‘নতুন স্বপ্ন নিয়ে জেগে উঠবে নতুন মানুষ’-আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ভাষার মাসে, ভাষা ও বইয়ের মানুষ ’ষাটের দশকের সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মুখোমুখি হয়েছিল সাম্প্রতিক দেশকাল। সেখানে উঠে আসে বাংলাভাষা চর্চা, সাহিত্য আন্দোলন, বই বিমুখতাসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতার মতো বিষয়াদি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এহসান হায়দার।
ভাষা আন্দোলনের অর্ধশতাব্দীর পরও ভাষা চর্চায় বাঙালি এখনো অনেক পিছিয়ে- এর অন্যতম কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
কোনো কিছু পেতে হলে শ্রম দিতে হয়। শ্রমের পেছনে ভালোবাসা থাকতে হয়। এ নিয়ে একটা স্বপ্ন থাকতে হয়। উচ্চতর উদ্দেশ্য আর আকুতিও থাকতে হয়। এখন অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই বাংলা ভাষার উন্নতির ব্যাপারে এই আবেগটা দেখি না। মমত্ববোধ পাই না। ভাষার উন্নতি হবে কী করে?
দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা যদি বলি…
বাংলা একাডেমি এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি। সারাবছরে একটি বইমেলা করাই হচ্ছে তার প্রধান কাজ। এই মেলা দিয়ে বাংলা ভাষার কতটা উন্নতি হবে? কিছু বই বা অভিধান অবশ্য এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বের হয়; কিন্তু তা কয়টা? তাছাড়া যা আসল কাজ এই প্রতিষ্ঠানের- ব্যাপক গবেষণা- তা কতটুকু হয়। বাংলা ভাষার উন্নতিতে ভালোবেসে উদ্যোগী হয়ে- ভালো কিছু করছে, এটা খুব কমই দেখা যাচ্ছে। বাংলা ভাষার উন্নতি হবে কার হাতে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ব্যাপারে উদ্যোগহীন। সরকারের মধ্যে ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্য কম।
তাহলে ’৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির সেই দিনটি
হ্যাঁ, সব মিলিয়ে আমরা দিনটিকে এখন প্রায় একটা উৎসবে পরিণত করে ফেলেছি। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখের রাত সাড়ে ৩টার সময় সে উৎসব শুরু হয়। বাংলা ভাষার উন্নয়ন-উন্নতির উৎসব। এ বিষয়ে আমি একটি জায়গায় লিখেছি: সাড়ে ৩টা সময় শহরের প্রত্যেক এলাকার তরুণ নেতাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায়- ‘ভাইসব আপনাদের কী বাংলাভাষার প্রতি ভালোবাসা নাই, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা নাই। আপনারা কেন এখনো ঘুমান, আপনারা উঠুন, ফুলের তোড়া দিতে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে চলুন।’ তখন সবাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে মিছিলের সঙ্গে রওনা হয়। শহীদ মিনারে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সকাল সাড়ে ৮টা বাজে। ততক্ষণে বাংলা ভাষার অবস্থা কাহিল হয়ে এসেছে। তারপর ওখান থেকে সবাই দলবেঁধে বইমেলায় যায়। সেখানে ঘণ্টা দুই চড়া রোদের মধ্যে হেঁটে বাংলাভাষা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারপর একটা-দেড়টা বাজলে বাংলাভাষা পরিশ্রান্ত শরীরে সেই যে বাড়িতে ফিরে ঘুম দেয়, তা থেকে ওঠে পরের বছর ২১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৩টায়।
ভাষার সাথে দেশাত্মবোধের একটি গভীর সংযোগ রয়েছে, বাংলার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ কি কমেছে দিনে দিনে?
ভাষার সাথে আমাদের এখন আর সম্পর্ক নেই। আমরা আছি নিজেদের নিয়ে। যারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত- তাদের দিয়ে কি দেশপ্রেম হয়?
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বড় ধরনের বিপর্যয় বলবেন কি একে?
হ্যাঁ, সংস্কৃতি জগতে ধস নেমেছে বড়সড়ভাবে। সারা পৃথিবীতেই নেমেছে। মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, লুণ্ঠন বল্গাহীন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রও জবাবদিহিহীন হয়ে রয়েছে বহুকাল ধরে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মানুষের মনোজগত। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সংগীত ও মূল্যবোধের এলাকা থেকে মানুষ সরে গেছে। যেমন করে হোক আমাকে টাকা বানাতে হবে- এই চিন্তায় মানুষ প্রবেশ করেছে। এটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপার। শিল্প-সংস্কৃতিতে যেসব দেশ অনেক ওপরে ছিল, তারাও নেমে এসেছে।
মানুষ বৈষয়িক হয়ে গেছে ও সেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি অতি-ক্ষুদ্র মামুলি একটি বিষয় বলতে চাইছেন?
শিল্প-সংস্কৃতি- এসবকে মানুষ বড় কিছু ভেবেছে এক সময়। একটা সময় ছিল মানুষ ভাবতে গৌরব বোধ করতো- আমি কবি হবো, দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক হবো। এখন আর এটি নেই। ‘এখন যদি কোনো তরুণকে বলা হয়, তুমি কি হতে চাও? সে হয়তো বলবে- বিল গেটসের কোম্পানিতে একটা চাকরি চাই। কখনো বলবে না- আমি বিল গেটস হতে চাই। বৈশ্বিক গণতন্ত্রের বিকাশে নিম্নগতি দেখা যাচ্ছে। মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে এসেছে। রাখো শিল্প, রাখো সংস্কৃতি- আমারটা হলেই হলো। এই হলো দেশের অধিকাংশ মানুষের স্লোগান।
সভ্যতার বিকাশে ভাষার ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?
যে জাতি ভাষার সমৃদ্ধ চর্চাকে টিকিয়ে রাখতে পারে, সেখানে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে আমাদের দেশে, তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এর মধ্যে সবচেয়ে অচল। ধরা যাক, বিদেশ থেকে একটি মেশিন আনা হলো কোনো সরকারি হাসপাতালে; কিন্তু সেই মেশিন হয়তো কোনো দিন ব্যবহৃত হলো না। শুধু লাভের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে আলাদা আলাদা পকেটে ঢুকে গেল। আমাদের আমলাতন্ত্র প্রায় জীবন্মৃত। প্রায় প্রত্যেকের উদ্দেশ্য নিজ নিজ স্বার্থ, সেবা বা সার্ভিস দিতে কেউই আগ্রহী নয়। সার্ভিস তো দেব; কিন্তু আমি পাব কী- এই হলো দেশব্যাপী প্রশ্ন?
অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তার দায়িত্ব পালন করছে না, ফলে ব্যর্থ হচ্ছে মূল উদ্দেশ্যগুলো…
আমাদের এই বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কথা বলি, প্রায় সাড়ে চার হাজার ভলান্টিয়ার ছিল এটিতে এক সময়, যারা টাকার জন্য বা বৈষয়িক কোনো লাভের জন্য কাজ করত না, মনের তাগিদে কাজ করত। সারাদেশে ৫শ’ শাখা ছিল আমাদের, প্রত্যেক জায়গায় ৮-১০ জন করে স্বেচ্ছাসেবী ছিল। সবাই তাদের জিজ্ঞেস করতো- এই কাজের বিনিময়ে তোমরা কী পাও? তারা বলত, আমাদের কিছু দেয়া হয় না, আমরা ভালোবাসার টানে কাজ করি। যখন তারা এটি বিশ্বাস করতে চাইত না- কিন্তু সত্যি আমাদের সারাদেশে প্রায় সাড়ে চার হাজার এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবী ছিল। আজ বিনা লাভের, বিনা স্বার্থের স্বেচ্ছাসেবীরা আর নেই।
যা হোক, শুধু ভাষা কেন, যেকোনো কিছু পেতে হলেই তার জন্য শ্রম-রক্ত দিতে হয়। আমরা তো সেটি দিচ্ছি না। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সেটি দিচ্ছে না। ফলে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে। একদিন এক ছাত্র এসে বললো- ‘স্যার, ভবিষ্যতে এদেশের কী হবে?’ আমি বললাম, ‘তোমার শরীর থেকে যে কয় ফোঁটা রক্ত দেবে, দেশের তাই হবে। এক ফোঁটা বেশিও না- কমও না।’ সেই রক্ত তো আমরা দিচ্ছি না। আমরা কী করে ভাবতে পারি যে, বাংলা ভাষার উন্নতি ঘটবে? আগে লেখকরা ছিলেন, স্কলাররা ছিলেন- তাদের চেষ্টাতেই চলত। সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে আমার কখনোই মনে হয়নি।
আপনার হাতে ষাটের দশকে যে সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশ ঘটেছিল, সেটি নিয়ে কি কিছু বলবেন বর্তমান সময়ের দিক ভেবে?
ষাটের দশক তো ছিল একটি স্বপ্নের দশক, উত্তরণের দশক, আকাশ জয় করার দশক। মানুষের মধ্যে একটি অন্তহীন স্বপ্নচারিতা কাজ করেছে তখন। যে যেখান থেকে কাজ করেছে, সে সেটিকে শ্রেষ্ঠ কাজ ভেবেই করেছে। আমরা ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকা বের করতাম, আমাদের মনে হতো- আমরা তো আজ স্বাধীন। পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলোর সমকক্ষ। কাজেই ওইসব দেশ যা পারে, আমরাও তা পারব। এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা কাজ করেছি। বিশ্বাস না ঠিক- আত্মপ্রত্যয়। সেই আত্মপ্রত্যয়টি তখন কম-বেশি সবার মধ্যেই ছিল। তাই আমাদের সাহিত্যে, শিল্পে যা কিছু ভালো কাজ হয়েছে- তার আশি ভাগই হয়েছে সেই সময়, পঞ্চাশ থেকে সত্তরের মধ্যে। স্বাধীনতার পর অনেকেরই মনে হয়েছিল, আমরা সব পেয়ে গেছি, সোনার বাংলা অর্জন করেছি; কিন্তু পরে ধরা পড়েছে যে, সোনার বাংলা নয়, এ কাদা ও মাটি দিয়ে তৈরি। সোনার বাংলা যদি আমাদের তৈরি করতে হয় তাহলে- রক্ত, শ্রম ও স্বেদ দিয়েই তা করতে হবে। এটি যখন বোঝা গেল, তখন যে জিনিসটি এ দেশে কাজ করলো, অনেক সংগঠন গড়ে উঠল। যেহেতু সংগঠন করতে টাকা লাগে আর এ দেশে তখন টাকা ছিল না। তাই বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া গড়ে তোলা যেত না। তাই শুরু হলো বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট সংগঠনের যুগ। এক কথায়- এনজিওদের যুগ। অবশ্য দেশে ছোট ছোট অনেক সংগঠন গড়ে উঠল। আমাদের কেন্দ্রকে আমরা কিন্তু দেশের প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে তুললাম। দেশের মানুষ, সংগঠন ও সরকারি সহযোগিতা হলো আমাদের পারানির কড়ি।
ষাটের দশকে যে উৎসাহ ছিল মানুষের মধ্যে, তা এখন নেই। আমরা সম্পূর্ণভাবে শিল্প-সাহিত্য, দর্শন-বিজ্ঞান- এক কথায় মানব সভ্যতার যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও মহান, তা থেকে বিচ্ছিন্ন। শিল্প-সাহিত্যের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে চায়, এরকম সংশপ্তক মানুষ, সুইসাইডার কোথায়? সব উত্থানের জন্যই তো সংশপ্তকের দরকার হয়!
হ্যাঁ, ডেডিকেশনের অভাব, ফলে মানসিক বিকাশের জায়গাও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তবে কি নতুন করে ভাববার সুযোগ এসেছে বলবেন না?
ডেডিকেশন, এটি তো নেই এখন আর। এখন যে যার ছোট্ট পেশা ও চাকরিতে ইঁদুরের মতো ঢুকে গেছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে অফিস করা, তারপর ঘরেফেরা। এই হলো জীবন। আর অন্যদিকে চলছে বল্গাহীন দস্যুতা। আমরা দরিদ্রতম একটি দেশ। আমাদের রাষ্ট্র ছিল না। আমাদের ঐশ্বর্য ছিল না। ধন-সম্পদ ছিল না। কিছুই না। আমরা স্বাধীন হলাম। এই প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ। যে সমাজে কিছু থাকে না, সেখানে উন্নয়নের প্রথম পর্যায়ে ন্যায়-নৈতিকতার বালাই থাকে না। তাহলে তো ধন-সম্পদ হবে না। এই সুযোগ ছেড়ে দেয়ার বোকামি অধিকাংশ মানুষই করেনি। এভাবেই ক্ষমতার প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়াল- অর্থ।
আমরা ষাটের দশকে সাহিত্য আন্দোলন করেছি, আমরা লেখকরা কিন্তু সব বন্ধু ছিলাম। আজও আমরা সবাই বন্ধু। লেখা নিয়ে আমাদের সমালোচনা হতো। তারপরও আমাদের মধ্যে সৌহার্দ্য কমেনি, একটি উন্মাতাল আনন্দ নিয়েই আমরা বেঁচে ছিলাম। একটি বড় জীবনের দিকে আমরা ছুটে গিয়েছিলাম। একটি বড় সাহিত্য যুগ আসছে- সেই স্বপ্নে। কতদূর কী হয়েছে, সেটি ভিন্ন কথা; কিন্তু স্বপ্নটি তো কাজ করেছিল। এখন মানুষের মধ্যে সেই স্বপ্ন নেই, তাই সবার মধ্যে এত কলহ আর কোন্দল। একটি অর্থসর্বস্ব যুগ এখন। যাদের মধ্যে ভালো কিছু আছে, তারা বিপদগ্রস্ত, একঘরে। আবার তারা হয়তো এক সময় সংগঠিত হবে। নতুন স্বপ্ন নিয়ে জেগে উঠবে নতুন মানুষ।

Joy Das says:
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সয়ীদের সাক্ষাত্কার টি পড়ে মন্তব্য করার সময় মনে পড়ছে বাংলা ভাষার জন্য তাঁর আজীবন কর্মকান্ড । বিভিন্ন মাধ্যমে অধ্যাপক মহাশয়ের বক্তব্য শুনেছি ।যে সমস্যার মধ্যে দিয়ে এই উপমহাদেশ চলেছে, সে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক তা আমাদের কলকাতাতেও প্রকট। সরকারি প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক হয়ে পড়লে মুক্ত মনে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা হয় না, এটা সব দেশেই সমস্যা । তবুও কিছু কিছু কাজ এই উপমহাদেশে হচ্ছে এটাই হয়তোবা এখনো আমাদের আশা । তবে যেহেতু এখন নির্ণায়ক ভূমিকা ধর্ম এবং রাজনীতি সেহেতু সব কিছু নিম্নগামী । তবে অধ্যাপক মহাশয়ের সংগে সহমত পোষণ করি এই জন্য যে আশা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আশা করছি আবার সব ক্ষেত্রে বাঙালি এগিয়ে যাবে ।