বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র একদিন সারা বাংলাদেশে হবে: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

Reading Time: 8 minutes

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আলোকিত মানুষ, লেখক ও ভাবুক; বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। জন্ম ২৫ জুলাই ১৯৪০, কলকাতা। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক এবং র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারের সম্মানিত। আজ তাঁর জন্মতিথিতে ইরাবতী পরিবার তাঁকে শ্রদ্ধা জানায়। তাঁর জন্মতিথির শুভক্ষণে মতিউর রহমান সম্পাদিত ‘সফলদের স্বপ্নগাথা: বাংলাদেশের নায়কেরা’ বই থেকে এই লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


একটি বইয়ে আমি লিখেছি: ‘আমার জীবনে সবকিছুই এসেছে দেরি করে। শৈশব এসেছে দেরি করে, কৈশোর এসেছে দেরি করে, যৌবন এসেছে দেরি করে, প্রৌঢ়ত্ব এসেছে দেরি করে। কাজেই বার্ধক্যকে যদি আসতেই হয়, তবে তাকে আমার মৃত্যুর পরেই আসতে হবে।’

চৌকস মানুষেরা যেরকম, আমি ঠিক সেরকম নই। সামান্য জিনিস বুঝতেও আমার সময় লাগে। প্রতিভাধর মানুষের মতো ভূমিষ্ঠ হয়েই আমি বই পড়তে শুরু করিনি। এ শুরু হয়েছে অনেক পরে, আমার কলেজজীবনে। স্কুলে পড়ার সময় আমার বড় বোন পাবনায় অন্নদাশঙ্কর পাবলিক লাইব্রেরির সদস্য ছিলেন।

প্রতি সপ্তাহে সেখান থেকে তাঁর জন্য দুটো করে উপন্যাস নিয়ে আসতাম। প্রথম শৈশবে এটুকুই বইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ। বোনের ওই বইগুলো আমাকে পড়তে দেওয়া হতো না।

সেসব ছিল মূলত উপন্যাস। ওগুলোতে নাকি নারী-পুরুষের কীসব রহস্যময় ব্যাপার-স্যাপার থাকে। পড়লে চরিত্র খারাপ হয়। বড় আপার চরিত্র উন্নয়নে সেগুলো সম্ভবত খুবই সহায়ক ছিল। কারণ, তাঁকে সারা সপ্তাহ ধরে শুধু ওসব বই-ই পড়তে দেখতাম।

বই আমি আগেও অনেকবার দেখেছি, তবে তা প্রথম কখন অনন্য মোহ ছড়িয়ে আমার নজর কাড়ল, তার একটা স্মৃতি মনে পড়ছে। তখন আমি ফাইভে পড়ি। আব্বা খুবই পড়াশোনা করতেন। দোতলার কোনায় ছিল তাঁর একান্ত পড়ার ঘর। আমরা প্রায় কেউই সে ঘরে যেতাম না।

একদিন আব্বা আমাকে সেখানে ডেকে পাঠালেন। ঘরে গেলে আব্বা আমাকে জীবন সম্পর্কে বেশ কিছু ‘সারবান’ কথা বললেন। কিছু তার মনে আছে, কিছু নেই। তবে সেসব কথার চেয়ে যা আমাকে সেদিন অনেক বেশি টেনেছিল তা হলো, তাঁর ঘরভর্তি বইয়ের বিশাল ভাণ্ডার।

ওই ঘরটা ছিল পাঁচ দেয়ালের। দেখলাম, সবগুলো দেয়ালে শেলফভর্তি রং-বেরঙের অজস্র বই। যেদিকে তাকাই শুধু বই। আমি তখন ছোট, তুচ্ছকেও সে বয়সে অসামান্য লাগে। ঘরভর্তি ওই বিপুল বই আমাকে অভিভূত করে ফেলল। ঘরটা আমার চেয়ে অনেক বড়, তাই ওই হাজার কয়েক বইকেও আমার কাছে প্রায় লক্ষ-কোটি বই বলেই মনে হলো, যেন আমাকে ঘিরে বইয়ের একটা অন্তহীন জগৎ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মনে হয়, এই ঘটনাটা আমার শিশুমনকে খুবই প্রভাবিত করেছিল। শৈশবে গভীরভাবে যে স্বপ্ন মানুষ একবার দেখে, সারা জীবন তাকেই সে বড়ভাবে পুনর্গঠন করতে চায়। আমি যে সারা জীবন শুধু দুনিয়া হাতড়ে রাশি রাশি বই সংগ্রহ করতে চেষ্টা করেছি, সে হয়তো সেদিনের ওই বিশেষ মুহূর্তের স্বপ্নটাকে বড়ভাবে ফিরে পাওয়ার জন্য।

দুই
ক্লাস নাইনে পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুকাল আগেই আমাদের স্কুলে একজন প্রধান শিক্ষক এসেছিলেন। তিনি ছিলেন অদ্ভুত মানুষ। থ্রি পিস স্যুট আর জিন্নাহ ক্যাপ পরে এই বিশালদেহী হেডমাস্টার স্কুলের বারান্দা দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে বেড়াতেন। সেই যুগে তিনি বিলেতের এডিনবরায় এক বছরের জন্য পড়তে গিয়েছিলেন।

ক্লাসে এসে তিনি নাকি বলতেন, ‘আমি যদি তোমাদের একবার বিলেতের গল্প বলি, সে যে কত কথা! তা তোমরা ভাবতেও পারবে না; বুঝতেও পারবে না।’ কথাটা হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সে সময় এ দেশ থেকে খুব কম লোকেরই বিলেতে যাওয়ার সৌভাগ্য হতো। বিলেতে গিয়ে সেই জৌলুশভরা সভ্যতার সঙ্গে আমাদের এই বিমর্ষ মলিন দেশটার যে বিশাল পার্থক্য তাঁরা দেখতেন, তা দেখে দেশ সম্পর্কে এক অপার বিস্ময় ও উদ্বেলিত শ্রদ্ধা নিয়ে তাঁরা ফিরে আসতেন।

পঞ্চাশের দশকে আমাদের এক লেখক বিলেত ঘুরে এসে একটা বই লিখেছিলেন। নাম : বিলেত দেশটাও মাটির। এমন অবিশ্বাস্য ব্রিটিশ জাতি যে দেশে বাস করে, সে দেশটা যে আমাদের মতোই কাদামাটির হতে পারে, তা দেখে তাঁরা অবাক হতেন।

সেই প্রধান শিক্ষকই হঠাৎ অ্যাসেমব্লিতে বলেছিলেন, ‘তোমরা আগামী মাস থেকে আর স্কুলের বড় লাইব্রেরিটাতে আসবে না। প্রতিটি ক্লাসে আমি একটা করে ছোট্ট লাইব্রেরি করে দিচ্ছি। সেখান থেকেই তোমরা প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে বই নেবে। তবে বই সবাইকেই নিতে হবে। এ বাধ্যতামূলক।’

এটা হয়তো ছিল তাঁর বিলেতি পড়াশোনারই ফসল। তিনি প্রতিটি ক্লাসের জন্য একটা করে বাক্স বানিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে থাকত বই। বাক্সগুলো ক্লাসের দেয়ালের সঙ্গে আটকানো। প্রতি শনিবারে ওখান থেকে আমাদের বই নিতে হতো। ক্লাসটিচার বেতন নিতেন আর ক্লাস ক্যাপ্টেন বই দিত।

বই নেওয়া তিনি সবার জন্য কেন বাধ্যতামূলক করেছিলেন, তা নিয়ে পরে ভেবেছি। আমার ধারণা, তিনি ভেবেছিলেন, যে ছেলেটা বই নিচ্ছে, সে যদি না-ও পড়ে, তবু তার বাড়ির অন্যরা বাবা-মা, ভাইবোন এমনকি বন্ধুরা হয়তো পড়বে।

আর দিনের পর দিন বাড়িতে বই গাধার মতো টানাটানি করতে করতে ছেলেটারও হয়তো একসময় মনে হতে পারে, কী এত আনা-নেওয়া করি, দেখি না একবার পাতা উল্টিয়ে। এভাবে দু-চারটা বই সে হয়তো পড়েও ফেলতে পারে। আর যারা পড়াবে, তারা তো পড়বেই। মানব-বিকাশের ওপর বইয়ের প্রভাব কী, তা তিনি জানতেন।

এর ফলে আমাদের স্কুলের পরিবেশ কয়েক বছরের মধ্যে আশ্চর্যভাবে পাল্টে গেল। দেখা গেল সবাই ক্লাসে, টিফিনের সময়ে বই নিয়ে কথা বলে। বইয়ের কোনো হাসির কথা উঠলে সবাই হো হো করে হাসে, কোনো দার্শনিক কথা উঠলে দার্শনিক হয়ে যায়, কবিতার কোনো লাইন বললে সবাই কবি। আমাদের পুরো স্কুলটাই একটা ইন্টেলেকচুয়াল স্কুল হয়ে গেল। তার ফলও ফলতে লাগল।

গোটা স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার পিপাসা জেগে উঠল। স্কুল থেকে প্রতিবছর ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করতে বা স্টার পেতে লাগল। সাধারণ ফলাফল হয়ে উঠল অসম্ভব ভালো। স্যার ফজলে হাসান আবেদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার- সবাই এই স্কুলের প্রায় সে সময়কার ছাত্র। বই যে মানুষকে কীভাবে উজ্জীবিত সুতোয় গেঁথে দিতে পারে, এ দৃশ্য এই আমার প্রথম দেখা।

তিন
১৯৬৮ সালে আমি একটা পাঠচক্র শুরু করি। আমার তখন মনে হয়েছিল, আমাদের জাতির জ্ঞানের এলাকা একেবারেই নিঃস্ব। জাতির ভেতর জ্ঞান দরকার। ঢাকা কলেজের কিছু মেধাবী ছেলেকে নিয়ে শুরু হয়েছিল পাঠচক্রটা। কিছুদিন চলেছিলও ওটা, কিন্তু উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ডামাডোলে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। সারা দেশে যে বিদ্রোহের ক্ষোভ প্রজ্বলিত হয়ে উঠল, তার মুখে সেই পাঠচক্র যে কোথায় ভেসে গেল, খুঁজেও পেলাম না।

স্বাধীনতার পর মনে হলো, সোনার বাংলা তো হয়েই গেছে, এখন লেপমুড়ি দিয়ে একটা ভালোমতো ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ১৯৭৮ সাল আসতে আসতে টের পেলাম, সোনার বাংলা বলে আসলে কিছু নেই। ওটা একটা স্বপ্নের নাম। বাংলা আসলে মাটি আর কাদার।

সবার শ্রম, চেষ্টা, সাধনা আর সংগ্রাম দিয়ে একে সোনায় পরিণত করতে হয়। তখন আবার নতুন করে শুরু হলো নতুন পাঠচক্র। এই পাঠচক্র পাঁচ বছর চললে বুঝলাম, আমাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। বহুমুখী জ্ঞান ও জীবনচর্চার ভেতর দিয়ে ছেলেমেয়েদের মনের অচিন্তিত বিকাশ ঘটেছে। বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষুরধার আর সম্পন্ন হয়ে উঠেছে তারা। সেই পাঠচক্রে ২০ জন ছেলেমেয়ে ছিল। তাদের প্রায় সবাই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রের নেতৃত্বে।

মনে হলো, এই পথে আমরা স্বচ্ছন্দে এগোতে পারি। প্রথমেই মনে হলো, ছোট্ট পরিসরে যা সফল হলো, সারা দেশের সবখানে কেন তা সফল হবে না। কেন নয় দেশের সব স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনি পড়াশোনা আর সংস্কৃতিচর্চার আনন্দময় উৎকর্ষ কেন্দ্র? এভাবেই যাত্রা শুরু বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের। মাত্র ৩৫ টাকায় ১০টি বই কিনে ১৯৭৮ সালে শুরু হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ১৫ জন সভ্য নিয়ে শুরু হওয়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আজ সভ্য ১৫ লাখ।

চার
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নাম দেওয়ার পর তা নিয়ে আমি হতাশায় ভুগেছিলাম। মনে হয়েছিল, আমাদের কর্মকা- শুধু সাহিত্যচেতনার বিকাশ ঘটাবে- আমাদের স্বপ্ন তো এমন ছিল না। আমরা চেয়েছিলাম মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ। টোটাল ম্যান। তবে এ নিয়ে এখন আর দুঃখ করি না।

কেননা, আমরা কাজ করি মূলত তরুণ সম্প্রদায়কে নিয়ে। সাহিত্যের নন্দিত ও অনন্য বইগুলো পড়ে ফেলা এই বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য খুবই উপকারী। তাদের আমরা পড়তে দিই তাদের মন ও বয়সের উপযোগী বড় বড় লেখকদের সেরা ও অনবদ্য বইগুলো।

এসব বইয়ের ভেতর ওই লেখকদের ভেতরকার স্বপ্ন, সৌন্দর্য, আলো, মূল্যবোধ সবকিছু বিচূর্ণিত অবস্থায় মণিমুক্তার মতো ছড়িয়ে রয়েছে। ছেলেমেয়েরা সেগুলো পড়লে সেই জ্যোতির্ময় জিনিসগুলো তাদের ভেতর সরাসরি চলে আসে। এতে তাদের জীবন পূর্ণ হয়, আলোকিত হয়। আর জীবনের বহুমুখী বিকাশের কর্মসূচি একটু একটু করে আমরা তো গড়ে তুলেছি।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রথম কার্যালয় ছিল ঢাকা কলেজের পেছনে, নায়েমে তখনকার শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রের একটা ছোট্ট মিলনায়তনে। সেখান থেকে আমরা চলে যাই ৩৭ ইন্দিরা রোডে। সেটা ছিল একটা ভাড়া করা বাড়ি। বাড়িটা খুব সুন্দর।

আমাদের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওই সময় ছিলেন বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব। তিনি কোনো একটা তহবিল থেকে আমাদের পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। ওই সহযোগিতা আমাদের সামনে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। বাড়িটা আমরা ভাড়া নিই ওই টাকা দিয়েই।

সেই বছরেই কেন্দ্রের ভবনের জমিটা আমরা পাই। দিয়েছিলেন আবুল হাসনাত, ঢাকার প্রথম মেয়র। আমার সহপাঠী। তিনি পুরান ঢাকার লোক। আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার মতো তাঁর হাতে তখন গোটা কয়েক বাড়ি ছিল। বাড়ির জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে হেসে বললেন, ‘ক্যান, আমাগো কাছে ক্যান?’ কথাটা বলেছিলেন তিনি ছাত্র বয়সের রাজনীতিতে আমাদের বিরুদ্ধ অবস্থানকে কটাক্ষ করে।

আমি তাঁকে আমাদের স্বপ্নের আদ্যোপান্ত বুঝিয়ে বলি। তিনি বললেন, ‘বুঝছি বুঝছি, ওই যে প্যারিসে আছে না শিল্পী-লেখক-বুদ্ধিজীবীগো ছোট ছোট আখড়া। ওই সব বানাইবার প্ল্যান করছেন।’ দেখলাম, উনি আশ্চর্যভাবে ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন।

পাঁচ
১৯৯২ সালে আমি চাকরি ছাড়ি। চাকরি ছাড়াটা শুধু বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য কাজ করার তাগিদে নয়। চাকরি ছাড়ার আরেকটা কারণ ছিল, তা হলো শিক্ষকজীবন নিয়ে আমার সুগভীর ব্যর্থতাবোধ। দেশে শিক্ষাব্যবস্থার পতন আমার মনে ভেঙে দিয়েছিল।

একটা বিরাট স্বপ্ন নিয়ে আমি শিক্ষকতায় গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, বড় জীবনের স্বপ্নে উজ্জীবিত করে ছাত্রদের আমি বড় করে তুলব। কিন্তু এক সময় মনে হলো, দেশব্যাপী কোচিং, নোট, মুখস্থ আর পাঠ্যবইয়ে সমাকীর্ণ অধঃপতিত শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর তার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

আমি মনে করি না যিনি ভালো বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রদের মুগ্ধ, বিস্মিত আর হতবাক করেন, তিনিই ভালো শিক্ষক। চাকরি হিসেবে শিক্ষকতা করলেও একজন ভালো শিক্ষক হয়ে যান না। আমার ধারণা, পৃথিবীতে একধরনের লোক আছেন, যাঁরা স্বপ্ন দেখেন তাঁর চারপাশের মানুষেরা বড় হোক, সমৃদ্ধ হোক, পৃথিবীকে জয় করুক; তা এঁরা যে পেশার মানুষই হোন না কেন। আসলে শিক্ষক এঁরাই।

আমি মনে করি, আমার মধ্যেও শিক্ষকের এমনি একটা ছোট্ট হৃদয় আছে। এটা আব্বার মধ্যেও দেখতাম। যখন দেখলাম এই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আমি কাউকে কিছু দিতে পারব না, তখন আর অর্থহীনভাবে বসে সময় নষ্ট করিনি। জীবন তো পালিয়ে যাচ্ছে।

সাফল্যে আমি বিশ্বাস করি না। সাফল্য একটা বৈষয়িক বিষয়। এ একটা দক্ষতা। অনেক সময় চোর-ডাকাত-দুর্বৃত্তরাও জগতে সফল হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ সফল মানুষই হয়তো তা-ই। সাফল্যে আগ্রহ না থাকায় জীবনে কোনো কিছু নিয়ে বিমর্ষ বোধ করি না।

আমি উচ্চাকাক্ষাহীন মানুষ। আমার আগ্রহ আনন্দে, কাজে, উদ্দীপনায়। কাজের নিজেরই একটা দীপান্বিত আনন্দ-জগৎ আছে। আমি সেই আনন্দলোকের শিকারি।

সাফল্য এলে আশা বাড়ে, আশার সঙ্গে ভয়। আমার ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। প্রতিদিনের কাজের মধ্য দিয়ে আমি পরের দিনকে তৈরি করতে চেষ্টা করি। কী করে বলব এক বছর পরে কী হবে? আমি তখন থাকব কি না, তা-ই বা কে জানে।

আমি কেবল জানি, আজকের কাজের মধ্য দিয়ে কাল তৈরি হচ্ছে। কালকের মধ্য দিয়ে পরশু। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কোনো দিন এত বড় হবে, এ তো আমরা কল্পনাও করিনি। আমরা জনা কয় মানুষ একসঙ্গে হব, পড়ব, আনন্দে থাকব, বন্ধুত্বে সৌহার্দ্যে এক হয়ে বাস করব, এই ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আর ভালোবাসার উপজাত হিসেবে যদি এসব হয়ে থাকে, তবে মন্দটাই বা কী?

ছয়
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে আজও আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। যখন যে স্বপ্ন মনকে প্রজ্বলিত করে, তা করার দিকে এগিয়ে যাওয়াকেই করণীয় বলে ধরি। বহু ছেলেমেয়ে এ পর্যন্ত এর সভ্য হয়েছে, এখানে পড়েছে, এতেই আমি খুশি। ভবিষ্যতে হয়তো আরও পড়বে।

তাদের শুধু যে বই পড়াচ্ছি, তা নয়; বহু জায়গায় সাংস্কৃতিক কর্মকার্তার ব্যবস্থাও আছে। ভবিষ্যতে এ আরও বাড়াব। সরকার এখন ভাবছে, কর্মসূচিটাকে সব জায়গায় প্রতিটি স্কুল-কলেজে কীভাবে সহজে, স্বল্প ব্যয়ে চালু করা যায়। আমরা সেই ছকটা বানিয়ে দিয়েছি, যাতে বই বা মনন-শিক্ষা জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে যায়
একদিন দেশের প্রতিটি মানুষের হাতে বই পৌঁছেছে, কেন্দ্র নিয়ে এই আমার শেষ স্বপ্ন।

কেন্দ্রের পরিবেশে মানুষ হয়ে ছেলেমেয়েদের মন সুন্দর হচ্ছে, বিকশিত হচ্ছে, তাদের মনের জানালা খুলছে; বইগুলোর মধ্য দিয়ে একটা বড় স্বপ্নের সামনে তারা দাঁড়াচ্ছে, বড় জায়গা থেকে জীবনকে দেখছে, এ আমার জীবনের একটা আনন্দ।

আমাদের বই তো পাঠ্যবই নয়। পাঠ্যবইয়ের উদ্দেশ্য টাকা। ও দিয়ে গাড়িঘোড়ায় চড়া যায়, কিন্তু উচ্চতর জীবনকে স্পর্শ করা যায় না। আমাদের বইয়ের স্পর্শে কচি বয়সে এই যে তাদের মধ্যে এত বড় বড় জিনিস জড়ো হচ্ছে, বড় স্বপ্নে তারা জেগে উঠছে, এতে ভালো কিছু না হয়ে কি পারে?

সাত
আমরা গড়ে উঠেছি প্রায় পুরোপুরি দেশের ভেতর থেকে সরকার, জনগণ আর নানা প্রতিষ্ঠানের সমর্থন, সহযোগিতা ও ভালোবাসা নিয়ে। এর শিকড় বাংলার মাটির গভীরে প্রোথিত। আমরা শুধু দিই, কারও কাছ থেকে কিছু নিই না। তাই দেশের মানুষ একে তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে।

দেশের এক অন্ধকার পরিস্থিতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা আলোর কথা বলেছি। তাই এ প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে আমাদের এত কষ্ট গেছে। আমরা যদি উন্নত হাঁস-মুরগি, গবাদিপশুর উন্নয়নের কথা বা দাতা সংস্থাগুলোর অ্যাজেন্ডায় সুর মিলিয়ে কথা বলতাম, তবে হয়তো বন্যার তোড়ে সহযোগিতা এসে যেত।

কিন্তু আমরা বলেছি আলোকিত মানুষের কথা; যা না বুঝি নিজেরা, না বোঝাতে পারি অন্যদের। তাই দারিদ্র্য ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। আমরা অর্থবিত্তহীনভাবে শুধু ভালোবাসার জোরে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। যেখানে দশ টাকা দরকার, কষ্ট করে তা করেছি এক টাকায়।

টাকা ছিল না বলে আমাদের চরিত্র ছিল। আমরা প্রায়ই বলি, টাকা দিয়ে কী করা যায়, তা দেখিয়েছে অনেকে। কিন্তু ও ছাড়া কী করা যায়, তা দেখিয়েছি আমরা।

আজ হয়তো আমাদের ছেলেমেয়েরা কিশোর-তরুণ। কিন্তু একদিন জাতির হাল তো তাদের হাতেই আসবে। তখন তাদের এই মূল্যবোধসম্পন্ন আর উচ্চায়ত হৃদয় কি একটা বড় বাংলাদেশ গড়ে তুলবে না?

চীনা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে। তা এরকম :
‘যদি এক বছরের জন্য পরিকল্পনা করতে চাও তবে শস্য রোপণ করো।
যদি ত্রিশ বছরের জন্য পরিকল্পনা করতে চাও, তবে বৃক্ষরোপণ করো।
যদি এক শ বছরের জন্য পরিকল্পনা করতে চাও, তবে মানুষ রোপণ করো।’

আমাদের স্বপ্ন সেই এক শ বছরের বাংলাদেশের জন্য। আমার ডায়েরিতে আমি একবার লিখেছিলাম, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র একদিন সারা বাংলাদেশ হবে।’ কথাটা শুনে অনেকে হেসেছিল।

আমার ধারণা, তাদের বাঁকা হাসি সঠিক ছিল না। কারণ, এ কথার মানে এ নয় যে আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি- এই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রই এর ইট-কাঠ, জানালা-দরজা একদিন বাংলাদেশ হয়ে যাবে। এর মানে একটাই : আলোকিত মানুষের যে স্বপ্ন আমরা আজ দেখছি, একদিন সারা বাংলাদেশের মানুষ তা দেখবে। মানুষ ছোট আর জাতি বড়- এ কখনো হয় না।

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>