Abdur rob, irabotee.com

পাঠ প্রতিক্রিয়া: বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় অদৃশ্য নোটবুকে

Reading Time: 3 minutes

কবিতা দ্রষ্টব্য নয়, শব্দের যথার্থ বিন্যাসে অন্তর্দৃষ্টির সুশৃঙ্খল প্রকাশ। এটা মূলত সৌন্দর্য সৃষ্টির লক্ষ্যেই। আর কবি? তাঁকে দ্রষ্টা হওয়ার দাবি তুলেছিলেন প্রতীকবাদী কবি আর্ত্যুর র‌্যাঁবো। যে বিষয়ে বা উদ্দেশ্যে কবি ব্যাখ্যা করতে চান না কেন-কবিতার মৌল বক্তব্য অন্তরকে ছুঁয়েই ঋদ্ধ হতে চায়। মন্ময়-চেতনা এই ক্ষেত্রে একটু বেশিই অগ্রসর (অবশ্য তন্ময়তাকে বাদ দিয়ে নয়)। প্লেটো কর্তৃক কবিতায় মিথ্যাচারের অভিযোগের পরও আমরা জানি, কবিও সত্যের উপাসনা করেন, প্রকাশ করেন চিত্রণে, চর্বণে;-অর্থাৎ কোনো ঘটনা কিংবা সত্যকে কবি কল্পনায় রূপায়িত করেন; যেহেতু কবিতার প্রকাশভঙ্গি দর্শনের কিংবা বিজ্ঞানের প্রকাশভঙ্গির মতো নিরাবরণ ও নিরলঙ্কার হলে পোষায় না। প্রত্যেক কবির বোধ, প্রজ্ঞার ধরন এক নয়, হতেও পারে না। এখানে কথা হচ্ছে, কবিতার দোষগুণ নির্ণয়ের কিছু ইন্ডিকেটর থাকার পরেও একজন সমালোচক খেয়ালিভাবে একটি কবিতাকে সফল কিংবা ব্যর্থ বলে ঘোষণা করবেন কিভাবে? প্রত্যেক কবিই কবিতা সৃষ্টির পর তার পাঠক এবং উত্তরকালের উদ্দেশে্য নিবেদন করেন। কবিতার চূড়ান্ত গ্রহণ-বর্জন উত্তরকালের হাতেই থাকে। স্বীকার্য যে, আজকের প্রেক্ষাপটে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে কবিতা হয়ে উঠছে প্রাণহীন এবং জটিল।

একদা অন্ধকারে দেখতে পেতাম

তরল দূরত্ব-

সূচিমুখ, কালো আলো।

রেড়িয়ামের মতো জ্বলে উঠত নক্ষত্র;

দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতায় সে ক্ষমতা লুপ্ত আজ।

ঠিক সাত বছর এগারো মাস একদিন পরে কবি লিখছেন-

সেই কবে রাতের আঁধারে

খসে পড়েছিল এক তারা,

আজও সে আমার বুকে নিয়তির মতো

কেটে বসে থাকা এক ক্ষত;

আমি তার ক্ষত।

বাংলা ভাষার গত হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় বাংলা ভাষাটি “পালি-প্রাকৃত, ওড়িয়া, অসামিয়া, সংস্কৃত, সাধু, চলিত” ইত্যাদি বিভিন্ন ধারায় পরিবর্তন হয়েছে; সর্বশেষ এ ধারায় যুক্ত হয়েছে ‘প্রমিত বাংলা’। এগুলোর মাধ্যমে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষা লেখার এবং পড়ার রীতি সামান্য পরিবর্তন করা হয়েছে। আধুনিক মানে স্মার্ট । কবিতা যেহেতু এ যুগের স্মার্ট মানুষদের জীবন ও চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ সেহেতু কবিতার ভাষাও স্মার্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন- গত বিশ বছর আগে যখন স্মার্ট ফোন ছিল না; তখন মোবাইল প্রযুক্তি এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না; এখন প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে কিন্তু এর ব্যবহার সহজ হওয়ায় এবং নতুন নতুন ফিচার সংযুক্ত হওয়ায় মোবাইল হয়ে উঠেছে মিনি কম্পিউটার। ঠিক তেমনি, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কবিতার কারুকাজ আরো উন্নত হওয়ার পাশাপাশি কবিতা আরো বেশী সুখপাঠ্য হওয়ার কথা ছিল। দুঃখজনক হলেও তা হয়নি।

কবিতা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে যিনি আধুনিক কবিতা লিখে নিজেই বুঝতে পারেন না, কবিতাকে কঠিন থেকে আরো কঠিন করে তুলতে অভিধান থেকে শব্দ ধার করেন, ভাব-ভাষা আর সময়ের তাল-লয়ে গোলমাল করেন তিনি স্ব ঘোষিত আধুনিক কবি হবেন। তিনি মানুষের কবি নয়। কবিতা লেখা খুব সহজ কিন্তু কবি হওয়া খুবই কঠিন; অনেক সাধনা লাগে। আধুনিক সময়-সমাজ কিংবা আধুনিক পাঠকের কবি তিনি কখনো হতে পারবেন না; যদি না পাঠক নিজেকে কবিতায় আবিষ্কার করতে না পারে । যা আধুনিক জমানার মানুষ বুঝে না, তা আর যাই হোক কবিতা নয়। যিনি আধুনিক পাঠকদের মন-মানসিকতা, সমাজ-রাষ্ট্র, প্রকৃতি-প্রেম আর জীবন-যৌবন নিয়ে কবিতা লেখেন তিনিই এ যুগের কবি। সেইদিক থেকে আবদুর রব তার কবিতায় বারবার স্মার্ট এবং পাঠক নিজেকে তাঁর কবিতায় আবিষ্কার করতে সক্ষম। দুদিন আগে হাতে এলো আবদুর রবের নতুন কাব্যগ্রন্থ বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। এই বইটিতে সাত বছর এগারো মাস একদিনের কবিতা যাপনের কবিকে পাই। এবং স্পষ্ট করে খুঁজে পাওয়া যায় কবির ভাঙন ও বিনির্মানের দৃশ্যপট যা আবদুর রব তার কবিতায় শব্দে শব্দে এঁকেছেন।

বিমূর্ততায় ভরে আছে কবিতা। কিন্তু তা যথেষ্ট নমনীয়। যেন একতাল নরম মাটিতে গড়া। সেই বিমূর্ততায় পাঠকের অনেক পরিসর। সে তার ইচ্ছেমতো বিমূর্ততাকে নিজের চিন্তা চেতনায় ধারণ করতে পারছে। কে ঘুমায় কে জাগে বা রূপান্তরের গান কিংবা আপেলসূত্র, সূক্ষ্ম এক সুতোয় বাঁধার প্রয়াস আছে, আবার কোথাও ছেড়ে দেওয়াও আছে। এ এক নতুন অভিযান, যেখানে ছোট্ট ছোট্ট শব্দবন্ধ ও বাক্যে, বিন্দু বিন্দু ভাবনার অনায়াস সম্প্রসারণে, নিজস্ব কিছু চিহ্ন, সংকেত, স্বাক্ষরে, নিজস্ব একটা বাকভঙ্গিতে কবিতা। কবির কবিতা আর পাঠকের কবিতা যখন একই সমতলে আসে তখন তা হয়ে ওঠে মহার্ঘ। কবি আবদুর রব কবির নীবরে নিভৃতে সেই মহার্ঘ কবিতার জনক হয়ে উঠেছেন। কবিতার অভিযাত্রায় সেখানেই কবির সাফল্য। রব আমাদের কাব্যাঙ্গনে তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর নিয়ে হাজির হয়েছেন। কাল তাকে সেভাবেই সনাক্ত করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। রবের কলম অব্যাহত থাকুক পাঠক হিসেবে এটুকুই আমার আন্তরিক চাওয়া।

 

 

 

কাব্যগ্রন্থ

বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়

আবদুর রব

বিদ্যা প্রকাশ

প্রচ্ছদ: হিরন্ময় চন্দ

মূল্য: ১৩৫ টাকা

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>