| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

একটি ঐতিহাসিক বিয়ে

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

কৌশিক চৌধুরী

১৮৭৮ সালে এক শুভ দিনে বিয়ে হয়েছিলো কোচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এর সাথে প্রভাবশালী ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের মেয়ে সুনীতি দেবীর। জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কালে এই বিবাহ নিয়ে তৎকালীন বাংলা যেমন উত্তাল হয়েছিলো সেরূপ বোধ হয় আর কোন বিবাহকে কেন্দ্র করে হয়নি। ব্রাহ্ম সমাজ এর তরুণ নেতারা বিবাহে খুবই আহত বোধ করেন। এই সমাজ ভেঙে তৃতীয় একটি দল তৈরি করেন শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ। সেটার নাম দেওয়া হয়, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেশব চন্দ্র ১৮৫৭ সালে ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করেন এবং এক বছরের মধ্যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ডান হাতে পরিণত হন। কিন্তু প্রধানত বর্ণপ্রথা পালন ও সামাজিক সংস্কারসমূহকে কেন্দ্র করে তাদের দুজনের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। ফলস্বরূপ ১৮৬৮ সালে কেশবচন্দ্র সেন ভারতের ব্রাহ্ম সমাজ নামে একটি নতুন সংগঠন গড়ে আলাদা হয়ে যান। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে অন্য সংগঠনটি আদি ব্রাহ্ম সমাজ নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন হয়েছিলো দুটো দল। এবারে হল তিনটি দল।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
শুধু দুটো পরিবার নয়, এই বিয়েতে জড়িয়ে পড়েছিলো রাজ ক্ষমতায় আসীন ব্রিটিশ শক্তি। এতদিন পর্যন্ত স্বাধীন ভাবে রাজত্ব করতে থাকা ,বৃটিশ দের বশ্যতা স্বীকার না করা সুবিশাল কোচ রাজ্যে সুচতুর ব্রিটিশরা চেয়েছিলো ঔপনিবেশিক প্রভাব বিস্তার করতে। এক্ষেত্রে তাদের সফট টার্গেট ছিলেন মাত্র দশ মাস বয়সে পিতৃহীন হয়ে সিংহাসন পাওয়া কিশোর মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ। তারা চাইলেন ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্যের মূল্যবোধের সাথে কিশোর রাজা কে পরিচিত করিয়ে তাকে ইংরেজ অনুরাগী বানাতে পারলে কোচবিহার রাজ্যে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজটি অনেক মসৃণ হবে। সেজন্য দরকার ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একজন শহুরে রমণী যিনি সহধর্মিনী হিসাবে ঔপনিবেশিকতার ধারা বহন করে নিয়ে যাবেন কোচ রাজপ্রাসাদে। আর এই বিষয়ে ইংরেজরা দেখলেন ব্রাহ্ম সমাজের সবচেয়ে প্রভাব শালী নেতা কেশব সেনের চতুর্দশ বছরের বালিকা সুনীতি দেবীই সর্বোত্তম পাত্রী। এবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা কাজে নেমে পড়লো। তারা কোচ প্রাসাদে খবর পাঠালেন যে নৃপেন্দ্র নারায়ণকে তারা নিজেদের খরচে বিলেত থেকে ঘুরিয়ে আনবেন, শিখিয়ে দেবেন বড় বড় রাজ পুরুষদের সাথে মেলামেশার কায়দা। তবে শর্ত একটাই যে, বিলেত গমনের পূর্বে কলকাতার ইংরেজি জানা সুনীতি দেবীকে বিয়ে করতে হবে – যিনি পাত্রী হিসেবেও যথেষ্ট যোগ্য। ইতিহাস সাক্ষী , ১৮৭৮ সালে বিবাহের কয়েক মাসের মধ্যেই তরুন রাজা লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
এদিকে কোলকাতায় সেই সময়, কেশবচন্দ্র নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী ছিলেন। তিনি অনুভব করলেন, নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বাল্যবিবাহ । বাল্যবিবাহ রোধ করতে না-পারলে নারী শিক্ষার কথা ভাবা ও অর্থহীন। ১৮৭২ সালে তিনি ব্রাহ্ম বিবাহ আইন প্রনয়ন করলেন যেখানে বিবাহের ন্যূনতম বয়স ঠিক হল মেয়েদের ক্ষেত্রে চোদ্দো বছর আর ছেলেদের আঠারো। তখন চারদিকে কেশব চন্দ্রের জয়জয়কার।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
কিন্তু গোল বাধল, যখন ইংরেজ প্রতিনিধির ইন্ধনে কোচবিহারের রাজবাড়ি থেকে যুবরাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের বড় মেয়ে সুনীতির বিয়ের প্রস্তাব এল। সুনীতি তখনও চোদ্দো বছরে পৌঁছাননি। আর নৃপেন্দ্রনরায়ণেরও বয়স আঠারোর কম। তবু কেশবচন্দ্র এই বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিলেন।প্রথমে সবাই হতবাক হয়েছিল। বিয়ের বয়সের সীমা নিয়ে কেশবচন্দ্র যে আন্দোলন করেছিলেন, নিজেই তা ভাঙতে রাজি হয়ে গেলেন? বাংলার সমাজে এটা একটা দারুণ আলোচনা ও নিন্দামন্দের প্রধান বিষয় হয়ে উঠল। বুদ্ধিমান, প্রগতিশীল কেশব সেন দেখলেন, এই বিবাহের ফলে শুধু তার কন্যার রাজরাণী হওয়াই নয়, ব্রাহ্ম ধর্মের বিস্তারেও এক সুবর্ণ সুযোগ। ১৮৭৮-এ স্থির হল, (১) যুবরাজ বিলেত যাওয়ার আগেই বিয়ে হবে, (২) হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী বিয়ে হলেও পৌত্তলিক অংশ বাদ থাকবে, (৩) কেশব হিন্দুধর্মে কৌলীন্য হারানোয় তাঁর ভাই কৃষ্ণবিহারী সম্প্রদান করবেন এবং (৪) কোচবিহারের পুরোহিতগণ বিবাহ পরিচালনা করবেন, এতে ব্রাহ্মসমাজের করণীয় কিছু থাকবে না।
এই বিবাহ উপলক্ষে কেশবচন্দ্র বার বার অপমানিত হয়েছিলেন এবং মেনেও নিয়েছিলেন মেয়ের ও ব্রাহ্ম ধর্মের ভাল হওয়ার কথা ভেবে ।বিয়ের রাত্তিরেও নানা রকম মতবিরোধ হয়েছিল। বিয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সুনীতির মা চাইছিলেন, বিয়ের অনুষ্ঠান ছাঁটাই করে সংক্ষিপ্ত ভাবে যেন কিছু ব্রাহ্ম প্রথাও অনুসৃত হয়। আর রাজমাতা ধরে বসে রইলেন যে, বিয়ে হবে পুরোপুরি হিন্দু মতে। হিন্দু মতে না-হলে তা সিদ্ধ হবে না। সুনীতিও মহারানির মর্যাদা পাবেন না। এবং সুনীতির মাকে বেশ অপমানজনক ভাষায় এ সব শুনতে হল।পাত্রপক্ষ যা চাইবে, তাই শুনতে হবে। এর প্রতিবাদ করার সুযোগ কেশবচন্দ্রের নেই। শুধু তিনি চাইলেন রাজপরিবার থেকে একটা ঘোষণা যে, নৃপেন্দ্রনারায়ণ এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং বহুবিবাহের বিরোধী। এই তর্কাতর্কিতে বিয়ের সব অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেল। বিয়ের সব আলোর রোশনাই ও সাজসজ্জা, সব বন্ধ হয়ে গেল। সুনীতি লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার উপক্রম হল। বাংলার সমাজে লগ্নভ্রষ্টা কুমারীদের যে কত রকম অপমান ও নির্যাতন সইতে হয়, তা অনেকেই জানেন।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
পরে রাত তিনটের সময় আর একটা লগ্ন ছিল। রাজকুমার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে ডেকে তোলা হল। কেশবচন্দ্রকে নিয়ে আসা হল বিবাহ বাসরে। কেশবচন্দ্র সবই মেনে নিলেন। নমো নমো করে বিয়ে হয়ে গেল। এর পরেও কোচবিহারের রাজবাড়িতে সুনীতিকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে। তিনি যখন গর্ভবতী হন, তখনই জেনে গিয়েছিলেন পুত্রসন্তান না-জন্মালে সে রানিকে অপয়া মনে করা হয়। তার প্রতি আকারে-ইঙ্গিতে প্রচুর বিদ্রুপ বর্ষিত হয়। কিন্তু সন্তান ছেলে না মেয়ে, তা তো জানার কোনও উপায় ছিল না। শেষের দিকে একটা মাস সুনীতির নিদারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছিল। সুখের বিষয়, সুনীতির প্রথম সন্তানটি ছেলেই হয়। এই কথা গুলো মহারাণী সুনীতি দেবী জানিয়েছেন তার আত্ম জীবনী ‘অটোবায়গ্রাফি অফ অ্যান ইণ্ডিয়ান প্রিন্সেস’ বইতে। ওই বইটি প্রথম কোনো ভারতীয় রমণীর ইংরেজিতে লেখা আত্মজীবনী।
যাহোক বিয়ে যথারীতি হয়ে গেল, তবে কেশবের সম্মানে পৌত্তলিক মন্ত্রোচ্চারণ এবং শালগ্রাম শিলা থাকল না। প্রবল বাদানুবাদের প্রেক্ষিতে ২৩ জন ব্রাহ্ম এর প্রতিবাদে এক পত্রে স্বাক্ষর করলেও কেশব তা পড়েও দেখলেন না। এই বিবাহের হাজারো প্রতিবাদকে তিনি পাত্তাই দেননি। ব্রাহ্ম সমাজ দু ভাগে ভাগ হয়ে গেল এর ফলে।
ঘটনায় ব্রিটিশ প্রভুদের জয়ই হয়েছিল আবার কেশব সেনের ব্রাহ্ম ধর্ম কে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও সফল হয়েছিলো । কোচ রাজ্যে ঔপনিবেশিকতার পত্তন হয়েছিল কোচ রাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণের হাতেই। তিনি নিজেও নববিধান ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিয়ের পর পরই নবদম্পতি রাজপরিবারে বহুবিবাহ ও রাজ্যে সশ্রম কারাদণ্ড রদ করেন। শুধু তাই নয়, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কোচবিহারে আসার ক’বছর আগেই ১৮৮২-তে রাজা-রানির ঐকান্তিক প্রয়াসে কোচবিহারে দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে বড় ব্রাহ্মমন্দির নির্মিত হয় এবং এর দেখভালের জন্য রাজকোষ থেকে বাৎসরিক ৫ হাজার টাকা মঞ্জুর হয়। ১৮৮৮-তে নৃপেন্দ্রনারায়ণ ব্রাহ্মধর্মকে রাজ্যের ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। ৪৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন নৃপেন্দ্রনারায়ণ, তাঁর ইচ্ছানুসারে সৎকার হয় ব্রাহ্মমতে, এবং অস্থিভস্মের উপর গড়া হয় স্মৃতিসৌধ। আজও তোর্ষার পাড়ে সে স্মৃতি অমলিন। আর সুনীতি রোডে দাঁড়িয়ে আছে সেই ব্রাহ্মমন্দির, উত্তরবঙ্গের চেতনা-উন্মেষের প্রার্থনাঘর।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
সুনীতি- নৃপেন্দ্রনারায়ণ ছিল তখনকার ভারতবর্ষে সবচেয়ে আধুনিক রয়্যাল জুটি। ভাবা যায় মাত্র সতেরো বছরে সুনীতি প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের নামেই মেয়েদের স্কুল ‘সুনীতি একাডেমী’ এবং অচিরেই তা হয়েছিল একটি বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠান। আজীবন অনেক কাজ করে গেছেন সুনীতি দেবী। ভারতবর্ষীয় রাণীদের মধ্যে যেমন প্রথম বিলেত গিয়েছিলেন সম্রাজ্ঞী ভিক্টরিয়ার রাজ্যাভিষেকে যোগ দিতে, মিশেছেন লন্ডনের ভিক্টোরীয় সমাজের উচ্চবর্গীয়দের সঙ্গে, তেমনি দেশে নারী কল্যাণ ব্রতে কাজ করেছেন। খুলেছেন মেয়েদের স্কুল, কলেজ, লেডিস ক্লাব আবার লিখেছেন বই। কলকাতা শহরে সবচেয়ে বিখ্যাত, অভিজাত ক্লাব, যাতে সদস্য পদ পেতে বহু অপেক্ষা করতে রাজী কলকাতার এলিট সমাজ, সেই ‘ক্যালকাটা ক্লাব’ র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কোচ মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ। ক্লাবের প্রথম প্রেসিডেন্ট। কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত হসপিটাল ‘উডল্যান্ডস’ ও নৃপেন্দ্রনারায়ণের আলিপুর রোডস্থ জমিতে। হসপিটাল হবার আগে ‘উডল্যান্ডস’ ছিল কোচবিহার রাজবংশের কলকাতাস্থ ঠিকানা। তীব্র বাক বিতণ্ডার পরেও সেদিনের সেই বিয়েটি না হলে হয়তো ইতিহাসের অনেক গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনাই অদেখা হয়েই থেকে যেত !

তথ্যসুত্র –
১। স্বপ্ন দেখা এবং আমার ভয়ে কেঁপে ওঠা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ ফাল্গুন ১৪১৮ বুধবার ৭ মার্চ ২০১২
২। কোচবিহারঃ ইতিহাস ও কিছু কথা – অর্জুন অভিষেক রায়
৩। উইকিপিডিয়া
ছবি অনলাইন থেকে গৃহীত।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত