| 29 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস

হুগলীর ডাকাত : একটি আর্থ-সামাজিক পর্যালোচনা

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

বাঙালি যে ডাকাত-ঠ্যাঙাড়ের বংশধর তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই, সকলেই মোটামুটি জানেন। গোটা বাংলাই এক সময় ছিল ডাকাত অধ্যুষিত। চিতে ডাকাত, রঘু ডাকাত, বিশে ডাকাত- সাংঘাতিক সব নাম আর তাদের রোমহর্ষক সব কীর্তিকলাপের কথা ঠাকুমা-দিদিমার কাছে শুনতে শুনতে আমাদের অনেকেরই শৈশব কেটেছে। পরে বড় হয়ে যারা অল্পবিস্তর বাংলা সাহিত্যের পাতা উল্টেছেন তাঁদের সঙ্গেও বার বার দেখা হয়ে গেছে বিগত শতাব্দীর এই সমস্ত ভয়ঙ্কর রক্তচক্ষু পূর্বপুরুষদের। তবে এইসব বাঙালি ডাকাতরা ছাড়াও বাঙলায় আরেক রকমের ডাকাত ছিল। যেমন পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ছিল পর্তুগীজ জলদস্যুরা। এরা জলপথে ও জলপথ সংলগ্ন গ্রামগুলিতে যথেচ্ছ লুঠপাঠ চালাত। বাঙলায় এদের ডাকাতির মূল উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য সংগ্রহ করা ও দাস ব্যবসার জন্য মানুষ সংগ্রহ করা। পর্তুগীজ যুদ্ধজাহাজ ‘আর্মাডা’ শব্দটির থেকে তারা ‘হার্মাদ’ নামে পরিচিত হয়। পরে এদের সঙ্গে যোগ দেয় আরাকান প্রদেশের (বর্তমান মায়ানমার) মগ দস্যুরা। সে যুগে বাংলায় পর্তুগীজ ও মগ দস্যুদের দৌরাত্ম এমনই লাগামছাড়া হারে বেড়ে গেছিল যে সেই অরাজকতার স্মৃতি আজও আমাদের কথ্য ভাষায় ‘মগের মুলুক’ প্রবচনের মধ্যে দিয়ে রয়ে গেছে। বৃন্দাবন দাস (১৫০৭-১৫৮৯ খ্রীঃ) তাঁর ‘চৈতন্য ভাগবত’-এ সে যুগের জলপথের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, “নিরন্তর এ পানীতে ডাকাত ফিরে” ইত্যাদি। বাঙলায় পর্তুগিজদের প্রধান ঘাঁটি ছিল চট্টগ্রাম ও হুগলী। সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে দিল্লীর সম্রাট শাহজাহান পর্তুগীজ জলদস্যুদের উপদ্রবে তিতিবিরক্ত হয়ে সেনাপতি কাশিম খাঁ-কে হুগলীতে পাঠান এবং কাশিম খাঁ হুগলীতে এসে পর্তুগীজদের প্রধান ঘাঁটি দখল করেন এবং পর্তুগীজদের বাংলা ছাড়া করেন (১৬৩২ খ্রীঃ)। পর্তুগীজরা যাওয়ার প্রায় একশ বছর পর বাংলায় আবার একদল বিদেশী ডাকাতের আবির্ভাব হয় যারা বর্গি বা মারাঠা নামে পরিচিত। এক টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলার গ্রামে গ্রামে এই বর্গিদের হানাদারি, লুঠতরাজ ও খুন ধর্ষন চলেছিল (১৭৪১ থেকে ১৭৫১ খ্রীঃ) দীর্ঘ প্রায় দশ বছর ধরে। এর ঠিক পর পরই ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শাসন ক্ষমতা চলে গেল ইংরেজদের হাতে এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই গোটা ভারতে শুরু হলো ‘কম্পানির শাসন’।

portu.jpg
হুগলীর মন্দির ভাস্কর্যে পর্তুগিজ আর্মাডা জাহাজ

এত কথা বলার কারন হল আজ আমরা যে ডাকাতদের কথা বলব তারা এই কম্পানির শাসনের প্রথম যুগেই অর্থাৎ সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময় জুড়ে গোটা বাংলার নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছিল। তবে আমাদের আলোচনার এই সীমিত পরিসরে সামগ্রিকভাবে বাংলার ডাকাতদের নিয়ে আলোচনা করলেও আমাদের মূল ফোকাস থাকবে হুগলির ডাকাতদের উপরে। তাহলে চলুন, “জয় মা” বলে শুরু করা যাক।

 ১. ডাকাতি কী?
প্রথমেই ভারতীয় আইনের চোখে ডাকাত বা ডাকাতি ব্যাপারটিকে একটু দেখে নেওয়া যাক। ভারতীয় পেনাল কোডের সেকশান ৩৯১ অনুসারে ডাকাতি বলতে ধরা হয়, “যখন অন্তত ৫ জন বা তার বেশী সংখ্যক ব্যক্তি সম্মিলিত ভাবে কোনও লুণ্ঠন কর্মে লিপ্ত হয় বা লুণ্ঠনের চেষ্টা করে, তখন সেই দলে উপস্থিত থাকা প্রত্যেক ব্যক্তি এবং সেই লুন্ঠন কর্মে যেকোনও প্রকারে সহায়তা করা প্রত্যেক ব্যক্তিকে ডাকাত বলে গণ্য করা হবে”।

সেকালে যে যে উপায়ে ডাকাতি হত তার বেশ কয়েকটি রকমফের আছে। যেমন স্থল ডাকাতি, অর্থাৎ গ্রামের নির্দিষ্ট কোনও ধনবান ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীর বাড়িতে সদলবলে হানা দিয়ে ডাকাতি। বাড়ির মালিককে চিঠি দিয়ে ডাকাতি করতে যাওয়ার গল্প কে না জানে! এছাড়া ছিল নদী-ডাকাতি, যা এককালে পর্তুগীজদের একচেটিয়া ছিল। এক শতাব্দীর মধ্যেই এদেশীয় দুর্বৃত্তরাও পর্তুগীজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে শুরু করে। পর্তুগীজ আর্মাডা ফ্লিটের স্থান নেয় দেশীয় দ্রুতগামী ছিপ নৌকা। এই নৌকার সাহায্যে ডাকাতরা গঙ্গায় ও অন্যান্য নদীপথের পণ্যবাহী নৌকায় ডাকাতি করে পালিয়ে যেত। যাত্রীবাহী নৌকাগুলিও নদী-ডাকাতদের হাত থেকে নিস্তার পেত না। পণ্যবাহী বা যাত্রীবাহী নৌকাগুলি ধীর গতির হওয়ার কারণে নদী-ডাকাতদের পক্ষে সেগুলিকে আটকানো সহজ হত। সে কারণে দূরপাল্লার নৌকায় সর্বদা লেঠেল ও বরকন্দাজ মোতায়েন করা হত এবং নৌকা গুলি ডাকাত উপদ্রুত এলাকা দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এবং নদীর পার থেকে যত দূর দিয়ে সম্ভব পাস করে যেত। গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এলাকাতে ডাকাতদের চর থাকতো, এবং কোনও ‘মালদার’ নৌকা কাছাকাছি নোঙর করে থাকলেই সে খবর পৌঁছে যেত ডাকাত সর্দারদের কানে।

এছাড়া ছিল ফাঁসুড়ে বা ঠ্যাঙারে ডাকাত যারা গুরুত্বপূর্ণ স্থলপথের (যেমন কোনও বড় হাটে যাওয়ার পথ বা তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার পথের) আশেপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত এবং সেই পথের যাত্রীদের উপর হামলা চালিয়ে নৃশংস ভাবে খুন করে লুঠপাট করে নিত। এদের ভয়ে এককালে একা পথিকের পক্ষে প্রাণ নিয়ে পথ চলা ছিল অসম্ভব।

Thugs_Blinding_and_Mutilating_Traveller

অজ্ঞাত শিল্পীর তুলিতে পশ্চিম ভারতীয় ঠগি নামক ডাকাতদের হাতে পথচারীদের হত্যা ও কুয়োয় ফেলে দেওয়ার দৃশ্য 

আবার কিছু কিছু নির্দিষ্ট পেশার মানুষদের কথাও জানা যায় যারা কর্মসূত্রে দূরদেশে যেত এবং কাজ শেষে ফেরবার পথে দলবদ্ধ ভাবে ডাকাতি করে পালিয়ে যেত। যেমন নদীয়ার ঘোষ বা গোয়ালা ডাকাত-দল এক কালে নদীয়া ও যশোর অঞ্চলে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। আরেক শ্রেণীর ডাকাতদের কথা জানা যায় যারা দিনের বেলায় ভদ্রলোক বাবু সেজে থাকত এবং রাতে দলবল নিয়ে ডাকাতি করতে বেরত। এদের কথা আমরা পরে বিস্তারিত আলচনা করব।

২. ডাকাত কারা?
“বাংলার ডাকাত কারা” এ প্রশ্নের সহজ উত্তর বাংলার ডাকাত সকলেই। এমন নয় যে কোনও নির্দিষ্ট জাতি বা শ্রেণীর মানুষই কেবল ডাকাতি করত। অনেকেরই একটি প্রচলিত ধারনা রয়েছে যে কেবলমাত্র সমাজের নিম্নগোত্রীয় শ্রেণীর মানুষরাই ডাকাতি করত। কিন্তু আসলে তা সত্যি নয়। বিভূতিভূষণ তাঁর পথের পাঁচালি উপন্যাসের শুরুতেই জানিয়েছেন –

“বৃটিশ শাসন তখনও দেশে বদ্ধমূল হয় নাই। যাতায়াতের পথ সকল ঘোর বিপদসঙ্কুল ও ঠগী, ঠ্যাঙারে, জলদস্যু প্রভৃতিতে পূর্ণ থাকিত। এই ডাকাতের দল প্রায়ই গোয়ালা, বাগ্‌দী, বাউরী শ্রেণীর লোক।… তখনকার কালে অনেক সমৃদ্ধিশালী গৃহস্থও ডাকাতি করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিতেন। বাংলাদেশে বহু জমিদার ও অবস্থাপন্ন গৃহস্থের অর্থের মূলভিত্তি যে এই পূর্বপুরুষসঞ্চিত লুণ্ঠিত ধনরত্ন-, যাঁহারাই প্রাচীন বাংলার কথা জানেন, তাঁহারা ইহাও জানেন”। [পথের পাঁচালি, “বল্লালী বালাই”- দ্বিতীয় পরিচ্ছদ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়]

বঙ্কিমচন্দ্রের চন্দ্রশেখর উপন্যাসেও এই কথারই প্রতিধ্বনি লক্ষ্য করা যায়-

“প্রতাপ জমিদার এবং প্রতাপ দস্যু। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি সে সময়ে অনেক জমিদারই দস্যু ছিলেন। …” [চন্দ্রশেখর, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছদ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]

বাংলা সাহিত্যের মনযোগী পাঠকেরা নিশ্চয়ই আরও একাধিক উদাহরণ দিতে পারবেন। তবে বঙ্কিমচন্দ্র ও বিভূতিভূষণের এই দুই বক্তব্য থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে সেকালে, অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনের প্রথম যুগে সমাজের নিম্ন ও উচ্চ এই দুই স্তরের মানুষই ডাকাতি করত। ব্রিটিশ সরকারের ডাকাতি কমিশনের রিপোর্টগুলিতেও এই বক্তব্যেরই সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায়। ১৮৪১ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত এই পনেরো বছরে যে সমস্ত ডাকাতির কেসে ধরা পড়া ও সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের নামের তালিকা পাওয়া যায় তাদের পদবীগুলি লক্ষ্য করলে পাওয়া যায় দুলে, বাগদি, ডোম, হাড়ি, ক্যাওড়া, আগুরি, বেহারা, কৈবর্ত, ঘোষ, সাহা, সেন, সরকার, মাইতি, মান্না, পাল, জানা, ঠাকুর, ভুঁইয়া, চক্রবর্তী, রায়, ব্যানার্জি, মল্লিক, গাঙ্গুলি, দাস ইত্যাদি হিন্দু সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নাম। মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে শেখ, গাজী, খান, শাহ, ফকির, পাঠান, জোলা ইত্যাদি। এই সুদীর্ঘ নামের তালিকা থেকে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রের মতই ডাকাতির ক্ষেত্রেও বাঙালিরা জাত-ধর্ম-বর্ণের বাউন্ডারি মেনে চলেনি। যদিও এ কথা না বললে সত্যের অপলাপ হয় যে বিভিন্ন জাতির মানুষের নাম থাকলেও এই তালিকায় ডোম, বাগদি, ক্যাওড়া ও বাউরি জাতির আসামীদের নামই সর্বাধিক। এ থেকে অনুমান করা যায় যে সে যুগে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে শুরু করেছিল। এর কারণগুলি অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে।

 ৩. বাঙালি কেন ডাকাত হ’ল
প্রখ্যাত নরখাদক শিকারি ও কনজারভেসনিস্ট জিম কর্বেট সাহেব বলেছিলেন বাঘ নরখাদক হয় প্রধানত দুটি কারনে। এক, যদি কোনও আঘাতের ফলে বা বার্দ্ধক্যজনিত কারণে বাঘের স্বাভাবিক শিকারের ক্ষমতা লোপ পায় তখন পেটের টানে বাঘ মানুষ শিকার করে; অথবা দুই, যদি কোনও নরখাদক বাঘিনী সন্তানের জন্ম দেয় এবং ছোটবেলা থেকেই শিশুদের নরমাংসে আসক্তি জন্মায় তাহলে পরবর্তী কালে সেই শিশুরাও বড় হয়ে নরখাদক হয়ে উঠতে পারে।

বাঘের সঙ্গে বাঙালিদের আর কোনও মিল থাকুক না থাকুক, ডাকাত হয়ে ওঠার ব্যাপারে অদ্ভুত মিল রয়েছে। উত্তর বা পশ্চিম ভারতের যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে ডাকাতিকে বৃত্তি হিসাবে নেওয়া বা ব্রিটিশদের ভাষায় ‘অপরাধ প্রবণ জাতি’ বলে বাংলায় কখনও কিছু ছিল বলে জানা যায় না। যদিও ব্রিটিশদের ‘অপরাধ প্রবণ জাতি’র তত্ত্বটি যে প্রকৃতপক্ষে একটি বর্ণবাদী ও জাতিবিদ্বেষী আইন, সে আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আসল কথা হল, পেটের টানে এক রকম বাধ্য হয়েই বাঙালিকে অপরাধের পথে পা বাড়াতে হয়েছিল। যে বাংলার মাটিতে এক কালে সোনার ফসল ফলত, বাণিজ্যে লক্ষ্মী বসত করত, পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই সেই সোনার বাংলারই গোটা জাতি ও সমাজ ভয়ংকর অপরাধ প্রবণতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই কার্যত বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শাসন শুরু হবার কিছুকালের মধ্যেই বাঙলার সমস্ত বাণিজ্যক্ষেত্রগুলি ব্রিটিশরা কব্জা করে ফেলে। ব্রিটিশ কোম্পানির হাত ধরে নীলচাষ ও গোমস্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলার গ্রাম-সমাজের চিরাচরিত গ্রাম্য অর্থনীতির পালে এসে লাগে ইউরোপীয় পুঁজিবাদের এলোমেলো হাওয়া। ফলে বাংলার স্বাধীন কৃষক-শ্রমিক-উৎপাদক-কারিগররা ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের সুবিধার্থে তাদেরই নিয়োগ করা গোমস্তা ও দালালদের রক্তচক্ষু ও দুর্নীতির শিকার হয়ে ক্রমে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে যেতে লাগলেন। অন্যদিকে কম্পানির বণিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক আগ্রহ ও ইউরোপীয় ধনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে ভারতের মাটিতে বদ্ধমূল করার উদ্দেশ্যে কম্পানির প্রভুরা একের পর এক যুগান্তকারী আইন প্রণয়ন করতে শুরু করলেন। যার মধ্যে একটি হচ্ছে কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (permanent settlement, 1793)। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে স্থানীয় জমিদারদের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হল যা আগে কোনোকালে ছিল না। এই আইন অনুসারে জমিদাররা জমির চিরস্থায়ী মালিকানা লাভ করার বদলে ব্রিটিশ প্রভুদের কাছে নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিতে বাধ্য থাকল যা মুঘল আমলের জমিদারি ব্যবস্থায় ছিলনা। বন্যা হোক বা খরা হোক, ফলন হোক বা না হোক, কর দিতেই হবে। না দিতে পারলে জমিদারী নিলামে উঠবে। ফলে এই কর আদায়ের চাপে স্থানীয় ভূস্বামী ও জমিদাররা প্রজাপালক থেকে ক্রমশ হয়ে উঠলেন প্রজা উৎপীড়নকারী জমিদার। এই প্রজা উৎপীড়নের জন্য তৈরি হলো জমিদারদের নিজস্ব লেঠেল বাহিনী। একই সঙ্গে ব্রিটিশদের অতিরিক্ত চাহিদা পূরণের কারণে চাল ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে উঠল। অন্যদিকে ব্রিটিশদের নীলের চাষ শুরু হবার পর নীলকুঠিগুলিতেও লেঠেল বাহিনী নিযুক্ত করা হত। ১৮৩০ সালের পর ভারতের শাসন ভার পাকাপাকি ভাবে ব্রিটিশ কম্পানির হাতে চলে যাওয়ার পর এই লেঠেল বাহিনীর লাঠিয়াল ও চৌকিদাররাই ধীরে ধীরে ডাকাতিতে হাত পাকাতে শুরু করল। ডাকাতি কমিশনের রিপোর্টে এমন বহু ডাকাত সর্দারের নাম রয়েছে যারা পেশাদার লাঠিয়াল বা জমিদারের চৌকিদার ছিল। বস্তুত ডাকাতি কমিশনের কমিশনার জন ওয়ার্ডের কাছে জবানবন্দীতে বহু ডাকাত-সর্দার স্বীকার করেছিল যে তারা পেশাদার লাঠিয়ালদের নিয়েই ডাকাত দল তৈরি করত।

Indigo-factory_Bengal4
শিল্পীর তুলিতে বাঙলার একটি নীলকুঠি

৪. ডাকাত দলের গঠনতন্ত্র
আইনে অন্তত পাঁচ জনের কথা থাকলেও ডাকাত দলে তার চেয়ে অনেক বেশী লোকজনই থাকত। ডাকাত দলের প্রধান ডাকাত সর্দার, যার কাজ ছিল লোকজন যোগাড় করে ডাকাত দল তৈরি করা। কোথাও ডাকাতি করতে গেলে সর্দার বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পাহারা দিত আর বাকিরা ভিতরে ঢুকে ডাকাতি করত। এই বাইরের দরজা আটকে থাকা ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত সাহসিকতার কাজ। কারণ কেউ এসে পড়লে বাকিদের সতর্ক করা অথবা কেউ পুলিশে খবর দিতে উদ্যত হলে তাদেরকে আটকানো ইত্যাদি কাজ তাকে করতে হত। ডাকাতি কমিশনের রিপোর্টে ধরা পড়া ডাকাত সর্দারদের জবানবন্দি থেকে জানা যায় যে অধিকাংশ ডাকাত সর্দার এক সময় জমিদারদের লেঠেল সর্দার হিসাবে কাজ করত। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে জমিদার স্বয়ং ডাকাত সর্দার হিসাবে দল গঠন করত সে তথ্যও অজানা নয়। এই দল এরপর নির্দিষ্ট তথ্য বা খবরের ভিত্তিতে ডাকাতির পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করত। আর এই খবর যারা নিয়ে আসত তাদের বলা হত ডাকাতির ঘটক বা স্পাই। আজকের দিনে ঘটক বলতে আমরা বিয়ের ঘটকই বুঝি, যারা বিবাহ ইচ্ছুক ব্যক্তির কাছে বিবাহযোগ্য বর বা কনের সন্ধান এনে দেয়। ডাকাতির ঘটকের কাজটিও তাই, শুধু বিবাহের জায়গায় কাজটি ডাকাতি। অর্থাৎ এই ঘটকরা বিভিন্ন জায়গার ডাকাতিযোগ্য বাড়ি বা ব্যক্তির সন্ধান এনে ডাকাত সর্দারদের দিত, এবং এর পরিবর্তে মোটা কমিশন পেত। এরা ছদ্মবেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে এই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে আনত। এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দরে মালবাহী নৌকা বা জাহাজের উপরেও ঘটকদের তীক্ষ্ণ নজর থাকত। কোনও সওদাগরী নৌকায় পর্যাপ্ত পাহারাদার না থাকলেই যথাস্থানে খবর চলে যেত। আর যেহেতু ঘটকই খবর এনে দিয়েছে, তাই একটি সাকসেসফুল ডাকাতি হলে ঘটকের জন্য মোটা অঙ্কের শেয়ার বরাদ্দ থাকত। ফলে অচিরেই ঘটকরা নিজের ডাকাত দল গঠন করে সর্দার হয়ে উঠত এবং সরাসরি ডাকাতিতে লিপ্ত হত।

হুগলীর ডাকাতি – কিছু গল্প, কিছু পরিসংখ্যান

পলাশী পরবর্তী সত্তর বছরে বাঙলায় যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় তার ফলশ্রুতিতে গোটা বাঙলাতেই ডাকাতি একটি এপিডেমিকের আকার ধারন করে। ব্রিটিশ শাসকদের অস্বাভাবিক নিপীড়ন, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, স্থানীয় জমিদারদের ক্ষমতাহ্রাস এবং পুলিশ-প্রশাসনের দুর্নীতি – এই সমস্ত কারণগুলি গ্রাম বাঙলার দরিদ্র মানুষকে অপরাধের পথে ঠেলে দেয়। বাঙলার বাকি অন্যান্য জায়গাতেও ডাকাতি ছিল বটে, তবে হুগলী ছিল সে সময়ের ডাকাতির আঁতুড়ঘর। এ প্রসঙ্গে টয়েনবি সাহেব বলেছেন, ১৭৯৫ থেকে ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হুগলী জেলার অপরাধের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে ডাকাতির ইতিহাস। আগেই বলা হয়েছে, হুগলীর ডাকাতরা মূলত ছিল জলদস্যু বা জল-ডাকাত। আর হুগলীর ডাকাতরা যে কেবল হুগলীতেই ডাকাতি করত তা নয়। হুগলী ও নদীয়ার গঙ্গার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে ধনী ব্যক্তিদের বসবাসের আধিক্যের কারণে এই সমস্ত ডাকাতরা অনেকেই জলপথে ডাকাতি করতে আসত এবং ডাকাতি করে দ্রুতগামী ছিপ নৌকায় চেপে দ্রুত নিরুদ্দেশ হত। তবে ব্রিটিশদের প্রথম এই ডাকাতি নিয়ে টনক নড়ে যখন ডাকাতরা দেশীয় মানুষদের পাশাপাশি ব্রিটিশ কুঠি ও পণ্যবাহী নৌকাগুলিকে আক্রমণ করতে শুরু করে। এ দেশে উন্নয়নের অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রের মতই ডাকাতি নিবারণের যাবতীয় ব্রিটিশ-প্রচেষ্টার পিছনেও প্রধান ছিল নিজেদের ব্যবসার লভ্যাংশ কমে যাওয়ার কারণটি।

dak1

dak2
ডাকাতি কমিশনের রিপোর্ট থেকে হুগলীর ডাকাতি সংক্রান্ত রিপোর্টের কিছু অংশ

সরকারি স্তরে সর্বপ্রথম ডাকাতির রিপোর্ট জানা যায় ১৭৯৪ সাল নাগাদ, যখন মি. ডি সি ডেক্সটারের নীলকুঠিতে ডাকাতি হয় এবং ডাকাতরা এক হাজার টাকা লুঠ করে পালিয়ে যায়। এছাড়াও মি. হেইগের নীলকুঠিতে একদল সশস্ত্র ডাকাত হানা দিয়ে চারজন ব্যক্তিকে হত্যা করে ও প্রায় দশ-বারো জন কর্মী আহত হয়। গঙ্গার দুই পাড়ে হুগলী, নদীয়া, হাওড়া ও কলকাতা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হুগলীর ডাকাতদের রমরমা এই সময়েই মারাত্মক রূপ ধারণ করে। ১৮১৯ সালের গেজেট থেকে জানা যায় যে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে একটিও এমন দিন নেই যেদিন অন্তত একটি নতুন ডাকাতির খবর পাওয়া যায়নি। কলকাতার ইংরেজ সরকার বাধ্য হয়েই এ সময় ডাকাত ধরার জন্য নানাবিধ প্রচেষ্টা শুরু করে। আর ডাকাতরাও পুলিশের নাগাল এড়িয়ে প্রাণ বাঁচাবার নানাবিধ ফাঁক-ফোকর খুঁজে বের করতে থাকে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে চন্দননগরের ফরাসী কলোনিতে গা ঢাকা দিয়ে থাকা। যেহেতু চন্দননগর সে কালে ছিল ফরাসী সরকারের অধীনে, সে কারণে সেখানে ব্রিটিশ আইন কার্যকর ছিলনা, এবং অপরাধীরা এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করত এবং কলকাতা ও অন্যান্য স্থানে ডাকাতি করে ‘বিদেশ’ চন্দননগরে এসে গা ঢাকা দিয়ে থাকত।

হুগলীর ডুমুরদহ থেকে ত্রিবেণী, বাঁশবেড়িয়া, ব্যান্ডেল, সপ্তগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলের গঙ্গার ধারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ডাকাত সর্দারদের নাম সে যুগে মানুষের মুখে মুখে ফিরত। এদের মধ্যে ডুমুরদহ অঞ্চল এবং এ অঞ্চলের কুখ্যাত বিশে ডাকাত ওরফে বিশ্বনাথবাবুই বোধহয় সে সময় (কু)খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন। এই বিশে ডাকাত সম্পর্কে নানা মিথ ছড়িয়ে আছে। বিশ্বনাথ রায়, বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ বাগদী ইত্যাদি নামের পাশাপাশি তার জমিদার পরিচয় নিয়েও একাধিক পরস্পরবিরোধী ও বিভ্রান্তিকর মতামত পাওয়া যায়। শোনা যায় বিশে ডাকাতের দল বিভিন্ন নীলকুঠিগুলিতে একের পর এক ডাকাতি করে ব্রিটিশদের নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছিল এবং নীল বিদ্রোহের বহু আগেই এক অর্থে এই বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। এই বিশে ডাকাত বা বিশ্বনাথবাবুর কথা বাঙলা সাহিত্যে একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে যার মধ্যে দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্তে আগমন’ এর অংশটি উল্লেখযোগ্য-

“বাম দিকে দেখা যাইতেছে ডাকাইত প্রধান স্থান ডুমুরদহ। এক সময় ঐ স্থানের বালক বৃদ্ধ সকলেই ডাকাইত ছিল। ঐ গ্রামের লোকেরা বাটীতে অতিথিদিগকে বাসা দিয়ে রজনীতে প্রাণ সংহার করিত। দিবসে মৎস্যজীবীরা মৎস্য ধরিত ও রজনীতে নৌকায় বোম্বেটেগিরি করিত। ফলতঃ সে সময়ে কি জলপথ কি স্থলপথ, কোন পথেই ডুমুরদহের নিকট দিয়া টাকা কড়ি সহ কেহ যাইলে নিস্তার থাকিত না। প্রায় ৬০ বৎসর অতীত হইল, বিখ্যাত ডাকাইত বিশ্বনাথবাবু এই স্থানে বাস করিতেন। একবার মত্ত অবস্থায় কতিপয় সঙ্গীর সহিত ধৃত হন ও তাঁহার ফাঁসি হয়। যে বাড়ীতে তিনি বাস করিতেন, উহা গঙ্গাতীরের সন্নিকটস্থ একটি দোতলা কোঠা। ঐ বাড়ীর ছাদ হইতে গঙ্গার বহুদূর পর্যন্ত কোথায় কে আছে দেখিতে পাওয়া যাইত।”

বিশ্বনাথবাবু ১৮১৮ সালে একটি ডাকাতি করার সময় ধরা পড়েন ও হুগলী জেলখানায় তাঁর ফাঁসি হয়। এই সময়কালেই এই অঞ্চলের আরও একাধিক ডাকাতের নাম পাওয়া যায়, যার মধ্যে আছে কেনারাম সর্দার, রাধা চঙ্গ, মধু চঙ্গ, চিরু চঙ্গ, ভজহরি বাগদি, ঈশ্বর বাগদি, বংশী দাস, বেণী বাগদি প্রভৃতি। এরা প্রত্যেকেই পরে ধরা পড়ে ও নিজেদের ডাকাতির কথা স্বীকার করে এবং অধিকাংশের দ্বীপান্তর বা ফাঁসির সাজা হয়।

fl14 Crucified Dacoits 5jpg
গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়া ও সাজাপ্রাপ্ত দুই ডাকাত, ১৮৮৫

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ডাকাতরা অনেকেই কার্যসিদ্ধির জন্য সিদ্ধেশ্বরী কালীর পুজো করত বলে শোনা যায়। হুগলীর বিভিন্ন স্থানে এরকম বেশ কিছু ডাকাত কালীর মন্দির রয়েছে যেগুলির সঙ্গে এই অঞ্চলের বিভিন্ন কুখ্যাত ডাকাতদের নাম ও কুকীর্তির গল্প জড়িয়ে রয়েছে। 

 

 

 

তথ্যসূত্র
Reports on the Suppression of Dacoity in Bengal [John Gray, “Calcutta Gazette Office”. 1857] 
Bengal Administrative Reports
The Asiatic Journal and Monthly Miscellany
হুগলী জিলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ – সুধীর কুমার মিত্র 

ছবি   
প্রোজ্জ্বল দাস, ইন্টারনেট 

গবেষণা ও লেখা
শঙ্খশুভ্র গঙ্গোপাধ্যায়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত