| 28 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-৩) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
তিনি ভারতসম্রাজ্ঞী। অথচ পারিবারিক কোন্দল আর ঈর্ষার কারণে সভামধ্যে পরিবারের মানুষেরাই কাপড় খুলে তাঁকে উলঙ্গ করার চেষ্টা করল। রাজকোষ পরিচালনার দক্ষতা যাঁর ছিল, তাঁকে সাজগোজ করানোর কাজ নিতে হল। যাঁকে চেয়েছিল ভারতবর্ষের তাবৎ পুরুষ, তিনি নিজের বাঞ্ছিত প্রেম পেলেন না। দুইটি পুরুষের পারস্পরিক প্রতিহিংসা সাধনের কারণে তাঁর নিজের জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। নারী যুদ্ধের কারণ? না পুরুষের অহমের আগুনে নারী বলিপ্রদত্ত জন্ম থেকেই? একাকিনী। এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব তেজে ভরপুর অথচ একা এক নারীকে। আজ থাকছে একাকিনীর পর্ব-৩।


অর্জুনের প্রতি তাঁর যে মনোভাবই  থাক না কেন, একথাও তো ঠিক যে অন্যদের প্রতিও মনে দিব্যি আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। কী সুন্দর সব চেহারা! কী আশ্চর্য সব শরীর! তখনও তো সবার নাম জানেন না। সত্যি বলতে কি, অর্জুনকেও তখন নামে চেনেন না। শুধু মনে মনে একটা ধারণা যে এঁরাই সেই পঞ্চপাণ্ডব, আর ধনুর্ধর পুরুষটিই দ্রুপদের মহা কাঙ্খিত অর্জুন। বাবার কাছে এত বর্ণনা শুনেছেন প্রত্যেকের, যে গাছ উপড়ে গদা বানিয়ে ঘোরানো ভীমকে আন্দাজ করতেও খুব অসুবিধা হয় নি। স্বয়ংবর শেষে সেই দক্ষযজ্ঞ ভালো করেই মনে আছে তাঁর এখনও। ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন লক্ষ্যভেদ করামাত্র উপস্থিত ব্রাহ্মণেরা সবাই নিজেদের উড়নি, চাদর যা কিছু ছিল, সব পাগলের মতো নাড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, “পেরেছে পেরেছে। আমরা ক্ষত্রিয়গুলিকে হারিয়েছি! রাজারা যা পারেনি, আমরা পেরেছি! কী আনন্দ! কী আনন্দ!” কয়েকজন তো আনন্দের আতিশয্যে ছুটে গিয়ে অর্জুনকে কাঁধে বসিয়ে পুরো সভাস্থল পরিক্রমা করতে শুরু করল। কেউ কেউ আর কিছু না পেয়ে পাশে যাকে পেল, তাকে জড়িয়ে ধরল। 
এই সব গোলমালের মধ্যে কেউ খেয়ালও করল না যে রাজাদের সব চোখ মুখ লাল। রাগে গসগস করছেন তাঁরা। এতজন রাজা, যুবরাজ থাকতে একজন বামুনের ব্যাটা রাজকন্যাকে জয় করে ফেলল! এতো সবার অপমান!! তাছাড়া অদ্ভুত মানুষের মনস্তত্ত্ব। হেরে গেলে স্বীকার করতে লজ্জা পায়। আর সেই লজ্জা ঢাকতে চায় অপরের প্রতি ক্রোধ আর ব্যঙ্গের প্রকাশে। আর এই হার স্বীকারে পুরুষের চিরকাল আরও বেশি করে আপত্তি! সেখানে এতজন ক্ষত্রিয়, একজনও লক্ষ্যভেদ করতে পারলে রাজারা এতটা অপমানিত বোধ করতেন না। কিন্তু একটা অতি সাধারণ কাপড় পরা বামুন! তাও যদি একটু উঁচুস্তরের হত। মানে অন্তত আর্থিক দিক দিয়ে। পোষাক আশাক দিয়েই বোঝা যায় কতগুলো ভিখিরি বামুন। সুতরাং সবকটা রাজা মিলে ঠিক করল দ্রৌপদীকে আগে বলা হবে রাজাদের মধ্যেই একজনকে বেছে নিতে। নয়ত “মেয়েটাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলব!” মজা হল, এক তো একজনও স্বয়ংবর সভার শুরুর শর্তের কথা মনে রাখলেন না! আধুনিক বহু মানুষও দ্রৌপদীর কর্ণকে প্রত্যাখ্যানের ঘটনাকে ভয়ানক চোখে দেখান, যে সূতপুত্রকে না বলে দ্রৌপদী এমন অমার্জনীয় অপরাধ করেছে যে সর্বসমক্ষে তাকে উলঙ্গ করে দিলেও তা অনুচিত নয়। মহাভারতের সব প্রকারে এই প্রত্যাখ্যানের কথাও নেই! আর যদি তা সত্যিই ধরি, তাহলে বলতেই হয় যে স্বয়ংবর সভার শুরুতেই ধৃষ্টদ্যুম্ন যে যে শর্ত বলে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হল প্রতিযোগীকে উচ্চবর্ণের হতে হবে। তাই নিয়ে যত খুশি প্রতিবাদ করাই যায়, তবে এখনকার সমাজেও কি এই বর্ণভেদ থেকে অভেদ হতে পেরেছি আমরা? চুণি কোটাল থেকে রোহিত ভেমুলা, দলিত মেয়েদের ধর্ষণ থেকে উত্তরপ্রদেশ, বিহারে ঠাকুর সম্প্রদায়ের নির্মমতা কিছু কমেছে? তবুও অবশ্যই এই অন্যায়, এই অসহনীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে সব রকমে সবাই সোচ্চার হই; কিন্তু কারণ যাই হোক, একটি মেয়ের কি নিজস্ব পছন্দ থাকতে নেই? বিশেষ করে সেটি যখন স্বয়ংবর সভা? সে কি শেষ মুহূর্তেও না বলতে পারে না? সেখানে রাজাদের নিজেদের পরাজয় না মানতে পেরে বিদ্রোহ, দ্রৌপদীকে পুড়িয়ে মারার ভাবনা, দ্রুপদকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র নিয়ে কেন বলুন তো কেউ কিছুই বলেন না? কারণটা কি সেই পুরাতন অথচ এখনও সমান চালু কথাটি? যে যা কিছু হোক, একটি মেয়ের দিকে চট্ করে আঙুল তোলা যায়? দোষ দেওয়া যায়? তাকে ধর্ষণের অধিকার পেয়ে যায় পুরুষ? সেক্ষেত্রে প্রেমে না শুনে অ্যাসিড আক্রমণ করা, বহরমপুরের মেয়েটিকে কুপিয়ে মারাও তো justified! আর সত্যিই তো এই সব নৃশংস খুনিরা সমবেদনা পাচ্ছে! আহারে! ছেলেটি তো বিয়ে করতে চেয়েছিল! ইসস্, বেচারা মেধাবান ছেলেটার জীবনটা একটা নোংরা মেয়ের জন্য নষ্ট হয়ে গেল! এবং এই কথাগুলি আমার নিজের ব্যাখ্যা বা মত নয়। এটাই রূঢ় সত্যি। অ্যাসিড আক্রান্ত মনীষা পৈলান আজও সুবিচার পাওয়ার আশায় কোর্টে ঘুরছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েই যাচ্ছে। অথচ যে ওর জীবনটা নষ্ট করার চেষ্টা করল, সে জামিন পেয়ে বিয়ে করে জমিয়ে সংসার করছে! আর বহরমপুরের খুনী ছেলেটি বহু মানুষের সহানুভূতি কুড়োচ্ছে! 
যাই হোক, আবার ফিরি দ্রৌপদীর কথায়। আসলে কয়েক হাজার বছর আগের মহাভারতের নারী চরিত্র বিশ্লেষণ করতে বসলেও এখনকার মেয়েদের অবস্থান মনে ভেসে ওঠে। মনে হয় কতটুকু পাল্টেছে সমাজের মানসিকতা? অন্তত মেয়েদের প্রতি? কতটুকু পাল্টেছে মেয়েদের নিজেদের মানসিকতা? নিজেদের প্রতি?দ্রৌপদী, সেই সময়ে, সেই দৃঢ়তাটুকু তো দেখিয়েছিলেন। সবার মাঝে। সভার মাঝে। “আমি  সূতকে বরণ করব না, নাহং বরয়ামি সূতম্(১৭৯ অধ্যায়, ২৩ শ্লোক, পৃঃ ১৮১৪)!”

আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-২) । রোহিণী ধর্মপাল


তবে ধৃষ্টদ্যুম্ন যদিও শর্তে বলেছিলেন,  উচ্চ বংশ, মনোহর রূপ এবং অসাধারণ বলশালী যিনি এই লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, তিনিই দ্রৌপদীকে লাভ করতে পারবেন। অথচ উপস্থিত সব রাজাদের পরিচয় করানোর সময় অন্যান্য সমস্ত রাজাদের সঙ্গে কর্ণের পরিচয়ও করিয়েছিলেন। কর্ণেন সহিতা বীরাস্ত্বদর্থং সমুপাগতা (১৭৯ অধ্যায়, ৪র্থ শ্লোক, পৃ১৮০৫)। সেক্ষেত্রে বলা যায়, ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্ণের অঙ্গরাজরূপ পরিচয়টাই জানতেন। সুতরাং দ্রৌপদীর জানা ও খোঁজখবরের পরিধি ধৃষ্টদ্যুম্নের থেকে বেশিই ছিল। যদিও বারবার বলছি, এই বৈষম্য ভয়ানক অন্যায়। চিরকালই। তবু মনে পড়ছে কলকাতা দূরদর্শনের একটি অনুষ্ঠান। “গল্প হলেও সত্যি”। সেই সময়টি কলকাতা দূরদর্শনের স্বর্ণযুগ  ছিল। যাক গে, সেই গল্পের নায়ক ছিলেন উৎপল দত্ত। লেখক। রীতিমত প্রতিবাদী লেখকের চরিত্র। কলমের জোর সাংঘাতিক। অথচ তাঁর মেয়ে যখন একটি নাগা যুবককে পছন্দ করল, লেখকের মাথায় হাত। না পারছেন মানতে! নাগাল্যাণ্ডের ছেলে মানে তো সাপের মাংস খাওয়া আদিবাসী! সে যতই পড়াশোনা শিখুক! সে হবে জামাই! এদিকে নিজের লেখাতে সর্বদা এমন সব বৈপ্লবিক কথা লেখেন, যে এমনকী মেয়ের সামনেও না করতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত দেঁতো হাসি হেসে ভাবী জামাইকে অভ্যর্থনা জানালেন! উৎপল দত্তের সেই অভিনয় যেমন অবিস্মরণীয়, তেমন একথাও মনে রাখতে হবে ধর্ম জাতি বর্ণ লিঙ্গভেদ এখনও সমান প্রবল। তাই কর্ণকে প্রত্যাখ্যানের জন্য দ্রৌপদীর দিকে আঙুল তোলাটা এবার বোধহয় বন্ধ হওয়া দরকার। আগে নিজেরা শোধরাই। তারপর অন্যের দোষ ধরি। নয়ত, কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাকেই বহন করে নিয়ে চলার কলঙ্কিত ঐতিহ্যের দায় মেনে নিতে হবে আমাদের।
 এবার আসি কর্ণকে প্রত্যাখ্যানের রাজনৈতিক কারণে। তার জন্য সেইসময়ে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের অবস্থান জানতে হবে। জানতে হবে দ্রুপদের সঙ্গে পাণ্ডুর বন্ধুত্বের কথা। পাণ্ডু ছিলেন দ্রুপদের অভিন্নহৃদয় বন্ধু(১৬০ অধ্যায়, ১৮ শ্লোক, পৃঃ ১৮৫৪)। অতি শৈশবেই বাবাকে হারানো, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম, বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া আর তার থেকে উদ্ধার পেয়ে খানিক লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকা পাণ্ডুপুত্রদের সেকথা জানার উপায়ই ছিল না। একই কারণে কুন্তীরও নিশ্চয়ই মনে পড়ে বিপদের সময় পাঞ্চালরাজার আশ্রয় নেওয়ার কথা। অথবা ভেবেছিলেন ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ভাবে দ্রুপদ বেশ দুর্বল। কারণ তাঁর অর্ধেক রাজ্য দ্রোণের অধিকারে। আর সেই অর্ধ রাজ্য হারানোর প্রধান নায়ক তাঁর পুত্র অর্জুন। সুতরাং অর্জুনের প্রতি দ্রুপদের তীব্র রাগ থাকা আর প্রতিহিংসা নেওয়ার ভাবনা থাকাই স্বাভাবিক। এই কথা কুন্তীর মনে হলে তা এতটুকু আশ্চর্য নয়। হয়ত তাই, সচেতন ভাবেই কুন্তী পাঞ্চাল রাজ্যের কথা ছেলেদের বলেন নি। তিনি আর কী করে জানবেন যে বরং দ্রুপদ খুঁজে বেড়াচ্ছেন বিশেষ করে অর্জুনকে। কারণ তিনি বুঝে গেছিলেন দ্রোণ আর কৌরবদের হারিয়ে হৃত রাজ্য আর হৃত গৌরব যদি কেউ তাঁকে ফিরিয়ে দিতে পারে, তবে তা অর্জুনই পারবেন। তাই তিনি স্বয়ংবর সভায় এমন কঠিন শর্তই  রেখেছিলেন, যা এমনকী তাবড় তাবড় ক্ষত্রিয় রাজাদের পক্ষেও প্রায় অসম্ভব ছিল। শুধু গায়ের জোর আর তীর ধনুকে ওস্তাদ হলেই হবে না। চাই অসম্ভব ধৈর্য্য আর মনঃসংযোগের ক্ষমতা। এবং খানিক বাইরের জগতের প্রতি ঔদাসীন্য আর নির্লোভ মানসিকতা। এমন মানুষ পৃথিবীতে চিরকালই বিরল। তাই দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা আসলে ছিল দ্রুপদ পরিকল্পিত অর্জুনকে ধরার ফাঁদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত