| 23 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দুর্দিনের বিপ্লবী | রেজা রিফাত

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

পৃথিবীতে অনেক রকমের মানুষ থাকে। নানা রকমের লিগ্যাসি তৈরী করে যান। কিন্তু মানুষকে বদলে যাওয়ার জন্য আলো ফেরি করে বেড়ান এটা ভীষণ রকমের দুর্লভ। পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্য ভূমিকার দরকার হয় না। আমরা যখন তাদের নাম শুনি। তখন হুট করে কিছু না কিছু চলে আসে। কিছু শব্দ কিংবা কিছু ছবি কিংবা অন্যকিছু। অন্যকিছু কি? অনুভূতি? প্রেরণা, উপলব্ধি কিংবা প্রদীপ।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের জন্য লিখতে বসে অজস্র স্মৃতি আর আবেগ মুখোমুখি এসে পড়লো। এত কিছু থেকে অল্প কিছু ছেঁকে বলা প্রায় অসম্ভব। স্যারের সাথে আমার প্রথম দেখা ২০০৮ এর দিকে। বিশ্বসাহিত্যের কেন্দ্রের কবিতার ক্লাসে। এখনো চোখ বন্ধ করলে আমি খুব সহজে মনে করতে পারি স্যার কথা বলছেন ক্লাসে। মোহময় স্বরে বলে যাচ্ছেন অপূর্ব সুন্দর সব প্রেরণার কথা, শব্দের কথা কিংবা কবিতা আওড়াচ্ছেন ক্লান্তিহীন। আমাদের উন্নত মানুষ হতে চাওয়ার যে ইচ্ছা, তার ছাঁচে অনায়াসে স্যারকে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়। জীবনে কাজকে যে প্রার্থনায় রূপ দেয়া যায় সেটা উনাকে না দেখলে আমার জানা হত কিনা আমার জানা নেই। স্যারের একটা কথা আমি খুব মানি আমরা ঠিক ততটুক, যতটুক আমরা সংগ্রাম করি।

আমার অপরিণত তারুণ্যরর দিনে আমি স্যারকে পেয়েছি। এই পাওয়া ছিল বিস্ময়কর আর সমৃদ্ধ। স্যার একদিন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন ক্লাসে। জবাব না পেয়ে বলছিলেন, তোমরাতো কিছুই পারো না। সেই না পারার তাচ্ছিল্যে আমার এখনো মাথায় ঘুরে। জ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ-ই শুরু হয় না জানা থেকে। এই এত তথ্যের যুগে আমরা কি জানি না সেটা বোঝাটা খুব দরকার। চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বহু তরুণের হাতে এক প্রেরণার অদৃশ্য মশাল তিনি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তারুণ্যের প্রতি স্যারের আগ্রহ বেশ বিস্ময়কর পর্যায়ের। যখন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ তারুণ্যকে অপরিণত আর দুর্দমনীয় মনে করে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। স্যার বরং আজীবন তরুণদের কাছে এগিয়ে গেছেন কৌতূহলে। আলগোছে কাছে টেনে উসকে দিয়েছেন যা কিছু সুন্দর, বাড়িয়ে দিয়েছেন সেইসবের প্রতি আগ্রহ। দিনের পর দিন তাদের প্রেরণা দিয়ে গেছেন। শক্তি যুগিয়ে গেছেন কিভাবে নিজেরাই নিজেদের প্রদীপ হতে পারে। এইজন্য আমি বোধহয় স্যারের থেকে তরুণ আর আশাবাদী আমি কাউকে দেখিনি। কথা বলতে বলতে স্যারের চোখ কতবার জ্বলে উঠেছে আলোকিত পৃথিবীর প্রত্যয়ে, সেটা ক্লাসে বসে অবলোকন করা ছিল অতি আনন্দের। স্যারের কথা শুনতে গিয়ে কখনো কোন ক্লান্তি আসতো না। এই ছোট্ট জীবনে এত ভালোবাসা খুব মানুষের কপালে জুটে না। এই অদ্ভুত এক শক্তি নিয়ে স্যার জন্মেছেন।

আমরা যখন বলি দেশ উচ্ছন্নে যাচ্ছে। কিন্তু আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমাদেরকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলেন। বলেন, বাঙ্গালির কখনো রাষ্ট্র ছিল না। অন্যর অধীনে থেকে গেছে চিরকাল। এখন তারা রাষ্ট্র পেয়েছে। বাঙ্গালি তার ইতিহাসে এত সম্পদ আগে কখনো দেখেনি একসাথে। ফলে এই অস্থিতিশীলতা আর দুর্বৃত্তায়নের একদিন শেষ আসবে।

আমাদের সাহিত্যে হয়তো অনেক বড় লেখক/কবি জন্মেছেন। কিন্তু, সংগঠক পাওয়া বেশ বিরল। বাংলাদেশে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মত সংঘটক পাওয়া বেশ দুর্লভ। সেটা সাহিত্য পত্রিকা কন্ঠস্বর বলুন আর নানা সামাজিক উদ্যোগ বলুন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শুরুটা করেছিলেন আমি যতদূর শুনেছি ৪০ টাকা দিয়ে। সেই কেন্দ্রের ছড়িয়ে পড়া আলো এখন আমাদের দেশে প্রায় সর্বত্র পৌঁছে গেছে। আমি এখনো মনে করি স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির না পাওয়ার একটা কারণ দূর্বল সংঘটন সেটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হোক কিংবা ব্যক্তিগত অর্জনে। তবু, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিটা ফ্লোরে চলমান কর্মযজ্ঞ আমাদের আশাবাদী করে তোলে আলোকিত মানুষের।

লেখক হিসেবেও স্যার অত্যন্ত দূরদর্শী সম্পন্ন। “গণতন্ত্র ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা” বইয়ে স্যার অত্যন্ত নিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংকটের উৎপত্তিস্থল। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যে এখনো আমাদের গণতান্ত্রিক বিকাশকে রুদ্ধ করে রেখেছেন তা স্যার স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। তবে স্যারের লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয় বই ‘‘বিস্রস্ত জার্নাল’’। পুরো পাতায় পাতায় জীবনের নানা ঘটনা কে কখনো দর্শনের ছলে কখনো কৌতুকের ছলে কি সাবলীলভাবে লিখে গেছেন। না পাওয়াই যে মূলত প্রেমকে মহৎ করে তা অনেকবার বলেছেন স্যার।

একটা সময়ে স্যারের জন্মদিনে প্রতি বছর কেন্দ্রে যাওয়াটা একটা প্রথা ছিল। দেশের বাইরে চলে আসার কারনণ এখন আর হয় না। প্রতি জন্মদিনে বেশ চমৎকার কথা বলতেন সেটা মিস হয়ে যায়, আর এখনতো আমরা সবাই একটা কঠিন প্যান্ডেমিকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। টিকে থাকাটাই কখনো কখনো বড় যুদ্ধ। বাংলাদেশ যতটা এগিয়েছে তাতে নিশ্চয়ই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভূমিকা আছে। সারের একটা বিখ্যাত কথা আছে দুর্দিনে টিকে থাকা সুদিনে বিপ্লব করার সমান। শুভ জন্মদিন স্যার! এই জীবনে আপনার সাথে দেখা হওয়াটা আমার একটা বড় প্রাপ্তি। জীবনে যখন যেখানে একটা হিমালয় সুউচ্চ সমান মানুষের গল্প বলার দরকার হবে আমি অবশ্যই আপনার কথা বলবো। মানুষও যে কি অপরিমেয় শক্তি ধারণ করে, তা আপনাকে দেখে দেখে আমি জেনেছি। আরো বহু বছর আপনার স্পর্শে মানুষের জীবনে সজীবতা আসুক সেই প্রার্থনা- ই রইলো।

বি.দ্র. এই লেখাটি স্মৃতি হাতড়ে লেখা। প্রয়োজনীয় বই হাতের কাছে না থাকার কারণে এর কলেবর আর বেশি বড় করা গেলো না। ইচ্ছাসত্ত্বেও বলা গেলো না আরো অনেক কথা, তথ্যের গড়মিল হতে পারে এই আশংকায়।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত