| 25 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

 শতবর্ষের আলোকে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন  ।  দিলীপ মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

      সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালির প্রাণের যোগ। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু বোধহয় তার একটা কারণ। বাল্যকালে কবিতা বা ছড়া লেখেননি, গান শুনে মুগ্ধ হননি, এমন বাঙালি বিরল। তবে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, বৈঠক, সম্মেলন –এ সব ব্যাপার মধ্যযুগে ছিল না। এটা পাশ্চাত্য প্রভাবের ফল। উনিশ শতকের নবজাগরণেই তার সূত্রপাত। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সাহিত্যকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধ হবার প্রয়াস দেখা যায়। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সভা’ গঠিত হয় ১৮৩৬ সালে। তার আগে হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিও গঠন করেছিলেন‘ অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’, অক্ষয়কুমার দত্তের ‘তত্ত্ববোধিনী’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করেও তৈরি হয়েছিল লেখক গোষ্ঠী। সেখানে লেখকরা মাঝে মাঝে মিলিত হয়ে সাহিত্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন।

আধুনিক সাহিত্য সম্মেলনের  ভ্রুণ ছিল ‘বঙ্গ একাডেমি’ অথবা ‘ বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজে’র ( ১৮৭২) মধ্যে। এই একাডেমির প্রস্তাবক কোন বাঙালি নন, একজন ইংরেজ সিভিলিয়ান, জন বীমস। বাংলা ভাষার স্থিরতা বিধানের জন্য তিনি এই একাডেমি গঠনের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। একাডেমিটি বাস্তবায়িত হলে সেখানে অবশ্যই বাংলা ভাষার আলোচনার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিত। কিন্তু তখনকার কালের বিশিষ্ট বাঙালিরা জন বীমসের প্রস্তাবকে গ্রাহ্য করেননি। ১৮৮২ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কলিকাতা সারস্বত সম্মেলন’, বঙ্কিমচন্দ্র যার নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘একাডেমি অব বেঙ্গলি লিটারেচর’। এই সংগঠনটি  অল্প কিছুকাল পরে ‘সারস্বত সমাজ’ নামে পরিচিত হয়। ১৮৯৩ সালে জন্ম হল আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের। তার নাম ‘দ্য বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচর’। এর উদ্যোক্তা ছিলেন বিনয়কৃষ্ণ দেব, এল  লিওটার্ড, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী প্রমুখ।

এই বেঙ্গল একাডেমি থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের জন্ম ১৮৯৪ সালে। সাহিত্যানুরাগী যে কোন মানুষ এর সদস্য হতে পারতেন। সভাপতি, সহকারী সভাপতি, দুই সম্পাদক ও ৬ সদস্য নিয়ে গঠিত হয় এর কার্যনির্বাহক সমিতি।  সাহিত্য পরিষদের তিন ধরনের অধিবশন হত – মাসিক অধিবেশন, বিশেষ অধিবেশন ও বাৎসরিক অধিবেশন। রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে সাহিত্য পরিষদের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন হয় ১৮৯৫ সালের ৫-৬ এপ্রিল। সাহিত্য পরিষদের ১২টি বার্ষিক অধিবেশনের বিবরণ পাওয়া যায় ড. অমরনাথ করণের বইতে। বাংলার বাইরে পরিষদের বিস্তৃতির মূলে আছে রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব। পঞ্চম বার্ষিক অধিবেশনে তিনি প্রস্তাব করেন বাংলার বিভিন্ন জেলায় পরিষদের শাখা স্থাপন করা হোক এবং অনুষ্ঠিত হোক বার্ষিক অধিবেশন। 

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ১৯০৬ সালে বরিশাল প্রাদেশিক সম্মেলনের মঞ্চে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয় এবং রবীন্দ্রনাথকে নির্বাচিত করা হয় সভাপতি। তবে এই সম্মেলন পণ্ড হয় ইংরেজ সরকারের দমনমূলক নির্দেশে। ১৯০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় ‘সাহিত্য সম্মিলন’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়েছিল, যার সভাপতি ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ  সেন। ‘সাহিত্য সম্মিলনে’র উদ্যোগে  ১৯০৭ সালের ১৯ জানুয়ারি যে সারস্বত সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন তাঁর ‘সাহিত্য সম্মিলন’ প্রবন্ধটি, যা বরিশাল প্রাদেশিক সাহিত্য সম্মেলনের জন্য তিনি লিখেছিলেন।

প্রতি বৎসর বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।  এর প্রথম অধিবেশন হয় বহরমপুরের কাশিমবাজারে, ১৯০৭ সালের ৩-৪ নভেম্বরে। সভাপতি রবীন্দ্রনাথ; উপস্থিত ছিলেন  মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র রায়, শশধর রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, জগদানন্দ রায়, শিবচন্দ্র বিদ্যানিধি প্রমুখেরা। প্রথম অধিবেশন থেকে  সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত (১৯৩৮) দ্বাবিংশ সম্মেলন পর্যন্ত নিয়মিত হয়েছে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের অধিবেশন। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় তার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ১৯৫৯ সালে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে মেদিনীপুরের বৈষ্ণবচকে যে ত্রয়োবিংশ অধিবেশন হয়, সেখানে সংগঠনটি ‘বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’ নাম ধারণ করে।

বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো উত্তরবঙ্গেও সাহিত্য পরিষদের শাখা স্থাপিত হয়। উত্তরবঙ্গের শাখার উদ্যোগে আয়োজিত হয় উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের। এখানে ১৯০৮ সালের ২৭ জুন প্রথম সম্মেলন হয় রংপুরে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের সভাপতিত্বে। পরবর্তী সম্মেলনগুলি হয় বগুড়া, গৌরীপুর, মালদহ, কামাখ্যাধাম, দিনাজপুর, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর, প্রভৃতি স্থানে ।

বাংলাদেশের বাইরে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জীবিকার সূত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন বহু বাঙালি। সাহিত্য রসপিপাসা চরিতার্থ করার জন্য তাঁরা স্ব স্ব অঞ্চলে গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্য সংগঠন। যেমন লাহোরের ‘বঙ্গ সাহিত্যসভা’, সিমলার ‘বান্ধব সমিতি’, কাশীর ‘বঙ্গসাহিত্যাশ্রম’, কানপুরের ‘বঙ্গ সাহিত্য সমাজ’। কিন্তু প্রবাসী বাঙালিরা একটি কেন্দ্রীয়  সাহিত্যমঞ্চের জন্য  আকাঙ্খিত ছিলেন, যেখানে নানা রাজ্যের বাঙালি প্রতিনিধিরা মিলিত হতে পারবেন। ১৯২২ সালে সাহিত্য পরিষদের বারাণসী শাখার এক অধিবেশনে কানপুরের  সুরেন্দ্রনাথ সেন, লক্ষ্মৌ-এর অতুলপ্রসাদ সেন, কাশীর ললিতবিহারী সেনের উপস্থিতিতে ‘উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের’ পরিকল্পনা করা হয়। ১৯২৩ সালের ৩-৪ মার্চ কাশীতে উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন হয়। সম্মেলনে আগ্রা, লাহোর, পাটনা, দিল্লি, রামপুর, বারাণসী, এলাহবাদ, কানপুর, লক্ষ্মৌ-এর বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৩ সালের ২৬-২৭ ডিসেম্বর এলাহবাদে এর দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় প্রমথনাথ তর্কভূষণের সভাপতিত্বে। অমরনাথ করণ লিখেছেন, “এর পর লক্ষ্মৌতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় অধিবেশনে (১৩৩১) সংস্থাটি ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫২ সালে কটকে অনুষ্ঠিত অষ্টাবিংশতি অধিবেশন পর্যন্ত  এই নামে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে সম্মেলন হয়েছে। এর মধ্যে ১৯২৯ সালের ১৩ জুন লক্ষ্মৌতে সম্মেলনটি ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ নামে রেজিস্ট্রিও করা হয়। ” ১৯২৯ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত প্রবাসী বঙ্গে সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে  বারাণসী, এলাহবাদ, লক্ষ্মৌ, কানপুর, দিল্লি, মীরাট, ইন্দোর, নাগপুর, আগ্রা, এলাহবাদ, গোরখপুর, কলকাতা, রাঁচি, পাটনা, গৌহাটী, কানপুর, জামসেদপুর, কটক প্রভৃতি স্থানে  ।

১৯৫৩ সালে জয়পুরের অধিবেশনে আবার পরিবর্তিত হয় সংগঠনের নাম।  ‘প্রবাসী’ শব্দটি অনেকের আপত্তির কারণ হয়। নতুন নাম হয় ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’। ১৯৮১ সালের ২১ ডিসেম্বর এই নামেই সংস্থাটিকে রেজিস্ট্রি করা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন  দেবেশ দাস, নীহাররঞ্জন রায়, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, হুমায়ুন কবীর, নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কালিদাস রায়, দিলীপকুমার রায়, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তুষারকান্তি ঘোষ, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, অশোককুমার সরকার, শিবনারায়ণ রায়, প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, প্রবোধচন্দ্র সেন, অন্নদাশংকর রায়, রাধারাণি দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সমরেশ বসু, লীলা মজুমদার, জগদীশ ভট্টাচার্য, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মনিশংকর মুখোপাধ্যায়  প্রমুখেরা। ২০২২ সালে শতবর্ষে পা দিয়েছে এই সংগঠন। শতবর্ষের সে অনুষ্ঠান হবে কলকাতায়। আগামী ডিসেম্বর মাসে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিরা তো থাকবেনই, তার সঙ্গে ভারতের বাইরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। আমন্ত্রণ জানানো হবে মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে। আয়োজকরা একটি চমৎকার প্রদর্শনী ও তথ্যচিত্রেরও পরিকল্পনাো করেছেন। 

 

[লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত ( ভারত সরকার )  গবেষক ও কলামিস্ট ]

ঋণ :

সাহিত্য সম্মেলনের গবেষক ড. অমরনাথ করণের ‘ সাহিত্য সম্মেলনের ইতিবৃত্ত’ (নবজাতক প্রকাশন , ১৯৯৪)  ; ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের প্রথম অধিবেশন ও রবীন্দ্রনাথ’ ( বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ , ২০১৩) ;  ‘সভাপতির অভিভাষণ/ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন ১৯০৭-১৯৩৯’ ( লালমাটি , ১৪২৪ ) ; ‘সভাপতির অভিভাষণ / উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’ ( লালমাটি , ২০১৯ )

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত