| 29 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: আয়না । হারুকি মুরাকামি । অনুবাদক: অভিজিৎ মুখার্জি

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

সবার গল্পগুলোই শুনলাম একদম শুরু থেকেই, শুনেটুনে মনে হচ্ছে যে এধরনের ব্যাপারে দু’চারটে মূল ধরন আছে। একটা ধরন যেমন, একদিকে আছে জীবিতদের জগৎ, অন্যদিকে মৃতদের জগৎ, আর গল্পটা হচ্ছে একটা থেকে আরেকটায় যাতায়াতের। এগুলো ভূত বা ঐ ধরনের কিছুর ক্ষেত্রে হয়। আরেকটা টাইপ হচ্ছে এমন কিছু ঘটতে থাকা, বা এমন কোনও ক্ষমতা যা আমাদের এই দৈনন্দিন ত্রিমাত্রিক জগতের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত। অতীন্দ্রিয় চেতনা, ভবিষ্যতের কোনও ঘটনার আভাস পাওয়া, এইসব। মূলত এই দু’টো ধরনের মধ্যে কোনও না কোনও একটা গ্রুপে আপনি রাখতে পারেন সবগুলোকেই।
আরেকটু যদি খতিয়ে দেখেন, দেখবেন কোনও একজন নির্দিষ্ট লোকের অভিজ্ঞতাগুলোকে এগুলোর মধ্যে কেবল একটাই ধরনের মধ্যে ফেলা যায়। অর্থাৎ কিনা, যে লোক ভূত দেখে, সে কেবল ভূতই দেখে, কখনও ভবিষ্যতের কিছুর আভাস-টাভাস পায় না, আর যে অতীন্দ্রিয় চেতনার অধিকারী, সে কেবল ভবিষ্যতের ঘটনারই আভাস পেতে থাকে, ভূতটুত কদাপি দেখে না। এটা কেন হয়, সে সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নেই, যে-কোনও কারণেই হোক, এরকমই হয়। আমার তো অন্তত তাই মনে হয়েছে।
এবং অবশ্যই এমন লোকেরাও আছে, যারা এর কোনওটার মধ্যেই পড়ে না। যেমন ধরা যাক, আমি, বছর তিরিশেক ধরে বেঁচে আছি, অথচ একবারও ভূত দেখিনি। ভবিষ্যতের ঘটনার পূর্বাভাস-টাসও পাইনি কখনো। এমনও হয়েছে যে, একবার আমার দুই বন্ধুর সঙ্গে লিফটে যেতে যেতে, ওরা দুজনেই একটা ভূতকে দেখেছিল, কিন্তু আমার কিছুই চোখে পড়েনি। ওরা দেখল যে ছাই ছাই রঙের স্যুট পরা এক মহিলা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে, কিন্তু আসলে লিফটে কোনও মহিলাই ছিল না। আমরা তিনজনই কেবল ছিলাম। সত্যি বলছি। এই বন্ধুরা কিন্তু ধোঁকা দেওয়ার মতো লোক নয়। নিশ্চিত করেই এটা একটা গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা, কিন্তু আবার এও ঠিক যে আমি কখনও ভূত দেখিনি।
কিন্তু একবার, ঐ একবারই মাত্র, আমি এমন ভয় পেয়েছিলাম যা একেবারে যেন আত্মার গভীরে গিয়ে পৌঁছেছিল। দশবছরেরও বেশি হয়ে গেছে, কারুকে এ যাবৎ বলিনি তবু। বলতে গেলে পর্যন্ত ভয় করত। কেমন যেন মনে হত, যদি বলতে যাই, আবারও সেই একই জিনিস ঘটতে পারে। তাই এতগুলো বছর কেটে গেলেও এর মধ্যে কারুকে বলিনি। কিন্তু আজ সকলেই তাদের গল্প বলল তো একটার পর একটা, সবাই আমার অতিথি, গৃহস্বামী হয়ে তো আর একেবারে কিছু না বলে পাট চুকিয়ে দিতে পারি না, তাই আজ বলব বলে ঠিক করেছি।
না না, হাততালি টাততালি দিতে হবে না। অত দারুণ কিছু ব্যাপার নয়।
আগেই বলেছি, আমি কখনও ভূত দেখিনি, এবং আমার কোনও বিশেষ ক্ষমতাও নেই। আমি যতটা ভয় পেয়েছিলাম, ততখানি ভীতিপ্রদও কিছু নয় বলে আপনাদের মনে হতেই পারে। আপনারা হয়তো শুনেটুনে ভাববেন, ‘তো কী হয়েছে?’ সেরকম হলে, ক্ষতি কিছু নেই। যাই হোক, আমার গল্পটা এরকম।
ষাটের দশকের শেষদিকে আমি স্কুলের পাট সাঙ্গ করি, চারদিকে ভয়ানক গণ্ডগোল সেই সময়, পুরো ব্যবস্থাটাই ধ্বসে পড়বে বলে মনে হচ্ছিল। আমি নিজেও তার কবলে পড়ে, ঠিক করলাম যে কলেজে আর ভর্তি হব না, এদিক ওদিক সারা জাপান ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম, স্রেফ গতরে খেটে খেয়ে। জীবনযাপনের ওটাই আদর্শ উপায় বলে মনে হয়েছিল, হ্যাঁ, অনেক ধরনের কাজই করেছি তখন। তার মধ্যে কিছু তো ছিল বেশ বিপজ্জনক কাজ। অল্প বয়েস, বুদ্ধি পাকেনি। কিন্তু এখন ভেবে মনে হয়, বেশ মজারই ছিল সেই জীবন। জীবনটা আবার প্রথম থেকে বাঁচা শুরু করতে পেলেও হয়তো আবার সেগুলোই করব। আমি লোকটা এই টাইপেরই।


আরো পড়ুন:বেড়ালের শহর


সেই ভবঘুরে জীবনের সেটা বোধহয় দ্বিতীয় বছর, আমি একটা হাইস্কুলে মাস দুয়েক নাইট ওয়াচম্যানের কাজ করেছিলাম। সময়টা ছিল হেমন্তকাল। নিগাতা জেলার এক ছোট শহরের হাইস্কুল। এর আগে, গ্রীষ্মকালটা জুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ করতে হয়েছিল, তাই একটু জিরিয়ে নিতে চাইছিলাম। আর তাছাড়া নাইট ওয়াচম্যান হওয়ার মধ্যে মজাও আছে। সারাদিন জমাদারের জন্য বরাদ্দ একটা ঘরে ঘুমিয়ে থেকে, রাতে শুধু এদিক ওদিক হেঁটে দু’বার করে বাড়ির আনাচে কানাচে দেখে আসতে হত। এর বাইরে, লাইব্রেরিতে বসে বই পড়া যেত, জিমে গিয়ে বাস্কেটবল ছোঁড়া প্র্যাকটিস করা যেত রিং লক্ষ্য করে, যা আমার খুশি। একটা পুরো স্কুলে আমি একা, মন্দ না ব্যাপারটা। আঠারো উনিশ বছর বয়সে, ভয় কাকে বলে জানা নেই।
আপনারা কেউই যেহেতু কখনো কোনও স্কুলের নাইট ওয়াচম্যান ছিলেন না সম্ভবত, আমি বেশি সময় না নিয়ে কাজটার একটা বিবরণ দিয়ে দিচ্ছি। একবার রাউণ্ডে বেরোতে হত রাত ন’টায়, আবার একবার রাত তিনটেয়। একেবারে নির্দিষ্ট করে। তিনতলা কংক্রিটের বাড়ি, নতুনই বলা চলে, আঠারো কুড়িটা ক্লাসঘর। খুব পেল্লায় বড় কিছু নয় বাড়িটা। এছাড়া ছিল ল্যাবোরেটরি, আর্ট শেখানোর ঘর, সঙ্গে স্টাফরুম আর প্রিন্সিপালের অফিস। মেইন স্কুলবাড়িটা ছাড়াও ছিল সুইমিং পুল, আর জিম, আর অডিটোরিয়াম। এই হল গিয়ে আমাকে যেখানে যেখানে যেতে হত।
ঘুরে ঘুরে গোটা কুড়ি জায়গায় গিয়ে একটা ফর্মে ডটপেন দিয়ে টিক দিতে হত। স্টাফরুম—টিক, ল্যাবোরেটরি—টিক, এইভাবে। হ্যাঁ, জমাদারের ঘরে ঘুমিয়ে থেকেও আমি টিক দিয়ে দিয়ে যেতে পারতাম বৈকি কাগজের ওপর। কিন্তু আমি ঠিক অতটা অলস না। মোটের ওপর, সময় তো বেশি লাগত না, আর কিছু লোক ঢুকে পড়লে তো ঘুমের মধ্যেও আমাকে আক্রমণ করতে পারত।
সুতরাং ন’টায় এবং তিনটেয়, একটা বড় টর্চ আর একটা ভোজালি নিয়ে আমি স্কুল পরিদর্শনে বেরোতাম। টর্চটা বাঁ-হাতে, আর ভোজালিটা ডানহাতে। নিজেকে রক্ষা করার ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসীই ছিলাম। দা কি কাটারি নিয়ে যদি কেউ আক্রমণ করত, আমি বিশেষ ঘাবড়াতাম না বলেই মনে হয়। কিন্তু সে ঐ তখন। এখন হলে, দৌড় লাগাব।
অক্টোবর মাসের এক রাতে প্রবল বাতাস দিচ্ছিল। খুব একটা ঠাণ্ডা নয়। সত্যি বলতে কী, একটু স্যাঁতসেঁতেই লাগছিল। রাত হতেই মশার উপদ্রব অসহনীয় হয়ে উঠলো, কয়েকটা মশা তাড়ানোর কয়েল জ্বেলে দিয়েছিলাম বলে মনে পড়ছে। সারারাত বাতাসের গর্জন চলল। শুনে মনে হচ্ছিল সুইমিং পুলের গেটটা বোধহয় ভেঙে ফেলা হচ্ছে, এমনভাবে এদিক ওদিক আছড়ে আছড়ে পড়ছিল জোরালো বাতাসে। একবার ভাবলাম গিয়ে ঠিক করে দিয়ে আসি, কিন্তু সেই অন্ধকারে আর চেষ্টা করলাম না। সারারাত দুমদাম আওয়াজ হয়েই চলল।
ন’টার রাউণ্ডে যখন বেরোলাম, কিছুই হচ্ছিল না। কুড়িটা চেকপয়েন্টের সবক’টায় টিক দিয়ে এলাম। দরজাগুলো ঠিকমতো বন্ধ করা হয়েছে, সব কিছু ঠিকঠাকই আছে। অস্বাভাবিক কিছু নেই কোথাও। জমাদারের ঘরে ফিরে এসে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম তিনটেয় জাগিয়ে দেওয়ার জন্য, তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।
তিনটেয় অ্যালার্মটা বাজতে কেমন একটা খুব অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে জেগে উঠলাম। বলে ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারব না, কিন্তু খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি। সোজা কথায়, আমার উঠতেই ইচ্ছে করছিল না। অনুভব করলাম যে উঠে পড়ার ইচ্ছাটাতেই শরীর প্রতিরোধ দিচ্ছে। আমি সাধারণত চট করে উঠে পড়ি, তাই এরকম হওয়াটা একটু অদ্ভুতই। কষ্ট করে একসময় উঠে আমি রাউণ্ডে বেরোলাম। পুলের গেটে তখনও আগের মতোই সেই আছড়ে আছড়ে পড়ার শব্দ হয়েই চলেছে। আমার যেন মনে হল শব্দটা ঠিক আগের মতো নয়, একটু আলাদা। নেহাতই হয়তো আমার কল্পনা, কিন্তু কেমন গা’টা একটু সিরসির করে উঠল। একদম ভাল লাগছে না, নিজের মনেই বললাম। আমার রাউণ্ডে বেরোতে ইচ্ছে করছে না। তবে কিনা উঠে শেষপর্যন্ত বেরোলাম। একবার ফাঁকি দিলেই, এরপরে বারবার দেব। টর্চ আর ভোজালিটা নিয়ে জমাদারের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
কী যে দুর্বিপাকের রাত! বাতাস ক্রমেই আরও জোরালোভাবে বইছে, সঙ্গে আর্দ্রভাবটাও বাড়ছে। গা সিরসির করছে আর কোনও কিছুতে মনোনিবেশ করতে পারছি না। প্রথমে দেখে এলাম জিম, অডিটোরিয়াম আর পুল। তিনটেই ঠিক আছে। পুলের গেটটা এমনভাবে খুলে খুলে যাচ্ছিল যেন কোনও উন্মাদ অবোধের মত মাথা তুলছে নামাচ্ছে আর ঝাঁকাচ্ছে। এক্কেবারে এলোমেলো : হ্যাঁ, হ্যাঁ, না, হ্যাঁ, না, না, না… এইভাবে। আমি জানি যে এটা কেমন একটু শোনাচ্ছে, কিন্তু আমার সেরকমই মনে হচ্ছিল যে।
মেইন স্কুলবাড়িতেও কোনও গণ্ডগোল নেই বলেই মনে হল। প্রত্যেকবারের মতোই, সবগুলো জায়গার জন্যেই টিক দিয়ে দিয়ে আমি তড়িঘড়ি রাউণ্ড সমাপ্ত করলাম। তাছাড়া গণ্ডগোল কিছু ছিল বলে তো মনে হয়নি। আশ্বস্ত বোধ করে আমি এবার জমাদারের ঘরে ফিরব বলে ঠিক করলাম। শেষ চেকপয়েন্টটা ছিল বয়লার রুম, স্কুলের একেবারে পূর্বপ্রান্তে। দুর্ভাগ্যবশত জমাদারের ঘরটা আবার স্কুলের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে। ফলত জমাদারের ঘরে ফেরত আসতে আমাকে একতলার করিডরের পুরোটা হেঁটে আসতে হত। স্বাভাবিকভাবেই চারিদিকে সূচিভেদ্য অন্ধকার। আকাশে চাঁদ থাকলে খানিকটা আলো এসে ঢুকত সেই করিডরে, কিন্তু না থাকলে কিছুই দেখা যেত না। সামনে টর্চের আলো ফেলে ফেলে এগোব বলে ঠিক করলাম। সেই রাতে একটা টাইফুন এসে পড়েছে কাছেই, তাই চাঁদও নেই আকাশে। মাঝেমাঝে বাজের ঝলকানি, আর তারপরেই আবার অন্ধকার।
সেই রাতে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হাঁটছিলাম করিডর ধরে। আমার জুতোর রাবারের সোল লিনোলিয়ামের মেঝেতে চটাস চটাস করে আওয়াজ তুলছিল। করিডরটা সবুজ লিনোলিয়ামে ঢাকা। এখনও যেন দেখতে পাচ্ছি। করিডরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় স্কুলে ঢোকার দরজা, ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই মনে হল, “আরে এটা কী?” মনে হল যেন অন্ধকারে একটা অবয়ব দেখতে পেলাম। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম যেন। ভোজালিটা শক্ত করে ধরে সেদিকে ঘুরলাম। বুকটা ঢিপঢিপ করছে, টর্চের আলো ফেললাম ওখানটায়। দেওয়ালে একটা জায়গা, জুতোর র‍্যাকের পাশেই।
এ যে দেখি আমি! অর্থাৎ একটা আয়না। আমার নিজের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়ে আমার কাছে আসছে, আর কিছু নয়। নিশ্চয়ই সবে লাগানো হয়েছে আয়নাটা, আগেরদিনও ছিল না ওখানে। সেইজন্যই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। যেমন আশ্বস্ত বোধ করলাম, একইসঙ্গে তেমনই বোকাবোকাও লাগল। কী বোকা রে আমি, নিজের মনেই বললাম। আয়নার সামনে দাঁড়ানো অবস্থায়ই আলোটা নিচের দিকে করে, পকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালাম। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে কয়েকটা টান দিলাম। একটুখানি রাস্তার আলো একটা জানালা দিয়ে ঢুকে এসেছে, এবং আয়না অবধি পৌঁছচ্ছে। পেছন থেকে তখনও পুলের গেটের ঠং ঠং আওয়াজ আসছে।
সিগারেটে গোটা তিনেক টান দেওয়ার পরে হঠাৎ একটা আশ্চর্য জিনিস নজরে পড়ল। আয়নায় যার মুখ ফুটে উঠেছে, সেই লোকটা আমি নই। বাহ্যত আমারই চেহারা। তাতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু কিছুতেই আমি নই। আমি ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারছিলাম। না দাঁড়ান, ঠিক তা নয়। অবশ্যই আমি। কিন্তু আমার বাইরের কোনও আমি। এই আমির আকৃতি এমনই যা আমার হওয়ার কথা নয়।
আমি ঠিকমত বলে উঠতে পারছি না।
কিন্তু সেই সময় আমি শুধু নিঃসন্দেহভাবে এটাই বুঝতে পারছিলাম, যে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমাকে সে আত্মার একেবারে অন্তঃস্থল থেকে ঘৃণা করে। একটা কালো হিমশৈলের মতো ঘৃণা, কেউ যেটার প্রশমন ঘটাতে সক্ষম হবে না। সেটুকুই শুধু বুঝতে পারছিলাম। হতভম্ব হয়ে সেখানে একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে ছিলাম, নড়তে পারছিলাম না। আঙুল থেকে সিগারেটটা মেঝেতে পড়ে গেল। একইভাবে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার শরীর নড়তে চাইছে না, যেন বেঁধে রাখা আছে।
একসময় অন্যজন হাতটা একটু নাড়াল। ওর বাঁহাতের আঙুলগুলো ধীরে ওর গাল ছুঁলো, তারপর একটু একটু করে মুখের এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেল। টের পেলাম যে আমিও সেরকমই করছি। যেন আমি আয়নায় প্রতিবিম্ব। মানে আরকি, ও-ই তখন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে, যত জোরে পারি চেঁচিয়ে উঠলাম তখন। “অ্যাঅ্যাঅ্যাইই !” বলে জোরালো এক হাঁক পাড়লাম। এতে যেন বন্ধনটা একটু আলগা হল। সর্বশক্তি দিয়ে ভোজালিটা আয়নার দিকে ছুঁড়ে দিলাম। আয়নাটা চুরমার হয়ে যাওয়ার শব্দ কানে এল। পেছনদিকে না তাকিয়ে দৌড় দিলাম নিজের ঘরের দিকে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে, বিছানায় গিয়ে উঠলাম। সকাল অবধি পুল-গেটের আওয়াজ বজায় রইল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, না, হ্যাঁ, না, না, না……হয়েই চলল, হয়েই চলল।
গল্পটা কীভাবে শেষ হবে তা হয়তো আপনারা বুঝতেই পেরেছেন : ওখানে অবশ্যই কোনও আয়না ছিল না। সেধরনের কিছুই ছিল না। ঢোকার মুখে জুতোর র‍্যাকের পাশে কখনো কোনও আয়না লাগানো হয়নি।
এই সবকিছুরই সারকথা হচ্ছে, আমি ভূতটুত কিছু দেখিনি। কেবলমাত্র নিজেকেই দেখেছিলাম। সে রাতে এমন ভয় পেয়েছিলাম যা কখনও ভুলতে পারিনি। আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন যে এবাড়িতে কোত্থাও একটাও আয়না নেই। এমনকি দাড়ি কামাতেও আমি আয়না ব্যবহার করি না। যদিও এতে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। সত্যিই ঘটেছিল এরকম।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত