঁড়ে পড়বে। এদিকে সন্তু যতই তার স্থান ছেড়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তার পায়ের তলার জমি যেন চুম্বকের মতন তার পা দুটোকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সে চুম্বকের এমনই সাংঘাতিক আকর্ষণ-বল, যে সন্তু নিজের হাত দিয়ে পা দুটোকে ধরে টেনেও সড়াতে পাড়ছে না। সে ওপরের দিকে একবার করে ভয়ার্ত চোখে তাকাচ্ছে, আর নিজের পা দুটোকে দু হাত দিয়ে ধড়ে জোড়ে জোড়ে টানছে। তবুও সে একই যায়গায় দাঁড়িয়ে। আশপাশ থেকে কেউ তাকে সাহায্য করবার জন্যেও কাছে আসছে না। জীবনে এমন শোচনীয় অবস্থার সম্মুখীন তাকে এর আগে কখনই হতে হয়নি। কিছুতেই ঐ স্থান থেকে সড়তে পাড়ছে না সে। তার মুখ থেকে গোঙানির আওয়াজ বেড় হচ্ছে। তার দৃষ্টি আসতে আসতে ক্ষীণ হয়ে আসছে আর মুখ দিয়ে শুধুই গোঙানির আওয়াজ বেড় হচ্ছে। তারপর আরও গোঙানির আওয়াজ। যেন কারও কাছ থেকে নিরুপায় ভাবে সে সাহায্য চাইছে। হ্যাঁ সাহায্যই চাইছে। তবে কার কাছ থেকে সে তা জানে না। সন্তু শুধু এটুকুই বুঝতে পাড়ছে যে সে একটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখছে। এই দুঃস্বপ্নকে সে ভাঙতে চাইছে, চূর্ণ বিচূর্ণ করতে চাইছে, তবু পাড়ছে না। তার মুখ থেকে শুধুই গোঙানির আওয়াজ আর ক্লান্তির স্বর। সে দেখতে পাচ্ছে, গাছটা ধীরে ধীরে তার দিকে নেমে আসছে। যেন সব এখুনই শেষ হয়ে যাবে।

হঠাৎ সন্তু অনুভব করলো তার হাতটা কে যেন চেপে ধরে টানছে। “ও দাদা! শুনছেন? আপনি ঠিক আছেন তো?” এই বলে ভদ্রলোকটি একটা হ্যাঁচকা টান মারতেই সন্তুর চোখ খুলল। যেন প্রান ফিরে পেয়েছে এমন অবস্থায় সে বুকে হাত দিয়ে হাফাতে লাগলো। প্রথমে চোখ পিটপিট চাহনির পর বুঝল সে এখনও বাসেই আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, গোটা কতক লোক তার মুখের দিকে অবাক চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে। সন্তু বেশ ঘাবড়ে গিয়ে সরি! সরি! বলার পর সোজা হয়ে বসল। কন্ডাক্টর প্রশ্ন করলেন,

-কোথায় নামবেন দাদা?

সন্তু একপ্রকার হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল,-ডালহৌসি স্কোয়ার

-সে তো দশ-পনেরো মিনিট আগেই পার হয়ে গেছে।   

সন্তু জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে অবাক। ঠিকই তো! সে তার গন্তব্য স্থান পেড়িয়ে এসছে। সঙ্গে সঙ্গে বাসের সিট ছেড়ে সে এগিয়ে আসে সামনের দিকে। তারপর ভাঁড়া চুকিয়ে বাস থেকে নেমে পরে। গ্রীষ্মের দাবদাহে শুকনো ধুলো উড়োতে উড়োতে বাসটি চলে যায়। সন্তু দাঁড়িয়ে থেকে একদৃষ্টে বাসটির দূরে চলে যাওয়া দেখতে থাকে। পকেট থেকে মোবাইল বার করে সে দেখে, দশটা মিসড কল আর চারটে মেসেজ নোটিফিকেশানে জমে আছে। ফোনের সাইলেন্ট মোড্ বন্ধ করে সন্তু। সে আর এখন ঘুমের ঘোরে নেই। দুঃস্বপ্নের কবল থেকে ছাড়া পেয়ে বাস্তব দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে, সম্পূর্ণ জেগে থাকা অবস্থায়। অফিস থেকেই ফোন এসেছিল। প্রদীপ দা’র নাম মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল। তার নম্বর থেকে দুটো মিসড কল এসছে। তবে এই প্রদীপ দা তার অফিসের সহকর্মীও নন, সিনিয়রও নন। সন্তু যে এলাকায় তার ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকে, সেই চত্বরেই একটি ফারমেসির দোকান আছে যার প্রধান কর্মচারী হলেন প্রদীপ কুমার সান্ন্যাল ওরফে প্রদীপ দা। চারটি মেসেজের মধ্যে তিনটি ম্যাসেজ অফিস থেকে আর একটি মেসেজে লেখা, “তোমার ওষুধটা চলে এসছে, সময় করে নিয়ে যেও।“ সন্তু একবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ একেবারে পরিস্কার, চারিদিকে চচ্চড়ে রোদ। বৃষ্টির কোনরকম কোনো লক্ষন নেই। তার গলা শুকিয়ে এসছে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করতে গিয়ে দেখে ছাতাটা ব্যাগের ভেতরেই এক কোণে রাখা। বোতল বার করে জল খেয়ে বেশ স্বস্তির অনুভব করছে সে। জল খেয়ে ব্যাগে বোতল রাখতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই তার মোবাইলে একটি শব্দ বেজে উঠল। না…, এটা কোন ম্যাসেজ নয়, কেবল একটি রিমাইন্ডার মাত্র। প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে বাজে। অর্থাৎ সেই সময়েই তাকে ঐ নির্দিষ্ট ওষুধটি পেটে চালান করে দিতে হয়। গোটা মাসে মোট চারটে রিমাইন্ডার, অর্থাৎ সব মিলিয়ে মোট চারটে ওষুধ। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সে এই রিমাইন্ডারটিকে মোবাইলে চালু করে রেখেছে নিজের সুবিধের জন্যে। দৈনন্দিন জীবনে কাজের চাপে মনে করে একটি ওষুধ খাওয়াও তার কাছে এখন কঠিন ব্যাপার। তাই সে কথা মাথায় রেখেই এই আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ। ভালো কথা। কিন্তু অফিসে যে সে আজ নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে পারল না, সেই ব্যাপারটার কি হবে? প্রশ্নটা ঘুরতে লাগল তার মাথায়।    

রাস্তা পার হয়ে সন্তু বাসের জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল আর ভাবতে লাগল অফিসে পৌঁছে এমন কোণ্‌ অজুহাত দেওয়া যেতে পারে!? ভাবতে ভাবতে সে হাত ঘড়ির দিকে একবার চোখ বোলাল। 


আরো পড়ুন: ইরাবতী গল্প: উত্তরাধিকার । প্রতিমা রায়


প্যারাসম্‌নিয়া এমন একটি ঘুম সম্পর্কিত-ব্যাধি যা মানুষকে ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু কাজ কড়াতে বাধ্য করে। এমনকি সে ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্নও দেখতে পারে। মনে হতে পারে যেন সবকিছুই সত্যি ঘটনা ঘটছে। এই রোগ বেশ কিছু কারনে দেখা দিতে পারে, যেমন মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম, মানসিক চাপ, অনিদ্রা। অনেক সময় রাতের বেলায় ঘুম কম হয়, আর দিনের বেলায় সেই মানুষই একাবারে ঘুম কাতুরে হয়ে ওঠে। কিন্তু কাজের চাপে তার ঘুম সেই অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। সন্তুর সাথেও ঠিক একইরকম ঘটনা ঘটেছে। কারণ তার প্যারাসমনিয়া রোগটি আছে।

দুবছর আগের কথা, সন্তু প্রথমবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে ঘুমের সমস্যা নিয়ে যায়। এর আগেও তার জীবনে এইরকম ঘটনা ঘটেছে। তখন তার মা-বাবা দক্ষিন কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়িতেই থাকত। একদিন মাঝরাতে ছেলের গোঙানির আওয়াজ পেয়ে পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে তার মা। কিছুদিন পর মাঝরাতে আবার সেই একই ভাবে গোঙানির আওয়াজ। উপায় না পেয়ে শেষে ডাক্তার দেখায়। ওষুধ-পত্তর নিয়মিত চলতে থাকে। এদিকে তার অফিসের কাজও বাড়ে। মানসিক অবসাদও একপ্রকার বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, তার রাতের ঘুম হ্রাস পেতে থাকে। তাই রবিবারের ছুটি পেলে সে চুটিয়ে ঘুমোয়। গত একমাস যাবত ওষুধের মাত্রাত্রিরিক্ত চাহিদা বাড়ায় কিছু নির্ধারিত ওষুধের ঘাটতি শুরু হয়। অতএব, ওষুধ পেলে পর প্রদীপ দা তাকে ফোন করে জানাবেন, এটাই কথা ছিল।            

  

এই বিষয়ে সন্তু তার অফিসের কাউকে কিছুই জানায় নি এখনও। কেউ জানতে পারলে যদি তাকে মানসিক রুগি বলে পরক্ষভাবে খ্যাপায়? অফিসের সহকর্মীরা শুনে হয়ত হেসেই উড়িয়ে দেবে, বলবে – “ওসব মনের বাতিক-টাতিক। রাতে এক পেগ হুইস্কি মেরে শুয়ে পড়বি, তারপর দেখবি এক ঘুমে ভোর।“ সে কথা ভেবেই সন্তু কাউকে আর কিছু জানায় নি। আসলে যেকোনো মানসিক সংক্রান্ত-রোগ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে এখনও আমাদের সমাজে অনেক মানুষই বেশ সংকোচ বোধ করে, এবং লজ্জাও পায়। কিছু মানুষজনের কাছে এই রোগ কেবল একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক কলঙ্ক মাত্র। তারা এসব গ্রাহ্যই করেন না। বরং বলেন -মনের বাতিক। 

   

                                                                                                      

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত