| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ ফিচার্ড পোস্ট সাহিত্য

বাম থেকে দক্ষিণে : আবু সয়ীদ আইয়ুব

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

পৌষের পরিচয়ে একটি ইংরেজি পুস্তকের সমালোচনা করতে গিয়ে শ্রীযুক্ত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সম্পূর্ণ অবান্তর ও অহৈতুকভাবে আমার ওপর তিন পৃষ্ঠাব্যাপী ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও রূঢ় বাক্য বর্ষণ করেছেন, তাতে আমি বিস্মিত ও দুঃখিত হয়েছি। তাঁর সঙ্গে আমার মতভেদ আছে, সুতরাং তিনি আমার যুক্তির বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তের খণ্ডন করে নিজ মত প্রতিষ্ঠিত করবেন, এটা সবৈর্ব বাঞ্ছনীয়! বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির এই রাজপথ ত্যাগ করে তিনি ব্যক্তিগত গালিগালাজের পূতিগন্ধময় নর্দমায় ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন কেন? শ্রীযুক্ত নীরেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা এই দিক দিয়ে দৃষ্টান্তস্থল ছিল। দুঃখের বিষয় সে লেখার চারিত্রকে দেবীবাবু অনুকরণযোগ্য বিবেচনা করলেন না।

দেবীবাবু নিজেকে মার্ক্সবাদী বলে থাকেন, আমিও মার্ক্সীয় দর্শনের কাছে অনেকাংশে ঋণী এবং মার্ক্সের আদর্শের সঙ্গে সম্পূর্ণ একান্তঃকরণ। তাঁর, আমার এবং আমাদের মতন আরও অনেকের মতবৈচিত্র্য ও পরস্পর সংশোধনের মধ্য দিয়ে মার্ক্সীয় দর্শনের অফুরন্ত বিকাশ তার ডায়ালেক্টিক্ গতির আরও একটি পথ খুঁজে পাবে—এইটেই তো স্বাভাবিক ও কাম্য। সে গতি কি তিনি রুদ্ধ করে দেবেন কাদার মধ্যে নেমে? বিজ্ঞানকে যে এগিয়ে চলতেই হবে এবং এযাবৎ তার এগিয়ে চলা বহু বিভিন্ন মতের উত্থান-পতন, বিচার-বিশ্লেষণ, খণ্ডন ও সংশোধনের ভেতর দিয়েই সম্ভব হয়েছে। মার্ক্সীয় দর্শন তো শ্রুতি নয়, স্মৃতি নয়, বেদ-বাইবেল-কোরআন নয়, তা একটি বৈজ্ঞানিক প্রস্তাব মাত্র। কেমন করে তা ১৮৪৮ সালের খুঁটিতে চিরকালের মতো বাঁধা থাকবে? তার গতিই যে তার প্রাণ। আদর্শনিষ্ঠা এবং কর্মপন্থার স্থিরতার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক মতবাদের নিত্য-নব বিকাশের কোনো অসামঞ্জস্য নেই, যদি না বিজ্ঞানের নবধারা সে আদর্শকে বাক্যে বা কর্মে প্রত্যাখ্যান করে—যেমন করেছিল পূর্বতন যান্ত্রিক জড়বাদ কিম্বা অধুনাতন সোহংবাদ (সলিপ্সিজম) এবং বৈজ্ঞানিক রহস্যবাদ। একই মূল আদর্শের অনুপ্রাণনায় দর্শন-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের বহুবিচিত্র প্রকাশ সম্ভবপর।

আমি ইতিহাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছি বলে দেবীবাবু যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটা সম্পূর্ণ তাঁর কল্পনাপ্রসূত। যেখানে ইতিহাস মানা না-মানার কোনো প্রশ্ন ছিল না, প্রশ্ন ছিল এই যে সমাজের উন্নতি সম্বন্ধে ইতিহাসের সাক্ষ্য মানতে গেলে আরও কিছু মানতে হয় কি না। এ প্রসঙ্গে আমার লেখা থেকে উদ্ধৃত বাক্যের যে বিকৃত ব্যাখ্যা তিনি করেছেন, তা তাঁর ইচ্ছাকৃত কি অনিচ্ছাকৃত, যা-ই ভাবি, তাঁর প্রতি অসম্মানজনক হয়। সুতরাং সে ভাবনা ত্যাগ করে আমি আরেকবার আরও একটু বিশদ করে আমার বক্তব্যটি নিবেদন করছি। আশা করি এবার তিনি ভুল অর্থ না করেই আমার কথার খণ্ডন করবেন। সাম্যবাদের পেছনে শ্রেয়বোধের কী ধারণা নিহিত আছে, তার অনুসন্ধান করাই আমার সে প্রবন্ধের উদ্দেশ্য ছিল। মার্ক্সের চিন্তা ও শৈলীর ওপর হেগেলের প্রভাব অত্যন্ত বেশি, তাই অনেক সময়ে ধোঁকা লাগে যে তিনিও বুঝি বিশুদ্ধ নৈয়ায়িক বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করেই মেনে নেন যে ইতিহাসে যা পরবর্তী তা অবশ্যতই উন্নততর, অর্থাৎ ‘উন্নততর’ এবং ‘পরবর্তী’র সামান্যাভিধানিক সম্বন্ধটা লজিকের ভাষায় ইমপ্লিকেশন বা এনটেইলমেন্ট-এর সম্বন্ধ। কারণ, হেগেল নেতির নেতিকে পূর্ব প্রস্তাবের উন্নততর অবস্থা বলেছিলেন কেবল ন্যায়শাস্ত্রের জোরে এবং ঐতিহাসিক বিবর্তনকে তিনি পরব্রহ্মের নৈয়ায়িক ক্রমপর্যায়ের ছায়ামাত্র জ্ঞান করতেন। মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু ব্যবহারিক (ইম্পিরিক্যাল), শুদ্ধ ন্যায়-বিলাসী (এ প্রিয়োরি) নয়। কাজে কাজেই সমন্বয় প্রস্তাবকে (সিনথেসিস) পূর্ব প্রস্তাবের চেয়ে সমুন্নত বলার জন্য তাঁকে ইতিহাসের সাক্ষ্য নিতে হবে—হেগেলের পক্ষে যা নিষ্প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে বিচার করে তাঁকে সাব্যস্ত করতে হবে যে ইতিহাসের গতি উন্নতির দিকে, শ্রেয়সের দিকে। আমি ধরে নিচ্ছি যে ইতিহাসের কাছ থেকে তিনি এরূপ সাক্ষ্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের কাছ থেকে এই সাক্ষ্য সংগ্রহ করা তখনই সম্ভব যখন শ্রেয়সের আদর্শ সম্বন্ধে আমাদের মনে একটি সুস্পষ্ট ধারণা মজুদ আছে, নইলে ইতিহাসে আমরা কেবল পরিবর্তনই দেখব, প্রগতি নয়। কী সে ধারণা? সে ধারণা যা-ই হোক, কোনো একটি বিশেষ শ্রেণির বা বিশেষ সমাজের মধ্যে তা পর্যবসিত নয়, কারণ তার সাহায্যে আমরা এক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে আর এক সমাজব্যবস্থার গুণগত তুলনা করতে চাই। তার মানে আমাদের মূল্যবোধ হবে অপেক্ষাকৃত শাশ্বত (সামাজিক পরিবর্তনের দ্রুতগতির তুলনায় স্থায়ী) এবং সর্বমানুষের ওপর প্রযোজ্য। সামারভিল আধুনিক সোভিয়েত দর্শনে এই মতের সমর্থন পেয়েছেন:

‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদীরা অতীতকে পরিণতি ও মূল্যবোধের নিরিখে দেখে থাকেন, যেসব আবার শেষ বিচারে চূড়ান্ত…সোভিয়েত দর্শনে শুধু একটি নীতিই পুরোপুরি সঠিক। আর শ্রেণিবিশ্লেষণের মানে হলো, একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির অবস্থান ও প্রকৃতির কারণে যেসব কাজ করা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে, সেগুলো সর্বোচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ অর্জনে কতটা সহায়ক বা প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে, তার অনুসন্ধান করা।’ (সোভিয়েত দর্শন, পৃ. ৮৯)

শুধু সমবণ্টন শব্দের দ্বারা সাম্যবাদের নৈতিক আদর্শকে সংজ্ঞাবদ্ধ করা যায় না, সেইটে বোঝাতে গিয়ে আমি যে কাল্পনিক উদাহরণ দিয়েছিলাম, দেবীবাবু তার সঙ্গে ভাড়াটিয়া সোভিয়েত-নিন্দুকের কোনো উক্তির সংযোগ ঘটিয়ে এক উদ্ভট নৈয়ায়িক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তাঁর এই নৈয়ায়িক গবেষণাটি সমস্ত সমালোচনার অতীত। এইটুকু শুধু বলে রাখি যে ‘ক’-এর কোনো বাক্যের সঙ্গে ভিন্নমতাবলম্বী ‘খ’-এর সম্পূর্ণ জাতের একটি উক্তিকে একত্র করলে যেকোনো ঐহিক বা পারত্রিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া খুবই সহজ। তবে সে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব ‘ক’-এর স্কন্ধে চাপানোর চেষ্টা একটু কৌতুকপ্রদ, তাতে সিদ্ধান্তকারীর বক্রমানসিকতা ছাড়া আর কিছুই প্রমাণিত হয় না।

সত্য ও চারিত্রের প্রশ্ন তোলাতে দেবীবাবু এত খাপ্পা হয়েছেন কেন? (বলাকার মতো শূন্য মার্গে বিচরণ ভালো নয় স্বীকার করলাম, তাই বলে কি উটপাখির মতো বালির মধ্যে মাথা গুঁজে থাকা ভালো?) এ প্রশ্নের সম্মুখীন হবার সাহস যাঁর নেই, তাঁর পথ সাম্যবাদের পথ নয়, দেহে-মনে সুস্থ-মুক্ত মানব-সাধারণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ নয়। আমাকে তিনি ‘সত্য শিব সুন্দরের পূজারী’ বলে বিদ্রূপ করেছেন। এ বিদ্রূপে আমি সম্মানিত, যদিও সে সম্মানের যোগ্য আমি নই। তিনি স্বয়ং কিসের পূজারী তা অনুমান করে নেবার ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। অনুমানে ভুল হবার কথা নয়। যা কিছু সত্য, শ্রেয় ও সুন্দর তাকে প্রথমে বিদ্রূপ এবং পরে বন্দুক দিয়ে আঘাত করেছিল ফ্যাসিস্টরা! দেবীবাবু তাঁর সাম্প্রতিক লেখাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘বুদ্ধিমূলক বিচার-বিশ্লেষণের দাবি’কে প্রত্যাখ্যান করেছেন (‘বিজ্ঞানবাদ আর বুদ্ধির দাসত্ব’ দ্রষ্টব্য, সাহিত্যপত্র, শ্রাবণ সংখ্যা)। মার্ক্সবাদে আছে থিয়রি ও প্র্যাক্টিসের সমন্বয়, বুদ্ধির উচ্ছেদ নয়, বুদ্ধি-বিবর্জিত কর্মের প্রতি মোহাবিষ্ট উচ্ছ্বাস নয়। এ উচ্ছ্বাসের মন্ত্রদাতা কে? চিৎপ্রকর্ষের বহু সাধনালব্ধ ফসল অতি অল্পসংখ্যক কয়েকজনের পাতে পড়েছে, তাই আমরা দেশের কোটি কোটি নিরন্ন–নিরাশ্রয়–নিরক্ষর জনসাধারণের কাছে লজ্জিত, অপরাধী। বিশুদ্ধ শিল্প-সাহিত্য, দর্শন-বিজ্ঞানের গভীরতম আনন্দ বৃহত্তর শ্রমিক ও কৃষক সমাজের সঙ্গে সমানে উপভোগ করতে চাই বলে আমি সাম্যবাদে বিশ্বাসী। অর্থনেতিক সাম্য ও সুনিয়ন্ত্রণ তার সোপান মাত্র। সংস্কৃতির বিশুদ্ধ প্রকাশ, যাকে ঐহিক অর্থে (স্পিরিচুয়াল ভ্যালুজ) আখ্যা দেওয়া যেতে পারে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাকে কি দেবীবাবু সাম্যবাদ মনে করেন? সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্যবাদ তা নয়, এ দেশেও না, এটা শ্রীযুক্ত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত ব্যাভিচার মাত্র। এ দেশের সাম্যবাদের যথার্থ পরিচয় এ দেশের সাম্যবাদী নেতৃবৃন্দই দেবেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিষয়ে জন সামারভিলের শরণাপন্ন হই:

‘আত্মিক বলতে যদি আমরা সংস্কৃতি, শিক্ষা, শিল্প ও বিজ্ঞান বুঝিয়ে থাকি, তাহলে এটা ধরে নেওয়া গুরুতর ভুল হবে যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নৈতিকতা এর প্রতি নেতিবাচক। বরং এর বিপরীতে বলা যায়, এটা পুরোপুরি পরিষ্কার যে সমাজতন্ত্রের নৈতিকতায় ‘আত্মিক’ ব্যাপারটির স্থান একদম তার মূলে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদীদের দৃষ্টিতে ভালো জীবনের অনুষঙ্গ হচ্ছে উচ্চতর সংস্কৃতি ও শিক্ষা। উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানা বিপুল পরিমাণ বস্তুর সদ্ব্যবহারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা হলো, এসব বস্তুর প্রাপ্তিই হলো সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও নন্দনতাত্ত্বিক জীবনে মানুষের স্বাভাবিক অংশগ্রহণের শর্ত।’ (সোভিয়েত দর্শন, পৃ. ৯৮ ও ৯০)


দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়


তবে কি সোভিয়েত দার্শনিকেরাও শেষ পর্যন্ত ‘শোষক পান্ডাদের তুষ্টিসাধনে’ ব্রতী হলেন, ‘পেশাদার অপপ্রচারকদের দলে ভিড়ে’ গেলেন? দেবীবাবু এঁদের শায়েস্তা করুন, এঁরাই এবং মূলত মার্ক্সই, সত্য শিব সুন্দরের (সায়েন্টিফিক, মোরাল অ্যান্ড অ্যাসথেটিকস ভ্যালুজ–এর) পূজার পুরোহিত, আমি তো রবাহূত পূজারী মাত্র। এঁদের কাছ থেকে আরও একটু শিক্ষা আমি পেয়েছি, সেটা এই যে সত্যশিবসুন্দরের নাম শুনলে যাঁর অদম্য স্পৃহা হয় ‘টু ফিল ফর মাই রিভলবর’, তিনি সাম্যবাদী নন, তিনি প্রচ্ছন্ন ফ্যাসিস্ট। বিশ্বের জ্যামিতি বতূর্ল ধর্মী, তাই যিনি চোখ-কান বন্ধ করে বাঁ দিকে ছুটবেন, তাঁর অব্যর্থ আবির্ভাব দক্ষিণ মার্গে। দেবীবাবু মাসে মাসে তাঁর দক্ষিণ মার্গী পিস্তলের আওয়াজ করতে থাকুন। আমরা, ‘সত্যশিবসুন্দরের পূজারীরা’ তাতে ভয় পাব না, কারণ আমাদের পেছনে শুধু আদর্শের প্রেরণা নয়, সে আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর এক বৃহৎ উদীয়মান সভ্যতার সমর্থনও রয়েছে।

দেবীবাবুর সঙ্গে আমার আরও একটু সামান্য মতভেদের কথা উল্লেখ করে আমার বক্তব্য শেষ করি। গৌড়ীয় দেশে বিশুদ্ধ দার্শনিকের অভাব নেই বলে তিনি আক্ষেপ করেছেন, আর আমি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছি ভেজাল দার্শনিকতায় দেশ ছেয়ে গেছে দেখে। তাতে খাঁটি বিচার-বিশ্লেষণ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যত অভাব ঘটে, সেটাকে ঢেকে রাখার জন্য গালিগালাজ ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ঝালমসলা তত প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে জিনিসটা হয়ে ওঠে উপাদেয় কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত হানিকর। যাঁরা এ দেশের শাস্ত্রশাসিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্থবির চিত্তকে গতিশীল যুক্তিসংবলিত মার্ক্সবাদের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তাঁদের আরও একটু খাটতে হবে, আরও একটু খাঁটি হতে হবে। ফাঁকি দিয়ে নাম ছড়ায়, কাজ এগোয় না।

‘বাম থেকে দক্ষিণে’ নামে আবু সয়ীদ আইয়ুবের অগ্রন্থিত এই নিবন্ধটিতে জন সামারভিলের সোভিয়েত দর্শন-এর থেকে উদ্ধৃত ইংরেজি অংশগুলো বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে এবং বানানের ক্ষেত্রে এই সময়ের বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

সংগ্রহ ও ভূমিকা: ভূঁইয়া ইকবাল

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র-সমালোচক, ভাবুক, লেখক ও দার্শনিক হিসেবে আবু সয়ীদ আইয়ুবের (১৯০৬-৮২) স্থান অতি উচ্চে। তাঁর সঙ্গে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও ভারতীয় দর্শনের আধুনিক ভাষ্যকার দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের (১৯১৮-৯৩) ব্যক্তিগত সম্পর্ক ১৯৪১ সালের আগে থেকে। দেবীপ্রসাদকে লেখা আইয়ুবের একটি চিঠি (১৩ মে ১৯৪১) থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্বন্ধ ছিল। (দ্র. অনুষ্টুপ, শারদীয় ১৯৯৩)।

তবে ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যা পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত আইয়ুবের একটি প্রবন্ধের তীব্র ভাষায় আক্রমণাত্মক সমালোচনা করেন দেবীপ্রসাদ। ১৩৫৫-এর পৌষ সংখ্যা পরিচয়-এ ডাইসন কার্টারের সিন অ্যান্ড সায়েন্স বইয়ের সমালোচনা সূত্রে দেবীপ্রসাদ আইয়ুবের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন:

যে-কোনো জিনিষের সমবণ্টন হলেই কি আমরা আদর্শের দিকে এগোবো? আফিমের গুলি, সিফিলিসের বীজাণু, পকেট-মারের দক্ষতা—এগুলোর সমবণ্টন কি খুব ঘটা করে স্থাপন করবার বিষয়?

অনেক পরে আইয়ুব সাহেব তাঁর উল্লিখিত প্রবন্ধ সম্পর্কে লিখেছেন:

…বাংলাতেও খানতিনেক প্রবন্ধ চল্লিশের দশকে মার্কসবাদী ‘পরিচয়’-এ বেরিয়েছিল।

লেখক স্বীকার করেন যে সেগুলো ‘তাড়াহুড়ো করে লেখা এবং রাজনৈতিক বিবাদ-বিতর্কের সঙ্গে জড়িত।’ ওই রচনাত্রয় সংশোধন ও বিস্তারিত করার ইচ্ছা আইয়ুবের ছিল—১৯৮০ সালে দুর্বল শরীরযুক্ত মনেও পোষণ করেন। (দ্র. ‘ভাষা শেখার তিন পর্ব এবং প্রসঙ্গত’, পথের শেষ কোথায়, দ্বি-স ১৯৮০, পৃ.৮৬)।

দেবীপ্রসাদের ওই সমালোচনার উত্তরে আইয়ুব বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেন:

…একটি ইংরেজি পুস্তকের সমালোচনা করতে গিয়ে শ্রীযুক্ত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অহেতুকভাবে আমার উপর তিন পৃষ্ঠাব্যাপী ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ও রূঢ় বাক্য বর্ষণ করেছেন…।

এই প্রতিবাদ-নিবন্ধের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আইয়ুবের বক্তব্য:

দেবীবাবু নিজেকে মার্ক্সবাদী বলে থাকেন, আমিও মার্ক্সীয় দর্শনের কাছে অনেকাংশে ঋণী এবং মার্ক্সের আদর্শের সঙ্গে সম্পূর্ণ একান্তঃকরণ।

(দ্র. গোপাল হালদার সম্পাদিত–পরিচয়, ‘বাম থেকে দক্ষিণে’, ফাল্গুন ১৩৫৫) আইয়ুবের প্রতিবাদপত্রের প্রতিক্রিয়ায় দেবীপ্রসাদ লেখেন:

…সেই প্রবন্ধে আমার প্রতিপাদ্য ছিল: বিশুদ্ধ যুক্তি তর্ক দিয়ে বিজ্ঞানবাদকে খণ্ডন করা যায় না। তবু, ভাষা ব্যবহারের ত্রুটি নিশ্চয়ই ছিলো। তা না হলে অন্তত একজন পাঠকের পক্ষেও—তাঁর বুদ্ধি যতই ক্রোধাচ্ছন্ন হোক না কেন—এমন বীভৎস কদর্য বের করা সম্ভব হলো কি করে? ভাষা ব্যবহারের এই অসাবধানতা ধরিয়ে দিয়ে শ্রীযুক্ত আইয়ুব অবশ্যই আমার কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

‘লেখকের উত্তরে’ দেবীপ্রসাদবাবু লিখেছেন:

শ্রীযুক্ত আইয়ুব অস্বাভাবিক স্পর্শ-কাতর বলেই বুঝতে পারেন নি যে আমার পুস্তক-সমালোচনায় তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত স্তুতি-নিন্দার উৎসাহ ছিলো না। বিশুদ্ধ দার্শনিকতার অন্তঃসারশূন্যতা এবং অচেতন শ্রেণীস্বার্থ প্রবণতার একটি দৃষ্টান্ত দেখাতে গিয়ে আমি তাঁর একটি উক্তির ব্যঞ্জনাকে বিশ্লেষণ করেছিলাম মাত্র। আমার ভাষা ব্যবহারের অক্ষমতার জন্য যদি সেই বিশ্লেষণ-প্রয়াস তিন পাতাব্যাপী কটূক্তিতে পরিণত হয় তাহলে আমি নিশ্চয়ই লজ্জিত…।

(পাঠকগোষ্ঠী, পরিচয়, ফাল্গুন, ১৩৫৫)

আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬—২১ ডিসেম্বর ১৯৮২), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত