| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

স্মৃতিকথা: এই লভিনু সঙ্গ তব | তানিয়া রহমান

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

তখন দারুণ দিন আমাদের। দারুণ বয়স। স্যারের বয়স সবে তিন কুড়ি দশ মানে সত্তর বছর। আর আমাদের সবাই এক কুড়ির ঘর পেরিয়েছি মাত্র! একুশ থেকে তেইশ বছরের তরুণ তুর্কি সব। দলবেঁধে পাঠচক্রে ভর্তি হলাম। গা থেকে গাঁয়ের গন্ধ তখনও যায়নি (এখনো যায়নি)। কথাবার্তা, উচ্চারণ, আচরণে গ্রামের সবুজ মানুষটা কলকলিয়ে ওঠে আমাদের ভেতর। সেই সবুজ, সরল দিনের এক বিকেলে পাঠচক্রে ভর্তির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। তখন পুরনো দুইটা বিল্ডিংয়ে চলতো কেন্দ্রের কাজ কারবার। নতুন বিল্ডিংটা হয়েছে আমাদের চোখের সামনে। তো সেই পুরনো বিল্ডিংয়ের ততধিক পুরনো এক কক্ষে ততধিক নার্ভাস হয়ে ইন্টারভিউ দিলাম। সম্বল বলতে ছিল-গ্রামে থাকাকালীন ‘হাতের কাছে যা পাই,তাই পড়ি’ এমন পাঠক মন আমার। ইন্টারভিউতে কি কি প্রশ্ন ছিল আর আমি কিসব উত্তর দিয়েছিলাম তা আজ বারো বছর পরে আর মনে নেই, তবে এটা মনে আছে যে, সেই প্রথম সায়ীদ স্যারকে দেখেছিলাম আমি। সামনা-সামনি দেখার কথা বলছি না শুধু, বাস্তবিক সেদিনের আগে আমি স্যারকে পেপার, পত্রিকা, টেলিভিশন কোথাও আগে দেখি নাই। পড়াশোনার ঝক্কি ঝামেলা আর তখনকার পারিবারিক, সামাজিক আবহে সে বয়সে খ্যাতিমানদের নিয়ে গরজ দেখানোর অবসর, সুযোগ আমার ছিলো না। আমাদের বাড়িতে পেপার রাখা হতো না, টিভিও ছিল না (এখনো নাই)। সুতরাং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার সম্পর্কে পূর্ব ধারণা না থাকায় ‘আমি দেশের খ্যাতিমান বিদ্বান কারো কাছে ইন্টারভিউ দিচ্ছি’-এই অনুভূতিটা তখন আমার ভেতর ছিল না।

সুতরাং বলা যায় শুরু থেকে আমি স্যারকে একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে দেখেছি সবার আগে। এ কারণে স্যার সম্পর্কে লিখতে গেলে আমার লেখাটা পুরো দূর্বলতায় ঠাসা হবে। আরেকটা লেখায় পড়েছিলাম- ‘আজকাল কারো সম্পর্কে মানুষ লিখতে গেলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আলাপচারিতা, ট্যুর, ট্রিপ, সাক্ষাৎকার- এসব নিয়ে লেখে শুধু। বিখ্যাত, বড় মানুষদের কাজ নিয়ে আলাপ করে না। আলাপ করে তাঁর রসিকতা নিয়ে,পরিবার নিয়ে।’

সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরে লোকজন যখন স্মৃতিচারণ করছিল তখন তার কড়া সমালোচনা করে এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন একজন। সুতরাং বড় কাউকে নিয়ে লেখার সীমাবদ্ধতা অনেক। কারো প্রত্যাশা থাকে লেখাটা পড়ে ব্যক্তি মানুষটাকে জানার। কারো বা আগ্রহ শুধু বিখ্যাত মানুষটার কাজ-কর্মে। সুতরাং এই লেখার সীমাবদ্ধতা অসীম।

আমার কাছে স্যারের প্রথম পরিচয় তিনি শিক্ষক। তিনি আমাদের পাঠচক্রের ক্লাসগুলো নিতেন। শুক্রবার বিকেলবেলা নিয়ম করে পাঠচক্রের ক্লাসে পাঠানুভূতি লেখা ডায়েরি, খাতা জমা দিয়ে পাঠ আলোচনায় মনোযোগ দিতাম আমরা। তখন পাঠচক্রের অস্থায়ী ক্লাসরুম ছিল পান্থপথের শেল সেন্টার। শেল সেন্টারেই প্রথম ‘পূর্ণিমা উৎসব’ হয় বোধ করি। শেল সেন্টারে পাঠচক্রের দিনগুলোতে বই নিয়ে সকলের অংশগ্রহণমূলক আলোচনার বাইরে যে জিনিসটা আমাকে টানতো তা হলো, ক্লাস শেষের আড্ডাবাজি। আড্ডাবাজির সাথে চলতো চা, কফি পর্ব। পরিচয় হতো কত নতুন নতুন মানুষ, বন্ধুদের সাথে। পরবর্তীতে সেসব কোনো কোনো বন্ধুত্ব আমরা আজও বহন করে চলেছি। কেউবা আবার হারিয়ে গিয়েছে ঈর্ষায়, অভিমানে, বাস্তবতার তাপে-চাপে। সুতরাং পেশাজীবনের আগেই আমি যে নানা ধরনের বন্ধু পেয়েছি তার জন্য পাঠচক্রের ঐ সময়টা স্মরণযোগ্য আমার কাছে।

বই আলোচনায় যেমন আগ্রহ নিয়ে সবাই স্যারের বক্তব্য, যুক্তি, পাল্টা যুক্তি শুনতো তেমনি ক্লাস শেষের আড্ডাবাজির মধ্যমণিও ছিলেন স্যার-ই। তখন আমি অনভিজ্ঞ, নবীন। তবু খেয়াল করলাম, ক্লাসে পৌঁছাতে আমাদের কারো কারো দেরি হলেও অধিকাংশ দিন স্যার ঠিকঠাক সময়মত ক্লাসে পৌঁছাতেন। ক্লাস শেষে আমাদের কারো কারো তাড়াহুড়ো ছিল, থাকতো! কিন্তু স্যারকে দেখতাম দিব্যি বসে বসে হাসিমুখে সবার সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করছেন। তখন সেল সেন্টারে একদিন সাপ্তাহিক আড্ডা হলো। শহরের বড় বড় নাম করা বিদ্বান মানুষেরা এলেন সে আড্ডায়। আমরা কয়েকজন তখন স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করলাম সে আড্ডায়। সে রাতে হলে ফিরতে বেশ ঝক্কি হলো আমাদের। সে আরেক গল্প।

এরপর এলো কেন্দ্রের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করার সুযোগ। তরুণ তুর্কি আমরা পাঠচক্রের বন্ধুরা দলবেঁধে নিলাম স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার ছবক। স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাশাহীন সে দিনগুলোতে ‘আনন্দ পাওয়াই ছিল আমাদের জীবন ধর্ম। এই যে আজকের দিনে ছেলে-মেয়ের সোশ্যাল কমিউনিকেশন স্কিল নেই বলে বাবা-মায়েরা হা,হুতাশ করেন, তা আমাদের বাবা-মায়েদের করতে হয় নি। করতে হয় নি এই শহরে একটা ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’ আছে বলে। সেই কেন্দ্রে আমাদের যাতায়াত ছিল বলে টিম ওয়ার্ক করে কীভাবে ১০০ জনের একটা দল হৈ হুল্লোড় করতে করতে সোঁনারগাঁয়ে ডে ট্রিপে রওনা হওয়া যায় সে শিক্ষাটাও হাতে কলমে পাঠচক্রের দিনগুলোতে শিখেছিলাম আমরা।

এসব আয়োজনে স্যারের উপস্থিতি বরাবরই উজ্জ্বল হয়ে থাকতো আমাদের সবার মনে। আমাদের সে সকল ট্রিপের প্রধান আকর্ষণই ছিল স্যারের সঙ্গ পাওয়া। ক্লাস রুমের বাইরে এসে সায়ীদ স্যারের ‘স্যার’ পরিচয় ছাপিয়ে ব্যক্তি স্যারকে জানতে পারতাম আমরা তখন। মানুষকে জানার একটা বড় উপায় হলো তাঁর সাথে ভ্যাকেশনে যাওয়া- দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া। সেই সুযোগ আমরা পাঠচক্রের সদস্যরা পেয়েছিলাম। স্যারের সাথে এরপর শিলং, সমুদ্র, সিলেট, সোনারগাঁয়ে তাহের ভাইয়ের বাড়ি- এরকম বহু জায়গায় ঘুরেছি আমরা আর আবিষ্কার করেছি এক নতুন শিক্ষককে, নতুন মানুষকে। একজন মানুষ এতো এতো বিষয়ে কীভাবে জ্ঞান রাখেন, এতো পড়াশোনা কখন করেন এই বয়সে এসেও! সে বিস্ময় আজও আমাদের কাটে না।

এদিকে পাঠক হিসেবে আমি সর্বভুক না, বরং সিলেকটিভ। সে খবরও স্যার জানেন। সুতরাং মাঝেমধ্যে খোঁচা শুনতে হতো, আজো হয়- ‘তুমি তো আবার আমার লেখা পড়ো না।’ কথা সত্যি।

সংগঠক, শিক্ষক, কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, উপস্থাপক, সুবক্তা -এ সকল বহুবিধ বর্ণিল পরিচয়ের ভীড়ে স্যারের ‘লেখক’ পরিচয়টা কম পরিচিতি পেয়েছে বরাবর আমাদের কাছে। সেই দুঃখ ঘোঁচাতে কিনা জানি না- একবার আমি স্যারের ‘সুফলা ধরিত্রী’ বইটার প্রাথমিক প্রুফ দেখার সুযোগ পেলাম। প্রুফ কীভাবে দেখতে হয় সেটাও আমাকে কেন্দ্রে একদিন আক্ষরিকভাবে হাতেকলমে শেখালেন। শুরু করলাম স্যারের বই পড়া-‘সুফলা ধরত্রী’।

বইটা শেষ করে আমি স্যারকে বলেছিলাম -‘ জানি না আপনার এই বইটা পাঠকপ্রিয়তা পাবে কিনা। তবে আমি নিশ্চিত জানি, কোনো একদিন এই বই নগর ইতিহাস, উন্নয়নে রিসার্চ প্রিয় মানুষের প্রিয় বই হবে- পাঠ্য হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সে।’ ‘সুফলা ধরিত্রী’ বই সম্পর্কে আমার এই অনুভূতি এখনও বর্তমান। এই লম্বা লেখাটা যারা পড়লেন তাঁদের জন্য ‘সুফলা ধরিত্রী’র একটা অংশ তুলে দেয়ার লোভ করছি এখানে।

“আমরা যখন ছোট ঢাকা তখন ছিল গাছপালা ঢাকা একটা নিরিবিলি ছোট্ট শহর। জনসংখ্যা লাখ তিনেকের মতো। বিশ শতকের প্রথম দিকে নগর পরিকল্পনার আওতায় গড়ে তোলা রমণীয় এলাকা হিসেবে রমনার খ্যাতি তখন বাংলাদেশ-জোড়া। ওই শতকের তিরিশ দশকের পরিপাটি পুরানা পল্টন আর সবুজ রমনা এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তরুণ বুদ্ধদেব বসুর গল্পে স্মরণীয় হয়ে আছে। বিশ শতকের প্রথম দিকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জুড়ে ছিল নবাবদের বিস্তীর্ণ বাগান, সেখানে নাচঘরের (এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের মধুর ক্যান্টিনের) আশেপাশে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতো সুদৃশ্য শিংওয়ালা চিত্রল হরিণ। পিলখানা ছিল হাতি ব্যবসায়ীদের হাতিশালা, সেখান থেকে লাইন ধরে হাতিদের গোসল করাতে নিয়ে যাওয়া হতো এফডিসি’র পূব পাশের বিশাল জলাশয়ে। যে পথ দিয়ে হাতিদের হাঁটিয়ে নেওয়া হতো হাতির নাম অনুসারে তার নাম হয়ে যায় এলিফ্যান্ট রোড। ওই নামেই এখনও সে পরিচিত। হাতিদের গোসলের জায়গা হিসেবে জলাশয়টি পরিচিত হয়ে ওঠে হাতিরঝিল হিসেবে, যে হাতিরঝিলকে ভূমিদস্যুদের থাবা থেকে বাঁচিয়ে একটা গাছপালা ঘেরা সুদৃশ্য টলটলে পানির বিশাল লেক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমরা পরিবেশবাদীরা বহুদিন লড়েছি এবং শেষ পর্যন্ত সফলও হয়েছি।’
-(‘সুফলা ধরিত্রী’: স্মৃতির শহর:পৃ-১১)

আজ ২৫ জুলাই, স্যারের জন্মদিন। পরিবেশবাদী এই লেখককে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত