| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-৬) । আদনান সৈয়দ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

নিউইয়র্ক জ্যাকসন হাইটস এর বাঙালিদের জীবন, তাদের স্বপ্ন, তাদের ত্যাগ, তাদের মন, মনন, প্রেম, ভালোবাসা আর বুক চাপা কান্নার গল্প । সব মিলিয়ে এই ধারাবাহিক লেখায় উঠে আসবে নিউইয়র্কের বাঙালির গল্পগাথা। আজ ইরাবতীর পাঠকদের জন্য থাকছে পর্ব-৬।


 

এক অদ্ভুত মানব প্রেমিকের গল্প!

 

ভদ্রলোক খুব কম কথা বলেন। দশটা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেন। এমন মানুষের সাথে কথা চালানো সত্যি খুব কঠিন কাজ। কিন্তু কাজটা আমাকে করতেই হবে। কারণ আমি এই ভদ্রলোক সম্পর্কে যতকিঞ্চিৎ জেনে ফেলেছি। ওনি আর যাই হোন আমার—আপনার মত খুব সাধারন মানুষ না। উনি থাকেন জ্যাকসন হাইটস থেকে একটু উত্তরে ছোট শহর ফ্লাশিং এ। আমার বাড়ির আঙিনা থেকে উনার বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। এক সন্ধ্যায় হাজির হলাম তার এক তলা বাড়িতে।খুব পুরাতন একটা বাড়ি। বাড়িতো নয় যেন প্রেত পুরি। বাড়ির চারপাশে গাছ—গাছালি আর লতা—পাতায় ভরা। কাঠের দরজায় ঘুন পোকার বাসা আর বাড়ির লোহার দরজায় মরচে রং এর জং ধরেছে। ভাবতেই পারছিলাম না যে এরকম সাধারন পুরনো একটা জং ধরা বাড়িতে কেউ থাকতে পারে। কিন্তু তিনি থাকেন। আর তিনি যে এরকম একটা বাড়িতে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। না, নামটা গোপন রাখতেই হবে। কারণ তিনি নাম প্রকাশ করতে চান না।

ভদ্রলোক নিউইয়ের্কে আছেন বহু বছর আগে থেকেই। বিয়ে করেন নি। একা থাকেন আর নিজের কাজের মাঝেই ডুবে থাকেন সারাটা সময়। ওনার সম্পর্কে জানতে পারি তার খালাতো ভাই আমারই বন্ধু মিতুল এর মাধ্যমে। সব শুনেতো আমি অবাক! এই যুগে এমন মানুষও আছে? তিনি তো দেখি এ যুগের সাক্ষাৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর! সত্যিকারের মানব প্রেমিক বলতে যা বোঝায় তিনি হলেন তাই। বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গরীব শিশুদের কে সাহায্য করাই তার একমাত্র পেশা আর নেশা। বেশ কিছুদিন চাকরী করেছিলেন একটা ব্যাংকে। তারপর নিজেই একটা গ্রোসারি আর গ্যাস স্টেশন কিনে সেই আয় থেকে নিজে চলেন আর শিশুদের পেছনে খরচ করেন। বাংলাদেশের যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে তিনি তার সমস্ত কিছু নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। তবে তিনি যা করেন তা করেন খুব নীরবে, কাক পক্ষীটাও যেন জানতে না পারে। নিউইয়র্কের হরেক রকম মানবতাবাদী সংস্থার সাথে তিনি যুক্ত। বিশেষ করে কালো এবং হিসপানিক নেশা গ্রস্থ যুবকদের জন্য তিনি অনেক কাজ করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। নিজের গাটের পয়সা খরচ করে তিনি অনেক নেশায় আক্রান্ত যুবকদের চিকিৎসা করিয়েছেন, সুস্থ করেছেন। তবে শিশুদের জন্য তিনি যেন দয়ার সাগর। তার ড্রয়িং রুমে বিভিন্ন দেশের শিশুদের সাথে তার ছবিই যেন সে কথাটি বার বার বলে দেয়।


আরো পড়ুন: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-৫) । আদনান সৈয়দ


 বিকেলের ফিকে রোদে আমাকে দেখেই মনে হল তিনি যেন একটু বিরক্ত হলেন। মিতুল চোখের ইশারা দিতেই আমি আমার পরিচয় দিলাম আর করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনি সেদিকে ভ্রক্ষেপ না করেই আমাদের বসতে বলে উল্টো দিকের একটা পুরনো চামড়ার সোফায় কাত হয়ে বসলেন। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবেই। সারাক্ষণ কপালটা কুঁচকে রাখেন।  চোখে—মুখে কোথায় যেন একটা বিরক্তির চিহ্ন লেগেই আছে। কথা একদম বলেন না। মিতুল-ই আমাদের কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে কিছু চা—বিস্কুটের আয়োজন করতে বাড়ির অন্দর মহলে  হারিয়ে গেল। আমি নিজে মানুষের সাথে কথা বলতে পছন্দ করি কিন্তু এই ব্যাক্তিটির সাথে কেন যেন আমি খুব স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম চলেই বরং যাই। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই তিনি কথা বললেন, ” কিছু মনে করবেন না। আমি আপনাদের মত কথা গুছিয়ে বলতে পারি না। কেন এসেছেন জানতে পারি কী?” আমি যেন এবার হাতে চাঁদের নাগাল পেলাম। এইতো মুখ খুলছেন। আমাদের কথার খই ফুটতে শুরু করল। সত্যি বলতে সেদিন এই মৃদভাষী ব্যক্তিটির সাথে আমার প্রচুর কথা না হলেও আমার জীবনের অনেক ভাবনা—চিন্তায় তিনি যেন নতুন কিছু জুড়ে দিয়েছিলেন। সময়কে কি ভাবে বাঁচিয়ে মানুষের সেবায় নিজেকে উজার করে দেওয়া যায় এর মুল মন্ত্রটি সেই ব্যাক্তিটি যেন খুব ভালো করেই জানেন। আর জানেন বলেই তিনি বাড়তি কোন সময় নষ্ট করেন না। অযথা টাকা—পয়সা নষ্ট করেন না। প্রতিদিন এর জন্য একটা সময় সূচী আগের থেকেই তৈরি থাকে। ঘড়ির কাটার সাথে সাথে মেপে মেপে তিনি পথ চলেন। অনেক কষ্ট করে জানতে পারলাম যে বাংলাদেশের ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অনেক এতিম খানা তার টাকায় চলে। নিজের  দেশের বাড়িতে(চট্টগ্রাম) গরীব ছেলেমেয়েদের জন্য প্রতিদিন কাঙালি ভোজ দেন। গরীব আত্মীয়— পাড়া প্রতিবেশীর চোখে তিনি হলেন মানব—দরদী এক দেবতা । কিন্তু তিনি তাঁর এই দানের খবর কাউকেই বলতে চান না। বলেন না।  এমনকি  আমাকেও বিনয়ের সাথে বারণ করলেন উনার নাম যেন লেখাও উল্লেখ না করি। নিজের মত করেই যেন তিনি তার জীবনের পথটি খুঁজে নিয়েছেন। অনেক কথাই হয়েছিল সেদিন তাঁর সঙ্গে।তাঁর কাছ থেকে কত কিছু আমাদের শেখার আছে! সোসাল মিডিয়ার এই যুগে যেখানে মানুষ নিজের প্রচারে ব্যস্ত আর এই বাঙালি লোকটা খুব গোপনে নিজের কাজটি করে যাচ্ছেন। চলে আসার ঠিক পূর্ব মূহুর্তে শুধু বললেন, “ ঠিকমত আপ্যয়ন করতে পারলাম না। কিছু মনে করবেন না। একটা অনুরোধ। মানুষের জন্য কিছু করেন। যত সামন্যই হোক সেটা। যদি পারেন দুই ডলার খরচ করেও কিছু করেন। ” কথা গুলো বলেই তিনি যেন সেই আবার ভূতুরে বাড়ির কোন এক অন্ধকার কামড়ায় ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেন।

আমি তখনও মন্ত্র মুগ্ধের মত তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম! মনে মনে ভাবছিলাম এমন  মানুষ এই দুনিয়ায় আরো বেশি নেই কেন? কে জানে? হয়তো আছে, কিন্তু আমরা তাদের দেখতে পাই না। এই মহৎ আত্মাগুলো আছেন বলেই তো পৃথিবীটা এত সুন্দর! মনের মধ্যে কত এলোমেলো কথাই না আসছে। দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এলাম। মাথার উপর কী সুন্দর ঝকঝকে শরতের আকাশ! সেখানে এক ফালি সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশের পার্কে ছোট ছোট শিশুরা খেলা করছে। সেখানে লাল, কমলা আর হলুদ রং এ টিউলিপ ফুটে আছে। পৃথিবীটা কত সুন্দর! কত সুন্দর! হঠাৎ হৃদয়ের গভীরে কবি গুরুকে আবিস্কার করলাম।।

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।

এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে

জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত