| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১৫) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

            ১৭৮৯ তে একবার। মানুষ একরকমভাবে শুনেছিল সাম্য আর মৈত্রীর কথা। তেমনই ১৯১৭। বিংশ শতকের পৃথিবীর ইতিহাস নতুন বাঁক নেবে এইবার।

            সমাজবিপ্লব কি সফল? ফরাসি বিপ্লব কি আদৌ কিছু শেখাল? বা রুশ বিপ্লব? উত্তমের কেমন ধোঁয়াশা লাগে। ও তত্ত্বকথার লোক নয়। ওর থিওরি বুঝতে কোনওকালে তেমন ভালো লাগে না। নিয়মনীতি কারণ ফলাফল নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা ও বিশ্লেষণ করতে পারবে না। কিন্তু তবুও তো প্রশ্ন তৈরি হয়। আসলে পড়লে বা জানলেই বোধহয় প্রশ্ন গড়ে ওঠে। না জানা বা অজ্ঞানতার কোনও চিন্তা নেই। জিজ্ঞাস্য নেই। শুধু আনুগত্য। শুধু নির্দেশ পালন।

            উত্তম ভাবতে ভাবতে আসছিল কাকে এইসব প্রশ্ন করা যায়। অবশ্য প্রশ্ন করলেও উত্তর না’ও পেতে পারে। আবার সব সময় সব উত্তর যে ও বুঝতে পারে, তা’ও নয়। তবুও।  

            পার্টি অফিসে ঢুকে দেখে সুমিত বসে আছে। কলেজে সারাদিন একসঙ্গেই কাটিয়েছে। কিন্তু কলেজের মধ্যে আর কলেজের বাইরে ওদের পরিচয় বদলে যায়। কলেজে যে সংগঠনের নেতৃস্থানীয়, লোকাল কমিটিতে যে পিছনের বেঞ্চে গোবেচারা মুখ করে বসে থাকা একজন সাধারণ সমর্থক মাত্র।

            সুমিত ওকে দেখেই ডাকল, “উত্তম, এদিকে আয়। স্মিতাকে নিয়ে বসতে হবে একবার। তোর ওপর একটা কাজের দায়িত্ব পড়েছে।”  

            উত্তম স্পষ্টই হকচকিয়ে যায়। স্মিতা? মানে স্মিতা দত্ত?  

            সুমিত খোলসা করে বিষয়টা। কালই ইউনিট কমিটিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছিল। কুশলদা এসেছিলেন, প্রায়ই যেমন আসেন। শুভ্রাংশু, অনল, সুমিত ছিল। কলেজের সংগঠন নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা হল কিছু। ছাত্র পরিষদ থেকে একজন কলেজ ইলেকশনে নমিনেশন জমা দিয়েছিল আগেরবার। একটি মেয়ে। স্মিতা দত্ত। সকলে আড়ালে স্মিতা পাটিল বলে। স্মিতা পাটিলের মতো ওইরকমই শ্যামলা, তীক্ষ্ণ চেহারা। টিকোলো নাক। পাতলা ঠোঁট। অসম্ভব মুখরা। কেউ সামনাসামনি ঘাঁটানোর সাহস পায় না। সে ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচনে নমিনেশন জমা দেবে এটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টের পায়নি কেউ। এই কলেজে আদৌ এইরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে, তার বিন্দুমাত্র আঁচ ছিল না কারও কাছে। দীর্ঘদিন ধরে কলেজ ইলেকশনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা চলে আসছে। এটা সংগঠনের কাছে বিরাট ধাক্কা। যদিও স্মিতা দত্ত মাত্র তিনটি ভোট পেয়েছিল। তার নিজের এবং আরও দুজনের। তাদেরকেও চটপট চিহ্নিত করা হয়েছে। স্মিতার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ দুই তরুণ। ক্লাসমেট। তাদেরই ভোট। সেখানে রাজনৈতিক সমর্থনের আভাসমাত্র নেই জেনে আপাতত শান্তিকল্যাণ।  

            সংগঠন সতর্ক। কারণ, স্মিতার মতো জঙ্গি লড়াকু মেয়েদের নিয়ে দুটো সমস্যা। এক, তারা বড্ড চোখা চোখা প্রশ্ন করে। আর দ্বিতীয়ত তারা মেয়ে হবার অ্যাডভান্টেজটা পুরোপুরি নিয়ে নেয়। মহিলা সমর্থক বা মহিলা সমিতি দিয়ে এদের সব সময় কাউন্টার করা যায় না। লোকের চোখে পড়ে। চট করে সহানুভূতি তৈরি হয়ে যায়। লোকে বায়াসড হয়ে যায়। জনমত ঘুরে যায়। সুন্দরী আর চৌকস হলে তো কথাই নেই। হাইবেঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে পারলে অর্ধেক যুদ্ধ জেতা হয়ে যায়।   

            স্মিতার ক্ষেত্রেও বিষয়টা গোলমেলে দিকে চলে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে সালটানো হয়েছে। কিন্তু কেস জণ্ডিস। এ রোগ ছোঁয়াচে। সিস্টেমের মধ্যে থেকে বিরুদ্ধ প্রশ্ন করলে সে প্রশ্ন টেবিলে বসে সামলানো যায়। কিন্তু সিস্টেমের বাইরে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করলে একটু চাপের। স্মিতার পড়াশুনোটাও বড্ড বেশি। কিছু বোঝাতে গেলে পালটা তর্ক করার জন্য সমস্ত যুক্তি ওর ঠোঁটের ডগায় মজুত।

            দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির নানা রকম পর্যালোচনা চলছিল নিজেদের মধ্যে। তার মধ্যেই কুশলদা এসে আবার স্মিতার কথা তুললেন। কোনও ভূমিকা ছাড়াই।  

            “অনল, তোমাদের কলেজে এখন ঐ মেয়েটি, ওই যে ছাত্র পরিষদের হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কী যেন নাম… বোধহয় স্মিতা… ওর কর্মকাণ্ড কী?”

            “ঠিকই আছে।” অনল বলে।  

            “ঠিক ভুল কেমন জানতে চাইনি। সে এখন কী করছে, কী ভাবছে, এর পরে কলেজ ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তার সম্ভাব্য কাজ কী হতে পারে, সেটা জানতে চাইছি।” 

            কুশলদার সরাসরি প্রশ্নে চুপ করে যায় অনল। তাকায় সুমিতের দিকে। দুজনকে চাওয়াচাওয়ি করতে দেখে কুশল একবার হাসেন।

            “দেখছ তো, আমাদের কাজের মধ্যে কত ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আরে বাবা, শুধু চিহ্নিত করাই তো নয়। তাকে ট্র্যাক করতে হবে। ফলো করতে হবে। ইলেকশনের আগে তো তোমরা বুঝতেই পারোনি ও শেষ মুহূর্তে এসে ফস করে নমিনেশন জমা করে দিয়ে চলে যাবে। বুঝেছিলে? ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে একটা মেয়ে, তার সম্বন্ধে এটুকু হোমওয়ার্ক থাকবে না তোমাদের? তারপরে তার জন্য ভোটও পড়ে গেল তিনটে। হোয়াই? একটা ভোট নয় ওর নিজের। বাকি দুজনকে আটকানো গেল না? এতটুকু সেন্স নেই? আঁচ করতে পারলে না, যে এইসব মেয়েদের জন্য কিছু পেটোয়া প্রেমিক থাকবেই। প্রেমিক এক না থেকে একশো থাক, কে বারণ করেছে, কিন্তু ভোট থাকবে কেন?”

            “মানে, কুশলদা, বাকিরা যে ওকেই ভোট দেবে… আমরা ঠিক… আসলে ওরা কিন্তু কেউ স্মিতার প্রেমিক নয়।”  

            সুমিতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কুশল বলেন, “ওরা প্রেমিক নয়। আমি জানি। ওরা গুণমুগ্ধ। আর এই মুগ্ধতা বিষয়টা কত মারাত্মক তোমরা জানো? ধারণা আছে তোমাদের? রাজনীতির অঙ্কটাই এমন। মুগ্ধতা। সেইজন্যেই চিত্রতারকাদের নিয়ে টানাটানি। সাউথে দেখো না… বিশাল সব কাট-আউট। আরে, আমরা একমাত্র এই বেল্টেই ওইসব মুখ-দেখানো সিস্টেমে বিশ্বাস করি না। জনগণের প্রতিনিধি, মানুষের পাশে দাঁড়ানো কাজ আমাদের। কেরল, ত্রিপুরা আর এই পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বামপন্থীরা আছে বলে… আরে ভাই, এই দেশে আর ক’টা লোক পলিটিক্যালি কনশাস? একটা কথা তো মানবে, দেশে সাক্ষরতার হার যেখানে কহতব্য নয়, সেখানে এই দেশের রাজনীতিতে কেউ দল বা দলের নীতি দেখে ভোট দেয়? দিয়েছে আজ অবধি? সব তো সেই মুখের জয়,” বলতে বলতে নিজেকে সামলে নেন কুশল। তাঁর কথায় দলের সংবিধান-বিরোধী চিন্তার ছায়া পড়ছে। এরকম ভুল হবার কথা নয়। এটা ঠিক নয়। একটু ওপরে কেউ টের পেলে… বিষয়টা চট করে ঘুরিয়ে দেন তিনি।    


আরো পড়ুন: কদমতলি (পর্ব-১৪) । শ্যামলী আচার্য


 

            “শোনো, স্মিতা-র পরবর্তী মুভমেন্টের দিকে খেয়াল রেখো। খুব সাবধান। ও কিন্তু সতর্ক, সাবধানী। এত সহজে ময়দান ছাড়বে না। ওর ব্যাকগ্রাউণ্ড, কাদের সঙ্গে মিশছে… ওর পরের কাজ যদি আগাম ভেবে ফেলতে না পারো, তা হলে সংগঠন করতে এসেছ কেন? মনে রেখ, প্রতিপক্ষের চাল আগে বুঝে নিয়ে প্রস্তুত থাকাই আসল। অনেক লড়াই ওভাবেই জেতা যায়। ময়দানে ঢাল-তরোয়াল নিয়ে নামতে হয় না। এত বছর এমনি এমনি আমরা মানুষের ভোট পাইনি।”       

            কুশল যা যা বলেছেন, তার পুরোটা হুবহু উত্তম শোনেনি। শোনার কথাও নয়। সুমিত ওকে সবটা বলবে কেন? যা ওর আড়ালে আলোচনা হয়েছে, তা’ আড়ালেই থাকবে। সামনে আসবে শুধু কিছু নির্দিষ্ট নির্দেশ আর নির্দেশ মেনে চলার নির্দেশাবলী।

            “কিন্তু স্মিতাকে নিয়ে আমি কেন বসব? আর বসার মানেটাই বা কি?”

            “তুই কেন বসবি, এই প্রশ্নের উত্তর তুই আমার কাছে জানতে চাস না। আমি জানি না। আর স্মিতাকে নিয়ে বসার মানে তুই নিজেও জানিস।”

            “শোন সুমিত, স্মিতার সঙ্গে একমাত্র আমিই কথা বলি। তোরা জানিস, ও নমিনেশন জমা দেবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা কেউ কিচ্ছু জানতাম না। কিন্তু এটাও ঠিক, ও নমিনেশন জমা দেবার পর সবার আগে এবং একমাত্র আমি ওকে গিয়ে চার্জ করেছিলাম। এবং যথেষ্ট কড়াভাবে।”

            “আমি একা নই। কলেজসুদ্ধ লোক জানে। যে কোনও কারণেই হোক, স্মিতা তোর সঙ্গে মিনিমাম কথাবার্তা বলে। মানে, সাংগঠনিক পরিচয় জেনেও কথা বলে। আর সেটাই বোধহয় এবারে কাজে লাগাতে হবে। তুই যে প্রত্যেকের কাছে মোটামুটি ইজি-গোয়িং, সেটা তো খুব বড় প্লাস পয়েন্ট রে।”  

            উত্তম গম্ভীর হয়ে যায়।

            “হুম বুঝেছি। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে রোজ বসলেই ও কংগ্রেস থেকে সিপিএম হয়ে যাবে না। বাড়িটাই পাঁড় কংগ্রেসি। বনেদি এবং ওই যাকে বলে অর্থোডক্স।”

            “আমাদের দল ভাঙানো কাজ নয়। আর ও রাতারাতি তুই বললেই তোর মতের লোক হয়ে যাবে না। কঠিন মাল। আপাতত আগামী বছর দুয়েক ঠেকনা দিয়ে রাখা আর কি… ভোটের সময় ঝামেলা না করে আর ফালতু কিছু সমর্থক জুটিয়ে না ফেলে। ভোটের সময় একশোয় একশো পাওয়াটা কেমন অভ্যেস হয়ে গেছে না? কম নম্বর পেলে বড্ড ইয়ে হয় আর কি…। তবে চিন্তা করিস না, এদেশের মেয়েদের লেখাপড়া সংসার হ্যানত্যান করে জঙ্গি বিপ্লব করতে আসার সময় নেই। ফস করে দেখবি এনআরআই বিয়ে করে ধাঁ করে হাওয়া হয়ে গেছে। তদ্দিন যদি ঠেকিয়ে রাখা যায় আর কি…”

            সুমিতের কথা শুনতে শুনতে উত্তম ঠিক করে ফেলে স্মিতার সঙ্গেই একদিন রুশ বিপ্লব নিয়ে কথা বলতে বসবে। যদি ওর দিক থেকে ওর ভার্শানটা জানা যায়? মেয়েটা পড়াশুনো করে। পেটে বিদ্যে আছে। ওর ক্লাসের ছেলেমেয়েরাই বলেছে পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে অনার্স পড়লেও পাসের ইতিহাস ক্লাসে ও ভীষণ রেগুলার। বেশ কয়েকবার ইতিহাসের হেড-এর পারমিশন নিয়ে হিস্ট্রি অনার্স ক্লাসেও ঢুকেছিল।

            অ্যাজেণ্ডা যাই থাক, ইতিহাস দিয়েই স্মিতার সঙ্গে মীটিং শুরু হোক বরং।

            পরদিন ফার্স্ট আওয়ারে কলেজে গিয়েই স্মিতার খোঁজ করে উত্তম।    

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত