| 29 মার্চ 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

লোকসাহিত্যে ধাঁধা ও খনার বচন । সুশান্ত কুমার রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
ধাঁধা লোকসাহিত্যের একটি অত্যন্ত প্রাচীন শাখা। অনেকের মতে ধাঁধা হলো ‘A Short of Verbal Puzzle.’। প্রায় ধাঁধার মধ্যেই চমৎকার ছন্দ ও বিষয়বস্তুরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ধাঁধা যে একটি বিশ্বব্যাপী সম্পদ তা ইংরেজী ‘Riddle’ বা ‘Enigma’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায়। ল্যাটিন ‘Aenigma’ ফরাসি ‘Enigme’এবং ইংরেজী ‘Enigma’ গ্রীক শব্দমূল থেকে গৃহীত। সংস্কৃতে যা ‘প্রহেলিকা’ আধুনিক উর্দুতে তা ‘পহেলিয়া’ এবং বাংলা ‘হেয়ালী’। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে প্রাচীন কাল থেকেই এই শব্দ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ধাঁধার ব্যবহারও চলে আসছে। ব্লুমফিল্ডের মতে সহজ সরল আদিম সমাজে ধাঁধার জন্ম হয়েছে এবং সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে তা ‘Complecated’ হয়ে চলেছে। বাইবেলে যে সব ধাঁধা দেখা যায় তা বেশ র্দীঘ কিন্তু বর্তমান যুগে প্রচলিত ধাঁধাগুলির আকার সংক্ষিপ্ত। আমেরিকার প্রখ্যাত লোকবিজ্ঞানী টেলর সাহেব প্রমাণ করেছেন যে ‘Hebrew’ ধর্মগ্রন্থে চীনাভাষায় অষ্ট্রেলিয়ার ও আমেরিকার অধিবাসীদের মধ্যে প্রচুর ধাঁধার নমুনা আছে। ধাঁধার ব্যবহার আমাদের দেশে অত্যন্ত প্রাচীন। প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ঋকবেদে ধাঁধার নিদর্শন আছে। অনেক ধাঁধা লোকঐতিহ্য থেকেই ধর্মানুষ্ঠানে প্রবেশ লাভ করে। ফেরদৌসীর শাহনামা গ্রন্থেও ধাঁধার পরিচয় পাওয়া যায়। সবচেয়ে প্রাচীন ধাঁধার সন্ধান পাওয়া যায় গ্রীসদেশে। জনশ্রুতি এই যে গ্রীসদেশের থিবসের স্ফিংক্স নামক রাক্ষস যুবরাজ ওডিপাসকে একটি ধাঁধা জিঙ্গেস করেছিলেন-’সকাল বেলায় চার পায়ে হাঁটে / দুপুর বেলায় দুই পায়ে হাঁটে / বিকেল বেলায় তিন পায়ে হাঁটে / দেশে চলে বাবাজি-। বলা বাহুল্য, মানব জীবনের শৈশবে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটা, যৌবনে দুপায়ে স্বাভাবিকভাবে চলা এবং বার্ধক্যে লাঠিতে ভর দিয়ে চলা এ ধাঁধার বিষয়বস্তু। ওডিপাস ধাঁধাটির উত্তর দিলে সে পর্বত থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়। বিশ্বের সর্বত্রই এ ধাঁধাটির প্রচলন আছে। কথিত আছে যে খীষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে গ্রীক মহাকবি হোমার রাজসভায় ‘জোঁক’ সমন্ধীয় একটি ধাঁধার উত্তর দিতে না পারায় লজ্জিত ও জীবনে বিতৃষ্ণ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আরব দেশের হাজী খলিফা কর্তৃক লিখিত চর্তুদশ শতকের পান্ডুলিপি থেকে জানা যায় যে আরবেও উৎকৃষ্ট ধাঁধা তৈরি হয়েছিল। বসোরা অঞ্চলের আল-হারিরী তাঁর ধাঁধার জন্য সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছিলেন। এছাড়াও আরব্য উপন্যাস, ইহুদীদের গ্রন্থ, বাইবেল, পারস্য সাহিত্যে ফেরদৌসীর ‘জাল’ ও আরব্য সাহিত্যের ‘বাদশাহ্ সোলায়মান’ ও ‘রাণী বিলকিসের ধাঁধা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কঠিন ধাঁধার উত্তর দিয়ে অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যা লাভ পাকভারতীয় গল্পের একটি বহুল প্রচলিত মোটিফ। সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ করে বেতাল ‘পঞ্চবিংশতি’ গ্রন্থে, আরব্য উপন্যাসে,প্রাকৃত সাহিত্যে সুদীর্ঘ কাহিনীর আকারেও ধাঁধা সাহিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদে’ও বহুসংখ্যক হেয়ালী বা প্রচ্ছন্ন প্রশ্নের দেখা পাওয়া যায়- ‘দুহি দুহি পীঢ়া ধরণ ন জাই / রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাই / দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই / রাতি ভইলে কামরু জাই’ । উন্নত ধরনের সাহিত্যিক ধাঁধার অজস্র দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ষোঁড়শ শতকের কবি মুকুন্দরামের ‘চন্ডিমঙ্গল’ অথবা ঘনরামের ‘ধর্মমঙ্গল’ গ্রন্থে। লৌকিক ধাঁধা ও তার উত্তর সবই লোক ঐতিহ্যেই থাকে। সংস্কৃত ও বাংলার বহু সাহিত্যিক ধাঁধার বিষয়বস্তু লৌকিক ধাঁধায় পাওয়া যায়। লৌকিক ছন্দের মাধ্যমেই আবার আমাদের বিভিন্ন ছড়া সৃষ্টি হয়। যেমন- মাঘেও নাই জার / পৌষেও নাই জার / যদি না বয় বাও / অল্প ভাতে পেট ভরে / যদি পরশে মাও । এমনিভাবে আবার- মাছের মাও কবুতরের ছাও / পাঠার হার কচ্ছপের নাড় / কচি পাঠা বৃদ্ধ মেষ / দইয়ের আগা ঘোলের শেষ । 
অন্যান্য দেশ থেকে বহু ধাঁধা আমাদের দেশে যেমনি এসেছে তেমনি করে আমাদের দেশের বহু ধাঁধা অন্যত্র ছড়িয়েছে। ত্রয়োদশ শতকে তুর্কিগণ কর্তৃক দেশ দখল, পঞ্চদশ শতক থেকে দেশের নানা অংশে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ ও ফরাসীদের আগমন এবং অবশেষে অষ্টাদশ শতক থেকে একটানা দুইশত বছরের ইংরেজ শাসন আমাদের ঐহিত্যকে নানাভাবে প্রভাবান্বিত করেছে। হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ও অন্যান্য বহু ধর্মাবলম্বী বিচিত্র বিপুল জনস্রোতের নানা ঐতিহ্য ও পলিমাটি আমাদের মনের ক্ষেত্রকে নানা সম্ভারে পূর্ণ করে তুলেছে। ধাঁধা কখনও কখনও অপূর্ব কাব্যসৌন্দর্য ও চিত্র-মাধূর্য প্রাপ্ত হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত ধাঁধাগুলি আজও মানুষের মুখে মুখে ফিরে। অসংখ্য ধাঁধা এখনও গ্রাম বাংলার পড়তে পড়তে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতার আলোকে বাংলাদেশ বর্তমানে আলোকিত হলেও প্রাচীনকালে এদেশে বিজ্ঞানের আলো পৌঁছেনি। ফলে আধুনিক জীবনাচরণ, চাষবাস ও কৃষিকাজে বিজ্ঞানের সাহায্য পায়নি। তখন ডাক ও খনার বচন চাষাবাদের অভিজ্ঞতা নির্ভর প্রনালী প্রদান করে সহযোগিতা করেছে। কৃষককে দেখিয়েছে সঠিক পথ। কৃষক-কূলকে জানিয়ে দিয়েছে ফসল বপনের সময় ও রীতিনীতি। ফলে কৃষিনির্ভর বাংলার মানুষের জীবন যাত্রার সাথে ডাক ও খনার বচনের সুনিবিড় বন্ধন অনস্বীকার্য। পৃথিবীর সকল কৃষি প্রধান দেশেই এরূপ খনার বচনের প্রচলন দেখা যায়। কৃষকদের হালচাষ,শস্য গণনা, বপন-রোপন, কর্তনের সময় নিরুপণ, বৃষ্টি-বন্যা, খরা, কুয়াশা, মড়ক ও শস্যাদির ফলন প্রভৃতি বিষয় সর্ম্পকিত জ্ঞান ‘খনা’ নামে রূপ লাভ করেছে। খনা নামের উৎপত্তির অন্যবিধ কারণ হচ্ছে আসাম ও বাংলার যে যে অঞ্চলে খনার বচনসমূহ রচিত হয়ে বর্তমান আকার পেয়েছে, সেসব অঞ্চল মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে কোচ জাতির অধিকারভূক্ত ছিল। এসব কোচ ও অন্যান্য শাখার নিম্ন শ্রেণির মেয়েরা কৃষিকাজ করতো। তারা কৃষি বিষয়ক বহু ব্যবহারিক জ্ঞান লাভ করে ছড়া বা বচনরুপে পুরুষানুক্রমে মুখে মুখে শিখে রাখতো। এই মেয়ে কৃষক সম্প্রদায়ের সাধারণ নাম খনা এবং তাদের বচন “খনার বচন” বলে অভিহিত হয়েছে। কৃষকদের জীবন সাধনায় কৃষিকাজ ও দৈনন্দিন জীবনে এসব বচনের মূল্য খুব বেশি। ছন্দাকারে রচিত গঠনরীতির দিক দিয়ে খনার বচনগুলো ছড়া জাতীয় হলেও এগুলো ছড়া নয়। ছড়াগুলোতে উপদেশ নেই- চিত্র আছে-শ্রুতিমধুর ধ্বনিব্যঞ্জনা আছে কিন্তু খনার বচনে উপদেশ আছে। খনার বচন কৃষকদের অভিজ্ঞতালব্ধ কৃষি ও ফলিত জ্যোতিষ সর্ম্পকিত ব্যবহারিক জীবনের বাণীরূপ- ষোল চাষে মূলা / তার অর্ধেক তুলা / তার অর্ধেক ধান বিনা চাষে পান ।আছে গরু না বয় হাল / তাঁর দুঃখ না যায় চিরকাল । লোক ধাঁধা ও খনার বচন শুধু আমাদের লোক মুখ নিঃসৃত বাণী হিসাবে কাল থেকে কালে, যুগ থেকে যুগে ও মুখ থেকে মুখে প্রবহমান নয় এগুলোর সাহিত্যিক মূল্য অনেক বেশি। দেশ, কাল পাত্র ভেদে এগুলোকে টিকিয়ে রাখার দ্বায়িত্বও আমাদের। আর তাই ঐতিহ্যের শেঁকড় সন্ধানে লোক ধাঁধা ও খনার বচন এক প্রবাদ প্রতিম দিক নিদর্শন স্বরূপ। 

One thought on “লোকসাহিত্যে ধাঁধা ও খনার বচন । সুশান্ত কুমার রায়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত