রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই নৈকট্য লাগে প্রবল। এই একটি চিরায়ত সাঁকো বাঙালির যার সাথে জড়িয়ে আছে তাদের উত্তরাধিকার সংস্কৃতিতে। শৈশব থেকেই সহজ পাঠের সাথে চলা শুরু, আর তার আগেও মায়ের কোলে শুয়ে তাঁর ই লেখা ছড়া মায়ের মুখে শোনা। সেই ছড়া ব্যাকরণ জানেনা, ছেদ যতি উচ্চারণের বিশুদ্ধতায় সজ্জিত নয় তবু কি নরম আলো আর আশ্রয়ের অমোঘ সুর। এই সুর ই আমাদের চিরন্তন রাবীন্দ্রিক হতে শেখায়, গুরু শিষ্য পরম্পরা চেনায়। চেনায় ঐতিহ্যের আকরগুলিকে সমৃদ্ধ করে ভাবনাকে। এই ভাবেই আমাদের বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের সঙ্গে চলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শতকের পর শতক চলে গেছে কবেকার, তবুও তিনি আমাদের মননে বিদ্যমান। তার ধ্যান ধারনায় আমরা স্নাত বহুরুপে বহুভাবে। শিক্ষা দীক্ষা সমাজ দর্শন ইতিহাস রাজনীতি শিল্পকলা, জীবন দর্শন রবীন্দ্রময় আমাদের এ ভুবন —
দশকের পর দশক কেটে যাবার পর আবার ফিরছে আরো একবার ২৫ শে বৈশাখ। আগামী ৮ মে কবির জন্মদিন। গত দশ বছরে বহু গুনে বেড়েছে রবীন্দ্র সংস্কৃতি চর্চার বহু প্রতিষ্ঠান , আলোচনা চর্চা কেন্দ্র, বিশ্বভারতীর কপি রাইট কেটে যাবার পর, প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনার অমুল্য গ্রন্থ সম্ভার অনেক সস্তায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেবার জন্যে। মানুষওকিনছেন ঘর সাজানোর জন্যে শুধু নয় গান কবিতা আবৃত্তি মনন দর্শনে তাকে গ্রহণ করার জন্যে। কিন্তু এই গ্রহণ কতটা আন্তরিক আর কতটা বাহ্যিক সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়
সত্যিই যদি তিনি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে বসত করতেন তাহলে প্রজন্মের, সমাজের এত অবক্ষয় কেন! বাঙালীও বা তার সংস্কৃতি ঐতিহ্য হারাচ্ছে কেন দ্রুত! আমরা বই পড়ি বাংলায়, গান গাই বাংলায় অথচ বাংলা স্কুলে ছেলে মেয়েকে পড়াই না, পড়াতে ভয় পাই,। হয়ত সত্যিই এ ভয় অমুলক ও নয়। কারণ বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু গুনগত মান সেই আন্দাজে পড়েছে জাতীয় স্তরে এই পঠন ততটা কার্যকরী হচ্ছে না। রবীন্দ্র নাথের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান সেই অর্থে সর্বজনীন সফল হয় নি। কবির পরিকল্পিত প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী ও কিছুটা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সার্বিক প্রচারে তার দায়িত্ব সে ভাবে পাওয়া যায়নি। সরকার নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন আর্কাইভ, অনুষ্ঠান, প্রকল্প, জন্মতিথি পালন, রবীন্দ্র পুস্তক প্রকাশনা ও তাকে পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্গতকরন করেছে এবং অনেক টা ফলপ্রসু হলেও সম্পূর্ন ভাবে মানুষের মনোজগতে গৃহিত হয়েছে কি! হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ যেন অবসরের বিনোদন হয়ে উঠেছেন ক্রমশ। তাত্ত্বিক নেতার মতই আদর্শবাদী এক ফেনোমেনন জীবনে প্রয়োগের থেকে বাহ্যিক প্রয়োগ যার বেশি অনেক।
২৫ শে বৈশাখ কি শুধুই রবি পূজো? পাড়ায় পাড়ায় মঞ্চ, মালা রবীন্দ্রপক্ষ, রবীন্দ্র সন্ধ্যা পালন? ২৫ শে বৈশাখ বাঙালীর সম্পূর্ন জীবনদর্শন, অমোঘ উত্তরাধিকার, আত্মচেতনা শেখায়। কত জন আত্মস্থ করতে পেরেছি আমরা সেই সত্য!
রবীন্দ্রনাথ রোজগার করার একটি সহজসাধ্য পথ। রবীন্দ্রনাথের গান শিখে স্কুল খুলেই উপার্জন , রবীন্দ্রনাথ পড়িয়ে সরকারী বিদ্যালয়ে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সমস্যা মেটানো, শিল্পীদের বিভিন্ন ভাবে রোজগারের পথ খুলে যায়।আগে রবীন্দ্রনাথের গান শেখা বা তার চর্চা, শিল্পী হিসেবে তার উত্তরণ প্রতিষ্ঠা অনেক দুরুহ ছিল। বেতার দুরদর্শন সরকারী সাংস্কৃতিক মঞ্চে ডাক পেতে অনেক অনুশীলন, কাঠ খড় পোড়াতে হত, এখন আর সে ভাবে ভাবতে হয়না।বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা আছে যারা প্যাকেজের মাধ্যমে নামী দামী মঞ্চ দেবে আপনাকে, আছে বেসরকারি চ্যানেল যারা অর্থের বিনিময়ে আপনার কন্ঠস্বর পৌছে দেবে পাব্লিকের কাছে। রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে যাদের অর্থকরী লাভ আছে, তারা রবীন্দ্রনাথকে সারা বছর কাছে রাখেন, বা রাখতে হয়! বাকিদের কাছে তিনি কত টা প্রাসঙ্গিক তা নিয়ে দ্বিধা থেকেই যায় মনে।
অথচ তার বাইরে কবি আজ কত একলা পড়ে আছেন! যদি আত্মস্থ করতে পারতাম সঠিক ভাবে তার দর্শন তাহলে বাঙালী জাতি এতো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতো কি। সে হত আত্মনির্ভর, স্বয়ং সম্পুর্ণ। এত বঞ্চনার কথা তাকে প্রচার করতে হত না। জাতীয় ক্ষেত্রে তার জায়গা প্রথমে থাকত। হিন্দু বাঙালী, মুসলিম বাঙালী, বঙ্গের বাঙালী না হয়ে সে শুধুই ভারতীয় বাঙালী হতো। বাঙালীর সেই একক উত্তরণ হয়নি অথচ একা একটি ২৫ শে বৈশাখ ই সারা বাঙালীর সঞ্চিত আজীবন মনুষত্বের আলোক উত্তরাধিকার। সেই অর্থে সেই বিশ্বমানব বাঙালীর চিরকালীন আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ একা, বড় একা হয়ে আছেন।