| 20 এপ্রিল 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের স্বনির্বাচিত প্রবন্ধ ও রচনা । জান্নাত লাবণ্য

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক হিসেবে বিশেষ অবদান রাখলেও ষাটের দশকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে তিনি নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সমালোচক ও সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবেও বিশেষ অবদান রেখেছেন।

‘স্বনির্বাচিত প্রবন্ধ ও রচনা’ তার একটি সংকলিত গ্রন্থ। যেখানে বিবিধ সময়ে রচিত ও প্রকাশিত প্রবন্ধাবলি একত্র করা হয়েছে বলে লেখকের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ এটি। সাহিত্য বিষয়ে ২১টি, সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ে ৫টি, স্মৃতিচারণামূলক ৯টি এবং অন্যান্য বিষয়ে ১০টি প্রবন্ধ এ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ ‘লিটল ম্যাগাজিন : ষাট ও সত্তরের দশক’, ‘ষাটের কবিতা’, ষাটের গদ্য’, আধুনিক কবিতার ইঙ্গিত’ থেকে বাংলাদেশের সাহিত্য সময় ও বৈশিষ্ট্য বিষয়ে সম্যক তথ্য বর্ণনা করা হয়েছে। ‘দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধের শুরু হয়েছে এভাবে, ‘শিবনারায়ণ রায় কোনো প্রবন্ধে এই বলে কটু মন্তব্য করেছিলেন যে, আমাদের নায়ক-নায়িকারা যে হাঁচে কাশে মলমূত্র ত্যাগ করে; রবীন্দ্রসাহিত্যের কারণে তা এখন আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি।’

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে নিজের মতামতের পাশাপাশি বিষয় সম্পর্কিত বিভিন্ন জনের মতামতও তুলে আনেন। তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের যে প্রবণতা তাঁর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল তা হল, ঋষিত্বের প্রতি তাঁর দুরপনেয় লোভ। …গুরুদেবের মহিমান্বিত সিংহাসন আজীবন কঠোর সততার সঙ্গে আগলে গেলেন। সম্মানের স্বারোপিত নির্বাসন থেকে নিম্নবিত্ত ধূলার সঙ্গে বজায় রাখলেন শ্রদ্ধেয় দূরত্ব।’

সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। ‘শিশুসাহিত্যের শিশুহীনতা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘শিশুসাহিত্যের বোঝার বিষয়টুকু লেখা হয় বড়দের জন্যে। অর্থাৎ এই সাহিত্যের গভীর বক্তব্যটুকু, ব্যক্ত নিবিড় অনুভবটুকু, শোক পিপাসা ও বিয়োগের লোকশ্রুত যন্ত্রণাটুকু শুধু লেখা হয় বড়দের জন্যে। শিশুরা এর বাইরের রঙেচঙে রঙিন জামাটুকু হাতে পেয়েই খুশি, এই সাহিত্যের রূপের অলীক জগৎটুকুতে হাঁটতে পেয়েই খুশি।’ সাহিত্যধারাতে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন জনের অবদানের কথাও বিশ্লেষণ করেছেন। ‘বাংলা সমালোচনা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে সমালোচনা সাহিত্যের বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে তিনি লিখেছেন। সেই সঙ্গে এই সমালোচনা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসুর অবদান বর্ণনা করেছেন।

‘বক্তা মুনীর চৌধুরী’, ‘ফররুখ আহমদ’, প্রবন্ধে লেখকদ্বয়ের ব্যক্তিগত জীবনচর্চা, সমকালীন সময়, রচনা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ‘জনপ্রিয় লেখকরা কি অলেখক’ প্রবন্ধটি পড়ে বেশ ভালো লাগল। সব সময়ের জন্যই সময়োপযোগী প্রবন্ধ এটি। তাঁর মতে, ‘যে লেখক সাহিত্যজগতের বিদগ্ধ ও রুচিশীল পাঠককে তৃপ্ত করতে পারুন আর নাই পারুন, বিপুল ও সাধারণ পাঠকসম্প্রদায়ের মনকে আনন্দে ও সজীবতায় তৃপ্ত করতে পারেন, তাঁর লেখার আকর্ষণকে তাদের কাছে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে পারেন তিনিই জনপ্রিয় লেখক।’ তিনি মনে করেন, জনপ্রিয় লেখকদের কারণেই বাংলাদেশের প্রকাশনা ব্যবসার অঙ্গনে চাঙ্গা ভাব রয়েছে।  ‘জনপ্রিয় লেখকের লেখা খুশি করে কিন্তু কিছু দেয় না। এই লেখা বিনোদন দেয় কিন্তু জীবনকে জোরালোভাবে কামড়ে ধরে না, এমন ভালো বা বড় কিছু উপহার দেয় না যা জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জীবনকে দীর্ঘমেয়াদে কৃতজ্ঞ করবে। বিনোদন একজন জনপ্রিয় লেখকের মূল ও হয়তো একমাত্র সম্পত্তি।’

সাহিত্য সমালোচনাবিষয়ক ‘লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া’, ‘আবদুশ শাকুরের রম্যরচনা’, ‘রফিক আজাদের অসম্ভবের পায়ে’, ‘আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধ’গুলোতে লেখক চমৎকারভাবে এই লেখকদের লেখনীর বৈশিষ্ট্য ও সার্থকতার সঙ্গে সমকালীন সাহিত্য অঙ্গনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছেন।

এই গ্রন্থের স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধগুলো পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করবে। ‘জাহানারা ইমাম’ প্রবন্ধটিতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শুরুই করেছেন এভাবে, ‘পঞ্চাশের দশকে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, জাহানারা ইমাম তখন ঢাকা শহরের সুচিত্রা সেন।’ জাহানারা ইমামের সঙ্গে তার পরিচয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাতের কথা বলা হয়েছে। শেষ হয়েছে তার লাশবাহী ট্রাক দেখার বর্ণনা দিয়ে; যা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্য কতটা বেদনার ছিল রচনাটি পাঠ করলেই বোঝা যায়। ব্যক্তিজীবনে জাহানারা ইমামের স্বতন্ত্রতা, লেখনী, রুচিশীলতা, আচার-আচরণ, সংগ্রামময় জীবনের নানা কথা যা কিছু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জানতেন, দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন সবকিছুই নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।

‘জাতির পিতার মৃত্যু’ সেদিনটা কেমন ছিল, সেদিনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড, সাধারণ মানুষের ভাবনা, দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র লেখক নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। ‘অনেক দিন পরে এক জনসভায় এক মুজিবভক্ত বলেছিলেন, শেখ মুজিব চল্লিশ লাখ কর্মী তৈরি না করে চল্লিশটা অ্যলসেশিয়ানও পুষতেন, তাহলেও হয়তো কিছুটা প্রতিরোধ হত। অবোধ জন্তুগুলো প্রভুর মৃত্যুর আগে অন্তত চল্লিশটা ঘাতকের টুঁটি ছিঁড়ে মরে পড়ে থাকত রাস্তার ওপর।’

দেশ ভাগ, সমসাময়িক সময়ের রাজনীতি, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ও এর প্রভাব, পরবর্তীকালে হিন্দুদের আকস্মিকভাবে ভারতে চলে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় নিজের জানা ও দেখার জ্ঞান থেকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ চমৎকার সহজ-সরলভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ‘বিদায়, অবন্তী!’ প্রবন্ধে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার সময়ের দাঙ্গা নিয়ে রচিত কৃষণ চন্দনের ‘গাদ্দার’ উপন্যাস এবং ভীস্মদেব সাহানীর ‘তমস’-এর থেকে দাঙ্গার ভয়াবহতার বর্ণনাগুলো তুলে ধরেছেন। ‘মৃত্যুপথযাত্রীদের মুখ থেকে শেষ যে নাম উচ্চারিত হয়েছিল সে নাম ঈশ্বরের। হত্যাকারীদের মুখেও ছিল তাঁরই নাম।’ (গাদ্দার)

লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, ‘হিন্দুরা চলে যেত নিঃশব্দে। সবার অজান্তে কারো কাছে জমিজমা বিক্রি করে, যাবার আগে গোপনে দখল বুঝিয়ে দিয়ে অলক্ষে চলে যেত। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবাইকে বলেকয়ে অশ্রুজলে বিদায় নেয়ার বিলাসিতার ভেতর নানা রকম ঝুঁকি ছিল। পিতৃ-পিতামহের জন্মভূমি, বাসস্থান, আশৈশবের পরিচিত পৃথিবী, আত্মীয়-বন্ধু, কৈশোর-যৌবনের মধুরতম স্মৃতি-স্বপ্ন, তুলসীতলা সবকিছু এভাবে পেছনে ফেলে চলে যেত তারা।’

‘আমার শৈশব’, ‘আমাদের বাড়ি’ প্রবন্ধদ্বয় থেকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বেড়ে ওঠা, তার বিকাশ ও মননের উৎকর্ষের সূত্রপাত বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা যায়। ‘শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য’, ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক’ প্রবন্ধ দুটি থেকে একজন শিক্ষক তার পেশার বিভিন্ন দিক ও দায়িত্ব-কর্তব্য বিষয়ে জানতে পারবেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের স্মৃতিচারণামূলক অংশটিকে ঠিক প্রবন্ধ বলে মনে হয় না। এই রচনাগুলোতে তার স্বভাবজাত চমৎকার গল্প বলার প্রভাব বিদ্যমান; যা খুবই সুখপাঠ্য। ‘চাই সাহিত্যের আড্ডা’, ‘জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা’, ‘সক্রিয় লাইব্রেরি’, ‘চাই লেখকে-লেখকে সহযোগ’ ইত্যাদি প্রবন্ধে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহিত্য, সাহিত্যিক, পড়াশোনা, লেখকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবনা, ষাট-সত্তর দশক ও বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের সাহিত্যের যাত্রাপথ সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নিজের বাছাই করা রচনাগুলো এ গ্রন্থটিতে স্থান পাওয়ার ফলে, তার ব্যক্তিজীবন, ভাবনা, পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম।

 

 

 

বই সমালোচক

শিক্ষক ও লেখক

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত