| 16 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

উনিশ মে বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

আনুমানিক পঠনকাল: 14 মিনিট

এ কথা গর্ব করেই বলা যায়, বাঙালি হল এমন এক জাতি, যারা মাতৃভাষা রক্ষার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, বরকত বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। পৃথিবীর আর কোনো জাতি তাদের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য এভাবে অকাতরে প্রাণদান করেছে বলে আমাদের জানা নেই। ২১শে ফেব্রুয়ারি তাই স্বীকৃতি লাভ করে ভাষা দিবস বা শহীদ দিবস হিসেবে। পরবর্তী সময়ে নজিরবিহীন সেই ঘটনার এ দিবসটিকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ঘোষণা করেছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বুকে তরুণ তাজা প্রাণের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের কথা জানা থাকলেও ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের বরাক উপত্যকায় তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড় জেলার শিলচরে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যে ১১ তরুণ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছিল সে ঘটনার কথা আমাদের অনেকের হয়তো জানা নেই। সেদিনের সেই সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, সর্বোপরি ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে অর্জিত হয়েছিল বরাক উপত্যকার তিনটি জেলায় সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি।

(ছবিঃ- বরাক উপত্যকা)

বরাক উপত্যকা আসামের বরাক নদীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। ভারত বিভক্তির আগে বৃহত্তর কাছাড় জেলা নিয়ে বরাক উপত্যকা গঠিত। বর্তমানে কাছাড় জেলাকে বিভক্ত করে তিনটি প্রশাসনিক জেলায় রূপান্তর করা হয়েছে। এগুলো হল কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি জেলা, যা বাংলাদেশের সিলেট জেলাসংলগ্ন আসামের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত। তৎকালে বরাক উপত্যকায় প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস ছিল, যার মধ্যে আশি শতাংশই ছিল বাঙালি। এছাড়া আসামের অন্যান্য অঞ্চলেও বাঙালিদের ব্যাপক বসবাস ছিল। উল্লেখ্য, আসামে অন্য সব জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে অসমিয়াদের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা আর্থসামাজিক বিচারে বাঙালিরা ছিল অগ্রসরমান। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের নীলনকশার অংশ হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের ওপর ‘অসমিয়া জাতীয়তাবাদী’ ধ্যান-ধারণাকে চাপিয়ে দেয়ার বীজ রোপণ করে এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই বাঙালিদের বিরুদ্ধে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকদের উসকে দেয়।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরও সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অসমিয়া নাগরিকদের ভেতর এমন মানসিক দুর্ভাবনা ও আশঙ্কা ভর করে যে, অগ্রসরমান বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতি হয়তো একদিন অসমিয়া যুবকদের শুধু কর্মসংস্থান দখলই নয়, পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এ ধরনের মানসিক ভীতি থেকে আসামের রাজনৈতিক শাসকরা ১৯৪৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বাঙালি ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। আসামের প্রতি বাঙালিদের আনুগত্য নিয়ে সংশয়, সন্দেহ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে মহল বিশেষের উদ্যোগে প্ররোচনায়।

‘আসাম শুধু অসমিয়াদের জন্য’ এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে সেখানে বাঙালির অধিকার হরণের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। শুরু হয় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে অসমিয়াকরণের প্রয়াস। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং অন্যথায় তাদের অনুদান বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১-র মধ্যে সেখানে ২৫০টি বাংলা মাধ্যমের স্কুলের মধ্যে ২৪৭টিই বন্ধ হয়ে যায়। এসময় তারা অসমিয়াদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ভাষা-নীতিমালা প্রণয়ন করে।

আসামের বিধানসভাতেও অসমিয়াকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয় ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বিধানসভায় অনসমিয়াদের বেলায় বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপনের বিধান ছিল। ঐ বছর নতুন আইন পাশ করে তা কেড়ে নেওয়া হয়। ঐ আইনে বলা হয়-

‘The business of the House shall be transacted in Assamese or in English.’

তবে ঐ বিধানে তখনও অধ্যক্ষের অনুমতিক্রমে মাতৃভাষায় বক্তব্য পেশের সুযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৫৪ সালে বিধানসভায় একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের ভাষা হিসাব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তাতে আসাম রাজ্যের সর্বত্র অনসমিয়া ভাষীদের মধ্যে বিতর্ক ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অবশ্য বেসরকারিভাবে উত্থাপিত ঐ প্রস্তাব তখন বিবেচনা না করে স্থগিত রাখা হয়।

বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে। ১৯৬০-এর ২১ ও ২২ এপ্রিল “আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি”র এক সভায় অসমিয়াকে আসামের একমাত্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর পর পরই আসাম প্রদেশের শাসকবর্গ উগ্র ভাষাপ্রেমের পক্ষে অবস্থান নেন এবং অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার অপচেষ্টায় সক্রিয় তৎপরতা শুরু করেন। এ ঘোষণায় বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ভেতর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। তারা তীব্রভাবে এর প্রতিবাদ করে। অসন্তোষ দেখা দেয় চারদিকে। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো এ অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে বাঙালি অধ্যুষিত কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি জেলায়। বাঙালিরা সংগঠিত হতে থাকে সম্মিলিত আন্দোলনের জন্য। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং সরকারি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ২১ জুন ১৯৬০ শিলচরে ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’-এর উদ্যোগে এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। লোকসভা সদস্য শ্রী দ্বারকানাথ তেওয়ারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ সভায় আলতাফ হোসেন মজুমদার, নন্দকিশোর সিংহ, নিবারণচন্দ্র লস্কর, রথীন্দ্রনাথ সেন, গোলাম শগির খান, শরৎচন্দ্র নাথ প্রমুখ বিশিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং প্রতিবাদ জানান। সভায় অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে বাঙালিদের উপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করা হয়।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনকে সংহত রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে ২ ও ৩ জুলাই ১৯৬০ তারিখে আবার অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’। এই সম্মেলনে আসাম রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পঁচিশ হাজার নরনারী সমবেত হয়। বিভিন্ন জাতি, উপজাতি ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্মেলন পরিণত হয় মহাসম্মেলনে। সভায় আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে একমাত্র অসমিয়ার প্রবর্তন স্থগিত রেখে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়। কেন্দ্রের কাছে ‘ভাষার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ’ করার প্রার্থনাও জানানো হয়।

এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পরই শুরু হয় দাঙ্গা হাঙ্গামা। অসমিয়াপন্থী উগ্র দাঙ্গাবাজরা পথে নামে। নির্বিচারে বহু বাঙালির বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুঠতরাজ, হত্যা ও ধর্ষণ চলে অসমিয়া ভাষা আন্দোলনের নামে। এ উত্তেজনা-পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে যখন, অসমিয়া জনগোষ্ঠী আসামের উত্তরে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কামরূপ জেলায় ‘বাঙাল খেদাও’-এর নামে বাঙালিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চালানো হয়। এ আক্রমণের শিকার হয়ে আনুমানিক পঞ্চাশ হাজার বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে এবং নব্বই হাজার বাঙালি বরাক উপত্যকা ও আসামের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। ক্ষমতাসীন সরকার এতে পরোক্ষভাবে মদত জোগায়। যদিও সরকারের সবার এতে সমর্থন ছিল না। প্রশাসনের এক শ্রেণীর উগ্র জাতীয়তাবাদী কর্তাব্যক্তি ও পুলিশ কর্মকর্তা এসব ঘটনায় নেপথ্যে ইন্ধন জোগান। এ ঘটনার পর বিচারপতি গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে একটি একক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ওই কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, অসমিয়ারা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কামরূপ জেলায় বাঙালি অধ্যুষিত প্রায় পঁচিশটি গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে আনুমানিক ৪০৭৭টি ঘরবাড়িতে লুটপাট ও ধ্বংস করে। এছাড়াও ৯ জন বাঙালিকে হত্যা এবং সহস্রাধিক বাঙালিকে মারাত্মকভাবে আহত করে।

১৯৬০ সালের ১৫ই আগস্ট কলকাতায় শোক দিবস পালন করা হয়। উগ্রজাতীয়তাবাদী বর্বরতার প্রতিবাদে সরকারি-বেসরকারি সমস্ত অনুষ্ঠান বর্জন করা হল। পরবর্তী লোকসভা অধিবেশনে আলোড়ন উঠলে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা উত্তেজনায় ফেটে পড়লো। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু শান্তি দূত পাঠালেন গোবিন্দবল্লভ পন্থকে। পন্থজী ফরমূলা দিলেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নির্দ্বিধায় তা নাকচ করে দিলো। কাছাড়বাসীর প্রতিনিধিরা ছুটলেন দিল্লি। তাসত্ত্বেও, দিল্লি রইলো নির্বিকার।


আরো পড়ুন: উনিশের চেতনা ও বরাকের বাংলা কবিতা


অবশেষে, ১০ অক্টোবর আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা বিধান পরিষদে আসাম সরকারি রাজ্যভাষা বিল উত্থাপন করেন। বিলটি উত্থাপিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে আসামের করিমগঞ্জ (উত্তর) থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের অন্যতম সদস্য রণেন্দ্র মোহন দাস তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, ‘দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণের ভাষাকে উপেক্ষা করে এক-তৃতীয়াংশ জনগণের অসমিয়া ভাষাকে এ অঞ্চলের দাফতরিক ভাষা হিসেবে আইন পাস করা চলবে না’। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এ বিল নিয়ে আলোচনা চলে। ২৪ অক্টোবর সকল সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ-নিবেদন উপেক্ষা করে এই বিল Assam (official) Language Act (ALA-1960) রূপে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এভাবে আসামের বিভিন্ন অসমিয়া উপজাতি গোষ্ঠী ও দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী লক্ষ লক্ষ বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দাবি উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত হয়। এর প্রতিবাদে অনেক সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। মাতৃভাষার অধিকার বঞ্চিত লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষোভে, দুঃখে, উত্তেজনায় ফেটে পড়ে।

‘৬০ সালের শেষ ও ‘৬১ সালের প্রথম ভাগে বাংলা ভাষা আন্দোলন আবারও দানা বাঁধতে শুরু করে। এসময় আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বাংলা ভাষা রক্ষা সমিতি সংগঠিত হয়। এদের মধ্যে ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’, ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’ অন্যতম। এসব সংগঠন আসাম প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক গৃহীত Assam (official) Language Act (ALA-1960) বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ১৯৬০-এর ৬ ও ৯ নভেম্বর নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সম্মেলনের উদ্যোগে কনভেনশন আহ্বান করা হয়। এমনকি জেলা কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক সংগঠিত ভাষা আন্দোলন সমিতিও এ প্রতিবাদে শামিল হয়। এছাড়াও সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা, সুধীসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল ভাষা আন্দোলনে যোগ দেয়।

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ক্রমেই সংহত রূপ নিতে থাকে। ১৯৬০-এর ১৮-২০ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় উপত্যকা তথা বরাক উপত্যকার বাঙালি নাথ যুগী সম্প্রদায়ের ৩৬তম বার্ষিক অধিবেশন। ঐ অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার মতো সরকারি মর্যাদা দেওয়া না হলে বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় জেলা জনসম্মেলন। সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবি তোলা হয়। অন্যথায় সমগ্র জেলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রথমদিকে এ আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে সভা, মিছিল, সত্যাগ্রহ, পদযাত্রা, হরতাল এবং অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। চলমান আন্দোলনকে বেগবান এবং সাধারণ মানুষের ভেতর বাংলা ভাষার দাবিকে আরও জোরালো করার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিনে কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পালিত হয় ‘সংকল্প দিবস’। সংকল্প করা হয় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। এই সংকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম হিসাবে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ২৪ এপ্রিল ১৯৬১ সালে সমগ্র বরাক উপত্যকায় ‘পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রা’র কর্মসূচি শুরু করে। এ পদযাত্রায় ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রাম অঞ্চল ঘুরে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ মে আবার শিলচরে এসে শেষ হয়।

পদযাত্রার এ কর্মসূচিতে সব বরাক উপত্যকায় ব্যাপক গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। পদযাত্রা শেষে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন, ১৩ মে’র মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা না হয়, তাহলে ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হবে। একইসঙ্গে তিনি অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকেও যথাযথ স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জোর দাবি জানান। আসাম প্রাদেশিক সরকার তাদের এ ঘোষণায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে ১৮ মে গণসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেনসহ ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নলিনীকান্ত দাস ও বিধুভূষণ চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট নেতা ও প্রথিতযশা সম্পাদককে গ্রেফতার করে। সে খবর দাবানলের মতো রাতেই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। শহর জেগে ওঠে উত্তেজনায়। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জনতা নামে রাজপথে।

১৯মে’র চারদিন আগে ১৫ মে থেকেই শিলচর শহরে সরকারি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী তৎপর ওঠে। প্রতিদিন তারা শহরে রোডমার্চ করছিল। ১৯ মে’র সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সমর্থন ১৮ মে সন্ধ্যায় এক বিরাট গণ-মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে। সরকারের বিশেষ করে রেল চলাচল অব্যাহত ও আন্দোলনমুক্ত রাখতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের ঘোষনা দেয়। সত্যাগ্রহীরা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করেছিল। সত্যাগ্রহীরা প্রস্তুতি নেয় ১৮ মে রাত ১২ টার পর রেল স্টেশন দখল করে নিতে। সে অনুযায়ী সত্যাগ্রহী- বাহিনী রাতে রেল স্টেশনে পৌঁছে ঠিকই, কিন্তু পুর্ব-পরিকুল্পনা অনুযায়ী স্টেশন দখলে নিতে পারেনি। তবে পূর্বেই আসাম পুলিশ, সিআরপি , পিএসসি এবং আসাম রাইফেলসের জোয়ানরা স্টেশনের চতুর্দিক কর্ডন করে নেয়। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মহিলা সত্যাগ্রহীরা সরকারি বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এক অভিনব পন্থায় অগ্রসর হয়। এক পর্যায়ে মহিলা সত্যাগ্রহীদের কয়েকজন সাহসী মেয়ে অতর্কিতে সরকারি বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনার আকষ্মিকতায় হতচকিত সরকারি বাহিনীর লোকেরা সড়ে পড়লে সত্যাগ্রহীরা দলে দলে স্টেশনে চত্বরে ঢুকে পড়ে।

এদিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ১৯ মে ভোর চারটায় হরতাল শুরু হলে উত্তেজিত জনতা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলা কান্দি জেলায় সরকারি অফিস, আদালত ও রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান গ্রহণ করে। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পুরুষ-মহিলা সবাই আন্দোলনের সমর্থনে, বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায়। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে এ গণজোয়ার দেখে প্রাদেশিক সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা শহরগুলোতে আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশের টহল নামায়। সত্যাগ্রহীরা নিরস্ত্র, অহিংস। তবুও পুলিশি লাঠিচার্জ হয়েছে তাদের ওপরে। কাঁদানো গ্যাস শেল নিক্ষেপ হয়েছে তাদের ওপর। সত্যাগ্রহীদের কেউ কেউ পুলিশের শেলই তুলে নিয়ে পালটা ছুড়ে মেরেছে পুলিশের দিকে। তবুও স্টেশন থেকে সত্যাগ্রহীদের সরানো যায়নি।

সকাল থেকে হরতালের কর্মসূচি কোনো ধরনের অঘটন ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছিল; কিন্তু দুপুরের পর থেকে আসাম রাইফেলস ও পুলিশ অবস্থান ধর্মঘট পালনকারীদের গ্রেফতার শুরু করলে চারদিকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি ক্রমেই জঙ্গিরূপ ধারণ করতে থাকে।

এদিকে সারা শহরে সত্যাগ্রহীদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করা হয়। সকাল ১১ টার মধ্যে প্রায় ২ হাজার সত্যাগ্রহীকে জেলে পোরা হয়। একদলকে গ্রেফতার করা হলে নেতৃত্বের নির্দেশ মতো অন্যদল সে স্থান সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করে নেয়। আন্দোলনকারী অনেককে পুলিশ ট্রাকে তুলে দূরে ফেলে আসে। সত্যাগ্রহীদের ট্রাক সঙ্গে সঙ্গে তাদের তুলে শহরে নিয়ে আসে। বিকেল চারটা পর্যন্ত সত্যাগ্রহের সময়সীমা ছিল। কোন বড় অঘটন ছাড়া কেটে যায় বেলা আড়াইটা পর্যন্ত। বেলা আনুমানিক আড়াইটের সময় পুলিশের একটি দল ট্রাকে করে ৯ ধর্মঘট পালনকারী বাঙালিকে কাটাগড়া থেকে গ্রেফতার করে শিলচরের তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানকারী উত্তেজিত বাঙালিরা ট্রাকটিকে থামিয়ে দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পুলিশের সদস্যরা দ্রুত ট্রাক ছেড়ে চলে যায়। পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে গেলে উত্তেজিত জনতা ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রহরারত আধাসামরিক বাহিনীর একদল সদস্য জনতার ওপর চড়াও হয় এবং বেদম লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে উত্তেজনা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে।

(ছবিঃ- তারাপুর রেলস্টেশনে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ)

এরই মধ্যে কাটাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারীক রেবতি পালের নির্দেশে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই আধাসামরিক বাহিনী ও আসাম রাইফেলস-এর সদস্যরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে রাইফেলের গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে কমলা ভট্টাচার্যসহ ১২ বাঙালি একের পর এক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ ১২ জনের মধ্যে ৯ জন ঘটনার দিন এবং পরবর্তী সময়ে আরও দু’জন তরুণ তাজা প্রাণ মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। জনতার সহায়তায় লাশ এবং আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সারা শহরের মানুষ হাসপাতালমুখী। এর মধ্যে আচমকা ঘোষিত হয় বিকেল পাঁচটা থেকে সান্ধ্য আইন বলবৎ হবে। সিভিল সার্জন জানালেন লাশের পোস্টমর্টেম শেষে পরদিন সব মরদেহ ফেরত দেওয়া হবে। সত্যাগ্রহীরা ঘোষনা দিলেন লাশ নিয়ে পরদিন শোক মিছিল বের হবে টাউন ক্লাব মাঠ থেকে। সান্ধ্য আইনের সুযোগে বিএসএফ হাসপাতাল থেকে লাশগুলো গুম করে নিতে চেয়েছিল। সত্যাগ্রহীদের সতর্ক প্রতিরোধ ও সিভিল সার্জন আশুতোষ মুখার্জীর সাহসী ভূমিকার জন্য তাদের সে চক্রান্ত সফল হয়নি।

(ছবিঃ- বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের শহীদরা)

১৯ মে গুলিবর্ষণের পর স্টেশন চত্বরে ৯ টি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। ঘটনার দিন যে ৯ জন শহীদ হন তারা হলেন :

১.কমলা ভট্টাচার্য

২.শচীন্দ্রচন্দ্র পাল : মাত্র উনিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বুক পেতে নিয়েছিলেন আসাম সরকারের বুলেট শচীন্দ্র পাল। তাঁদের পূর্বনিবাস ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার নবিগঞ্জের সন্দনপুর গ্রামে। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে শচীন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। কাছাড় হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন।

৩.কানাইলাল নিয়োগী : আদিনিবাস ময়মনসিংহ জেলার খিলদা গ্রামে। মেট্রিক পাশ করে ১৯৪০ সালে রেলে চাকরি নেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শহীদ হন। তখন তাঁর মা শান্তিকণা নিয়োগীর বয়স ৭০ বছর। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী আগেই প্রয়াত।

৪.কুমুদরঞ্জন দাস : পিতা কৃষ্ণমোহন দাস মৌলভিবাজারের জুরি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কাছাড়ে যান। মায়ের মত্যুর পর আট বছর বয়সে কুমুদ দাস ত্রিপুরায় মামার বাড়িতে থেকে এম.ই. পর্যন্ত পড়ে গাড়িচালকের পেশা গ্রহণ করেন। পরে শিলচরের তারাপুরে চা-দোকানে বয়ের কাজ নেন। বৃদ্ধ পিতা, চার বোন ও এক শিশু ভাইকে নিয়ে সংসার ছিল তাঁদের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন কুমুদ দাস।

৫.তরণী দেবনাথ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের সময় শিলচরে গিয়ে বসবাস [শুরু] করেন পিতা যোগেন্দ্র দেবনাথ। মৃত্যুকালে বয়ন ব্যবসায়ী তরণীর বয়স ছিল মাত্র একুশ বছর।

৬.হীতেশ বিশ্বাস : বাস্তুহারা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পিতৃহীন হীতেশ বিশ্বাস মাত্র বার বছর বয়সে ত্রিপুরার খোয়াই শহরের উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দা হন। মা, ছোট ভাই ও এক বোনের সংসার ছিল তাঁদের। শিলচর শহরে ভগ্নিপতির বাসায় অবস্থানকালে মাতৃভাষার জন্য জীবনদান করেন।

৭.চন্ডীচরণ সূত্রধর : পিতৃহীন চন্ডীচরণ সূত্রধর ১৯৫০ সালে হবিগঞ্জের জাকেরপুর গ্রাম থেকে মামার সঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেন শিলচরে। পড়াশোনা এম.ই. পর্যন্ত। জীবিকা হিসেবে পৈতৃক বৃত্তি কাঠমিস্ত্রির কাজেই নিয়োজিত করেন নিজেকে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভাষার জন্য আত্মদান করেন। তিনি তখন একা শিলচরের রাঙ্গির খাড়িতে বাস করতেন।

৮.সুনীল সরকার : ঢাকার মুন্সিবাজারের কামারপাড়া থেকে ভারত বিভাজনের বলি হয়ে শিলচর শহরের নূতন পট্টিতে গিয়ে ঘর বাঁধেন [সুনীল সরকারের] পিতা সুরেন্দ্র সরকার। ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রের তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে সুনীল ছিলেন সবার ছোট। মাত্র এম.ই. পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন সুনীল।

৯.সুকোমল পুরকায়স্থ : করিমগঞ্জের বাগবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিতা সঞ্জীবচন্দ্র পুরকায়স্থ ডিব্রুগড়ে ব্যবসা করতেন। অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৫৯ সালে ‘বঙ্গাল খেদাও’ অভিযানের শিকার হয়ে সপরিবারে স্বগ্রামে চলে আসেন। ভাষা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়ে মাতৃভাষার ঋণ শোধ করেন সুকোমল।

ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ২০ মে যে দু’জন শহীদ হন তারা হলেন :

১.বীরেন্দ্র সূত্রধর : শৈশবে বাস্তুহারা হয়ে পিতামাতার সঙ্গে নবিগঞ্জের [হবিগঞ্জের] বহরমপুর গ্রাম থেকে শিলচর যান। জীবিকার অন্বেষণে বর্তমান মিজোরামের রাজধানী আইজল শহরে গিয়ে কাঠমিস্ত্রির পেশা অবলম্বন করেন। বিয়ে করেন ত্রিপুরার ধর্মনগরে। পরে কাছাড় জেলায় অবস্থিত মণিপুর চা বাগানের কাছে ঘর ভাড়া নেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ১৮ বছরের বিধবা স্ত্রী ও এক বছর বয়সী কন্যা রেখে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে আত্মদান করেন তিনি। শিলচর রেল স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে ২০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

২.সত্যেন্দ্রকুমার দেব : মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করেন। উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরায় নূতন রাজনগর কলোনিতে তিন বোন ও মাকে নিয়ে আশ্রয় নেন পিতৃহীন সত্যেন্দ্র। মা ও বোনকে সেখানে রেখে জীবিকার অন্বেষণে শিলচরে গিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পড়াশোনা ছিল প্রাইমারি পর্যন্ত। তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় ২০ মে শিলচর রেল স্টেশনের পুকুর থেকে।

উল্লেখিত ১১ শহীদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক। তিনি ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রামরমন ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম সন্তান কমলা। কমলা ভট্টাচার্যদের আদি নিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে কমলা ও তার পারিবারের অন্যান্য সদস্য বাংলাদেশ ছেড়ে আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে চলে যায় এবং শিলচর পাবলিক স্কুল রোডে বসবাস শুরু করেন। কমলা শিলচরের চোতিলাল সেন ইন্সটিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ১৮ মে ১৯৬১ সালে তার মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়। চলমান ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে কমলা বরাবরই সচেতন ছিলেন। এ কারণে তিনি মেট্রিক পরীক্ষার পর আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন বলে মনস্থির করেন।

১৯ মে হরতাল শুরু হলে শিলচরের তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান ধর্মঘটে অংশগ্রহণের জন্য সেদিন সকালে যখন তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার বড় বোন প্রতিভা সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে তাকে ধর্মঘটে যেতে নিষেধ করেন। এরপরও এ মহীয়সী সাহসী নারী তার বড় বোনের নিষেধ উপেক্ষা করে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য বেরিয়ে পড়েন। কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী কমলার এ সংগ্রামী চেতনায় খুশি হন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পুলিশের টিয়ার গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এক টুকরো কাপড় কমলাকে ধরিয়ে দেন। কমলার সঙ্গে কমলার ছোট বোন মঙ্গলাও বেরিয়ে পড়ে ধর্মঘটে অংশগ্রহণের জন্য। অবস্থান ধর্মঘটকালে আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা যখন লাঠিচার্জ শুরু করে, তখন মঙ্গলা সেই লাঠির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। ততক্ষণে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে কমলা তার বোনের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে গেলে একটি বুলেট তার চক্ষু ভেদ করে মাথায় আঘাত করে এবং মুহূর্তে কমলা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এভাবেই বাঙালির প্রথম নারী ভাষাসৈনিক মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মাহুতি দেন। ভাষার জন্য কমলা ভট্টাচার্যের সেদিনের সেই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ সমগ্র বাঙালি নারী সমাজকে করেছে মহিমান্বিত।

১৯ মে গুলিবর্ষণের পর স্টেশন চত্বরে তাৎক্ষণিক ভাবে ৯ টি মৃতসেহ পাওয়া গিয়েছিল। পরদিন ২০ মে এই মৃতদেহ কাঁধে বহন করে বিরাট শোক মিছিল সারা শিলচর শহর প্রদক্ষিণ করে। ২০-২১শে মে মৃতদেহের সংখ্যা দাঁড়ায় এগারোতে। এই মৃতদেহগুলিও কাঁধে বহন করে ২১ মে শহরে শোক মিছিল হয়।

(ছবিঃ- ২০শে মে-এর শোকমিছিল)

২৯ মে বরাক উপত্যকার সর্বত্র একাদশ আত্মোৎসর্গী বীরদের স্মরনে শোক দিবস পালন করা হয়। সে সঙ্গে একটি ব্যতিক্রমী কর্মসূচিও নেয়া হয়েছিল। এ দিন সর্বত্র ঘরে ঘরে অরন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। বেলা ২ টা পর্যন্ত সকল সরকারি অফিসে সত্যাগ্রহীদের পিকেটিং চলে। বেলা ঠিক ২টা ৩৫ মিনিটে শহরে-গ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষ নীরবতা পালন করে। ১৯মে এ সময়ই পুলিশ গুলি বর্ষন করেছিল। এ সময় বেসরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। জেলের বন্দিরাও জেলের ভিতরে শোক দিবস পালন করে। ১৯ মে পুলিশ গুলিবর্ষন করে ১১ জন ভাষাপ্রেমিককে হত্যার প্রতিবাদে, নিহতদের স্মরণে ও বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে লোকসভা ও বিধান সভার সদস্যবৃন্দ, মহকুমা পরিষদ, পঞ্চায়েত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণও পদত্যাগ করেন।

১৯ মে গুলি বর্ষণ এবং ১১টি তরতাজা প্রাণের আত্মবলিদানের পর আন্দোলনের নেতৃত্ব সত্যাগ্রহের গতানুগতিক ধরন পালটিয়ে অন্যরকম কর্মসূচি হাতে নেন। তাঁরা এ পর্যায়ে অফিস সমূহের গেইটে বা বারান্দায় সত্যাগ্রহ পালন না করে, সত্যাগ্রহীরা সকালে অফিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকে অফিসে চেয়ারে বসে পড়তেন। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ বসার জায়গা না পেয়ে ফিরে যেতেন। এমনিভাবে সমস্ত প্রশাসন একমাসব্যাপী অচল হয়ে পড়েছিল।

বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের ঘটনা পর্যালোচনা করলে ১৯৫২ সালের বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, আন্দোলনের কৌশল এবং আন্দোলনোত্তর বাংলা ভাষার স্বীকৃতি অনেকটা একই ধারায় পরিচালিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এটা বলা যায়, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, আন্দোলনের রণকৌশল, এমনকি ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ঘটনা পথপ্রদর্শক হিসেবে নিঃসন্দেহে আসামের আন্দোলকারীদের জুগিয়েছে সাহস এবং সেখানকার বাঙালিরা ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং তারই পথ ধরে বাংলা ভাষাকে করেছে প্রতিষ্ঠা।

(ছবিঃ- ভাষাশহিদদের সম্মানে স্মারক, শিলচর রেলস্টেশন)

১৯৬১ সালের ১৯ মে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা ভারতব্যাপী অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলনের দাবির পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। আন্দোলনের ঐক্য ও ব্যাপকতা লক্ষ্য করে সরকার পক্ষ আপসের উদ্যোগ নেয়। কাছাড় গণ-সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী দিল্লীতে এক বৈঠকে বসেন এবং বরাক উপত্যকার ভাষা সমস্যার সমাধানকল্পে আলোচনার প্রস্তাব দেন। আলোচনার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সকল রাজবন্দীর মুক্তিদান ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত করণের সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ি বন্দীমুক্তির দিন ধার্য হয় ১৬ জুন।

কিন্তু পুর্বাহ্নে জানা যায় সরকার সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিচ্ছে না। ফলে আন্দোলনের নেতৃত্বের নির্দেশে মুক্তিপ্রাপ্তরা সকল রাজবন্দির মুক্তি না দিলে জেল থেকে বের হতে অস্বীকৃতি জানান। সরকার বাধ্য হয়ে পরদিন ১৭ জুন সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে দিল্লির কেন্দ্রীয় কংগ্রেস লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে চলমান সংকট উত্তরণে উপায় উদ্ভাবনের জন্য দায়িত্ব প্রদান করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনার জন্য ছুটে আসেন শিলচর শহরে। আলোচনার ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধী হয়- আসাম সরকার বরাক উপত্যকার জেলাপর্যায়ে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি দেয়। পরে সন্ধী অনুযায়ী ১৯৬০ সালের ভাষা আইন সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী নিম্নলিখিতভাবে Assam (official) Language Act (ALA-1960) সংশোধনের প্রস্তাব করেন :

১.যার যার অঞ্চলে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সরকারি ভাষা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করা।

২.বৃহত্তর কাছাড় জেলা, পার্বত্য অঞ্চল ও প্রাদেশিক রাজধানীর সঙ্গে সরকারি পত্রালাপ বা যোগাযোগের মাধ্যম হবে ইংরেজি।

৩.প্রাদেশিক পর্যায়ে সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়া ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষা চালু থাকবে এবং

৪.ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রচলিত ভাষা রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতারা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর এ প্রস্তাবে প্রাথমিক পর্যায়ে বিরোধিতা করলেও পরবর্তী সময়ে কিছুটা নমনীয় ও সতর্ক সাড়া দেন। অবশেষে আসাম প্রাদেশিক সরকার লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর প্রস্তাবের সূত্র ধরে ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে Assam (official) Language Act (ALA-1960) সংশোধন করে বাংলাকে কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

১৯৬০ সালে আসাম ভাষা আইন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে বরাক উপত্যকায় শুধু যে বাংলা ভাষাভাষীদের অধিকার বিপর্যস্ত হয়েছিলো, তা নয়। অন্যান্য ভাষাভাষীদের ভবিষ্যৎ জীবনও অন্ধকারে ডুবতে বসেছিল। তাই নিজেদের আলাদা ভাষা থাকা সত্ত্বেও অন্য ভাষাভাষীরা বাংলা ভাষা আন্দোলনে সচেতন ভাবে অংশগ্রহন করেছিলেন। এই আন্দোলনকে সার্বজনীন রূপ দেবার জন্য বিভিন্ন ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের নেতারা কঠোর পরিশ্রম করেন। বিধান সভার সদস্য পদ ত্যাগ করে বিশ্বনাথ উপাধ্যায় চা বাগান ও অন্যান্য এলাকায় ঘুরে ঘুরে আন্দোলন সংগঠিত করেন। মণিপুরি নেতা সন্তু সিংহ, মদন মুখার্জি, নন্দকিশোর সিংহ প্রমুখের নেতৃত্বে মণিপুরি গ্রামে গ্রামে সভা বৈঠক হয়। করিমগঞ্জ শহরে অনুষ্ঠিত জনসভায় কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র শিক্ষানুরাগী ডঃ ত্রিগুণা সেন ও পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নন্দগোপাল ভট্টাচার্য এই আন্দোলনকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন।

১৯৬১ সালে সফল ভাষা আন্দোলনের পরও বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার উপর আন্দোলন বন্ধ হয় নাই। মণিপুরি ভাষার উপরও আক্রমণ এসেছে। ১৯৭২ সালে শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার দাবী জানাতে গিয়ে আত্মউৎসর্গ করেন বাচ্চু চক্রবর্তী। ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ সফর করেন। এই কালপর্বে আসাম সরকার নতুন ভাবে বরাক উপত্যকার সকল স্কুলে অসমীয়া ভাষাশিক্ষা বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ জারি করে। ২১ জুলাই মুখ্যমন্ত্রীর আগমনের দিন উক্ত নির্দেশ বাতিলের দাবিতে করিমগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচী পালন করা হয়। পুলিশ ঐ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে দু’জন যুবক নিহত হয়। এই দুই যুবকের নাম জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাশ। এই দু’জন নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ তে।

এ কথা গর্ব করেই বলা যায়, বাঙালি হল এমন এক জাতি, যারা মাতৃভাষা রক্ষার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ ‘জান দেবো, তবু জবান দেব না’ স্লোগানে মুখরিত হওয়া বরাক উপত্যকার সেই ভাষা আন্দোলনের কথা আজ আমরা কতজনইবা মনে রেখেছি? ’৫২-এর পরে ’৬১—একই ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ন’ বছরের ব্যবধানে দু’টি আন্দোলন দু’টি ভিন্ন দেশে। বিশ্বের ইতিহাসে এ এক বিরল ঘটনা। আমরা, বাঙালিরা, যেন মনে রাখি, একুশের পাশাপাশি আমাদের একটা উনিশেও আছে, ১৯ মে – কমলাদের আত্মত্যাগের দিন।

 

 

 

(সমস্ত ছবির সুত্রঃ- ইন্টারনেট)

Bengali Language Movement (Barak Valley) – Wikipedia

Bengali language movement in India – Wikipedia

In Language Movements of West Bengal and Assam, a Parallel in Governments’ Responses

https://www.researchgate.net/publication/290430979_Oblivion_of_Language_Movement_and_Martyrs_of_Silchar

বরাক উপত্যকা বাংলাভাষা আন্দোলন

বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা আন্দোলন

একুশের পাশাপাশি আমাদের একটা উনিশেও আছে – KhaborOnline

আসামের ভাষা আন্দোলন : ফিরে দেখা ইতিহাস | Fateh24

আসামে বাংলা ভাষা আন্দোলন

বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন | | অপূর্ব শর্মা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত