| 18 এপ্রিল 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

ইরাবতী সাহিত্য: একগুচ্ছ ভিলানেল কবিতা । অনিন্দ্য রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
ভিলানেল
(Villanelle)

উনিশ পঙ্‌ক্তির কবিতা ভিলানেল, ছয়টি স্তবকের। প্রথম পাঁচটি স্তবক তিন পঙ্‌ক্তির এবং শেষেরটি চার পঙ্‌ক্তির।
প্রথম স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় পঙ্‌ক্তিদুটির পুনরাবৃত্তি হয়, প্রথমটি ফিরে আসে দ্বিতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তি হিসেবে। প্রথম স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তিটি ফিরে আসে তৃতীয় ও পঞ্চম স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তি হিসেবে এবং শেষ স্তবকের চতুর্থ পঙ্‌ক্তি হিসেবে।
প্রথম স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় পঙ্‌ক্তিদুটির মধ্যে অন্ত্যমিল থাকে। প্রথম স্তবকের প্রথম পঙ্‌ক্তির সঙ্গে প্রতিটি স্তবকের প্রথম পঙ্‌ক্তির অন্ত্যমিল থাকে। একইভাবে প্রথম স্তবকের দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির সঙ্গে অন্ত্যমিল থাকে প্রতিটি স্তবকের দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির।
অন্ত্যমিল-বিন্যাস ক খ ক´ ক খ ক˚ ক খ ক´˚ ক খ ক˚ ক খ ক´˚ ক খ ক˚ ক´˚
(˚ চিহ্ন পুনরাবৃত্তি বোঝাতে ব্যবহৃত, ক´ প্রথম স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তির শেষ ধ্বনি )।
এই সব নিয়ম মেনে লেখা ভিলানেল হল নির্দিষ্ট কবিতারূপ (fixed verse form)।
এর উদ্ভব গাথাধর্মী গান থেকে, চাষীদের গাওয়া গানের দ্বারা অনুপ্রাণিত এই ধারাটির প্রাথমিক অবস্থায় বাঁধাধরা কোনো নিয়ম ছিল না। পল্লীবিষয়ক এই রচনাগুলি ছিল খানিক অমার্জিত আর পুনরাবৃত্তির প্রবণতা ছিল প্রবল। জঁ প্যাসার ( ১৫৩৪-১৬০২) কবিতা ‘ভিলানেল’ (আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে … ) থেকে এই ফর্মটি নির্দিষ্ট রূপ পায়।
ভিলানেল শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দ ‘ভিলানেলা’ থেকে, যার অর্থ গ্রাম্য গান বা নাচ । ‘ভিলানেলা’ আবার এসেছে ‘ভিলানো’ থেকে যার মানে পল্লীবিষয়ক, যার উৎস আবার মধ্যযুগীয় ল্যাটিনের ‘ভিলানাস’ শব্দটি, অর্থ খেতমজুর । ব্যুৎপত্তিগতভাবে গ্রামজীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক ভিলানেল বহন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত সাধারণভাবে পল্লীগীতি বোঝাতেই ব্যবহৃত হত শব্দটি।


 

 

 

হাট্টিমার ভিলানেল

 

চাঁদেরও রয়েছে জ্যোৎস্নার সীমা

কোথাও আড়াল থাকে, তাই দিয়ে

স্কুলমাঠে নেমে আসে হাট্টিমা

 

আহা! অপরূপ তার ভঙ্গিমা

কিছু দেখা যায়, কিছু দেখিনি হে

চাঁদেরও রয়েছে জ্যোৎস্নার সীমা

 

প্রতিরাতে একবারও পূর্ণিমা

হয় ঝুপ করে দারোয়ান-গৃহে

স্কুলমাঠে নেমে আসে হাট্টিমা

 

মাঠে খর্বুটে ছায়ার প্রতিমা

ঘুরতে ঘুরতে যাচ্ছে হারিয়ে

চাঁদেরও রয়েছে জ্যোৎস্নার সীমা

 

সাদা সাদা সাদা ডিমের গরিমা

ছড়ানো রয়েছে, কীসের স্মৃতি এ

স্কুলমাঠে নেমে আসে হাট্টিমা

 

কে তাকে ধরেছে? কীসের মহিমা

সহসা ফুসলে তাকে পোষে? বিয়ে?

চাঁদেরও রয়েছে জ্যোৎস্নার সীমা

স্কুলমাঠে নেমে আসে হাট্টিমা

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bengali-poetry-in-assam

 

 

সারারাত বাজে ওই বাড়িতে রেডিও

 

ভাঙা পাঁচিলের ফাঁকে পথ গোপনীয়
কখনও ঢোকে না কেউ বা বেরিয়ে আসে
সারারাত বাজে ওই বাড়িতে রেডিও

আমরাও দূর থেকে খানিক সমীহ
করে আলোচনা করি এ ভাদর মাসে
“ভাঙা পাঁচিলের ফাঁকে পথ গোপনীয়”

লতাপাতা ঢেকে রাখে উঠোনে বেদিও
গিরগিটি ঘোরে আর লাফায় খটাশে
সারারাত বাজে ওই বাড়িতে রেডিও

“যদি কোনওদিনও যাও আমাকেও নিও”
বলেছি নাপিতটিকে জ্বরের তরাসে
“ভাঙা পাঁচিলের ফাঁকে পথ গোপনীয়”

বাসনা, অজড়, আর থাকে না স্বকীয়

জটিলাকুটিলা করে নালিশ সকালে
সারারাত বাজে ওই বাড়িতে রেডিও

ময়ূরী তো রাজি নয়, দারুণ জেদি ও

ভাঙা পাঁচিলের ফাঁকে পথ গোপনীয়

ঘুরঘুর করি বাড়িটির আশেপাশে
সারারাত বাজে ওই বাড়িতে রেডিও

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya kobita habib emonn

 

 

রাক্ষুসি

 

এ গ্রামে পুকুরের সুহৃদ নাম হয়

পাড়ের তালসারি খেলার সহচর

প্রতিটি বালকের দুচোখে জলাশয়

 

প্রতিটি বালিকার হংসী মায়াময়

সদলে সাঁতরায়, কোঁদলে অকাতর

এ গ্রামে পুকুরের সুহৃদ নাম হয়!

 

হাওয়ায় কথা ওড়ে, কথায় নিরাময়

কখনও কারো নাকি হয় না জ্বরটর

প্রতিটি বালকের দুচোখে জলাশয়

 

এখানে তো আমার আসার কথা নয়

তবুও পোস্টিং হয়েছে এ বছর

এ গ্রামে পুকুরের সুহৃদ নাম হয়?

 

রুগীও সারাদিনে জোটে না কতিপয়

কেবল তুমি এসে বলছ, “ডক্টর

প্রতিটি বালকের দুচোখে জলাশয়

 

শুকিয়ে যাক, যেন সকলে অনুনয়

আমার কাছে করে পিপাসা মেটানোর”

এ গ্রামে পুকুরের সুহৃদ নাম হয়

প্রতিটি বালকের দুচোখে জলাশয়

 

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bengali-poetry-in-assam

 

 

একটি খুন সাক্ষী একজন                                 

 

রাত তখনই দেড়টা, নৈঃশব্দ্য সমাধিক

মুরুব্বি দুই খিস্তি ছোটায় কাপড়খোলা পথে

দরজা খুলে বাইরে এল বাঁটুল মেকানিক

 

চাঁদ কিছুটা খঞ্জ এবং তরল সামাজিক

বুক ঘষটে মধ্যাকাশে ঘুরছে কোনওমতে

রাত তখনই দেড়টা, নৈঃশব্দ্য সমাধিক

 

টর্চ ছিল তো দুজনকারই, জ্বলেওছে খানিক

হারিয়ে ফেলে জোরে চেঁচায় অশিব সঙ্গতে

দরজা খুলে বাইরে এল বাঁটুল মেকানিক

 

হাতের কালি শুকিয়ে গেছে, মুখের অমায়িক

সম্বোধনে রাশ ছিঁড়েছে সহসা ধৈবতে

রাত তখনই দেড়টা, নৈঃশব্দ্য সমাধিক

 

কথার নীচে পরস্পরে হিস্যা বুঝে নিক

রাত্রি অভিনেত্রী, তারও নির্জনতা শোতে

দরজা খুলে বাইরে এল বাঁটুল মেকানিক

 

একজনই তো ঢুকতে পারে সে নির্জনে ঠিক

চাঁদের আলো অকম্পিত মরিয়া অস্ত্রতে

রাত তখনই দেড়টা, নৈঃশব্দ্য সমাধিক

দরজা খুলে বাইরে এল বাঁটুল মেকানিক

 

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla-kobita-by-krishna-malik/

 

 

সন্ধের ভিলানেল  

 

বকুলতলা, সন্ধে, ভিড়ও বেশ

অন্ধকারও অল্প টলোমল

ধোঁয়ায়-ভাপে গুমোট পরিবেশ

 

পেছন দিকে যে ধ্বংসাবশেষ

ঝোপে মোদক ঝুলছে, পাকাফল

বকুলতলা, সন্ধে, ভিড়ও বেশ

 

অন্ধকারে সে ফল জম্পেশ

কেউ তো ভিড়ে হয়েছে চঞ্চল

ধোঁয়ায়-ভাপে গুমোট পরিবেশ

 

কেউ তো পেড়ে এনেছে শেষমেশ

খাওয়ার পরে একটু মিঠাই, জল

বকুলতলা, সন্ধে, ভিড়ও বেশ

 

কেউ দাঁড়াল হাওয়ায় দিয়ে ঠেস

হড়কে গিয়ে ঘুরছে নভস্থল

ধোঁয়ায়-ভাপে গুমোট পরিবেশ

 

দৃশ্য শোনা যাচ্ছে সবিশেষ

দেখা যাচ্ছে শব্দরা প্রাঞ্জল

বকুলতলা, সন্ধে, ভিড়ও বেশ

ধোঁয়ায়-ভাপে গুমোট পরিবেশ

 

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kobi girish goiric kobita

 

 

ঘাট

 

ইতস্থত অর্বুদের থোক

সারা গায়ে দুপুরের ধুলো

ডুমুরগাছের মতো লোক

 

অন্ধ, বোবা খঞ্জনি-বাদক

বেদনার হাত দিয়ে ছুঁলো

ইতস্থত অর্বুদের থোক

 

ডেকে ওঠে কেউ ভয়ানক

উড়ে যায় ভীতু কাকগুলো

ডুমুরগাছের মতো লোক

 

শীর্ণকায়, মুণ্ডিতমস্তক

পায়ে উইঢিপি জমে স্থূল

ইতস্থত অর্বুদের থোক

 

সহসা মৃত্যুর মতো শোক

কেঁপে ওঠে অস্তিত্ব আমূলও

ডুমুরগাছের মতো লোক

 

অল্পসল্প বৃষ্টি হলে হোক

তুমি শুধু কান্নাটুকু তুলো

ইতস্থত অর্বুদের থোক

ডুমুরগাছের মতো লোক

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bengali-poetry-in-assam

 

 

জনবিহীন মাঠ

 

জনবিহীন মাঠ, প্যাস্টোরাল

দেয়াল বলে কিছু সত্যি নেই

ছয়টি খুঁটি আর খড়ের চাল

 

তখনও পুরোপুরি গ্রীষ্মকাল

যায়নি দেশ থেকে, দিন গুনেই

জনবিহীন মাঠ, প্যাস্টোরাল

 

সেখানে গিয়ে দেখি এক শেয়াল

আমার আগে এসে পুঁতেছে সে-ই

ছয়টি খুঁটি আর খড়ের চাল

 

সভয়ে ঢুকি, ছিঁড়ি তন্তুজাল

দাঁড়াই কোনওমতে এককোণেই

জনবিহীন মাঠ, প্যাস্টোরাল

 

জন্তুটির বুঝি ইন্তেকাল

হয়েছে সবে, পড়ে রয়েছে এই

ছয়টি খুঁটি আর খড়ের চাল

 

একলা শুরু করি সুরতহাল

মৃতের মাংসের বানাই লেই

জনবিহীন মাঠ, প্যাস্টোরাল

ছয়টি খুঁটি আর খড়ের চাল

 

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bengali-poetry-in-assam

 

 

শুকতারাদের বাড়ি

 

শুকতারাদের বাড়ি চিনতাম না তো

সারারাত ঘুরে পৌঁছে গেলাম ভোরে

এত বড়ো বাড়ি, নিশ্চুপ, অভিজাত

 

এখানে সময় এখনও সদ্যোজাত

কাউকে না দেখে বসে পড়ি চত্বরে

শুকতারাদের বাড়ি চিনতাম না তো

 

দেখা হলে কেউ আমাকে কি সামলাত?

ডাকনাম ধরে চেঁচিয়ে উঠেছি জোরে

এত বড়ো বাড়ি, নিশ্চুপ, অভিজাত

 

এখানে ফুলেরা এখনও অনাঘ্রাত

পাপড়ি খুলছে একটি একটি করে

শুকতারাদের বাড়ি চিনতাম না তো

 

ক্রমশ সকাল চারদিকে প্রতিভাত

জানলা খুলছে একটি একটি ঘরে

এত বড়ো বাড়ি, নিশ্চুপ, অভিজাত

 

শেষ জানলায় সে নাড়ছে, দেখি, হাতও

সংজ্ঞা হারাই প্রথম রোদের ঘোরে

শুকতারাদের বাড়ি চিনতাম না তো

এত বড়ো বাড়ি, নিশ্চুপ, অভিজাত

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত