| 10 অক্টোবর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

দেখেছি শুনেছি বুঝেছি যা-কিছু, লিখে দিয়েছি

কোনো সম্পর্ক ছাড়াই তোমার ভালো লাগুক

বা না-লাগুক, সে তোমার ব্যাপার ;

আমার কাছ থেকে সাজানোগোছানো ভাষা

একেবারেই প্রত্যাশা ক’রো না।

জীবনের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলতে চলতে

আমার ভাষাও হয়ে গেছে কাঠখোট্টা।

আমি কবিতার পরিভাষা বুঝি না

জ্ঞান নেই কবিতার ছন্দ-মাত্রার,

শব্দ ও ভাষার ওপরেও নেই কোন দখল।

ঘর-গেরস্থালি সামলাতে সামলাতে

নিজের হকের লড়াই করতে করতে

যা কিছু দেখেছি শুনেছি ভোগ করেছি

আশপাশের সঙ্গীসাথীদের বলেছি অকপট ;

যেমনতেমন করে ভাঙাচোরা অক্ষরে

সে সবই লিখে দিয়েছি সময়ের স্লেটে –

পড়ো অথবা না-পড়ো, তোমার মর্জি !

কিংবা মুছে দাও, ভেঙে ফেলো স্লেটখানি।

তবে মনে রেখো, আবার কেউ আসবে

তোমার সঙ্গে থেকে যা-কিছু দেখবে শুনবে

আবার লিখবে কেউ, বলবে সে সবই !

তোমার কাছে শব্দ আছে তর্ক আছে বুদ্ধি আছে

সমস্ত শাসন-ক্ষমতাও তোমারই হাতে,

বারবার বলে বলে তুমি সত্যিকে মিথ্যে বানাতে পারো

একটিমাত্র বাক্যে খারিজ করতে পারো আমার সবকিছু

চোখেদেখাকেও প্রমাণ করতে পারো ভুল…

জানি, আমি সব জানি –

তবে ভুলে যেও না, সমস্ত জীবন দিয়ে

সত্যকে সত্য আর মিথ্যেকে মিথ্যে বলার মত লোক

এখনও কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি।


 

ততই জন্ম নেবে নির্মলা পুতুল

এই তো লেগেছে আগুন

আগুন লেগেছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত

আমি জ্বলছি তোমার শাসনব্যবস্থায়

জ্বলছি আর থেকে থেকেই ফুঁসে উঠছে আগুন…

এ কারণেই নীরব থাকব না আর

তোমার বিরুদ্ধে উসকে দেব আরো আরো আগুন

যত নিষেধ করবে, ততই চিৎকার করব

জানি, মাথায় পাথর তুলে মারবে আমায়

তবে মনে রেখো, আর ভাঙছি না আমরা

তোমার ভয়ের আঁধিতে ভেসে যাব খরকুটোর মত

তা আর হবে না।

মাথা ফাটবে না বরং চূর্ণ হবে তুমি

গুঁড়িয়ে যাবে তোমার ওই হাতের পাথর।

আর যদি কোনভাবে হেরেও যাই এ বার

তোমার মগজের ডায়েরিতে

আজকের তারিখ দিয়ে লিখে নাও –

এ মাটিতে যত ঝরবে রক্তবিন্দু

শূন্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে

ততই জন্ম নেবে নির্মলা পুতুল !

 


আরো পড়ুন: একগুচ্ছ হিন্দি কবিতা । রতি সক্সেনা


 

আদিবাসী মেয়েদের সম্পর্কে

ওপর ওপর দেখতে কালো

ভিতরে কিন্তু ঝকঝকে দাঁতের মত শান্ত শুভ্র

ফেনিল দুধের মত হাসে যখন ওরা

ছলনাহীন হাসি –

যেন পাহাড়ের কোল থেকে

ঝরঝর ঝরে পড়ছে মিষ্টি জলের ধারা

মাদলের দ্রিমি দ্রিমি তালে

মাথায় গুঁজে হলুদ-সবুজ পাতা

যখন ওরা নাচতে থাকে সারিবদ্ধ

অকাল বসন্ত আসে যেন !

ফসল রোয়া আর কাটার কাজে যখন

মাঠে মাঠে গান গায় ওরা

বলা হয়, ভুলে যায় নাকি জীবনের কষ্ট !

ওদের নিয়ে কে বলেছে এতবড় মিথ্যে? কে?

নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে কোন পেটমোটা মাতব্বর

সত্যিকে ধাঁধিয়ে দেবার নির্লজ্জ সওদাগর কোনো

অথবা শব্দের সঙ্গে মিথ্যাচার করা কোন কবি

আসলে সে মস্তিষ্কেই বিকলাঙ্গ !

 


আরও এক বার

আরও এক বার

ভাড়াকরা ভিড়েঠাসা সভাঘরে

আমরা জমায়েত হব

আরও এক বার

আমাদের মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন

আধকাটা ব্লাউজ়পরা উন্নাসিক মহিলা

প্রতিনিধিত্বের নামে

আমাদের সামনে মঞ্চাসীন হবেন তিনি

 

আরও এক বার

বিশাল ব্যানারের সামনে

ক্ষমতার বিরুদ্ধে মঞ্চের মাইকে তুলবেন আওয়াজ

আর আমাদের লক্ষ করতালিতে

হাত তুলে মিথ্যে সঙ্গে থাকার বার্তা দেবেন

আরও এক বার

আমাদের সভাকে সম্বোধিত করবেন

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী

সভায় তাঁর উপস্থিতি নিয়ে

আমরা গৌরবান্বিত বোধ করব

আরও এক বার

তর্কের উত্তাপে পুড়বে নপুংসক বিচার

এবং পণ হত্যা বলাৎকার যৌন নিপীড়ন

আর বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে

নেওয়া হবে অনেক অনেক শপথ

আরও এক বার

আমাদের শক্তি প্রদর্শন করে শহরের অলিগলিতে

মিছিল করব পুরুষ শাসনের বিরুদ্ধে

শূন্যে তোলা মুষ্টিবদ্ধ হাত

আর শ্লোগানের উত্তাপে

গরম হয়ে উঠবে শহরের হাওয়া

আরও এক বার

পথের দু’পাশ জুড়ে নির্ভয়ে তাকিয়ে দেখবে

সবকিছু আমাদের দুই চোখ

রোমাঞ্চিত হয়ে বলাবলি করব –

বসন্ত এসে গেছে

আরও এক বার

শহরের ব্যস্ততম চৌরাস্তায়

একত্রিত হয়ে উত্তেজক শ্লোগান তুলব

আর সেখানেই

দেওয়ালে সাঁটানো পোস্টারে দেখব

নায়কের দু’বাহু ধরে ঝুলছে

ব্রা-প্যান্টি পরা নির্লজ্জ সিনে-নায়িকা

দেখাবে বুড়ো আঙুল আমাদের

ভেতরের আগুনও নিভে আসবে ধীরে ধীরে

আর, আরও এক বার

আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাব চৌরাস্তার চার ধার

ঘরের লোক আর বাচ্চাদের

অফিস আর স্কুল থেকে ফেরার চিন্তায়

 

 

খবর কাগজ বেচে মেয়ে

খবরের কাগজ বেচে মেয়ে

খবরকাগজ বেচছে

নাকি খবর বেচছে –

জানে না সে

আমি কিন্তু জানি

রুটির তাগিদে সে

বেচছে তার আওয়াজ

ছবি ছাপা হয়েছে খবরকাগজে –

তারই মত দুর্দশাগ্রস্ত কিছু মেয়ের

তার মুখের সাথে মিলও আছে কিছু

কখনো সে ছবি দেখে

কখনো নিজেকে

আবার কখনো তার খদ্দেরদের

সে জানে না

আজকের তাজা খবর কী

শুধু এটুকুই জানে –

কাল নোংরা মজা করে

তাকে ধমকেছিল পুলিশ

সে জানে না যে, খবরকাগজ নয়

নিজেকেই সে বেচছে

কেননা খবরকাগজে ছাপা হয়েছিল

যে মেয়েগুলোর ছবি

তাদের মুখের সাথে

তার মুখের অনেক মিল

 

 

পিলচু বুড়িকে

(সাঁওতাল আদিবাসী সমাজের বিশ্বাস সৃষ্টির প্রথম নারী পিলচু বুড়ি এবং প্রথম পুরুষ পিলচু বুড়ো)

 

পিলচু বুড়ি, সত্যি সত্যি বলো তো

সত্যিই তোমার অঙ্গুলিহেলনে নাচত

তোমার সখা পিলচু হাড়াম ?

শোনা যায়, একটিমাত্র চুম্বনের আকাঙ্ক্ষায়

সবসময় সে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত !

মালা গাঁথত নিজের হাতে

তোমার অঙ্গে, তোমার বেণীতে পরিয়ে দিত ?

পলাশের লাল লাগিয়ে দিত তোমার গালে ?

তোমাকে খুশি করার জন্য

ঘন্টার পর ঘন্টা নাচ করত সে ?

 

আমার দিদা বলত –

তখন তুমি ছিলে এই ধরিত্রীর অধিষ্ঠাত্রী,

আর তোমার মুখ দেখার জন্যে

সে ছিল মুগ্ধ ভৃত্য !

দিদা সত্যি বলত, পিলচু বুড়ি ?

 

যদি হ্যাঁ হয়,

তাহলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে

এই মগজহীন মানুষগুলোই তোমার বংশজ –

যারা একে ছেড়ে ওকে

ওকে ছেড়ে অন্য আরো কাউকে তুলে আনে,

তুলে এনে ঘর বসায় !

খিদে শুধু মন জুড়োবার।

সত্যি সত্যি বিশ্বাস হয় না, পিলচু বুড়ি

এরাই তোমার বংশজ ?

কিছুতেই বিশ্বাস হয় না !

 

আদিবাসী মেয়ে মানুষেরা

যা-কিছু চোখের সামনে

ততটুকুতেই সীমিত ওদের দুনিয়া

এই দুনিয়ার মধ্যে আছে আরো অনেক দুনিয়া

জানে না ওরা

ওরা জানে না ওদের সামগ্রী

কীভাবে পৌঁছে যায় সুদূর দিল্লিতে

রাজপথ অব্দি পৌঁছতেই যদিও

পাকদন্ডীতে হারিয়ে যায় ওদের দুনিয়া

ওরা জানে না

ওদের দুনিয়া পর্যন্ত আসতে আসতে

কীভাবে শুকিয়ে যায় নদী

কীভাবে পৌঁছে যায় ওদের ছবি

মহানগরে

ওরা জানে না ! জানে না !!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত