অবলুপ্তি

Reading Time: 2 minutes
 
বৃষ্টি মানেই আমাদের বাড়ির মেজ কাকা কবিতা আওড়াবেন- এ তল্লাটে তাকে থামাবে সাধ্য কার!
বৃষ্টি হলেই পিচ ঢালা ধূসর বর্ণ রাস্তাটা কুচকুচে কালো হয়ে যায়। আর বৃষ্টি থামার পর ফাঁকা রাস্তায় চোঙা ফুঁকতে ফুঁকতে উদয় হতেন লাল মিয়া। হতেন বলাই ভালো, কারণ তাকে এখন আর দেখা যায় না সচারাচর। লাল মিয়ার পোষাকটা ছিল বড় অদ্ভুত প্রকৃতির। হাজারটা তালি-পট্টি। মাথায় সান্তাক্লোজের মতো লম্বা টুপি। মুখে সুর তুলে বলে চলতেন তাঁর পণ্যের গুনকীর্তন। পোশাকের সে কী বাহারি রঙ! লাল-নীল-হলুদ-বেগুনী উজ্জ্বল কত শত রঙ। এই রঙ দিয়ে সঙ সাজা কেন? ছোটদের দৃষ্টি আকর্ষণ! নাকি নিজেই একটা চলমান বিজ্ঞাপন জানা হয়নি কখনো। তবে বড়রাই ভীর জমাতো তার ছোট্ট এন্টারপ্রেনারশীপে; আকাশের দিকে চোঙা তাক করে বাতাসে তরঙ্গ তুলতেন তিনি চুুরররর চা-না-চু-র, গরম গরম চা না চু র। বলে, বলে, সরগরম করে তুলতেন আমাদের মহল্লা।
একদিন দাঁড়িয়ে দেখি লাল মিয়া বেচা বিক্রি বাদ দিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত। যার সাথে ধুন্ধুমার চলছে সে আবার আরেক উদ্যোক্তা; গুঁড়ো মশলার সাপ্লাইয়ার ফরিদ মিয়া। লাল মিয়া যে রকম হাত পা ছুড়ে কথা বলছিল তাতে যে কারো মনে হবে ওখানে বিষয় খুব জটিল আকার ধারণ করেছে। লাল মিয়া যে ফরিদের উপর চটেছে তা দূর থেকেই বোঝা যায়। ফরিদ সম্ভবত লাল মিয়ার চানাচুর তৈরির মশলার সাপ্লাইয়ার। বললো তোমার গত চালানের মশলায় বাসনা নাই- বাসনা মানে ঘ্রাণ। মশলার ঘ্রাণে যদি রকমফের হয় তাহলে স্বাদে হেরফের হবেই। এ নিয়ে দু’জনের তুমুল তর্ক যখন তুঙ্গে- আশপাশের লোকজন জড়ো হতে শুরু করলো। লাল একটা বলে তো ফরিদ পাল্টা আরেকটা। লালের দাবী কাস্টমাররা ক’দিন ধরে তাকে অভিযোগ করছে চানাচুরে কেমন একটা আঁশটে গন্ধ। এই কারণে তার বিক্রি কম। ব্যবসা ক্ষতি হচ্ছে। সমিতির ঋণের টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এর জন্য ফরিদের দেয়া মশলা দায়ী। অভিযোগগুলো বলতেই ফরিদ দাবী করে তার মশলায় কোন সমস্যা নেই। সে দেখেশুনে মশলা কেনে। একেবারে খাঁটি। বলে ঘানির তেলে আবার ঘ্রাণ হয় নাকি। এক ড্রাম তেলে কয়েক ফোটা সেন্ট দিয়ে কৃত্রিম গন্ধ তৈরি করা হয়। খাঁটি জিনিসে সেন্ট মাখে না সে। মশলায় কোন কিছু মেশানোর প্রশ্নই ওঠে না তার বেলায়, এমন অভিযোগ ঈশ্বরও সইবে না। বগুড়ার মরিচ, বরিশালের হলুদ, দেশ-বিদেশ থেকে বেছে বেছে সংগ্রহ করে তবেই মশলা ভাংগায়! এই ভালো মশলার দুর্নাম মানতে সে নারাজ। দু’জনের বাকবিতন্ডায় ঢুকে পরে আরেক জন। সে আবার এক এক সিজনে এক এক কাজ করে বেড়ায়। গরমে তাল পাতার হাত পাখা, গরম শেষ হলে- শীতে ধুন হাতে শিমুল তুলার লেপ তোশক। একেবারে স্বাধীন পেশা। দুজনের মাঝে সে আবির্ভূত হয় রেফারির ভূমিকায়। দুজনকেই থামিয়ে দেয়। শুরু হয় তার বক্তৃতা- শোন, তোদের পণ্যের গুনগান বাদ দে। কাজের কথায় আয়। রাস্তার সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকায়। বলি, তোদের কোন ব্যবসাই থাকবে না তোরা যতই চেষ্টা কর! আমি কিন্তু ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। তার কথা শুনে সবাই এক গাল হাসে। সে আবার শুরু করে, না রে না এ কোন অভিশাপ না আমার হাত পাখা এখন প্লাস্টিক কোম্পানি প্লাস্টিক দিয়ে বানায়। লেপ তোশক বড় বড় কারখানায় তৈয়ার হয়। আমার ব্যবসা চাঙ্গে উঠছে। সামনে কি করে খাবি তাই নিয়ে চিন্তা কর।
সেদিনের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতে কালো কুচকুচে পিচের রাস্তায় লাল আর ফরিদকে দেখা যায়। ওরা দু’জনে দুটো বড় কোম্পানির কাভার্ড ভ্যান টানছে একটায় লেখা গুঁড়ো মশলা আরেকটায় চানাচুর। ঝাঁ চকচকে মোড়কে বাধাঁনো সে সব পণ্য। ওদের মুখগুলো ততটাই ফ্যাকাসে বিবর্ণ…. ওদের এন্টারপ্রেনারশীপ স্বাধীন পেশা উঠে গেছে। এখানে বৃষ্টি নামলে, এমন কি নেশার ঘোড়েও কেউ কবিতা পড়ে না আর- এ পাড়ায়।
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>