| 29 মার্চ 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

সরস্বতী উপাসনা ও বৌদ্ধ ধর্মমত । সুকন্যা দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সরস্বতী ভিন্ন নামে উপাসিতা।  জ্ঞান, বিদ্যা,বুদ্ধি যেখানে স্থান বাঁধে সেকানে  কোনো ধর্ম কোনো  গন্ডী মানে না। সরস্বতী সর্বত্র পূজিত হন। একাদশ শতকের পর মহাযান ও বজ্রযান পন্থীরা সরস্বতীর উপাসনা শুরু করেন। বৌদ্ধ থাঙ্কা চিত্রে ( বৌদ্ধ মঠের চিত্র ও পট চিত্র) দেবীর চিত্রাঙ্কন দেখা যেতে থাকে।


বৌদ্ধ ধর্মে দেবী আরাধনার বিষয়টি আমাদের অবাক করে। পূর্বে বৌদ্ধধর্মে নারীদের কোনো স্থান ছিলো না কিন্তু গৌতম বুদ্ধের পিতা রাজা শুদ্ধোধনের মৃত্যুর পর ওনার   পালক মাতা বিধবা রাণী গোতমী, সংঘ বা সন্ন্যাসীতে যোগদানের অনুরোধ নিয়ে বুদ্ধের কাছে গিয়েছিলেন। প্রথমে  বুদ্ধ আদেশে মহিলাদের প্রবেশের অনুমতি না দিলেও তিনি পরে তার পালক মায়ের ইচ্ছা মঞ্জুর করেছিলেন।  বৌদ্ধধর্মে বহু দেব দেবীর মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন সরস্বতী। বাক্ দেবী, শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান,বিদ্যা,বুদ্ধি, সঙ্গীতের দেবী সরস্বতী। প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের কাছাকাছি শুরু হয় বহু ঈশ্বরবাদী মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম। গুপ্ত শাসকদের হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে উভয়ের মেলবন্ধন ঘটতে থাকে। বুদ্ধ স্থান পায় দশাবতারে, বৈদিক দেবী সরস্বতী পরিবর্তিত হন এক বুদ্ধ তারায়। 

আনুমানিক একাদশ শতকের পর মহাযান ও বজ্রযান পন্থীরা সরস্বতীর উপাসনা শুরু করেন। বৌদ্ধ থাঙ্কা চিত্রে ( বৌদ্ধ মঠের চিত্র ও পট চিত্র) দেবীর চিত্রাঙ্কন দেখা যেতে থাকে। 

শ্বেত সরস্বতী..

“শ্বেত পদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা।

শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।।

শ্বেতক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।

শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারবভূষিতা।”

হিন্দু পুরাণে দেবী সরস্বতীর স্তব মন্ত্রে পুনঃ পুনঃ শ্বেত শব্দটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি শ্বেত পদ্মে আসীন, শ্বেত পুষ্প শোভিতা, শ্বেত বস্ত্র পরিহিতা। শুভ্র গন্ধ – চন্দন লেপিত দেবী শ্বেতকায় অলংকারে ভূষিতা হয়ে শ্বেত বীণা ধারণ করে আছেন। পৌরাণিক সরস্বতীর এই রূপ আমাদের নিয়ে যায় বৌদ্ধ ধর্মে বর্ণিত শ্বেত সরস্বতীর কাছে।  বৌদ্ধধর্মে ” কারান্ডাবুহ্য সূত্র” থেকে এই দেবী  সরস্বতীর জন্মবৃত্তান্তের বিষয়ে আমরা অবগত হই। মহাযানপন্থীদের গ্রন্থে পবিত্র ” ওম মনিপদ্মে হুং” মন্ত্রটি ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকারক অবলোকিতেশ্বর এর উদ্দেশ্য উচ্চারিত হয়। সৃষ্টির সময় তার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে নানান দেবতার জন্ম হয়েছিলো। অবলোকিতেশ্বর এর শুভ্র দন্ত থেকে আর্বিভূতা হন শ্বেত সরস্বতী। অপরদিকে লামা ইয়েশে গ্যামস্তোট মতে দেবী সৃষ্ট হন দুধ সাগরের ঢেউ থেকে। তিনিই তারা বা ইয়াং চেন মো নামেও পরিচিত। এই দেবী তিব্বতের মহাযানপন্থীদের আরাধ্যা। শ্বেত সরস্বতী দুটি ভিন্ন রূপে আমাদের কাছে দৃশ্যমান।  কোথাও  তিনি দ্বিভূজা, পদ্মাসনা,কমললোচনা, শ্বেত শুভ্র চন্দ্রের ন্যায় স্নিগ্ধ, শান্ত, রত্ন খচিত গন্ধর্ব বীণাধারিনী  আবার কোথাও তিনি চতুর্ভূজা,  ত্রিনয়নী, রাজ হংসে উপবিষ্টা। দেবী  চার হাতে ধারণ করে রয়েছেন   বীণা, পুস্তক এবং অক্ষমালা।  নেপালের থাঙ্কা চিত্রে দেবী সরস্বতীর এই রূপটি প্রতিভাত হয়।


আরো পড়ুন: বুদ্ধ, অবতারবাদ, ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম । কণাদ সিনহা


নীল সরস্বতী

তিব্বতি ভাষায় পালদেন হামো বা মগজর গ্যালহ নামে পরিচিতা নীল সরস্বতী। দেবীর জন্ম বৃত্তান্ত স্বরূপ বলা হয়েছে, তিনি অবলোকিতেশ্বর এর চোখের জল থেকে আর্বিভূতা। বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর এর চোখের জল ভূমিতে পতিত হলে সেখানে এক  সরোবরের সৃষ্টি হয়।  জলের ভিতর থেকে পদ্মফুল উঠে আসে এবং  সেই ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে সৃষ্টি হয় নীল সরস্বতীর। সৃষ্টির থেকে  কল্পনা, জ্ঞান,বোধ কে ছিন্ন করা যায় না।  বিদ্যা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান ব্যতীত  সৃষ্টি অচল। তাই বৌদ্ধ ধর্মে  বা হিন্দু পুরাণে সরস্বতীর জন্মের সাথে সৃষ্টিকর্তা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত।  হিন্দু পুরাণেও  বর্ণিত, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার বাক্ থেকে দেবী সরস্বতীর জন্ম হয়েছিলো। আবার বরাহ পুরাণ অনুযায়ী ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের সম্মিলিত দৃষ্টি থেকে জন্ম নেন – ব্রাহ্মীকলা- সৃষ্টি – সর্ব্বাসারা, বাগীশা,বিদ্যেশ্বরী, সরস্বতী।  নীল সরস্বতী  উগ্ররূপা, দক্ষিণ হস্তে  বজ্র অঙ্কিত গদা, বাম হস্তে মাথার খুলি, মাথায় জ্ঞানাগ্নি জ্বাজল্যমান। সম্মুখে পঞ্চ নরখুলি পঞ্চ রিপুর প্রতীক। নীল সরস্বতীর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত। তাঁর নাভিতে জ্ঞান সূর্য, মস্তকে দয়ার চন্দ্র। এই দেবীর বাহন হলেন অশ্বেতর। বাহনে আসীন হয়ে তিনি শোনিতের জন্ম- মৃত্যু  চক্র পার করছেন। নীল সরস্বতীর সাথে রয়েছেন দুই ডাকিনী।  দেবীর গলে মুন্ডমালা,কোটিদেশে  বাঘছাল আবৃতা। 

লাল সরস্বতী

শাক্যশ্রী ভদ্র এবং শাক্য পন্ডিত কুঙ্গা জ্ঞাল্টসেন এর মতে লাল সরস্বতী হলেন ধ্যান এবং বুদ্ধির দেবী। সহস্র সূর্যালোকের আলোক সদৃশ প্রবাল রক্তিম গাত্র বর্ণের দেবীর দুটি হাতের দক্ষিণ হস্তে ইচ্ছাপূরণ রত্ন এবং বাম হস্তে জ্ঞান দর্পণ ধারণ করে আছেন। 

মঞ্জুশ্রী

বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান দেবতারা হলেন বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্ব।  অবলোকিতেশ্বর, বজ্রপাণি, মঞ্জুশ্রী হলেন বোধিসত্ত্ব।  সকল বোধিসত্ত্বের এক একজন নারী সঙ্গিনী রূপে “তারা” বিরাজমান।   মঞ্জুশ্রীর সঙ্গিনী হলেন শিল্প, সাহিত্য,  সঙ্গীত এবং জ্ঞানের দেবী সরস্বতী৷ মঞ্জুশ্রীর গলায় বাঘনখ, হাতে তলোয়ার, হাতে প্রজ্ঞা পারমিতার পুথি।  তাঁর বাম হস্তের জ্ঞান মুদ্রায় নীল পদ্মের ডাঁটি।  মঞ্জুশ্রীর কোলের বিপরীতে অধিষ্ঠিত দেবী সরস্বতী। তার ডান হস্তে বীণা শুদ্ধ সুরের প্রতীক এবং বাম হস্তে পুস্তক হলো জ্ঞানের প্রতীক।  মঞ্জুশ্রী এবং সরস্বতী পূর্ণ জ্ঞান প্রকাশক। মঞ্জুশ্রী দ্বারা যুক্তিগত বিশ্লেষনাত্মক বাস্তব বুদ্ধি প্রকাশ পায় এবং সরস্বতী দ্বারা শৈল্পিক ও কাব্যিক চিন্তা।  মঞ্জুশ্রী এবং সরস্বতীর মিলনে প্রজ্ঞা পূর্ণতা পায়। 

মহা সরস্বতী

এই দেবী চন্দ্র মন্ডলে অবস্থিতা, শ্বেত বর্ণা, সালংকার, দ্বিভূজা। তাঁর বক্ষে মুক্তাহার,  দক্ষিণ হস্তে বরদা মুদ্রা এবং বামে সনাল শ্বেতপদ্ম। দেবীর সাথে থাকেন চারজন নারী। সম্মুখে প্রজ্ঞা, পশ্চাৎ এ মতি, দক্ষিণে মেধা এবং বামে স্মৃতি।

আর্য্যবজ্র সরস্বতী

এই বৌদ্ধ সরস্বতী রক্তবর্ণা, সালংকার। দেবীর ছয়টি হাত। দক্ষিণ তিনটি হাতে ব্রহ্মকপাল,রত্ন ও চক্র এবং দক্ষিণ দিকের মুখটি নীলবর্ণ,  বামমুখটি শ্বেতবর্ণ৷ 

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দ্বিভূজা  বজ্র বীণা সরস্বতী ও বজ্র সারদা ও  উল্লেখ রয়েছে।

হিন্দু পৌরানিক সরস্বতীর মতো  বৌদ্ধ ধর্মে উপাসিতা দেবী সরস্বতীর সাথেও  জল, পুস্তক, বীণা, পদ্ম সম্পর্ক এক সূত্রে গ্রথিত। এর সাথে বৌদ্ধ সরস্বতীর হাতে তরবারিও লক্ষ্য করা যায়।  

জ্ঞান,প্রজ্ঞা  জলের মতো প্রবহমান। বৌদ্ধ ধর্মে হোক বা বৈদিক কিংবা পুরাণকালে সরস্বতীর জন্মের সাথে নীর ধারাকে পৃথক করা যায় না। জ্ঞান-প্রজ্ঞার প্রতীক পুস্তক, সুর- সঙ্গীতের প্রতীক বীণা এবং অজ্ঞানতার অন্ধকারনাশক এবং আলোর দিশারী তরবারি বৌদ্ধ সরস্বতী হাতেও সদা সর্বদা  লক্ষিত। হিন্দু ধর্মে  সরস্বতীর ধ্যান মন্ত্রে বলা আছে,

” ওঁ সরস্বতী ময়া দৃষ্টবা, বীণা পুস্তক ধারণীম্। 

হংস বাহিনী সমাযুক্তা মা বিদ্যা দান করেতু মে ওঁ।”

তাই  কখনও মঞ্জুশ্রী তাঁর  হাতে তলোয়ার দেখা যায়   আবার  নীল সরস্বতীর হাতে শোভা পায়  বজ্র অঙ্কিত গদা। এই অস্ত্র অশিক্ষার অজ্ঞানতা নাশক এবং আলোর পথ প্রদর্শক।    দেবী সরস্বতী  কখনও  শান্তির প্রতীক, পবিত্রতার প্রতীক  শ্বেত বর্ণা কখনও বা  লাল বর্ণে উগ্ররূপা। দেবী সরস্বতীর সাথে  পদ্মফুলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ কারণ উৎপল অসীম জ্ঞান  কে নির্দেশ করে। 

তিব্বত, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া,নেপাল,জাভায়  সরস্বতী ভিন্ন নামে উপাসিতা।  জ্ঞান, বিদ্যা,বুদ্ধি যেখানে স্থান বাঁধে সেকানে  কোনো ধর্ম কোনো  গন্ডী মানে না। সরস্বতী সর্বত্র পূজিত হন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত