| 29 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

সুগন্ধির একাল সেকাল । আহমাদ শামীম

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ মানুষের চিরন্তন অভ্যাস। আর সেটা যদি হয় ইন্দ্রিয়জাত, তবে সেটা নিয়ে আকর্ষণ তো থাকবেই। সুগন্ধির প্রতি আগ্রহও অনেকটা সেরকমই। প্রাচীন মিসরের ধর্ম এবং সংস্কৃতির অংশ হিসেবে যে সুগন্ধির উদ্ভব এবং চলন শুরু হয়, নানাভাবে নানা হাত ঘুরে প্রায় সব সভ্যতায় সুগন্ধি ব্যবহার দেখা যায়। এককালে যে সুগন্ধি ছিল শুধু সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের জন্য, কালের পরিক্রমায় সেটাই পরিণত হয় সাধারণের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে। যার বৈশ্বিক আর্থিক বাজারও অর্থমূল্যে কম নয়। আর বিশ্বজুড়ে সুগন্ধি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও রয়েছে প্রায় বিশ হাজারের মতো। সুগন্ধি আমাদের মনোদৈহিক অবস্থার ওপর রাখে দারুণ প্রভাব। ইতিহাসের পাতা ঘুরে সুগন্ধির নানান বিষয় নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আহমাদ শামীম।


কবি আবুল হাসান তার ‘কল্যাণ মাধুরী’ কবিতায় লিখেছেন- ‘যদি সে সুগন্ধি শিশি, তবে তাকে নিয়ে যাক অন্য প্রেমিক!/ আতরের উষ্ণ ঘ্রাণে একটি মানুষ তবু ফিরে পাবে পুষ্পবোধ পুনঃ/ কিছুক্ষণ শুভ্র এক স্নিগ্ধ গন্ধ স্বাস্থ্য ও প্রণয় দেবে তাঁকে’। প্রশ্ন হতে পারে সুগন্ধি নিয়ে লিখতে বসে কেন কবিতার দ্বারস্থ হওয়া। কবিতার কাছে যাওয়া এ কারণে যে, ‘শুভ্র এক স্নিগ্ধ গন্ধ’ কীভাবে দেহ ও মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে সে বিষয়ে সম্যক ধারণা দেওয়া।

বর্তমান দৈনন্দিন জীবনযাপনে সচেতন মানুষের কাছে সুগন্ধি তথা পারফিউমের ব্যবহার অনেকটা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মতোই। আর এই সুগন্ধির সৌরভ অবচেতনে যে আমাদের মনোদৈহিক অবস্থার ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে সে খোঁজ জানি কয়জনা! যখনই আমরা কোনো গন্ধ পাই, সেই গন্ধ আমাদের মস্তিস্কের লিম্বিক সিস্টেমে একটি সিগন্যাল পাঠায়। লিম্বিক সিস্টেম হলো মস্তিস্কের সেই অঞ্চল, যা আমাদের স্মৃতি ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ফলে একটি সুন্দর ঘ্রাণ আপনাকে আনন্দ দেবে এবং মুড বুস্টার হিসেবে কাজ করবে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর স্টিফেন ওয়ারেন বার্গের কথাতেও মেলে যার সত্যতা। ওয়ারেনবার্গের মতে, ‘সুন্দর কোনো সুগন্ধি আপনাকে মানসিক চাপমুক্ত থাকতে সাহায্য করবে এবং আপনার মনকে সতেজ রাখবে।’

সুগন্ধির একাল সেকাল বিষয়ক কথামালায় যাওয়ার আগে কিছু আশ্চর্য তথ্য জেনে নেওয়া যাক, মানুষের পাঁচ ইন্দ্রিয়ের যে ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা ঘ্রাণ নিয়ে থাকি সেই নাকের ক্ষমতা নিয়ে। যদি প্রশ্ন করি, আপনি কতগুলো ঘ্রাণ বা ঘ্রাণের স্মৃতি ধারণ করেন? উত্তর দিতে না পারলে ক্ষতি নেই, জেনে রাখুন- আমাদের নাক ৫০ হাজার ঘ্রাণ মনে রাখার মতো ক্ষমতাবান! শরীরবিদ্যার তথ্যমতে, আমাদের নাক সর্বোচ্চ ১০ হাজারের মতো ঘ্রাণ শনাক্ত করতে সক্ষম। কিন্তু ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক সিটির রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিওরোবায়োলজিস্ট লেসলি ভোশাল ও তার টিমের দীর্ঘদিনের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে নতুন তথ্য। তার মতে, ‘এতদিন আমরা ভুল জেনে এসেছি, মানুষের নাক নানা রকমের এক ট্রিলিয়ন ঘ্রাণ শনাক্ত করতে পারে!’ সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে ঘ্রাণ এবং সুগন্ধির শক্তি আদতেই কতটা প্রভাববিস্তারি।

ইন্দ্রিয়জাত সমস্ত সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরকালের। সুগন্ধির ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, মানবসভ্যতার প্রারম্ভিক সময় থেকেই সুগন্ধির প্রচলন ছিল। সুগন্ধির আদি তথা মূল কারিগর হিসেবে ইতিহাসবিদরা মিসরীয়দেরই নাম নিয়ে থাকেন। খ্রিষ্টজন্মের এক হাজার বছর আগে থেকে প্রাচীন মিসরের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে সুগন্ধির ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। তারা বিশেষ কিছু গাছের বাকল এবং চর্বির মিশেলে এক ধরনের সুগন্ধি তৈরি করতেন। ধীরে ধীরে যা প্রাচীন বিভিন্ন সভ্যতা নিজেদের মতো আত্মীকরণ করে নেয়। যার ফলে মেসোপটেমিয়া, চীন, প্রাচীন ভারতের হিন্দু সভ্যতা, আরব ও গ্রিকদের মাঝেও সুগন্ধির ব্যবহার দেখা যায়।

সুগন্ধির ইংরেজি ‘Perfume শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘per fumus’ থেকে, যার অর্থ হলো ‘ধোঁয়ার মাধ্যমে’। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধূপ-ধুনোর মতোই প্রাচীনকালে আগুনের সংস্পর্শে সুগন্ধির প্রচলন ছিল বলেই মনে করা হয়। মিসরীয়দের পাশাপাশি খ্রিষ্টপূর্ব হাজার বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়ার নারী রসায়নবিদ ‘তাপ্পুতি’, যাকে পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম কেমিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন কিছু মাটির ট্যাবলেটে তাপ্পুতির সুগন্ধি বানানোর কিছু কৌশল লক্ষ্য করা যায়। তিনি ফুল, তেল ও অন্যান্য সৌরভযুক্ত বস্তুর মিশেলে সুগন্ধি তৈরি করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১৩০০ বছর পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের ইন্দুস ভ্যালি সিভিলাইজেশনেও সুগন্ধির ব্যবহার ছিল বলে ইতিহাসবিদরা প্রমাণ পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত বিদ্যমান প্রাচীনতম সুগন্ধির সন্ধান মিলেছিল সাইপ্রাসের লিমাসল শহরের পাইরগস গ্রামে। গ্রামটিতে ২০০৩ সালে আবিস্কৃত হয় এক সুগন্ধি কারখানা। সেখানে এক কৌটা সুগন্ধি পাওয়া যায়, যার বয়স আনুমানিক চার হাজার বছর!

অষ্টম ও নবম শতকে ক্রুসেড-পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের হাতে পশ্চিম ইউরোপের স্পেন এবং ইতালির দক্ষিণভাগ অধিকৃত হলে ইউরোপের যে নিজস্ব সুগন্ধি চর্চা ছিল তা ভেঙে পড়ে। সে জায়গা দখল করে নেয় ইসলামিক সুগন্ধি চর্চা। অষ্টম শতকে স্পেনের আন্দালুস পৃথিবীর অন্যতম সুগন্ধি উৎপাদন ও রপ্তানিকারক অঞ্চলে পরিণত হয়। গোলাপ, লোবান, মৃগনাভি, সুগন্ধি তেল এবং নিজস্ব পন্থায় মুসলমানদের তৈরীকৃত সুগন্ধির খ্যাতি ছিল প্রাচীন দুনিয়ার এশিয়া, আফ্রিকা ও বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে। নবম শতকে আরব রসায়নবিদ ও দার্শনিক আল কিন্দের লেখা বই ‘দ্য কেমিস্ট্রি অব পারফিউম অ্যান্ড ডিস্টিলাইজেশন‘ গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে ১০৭ ধরনের সুগন্ধি উৎপাদন পদ্ধতি ও রেসিপির কথা বর্ণনা করেছেন। প্রায় একই সময়ে আরেক মুসলিম দার্শনিক, চিকিৎসক, গবেষক, লেখক ও চিন্তক ইবনে সিনা গোলাপ ফুল থেকে বাষ্পীকৃত উপায়ে বিশেষায়িত এক ধরনের সুগন্ধি তৈরি করেন। এই পদ্ধতি পরবর্তীকালে সুগন্ধি নির্মাতাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৩৭০ সালে কুইন এলিজাবেথ অব হাঙ্গেরির জন্য দেশটির সুগন্ধি প্রস্তুতকারকরা রোজমেরি ও অ্যালকোহলের সংমিশ্রণে এক ধরনের পারফিউম তৈরি করেন, যার নাম ছিল ‘হাঙ্গেরি ওয়াটার’। সুগন্ধিতে অ্যালকোহলের ব্যবহার সেবারই প্রথম করা হয় এবং এই পদ্ধতি ইউরোপে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। পনেরোশ শতকে ইতালিয়ান রেনেসাঁর সময় ইতালিতেও সুগন্ধির উৎপাদন ও প্রসার লাভ করে ব্যাপকভাবে। ষষ্ঠদশ শতকে ইতালির সুঘ্রাণ পারফিউমার ক্যাথরিন ডি মেডিচি, যিনি পরবর্তীকালে ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় হেনরিকে বিয়ে করেছিলেন এবং রেনে দ্য ফ্লোরিন্টিনের হাত ধরে ফ্রান্সে যান। ফরাসিদের হাতে আধুনিক বিশ্বের সৌরভশিল্প নতুন মাত্রা লাভ করে এবং ধীরে ধীরে ফ্রান্স আধুনিক বিশ্বের সুগন্ধি ও কসমেটিক ব্যবসার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়, যার রেশ আজও বর্তমান।

আধুনিক সময়ের সুগন্ধি ব্যবসার পরিধিও কম নয়। ব্যবসা সমীক্ষা প্রতিষ্ঠান ইন্ডাস্ট্রি রিসার্চের তথ্যমতে, ২০২০ সালে গ্লোবাল ফ্রেগরেন্স অ্যান্ড পারফিউম মার্কেটের ফিন্যান্সিয়াল সাইজ ছিল ৪২ হাজার সত্তর মিলিয়ন ডলার। করোনা মহামারির প্রকোপের পরেও সুগন্ধির বর্ধমান চাহিদার কারণে প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে ২০২৬ সাল নাগাদ যার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৪৩ হাজার ৬২০ মিলিয়ন ডলারে।

নতুনের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। যার ফলে লাইফস্টাইল পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নিত্যই ভোক্তাদের নতুন ধারার সুঘ্রাণ তথা সুগন্ধি উপহার দিতে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ব্রিটিশ সৌরভ বা সুগন্ধি বিশারদ ও ইতিহাসবিদ মাইকেল অ্যাডওয়ার্ড ১৯৮৪ সাল থেকে বাৎসরিকভাবে প্রকাশ করে আসছেন ‘ফ্রেগরেন্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামের একটি গাইড। ২০১৫ সালে প্রকাশিত গাইডটির তথ্যমতে, বিশ্বে ১৭ হাজারেরও বেশি সুগন্ধি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ড রয়েছে! ২০২১ সাল নাগাদ যা আরও বেড়েছে বলেই মনে করা হয়।

সেই প্রাচীনকালে মিসরের কোনো এক প্রান্ত থেকে যে সৌরভ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বময়, বর্তমানে সেই সৌরভ বা সুগন্ধির চাহিদা এবং বাজার দিন দিনই যেন বেড়ে চলেছে। যে সৌরভ মনেপ্রাণে আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দেয়, সে সৌরভের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তো থাকবেই। ফলে বলাই যায়, সুগন্ধি থেকে যাবে আরও অনেক অনেক কাল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত