প্রেম কত প্রকার ও কী কী । আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ধরা যাক, হঠাৎ নিরুপায়ের মতো আপনি টের পেলেন আপনার পাড়ার কোনো তন্বী সুন্দরী আপনার দিনরাত্রির স্বপ্ন-অনুভূতির ভেতর জীবন্ত উপদ্রবের মতো ঘোরাফেরা শুরু করেছে এবং আপনার দিনের শান্তি আর রাতের ঘুম নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা কষছে। ধরা যাক, এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে একদিন আপনি সেই সুন্দরীর কাছে আপনার হৃদয়বেদনার কথা প্রকাশ করে ফেললেন। কিন্তু ফল হল আরও হৃদয়বিদারক, সেই হৃদয়হীনা আপনার বেদনাকে পুরোপুরি পায়ের তলায় নিষ্পিষ্ট তো করলেনই, উপরন্তু এসব অযথা বিষয়ে সময় নষ্ট না করে পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্যে আপনাকে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিলেন। তরুণ প্রেমিক, বলুন, তার কথা মেনে আপনি কি লক্ষ্মীছেলে হয়ে পড়াশোনায় ডুবে যাবেন? না। তাহলে তো আপনি তাকে পাবেন না। তাকে পেতে হলে আপনাকে করতে হবে অন্যকিছু। দিন-তিনেক পর আপনার বিমর্ষ মলিন অশ্রুবিধুর মুখখানা নিয়ে আবার তার সামনে গিয়ে হাজির হতে হবে। প্রথমদিনের মতো একইভাবে আবার আপনাকে তার ভালোবাসা ভিক্ষা করতে হবে, তাকে আপনার হৃদয়ন্ত্রণার একবার করে একইভাবে ফিরে-ফিরে আপনাকে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে।
দাঁড়াতে দাঁড়াতে একসময় আপনি দেখবেন, যে সুন্দরী প্রথম দিন আপনাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছিল সেই মেয়েটিই হয়ত আপনার ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় হয়ে আসছে। হয়ত একসময় আপনাকে তার কিছুটা ভালোও লেগে গেছে। একই ব্যাপার প্রায় একই ব্যবধানে বারে বারে ফিরে ফিরে আসতে থাকলে তা একসময় আমাদের মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে থাকে। একসময় তা ভালো, লাগতেও শুরু করে। তার ব্যাপারেও তা হতে পারে। হয়ত আপনি তাকে পেয়েও যেতে পারেন।
আরও একটা উপায় আছে তাকে পাওয়ার। তা হল, আপনি যদি তার পেছনে নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকতে পারেন। না, কোনো অশালীন ও অশিষ্টভাবে নয়, ভদ্রভাবেই। কিছু বই থেকে তার নোট করা দরকার, আপনি এগিয়ে গিয়ে সেটা করে দিলেন। সে রেস্টুরেন্টে বিল দিতে যাচ্ছে, আপনি প্রায় জোর করেই তার বিলটা দিয়ে দিলেন। তার একটা রিকশা দরকার, আপনি ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা ডেকে দিলেন। তার কলমটা মাটিতে পড়ে গেছে, আপনি ছুটে গিয়ে সেটা তুলে দিলেন। এমনিভাবে প্রতিমুহূর্তে তার পেছনে লেগে থেকে তাকে তিক্ত অতিষ্ঠ করে তুলতে পারলেও বিরক্ত হয়ে একসময় সে আপনাকে প্রশ্রয় দিয়ে বসতে পারে।
কিন্তু বন্ধুরা, এসবভাবে পাওয়া, এ কী প্রেম? এ তো দয়া, করুণা। করুণার মধ্যে কি প্রেম থাকে? যাকে মানুষ একবার কোনো কারণে ছোট ভেবে কৃপা করে বসে তাকে কোনোদিন সে কি ভালোবাসতে পারে? না, করুণার মধ্যে ভালোবাসার স্থান নেই। কিছুক্ষণ আগে বলেছি: যাকে আমরা বড় বলে ভাবতে পারি তাকেই আমরা শুধু ভালোবাসা দিতে পারি তাকেই যাকে আমরা কোনো-না কোনো জায়গায় আমাদের চেয়ে বড় বলে অনুভব করি, বুঝতে পারি সে আমাদের ওপরে। যাকে দেখার জন্যে চোখদুটোকে ওপরের দিকে তুলতে হয়, যার বিস্ময়ের সীমা আমরা খুঁজে পাই না, সে-ই তো আমাদের ভালোবাসা। যে প্রতিমুহূর্তে আমাদের জীবনকে নতুন কিছু উপহার দেয়, চোখের সামনে অজানা জগতের ছবি তুলে ধরে, জোছনারাতে আমাদের নিয়ে স্বর্গের কিনারায় কিনারায় ঘুরে বেড়ায়, সেই মানুষের জন্যেই তো আমাদের যত আকুলতা, হৃদয়ের যত রোদন। তার জন্যেই তো রাধার মতো বর্ষণঢাকা পিচ্ছিল পথে আমাদের অভিসার।
সুধীবৃন্দ, প্রেম তাই আসলে শ্রদ্ধারই অন্য নাম। তাকেই আমরা ভালোবাসি যার সামনে ছোট হতে পেরে আমরা গৌরব বোধ করি। যাকে আমরা শ্রদ্ধা করতে বা বড় ভাবতে পারি না, তাকে আমরা অন্তত ভালোবাসা দিতে পারি না। এইজন্যে যাদের আমরা সহজে পেয়ে যাই তাদের ভালোবাসতে আমাদের এত কষ্ট হয়। যাদের ভেতরটাকে আমরা দিঘির টলটলে পানির মতো অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারি তাদের জন্যে আমাদের প্রেম বাঁচে না। প্রেম চিরদিন তোলা থাকে দুর্লভের জন্যে, অপ্রাপণীয়ের জন্যে। তাদেরই আমরা চিরকাল ভালোবেসে যাই, যারা আমাদের ভেতর একটা না-পাওয়ার অনুভূতি, না-বোঝার বিস্ময় জাগিয়ে রাখতে পারে। যারা চির-অধরা, যারা ‘পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায় ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে’, যাদের মধ্যে রয়েছে এক রহস্যময়তার অন্ধকার, যে-রহস্যকে কোনোদিন জানা হবে না বলেই যার আকুতি আমাদের কোনোদিন ফুরোবে না।
বড়-র জন্যে আমাদের এই আকুতিই হল প্রেম। যাকে বড় বলে মনে হয়েছে বা মনের ভেতর যাকে বড় করে তুলে তার বিস্ময়ে অপলক হয়েছি, তার জন্যে আকুতিই প্রেম। তাকে হারানোর আশঙ্কার নামই প্রেমের আশঙ্কা। কৃষ্ণ আর রাধাÑকার মধ্যে আছে সত্যিকার ভালোবাসা? কার প্রেমের ভারী দীর্ঘশ্বাসে আকাশ-বাতাস আজও মদির? সে তো রাধা। কৃষ্ণের মধ্যে কি প্রেম আছে? যার জীবনে ষোলো শ’ গোপিনী, তার কি প্রেম থাকতে পারে? প্রেমের অপার্থিব পুলক যার ভেতর, অসহ্য দুঃখে রক্তমাখা গোলাপ হয়ে যে ফুটে আছে, সে তো রাধা। কৃষ্ণকে সে কেন এত ভালোবাসে? ভালোবাসে কারণ, সে তাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না। কৃষ্ণ তার তুলনায় অনেক বড় অনেক দুর্বোধ্য আর বৈভবময়; গাছের উঁচুতম ডালের সবচেয়ে অপার্থিব ফুল, যাকে সে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবে না। এতবড় বলেই তার প্রতিটা সুখের স্পর্শ এমন অগ্নিস্ফূলিঙ্গময় এমন অলৌকিক খুশিতে ভরা; তাকে না-পাওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত এমন দুঃসহ আর রক্তাক্ত। কিন্তু কৃষ্ণের কাছে রাধা কী? ষোলো শ’ গোপিনীর একজন গোপিনী মাত্র। অস্তিত্বের তুচ্ছতা দিয়ে ঘেরা একজন অতি সাধারণ মানুষ। তার জন্যে কৃষ্ণের ভালোবাসা এত তীব্র এত জ্বালাময় হবে কী করে?
৭
একই কারণে বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ ভ্রমরের জন্যে গোবিন্দলালের ভালোবাসা প্রবল হয় নি, যেমন প্রচন্ড বা আত্মধ্বংসী হতে পারেনি তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসে ঠাকুরঝির জন্যে কবি নিতাইচরণের ভালোবাসা। ঠাকুরঝির সঙ্গে নিতাইচরণের অনেক দিনের পরিচয় কিন্তু তারা প্রথম দিনেই পরস্পরকে ভালোবাসেনি। ঠাকুরঝির কাছে প্রথমে নিতাই ছিল আর দশটা মানুষেরই মতো সাধারণ একজন মানুষ। ঠাকুরঝিও নিতাইয়ের কাছে তা-ই। তাই তাদের সম্পর্ক প্রেমের দিকে গড়ায়নি। কবে ঠাকুরঝি নিতাইকে ভালোবাসল? যেদিন সে নিতাইয়ের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে একজন অবিশ্বাস্য মানুষকে আবিষ্কার করল। চোখের সামনে দেখল, তার এতদিনের চেনা এই তুচ্ছ লোকটি আসলে একজন ‘কবি’। মঞ্চে দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালিতে অভিনন্দিত ও ধন্য একজন ঈপ্সিত নায়ক। নিতাইয়ের জন্যে তার প্রেম তাই দেবতার জন্যে ভক্তের আত্মনিবেদনে উদ্বেল হয়ে উঠল। এইজন্যে এই প্রেম এত জন্মান্ধ ও আত্মধ্বংসী হয়েছে। কিন্তু ঠাকুরঝির জন্যে নিতাইয়ের প্রেম তো তা নয়! ঠাকুরঝি তো তার চোখে কোনো অসাধারণত্বের আলোতে জ্বলিত নয়। সে তো তার কাছে একটা সাধারণ মেয়ে। অনেক দিন ধরে যে-মেয়েটিকে সে ফিরে ফিরে দেখেছে সেই সামান্য মেয়ে। তাই তার মধ্যে প্রেমের সর্বগ্রাসী জ্বালা বা সর্বোচ্চ বৈভব কোনোটাই নেই। তাই যখন সে বুঝল এ প্রেম অনুচিত, সমাজের কাছে অগ্রহণীয়, বাস্তবে অসম্ভব, তখন সে বিমর্ষ হলেও ঠাকুরঝিকে ছেড়ে যেতে পেরেছে। যাবার সময় ঠাকুরঝিকে উদ্দেশ করে সে একটি চমৎকার কবিতা লিখে গেছে। কবিতাটি সুন্দর, কিন্তু আমার কাছে এ কবিতাকে ভালোবাসার উচ্চারণ মনে না হয়ে পরাজিত অক্ষমের আত্মসান্ত¡নার মতো লাগে। কিন্তু ঠাকুরঝি তো অত সহজে নিতাইকে ভুলতে পারেনি! সে নিজেকে ধ্বংস করে, নিজের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে তার প্রেমের ঋণশোধ করেছে। এই হল প্রেম। যাকে আমরা আমাদের চেয়ে বড় ভেবে শ্রদ্ধা জানাতে বা যাকে নিয়ে বিস্মিত হতে পারি, এ তার জন্যেই কেবল তোলা। যে-মানুষকে নিয়ে আমরা গর্ব অনুভব করি তার প্রেম থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।
অবশ্য একধরনের প্রেম আছে যা প্রধানত শ্রদ্ধার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে না; গড়ে ওঠে হৃদয়ের তপ্ত, উচ্ছ্রিত আবেগের ওপর নির্ভর করে। লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, দেবদাস-পার্বতীর প্রেম এই ধরনের। পৃথিবীর অধিকাংশ প্রেমই এ জাতের। এ ধরনের প্রেম একটা জায়গায় বিপজ্জনক। এর ঘোর সহজেই কেটে যায়। এ ঠিক প্রেম নয়, মোহ। আমরা প্রায়ই শুনি, ‘প্রেম করে ওরা বিয়ে করেছিল, কিন্তু ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল।’ কেন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল? কারণ তা প্রেম ছিল না, ছিল মোহ। মোহ বলে এই প্রেমের মরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। এর কারণ, এর ভিত্তি মানুষের সবচেয়ে অনিত্য জিনিশ: আবেগ। ভারী তাড়াতাড়ি এ মরে যায়। আবেগ শেষ হলে এই প্রেম ঝরা ফুলের মতো পায়ের কাছে পড়ে থাকে। কাজেই এই ধরনের ক্ষণিক প্রেমকে বড় প্রেমের দলে আমরা ফেলতে পারি না।
কিন্তু যতরকম প্রেম পৃথিবীতে আছে তাদের মধ্যে যে প্রেম সবচেয়ে জোরালো, গভীর ও চিরস্থায়ী তার নাম হল ‘পরিপূরক প্রেম’। এই প্রেম ঠিক কেমন, প্রথমে তা বুঝিয়ে নিই। তারাশঙ্করের ‘কবি’ বইটির কথাই আবার ধরি। সেখানে নিতাইচরণ আর বসন দুজন দুজনকে ভালোবাসে। নিতাইচরণ গান লেখে গান গায়, বসন সে-গানের সঙ্গে নাচে। এখানে গায়ক ও কবি হিসেবে নিতাইচরণের প্রতিভা, সাফল্য ও সম্পূর্ণতা নির্ভর করছে বসনের শিল্পিত ও সৌকর্যময় নৃত্য পরিবেশনের ওপর, আর বসনের শিল্পীজীবনের সাফল্য ও দীপ্তি নির্ভর করছে নিতাইচরণের কবিত্ব ও সংগীতপ্রতিভার ওপর। অর্থাৎ দুজনার জীবনের পরিপূর্ণতা ও বিকাশ নির্ভর করে আছে পরস্পরের ওপর। এমন প্রেমের মৃত্যু হয় না। এই প্রেমে আবেগ বা শ্রদ্ধা তো আছেই, তার ওপর আছে দুটো জীবনের সম্পূর্ণতার নিশ্চয়তা। এখানে প্রেমের মৃত্যু কেবল প্রেমের নয়, দুটো জীবনের সম্ভাবনারই মৃত্যু। তাই এ প্রেম শুধু আবেগ বা শ্রদ্ধার স্বার্থে নয়, পুরো জীবনের স্বার্থে। এজন্যেই এ প্রেম চিরায়ু। এখানে প্রেমের মৃত্যু জীবন-বিয়োগের সমান।
৮
এ-ধরনের প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটলে তা যে কী মর্মান্তিক হয়ে ওঠে তার উদাহরণ আছে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্পে। সেই গল্পের নায়ক মোতালেফ একজন গাছি। গাছি হিসেবে সে ভারি সমর্থ। সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী মোতালেফ কলসি কলসি রস আনার সামর্থ্যরে ওপর। কাজেই তাদের দুজনের জীবন-সম্ভাবনা নির্ভর করছে দুজনার ওপর। এমন জায়গায় তাদের দুজনার মধ্যে যদি প্রেম থাকত তবে তা হত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেম। মাজু খাতুনের মধ্যে সে-প্রেম ছিলও। সুদর্শন সুঠাম বাকপটু গাছিকে সে সত্যি সত্যি ভালোবাসত। কিন্তু গোর বাঁধাল দুষ্ট মোতালেফ। মাজু খাতুনের বয়স হয়েছে। দেখতে সে সুবিধার নয়। এদিকে গ্রামের অষ্টাদশী মেয়ে ফুলবানুর রূপ ফুটফুটে ফুলের মতো। যদিও এরই মধ্যে সে এক স্বামীর হাত ঘুরে এসেছে কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। সৌন্দর্যপিপাসু মোতালেফ ফন্দি আঁটল, মাজু খাতুনকে তালাক দিয়ে ফুলবানুকে বিয়ে করবে। কিন্তু এর জন্যে অনেক টাকা দরকার। তাই সে আরও খেজুরগাছ কেটে বেশি-বেশি রস আনতে লাগল আর মাজু খাতুনকে খাটিয়ে আরও বেশি গুড় তৈরি করাতে লাগল। মাজু খাতুন তো প্রতিভার আনন্দ আর ভালোবাসায় বুঁদ। কড়াইয়ের পর কড়াই রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানিয়ে যায়, জানে না এই গুড় বেচার টাকা দিয়েই তার স্বামী আর-একজনকে বিয়ে করে ঘরে তোলার ফন্দি এঁটেছে। সত্যি সত্যি একসময় মোতালেফের বিয়ের টাকা জোগাড় হয়ে যায়। সে মাজু খাতুনকে তালাক দিয়ে ফুলবানুকে ঘরে নিয়ে আসে।
মোতালেফের প্রত্যাশা, ফুলবানুও মাজু খাতুনের মতো রস জ্বাল দিয়ে চমৎকার গুড় বানাবে, সারা হাটের মানুষ সে-গুড়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। ঘরে সুন্দরী স্ত্রী, বাজার গুড়ের সুনাম, এর চেয়ে কাম্য আর কী আছে গাছির জীবনে? কিন্তু ফুলবানু তা পারবে কেন? ভালো গুড় বানানো তো তার প্রতিভা নয়। সে তো মাজু খাতুনের প্রতিভা। ফুলবানু তো ফুল। নামেই তার প্রমাণ। সে তো আঙিনার একপাশে রূপ ছড়িয়ে ফুটে থাকার জন্যে। গনগনে চুলার আঁচে নিজের রূপ নষ্ট করার জন্যে সে তো জন্মায় নি। ফুলবানু ভালো গুড় বানাতে পারল না, হয়ত চাইলও না। বেশি-বেশি গাছ কেটে মোতালেফ রাশি-রাশি রস নিয়ে এল, কিন্তু তার রসের আয়োজন সব ব্যর্থ হয়ে গেল। বাজারে মোতালেফের সুনাম নষ্ট হল। তার ব্যবসা মজে এল। হৃদতগৌরব ও বিমর্ষ হয়ে সে অনুশোচনায় জ্বলে জ্বলে মরতে লাগল।
এদিকে মাজু খাতুনের বিয়ে হয়েছে নদীর ওপারের এক গ্রামে। তার বয়স্ক স্বামী দাঁড়িওয়ালা নাদির শেখ ভদ্র সভ্য ভালো মানুষ। মোতালেফের সঙ্গে তার পরিচয়ও আছে। একদিন রিক্ত ও নিঃশেষিত মোতালেফ সকালবেলায় প্রায় স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো দুই হাতে দুই হাঁড়ি রস নিয়ে হাজির হল মাজু খাতুনের বাড়িতে। তার আশা, মাজু খাতুন এই দুহাঁড়ি রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানিয়ে দেবে। মাজু খাতুনের স্বামী তার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করল। খাতির করে তামাক খেতে দিল। কিন্তু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল অভিমানক্ষুব্ধ মাজু খাতুন। ঘরের বেড়ার ওপাশ থেকে বলে উঠল, ‘যাইতে কন এই বাড়ি গুনা, এখনই নাইমা যাইতে কন। একটুও কি সরম-ভরম নাই মনের মইধ্যে? কোন্ মুখে ওঠল আইসা এখানে? ক্যান?’ তার বুকের ভেতরকার প্রতারিতের অভিমান তখনো দাউদাউ জ্বলছে।
মোতালেফ আজ তালাক দেওয়া স্ত্রী মাজু খাতুনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অধিকারী নয়। তবু তার কথা সে বলে। মাজু খাতুনের স্বামীকে উদ্দেশ করে বলে: ‘কন যে (রস) আনছে জ্বাল দিয়া গুড় বানাইয়া দেওয়ার জৈন্যে। সেই গুড় ধামায় কইরা হাটে নিয়া যাবে মোতালেফ মেঞা। নিয়া বেচবে অচেনা খইদ্দারের কাছে। এ-বছর এক ছটাক গুড়ও সে হাটে-বাজারে বেচতে পারে নাই। কেবল গাছ বাওয়াই সার হয়েছে তার।’ এই সামান্য গুড় বাজারে বেচে মোতালেফের লাভ হবে কতটুকু? না, মোতালেফ গুড়ের জন্যে মাজু খাতুনের কাছে যায় নি। গিয়েছিল গুড়ের উছিলায় তার অনুতপ্ত হৃদয়ের কষ্টের কথা তাকে জানিয়ে আসতে। বলতে যে: আমার ভুল হয়ে গেছে। আমার মৃত্যুর অধিক মৃত্যু হয়েছে। জীবনের সব অর্থ আনন্দ শেষ হয়ে গেছে। এই হল পরিপূরক প্রেম। এর ভেতর মানুষ জীবনের সর্বোচ্চ শিখরকে এবং উত্তুঙ্গতম আনন্দকে স্পর্শ করে। থাকলেও সে জীবনকে ভরে রাখে। না-থাকলেও তাই-ই।
প্রেম মানুষকে অসহ্য কষ্ট দেয়। হয়ত জীবন ভরেই কাঁদায়। কিন্তু যে-সুখ দেয় তার সমকক্ষ বা তুলনীয় আর কিছু নেই। মানব-অস্তিত্বের এ সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। হতে পারে তা সামান্য কয়েকটা মুহূর্তেরই জন্যে, কিন্তু ঐ অল্প সময়ে এ আমাদের যে-সোনালি স্বর্গলোকের বাসিন্দা করে, জীবনের ওপর সন্ধ্যার অনিন্দ্য আভা ছড়িয়ে দিয়ে যে-প্রাপ্তির গৌরবে অস্তিত্বকে অমরত্বের স্বাদ দেয়Ñতার চেয়ে বড়কিছু কেবল এ জীবনে কেন, কোনোখানে নেই। ধন্যবাদ।
– আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর বক্তৃতা সংগ্রহ থেকে নেয়া