Abu Zafar Obaidullah,ইরাকতী এইদিনে,irabotee.com

মন্ত্রের মতো অমোঘ উচ্চারণের কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

Reading Time: 4 minutes

কুদরত-ই-হুদা

 

শিল্পসাহিত্যচর্চার ঝোঁক কারও কারও জন্য এক অনারোগ্য ব্যাধির মতো। ঘাপটি মেরে থাকে আর ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খায়। নিয়তির মতো, এ থেকে মুক্তি মেলে না। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ক্ষেত্রেও কাব্যচর্চার বিষয়টি অনারোগ্য ব্যাধি বা নিয়তির মতো ছিল। তাঁর কর্মজীবন অন্তত সেই সাক্ষ্য দেয়।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজিতে। ১৯৫৩ সালে এমএ পাস করে ১৯৫৪ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে অধ্যাপনা ছেড়ে যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা করেছেন ‘লেটার পোয়েমস অব ইয়েট্স: দ্য ইনফ্লুয়েন্স অব উপনিষদ’ বিষয়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরবর্তীকালে তিনি ডিপ্লোমা করেন উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে। একসময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। ছিলেন ‘ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন’ (ফাও)-এর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মহাপরিচালক। এ ছাড়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স ও জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের ফেলো ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের সচিব ছিলেন, সে কথা না হয় না–ই বললাম। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কর্মজীবনের এত এত দিকের উল্লেখ করলাম এটা দেখানোর জন্য যে এর মধ্যে কবিতা কোথায়! ওই যে বললাম, শিল্পসাহিত্যচর্চার বিষয়টা কারও কারও মধ্যে অনারোগ্য ব্যাধি বা নিয়তির মতো গেড়ে বসে থাকে! আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ক্ষেত্রে তাই ছিল। কাব্যচর্চা তাঁকে করতে হয়েছে, না করে তিনি পারেননি। এ যে তাঁর নিয়তি। এ কারণেই কি তিনি তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ (২০০২) গ্রন্থে বলেছেন, ‘মাননীয় অন্নদাতা/ আমাকে উঞ্ছবৃত্তি থেকে অব্যাহতি দিন’। কারণ, ‘আমার কিছু কিছু কর্মসূচি অসমাপ্ত/ যেমন কথা ছিল/ মিঠাপুকুরের এক তরুণ কৃষক/ যে ছোট্ট জমিতে ছ-রকমের সবজি ফলায়/ তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায়/ এবং বিরল বন্দরের কয়েকজন ক্ষুদ্র চাষি/ যারা অসময়ে টমেটো চাষ করে/ তাদের ওপরে একটি প্রতিবেদনের’। এই প্রেষণা, নিয়তির এই দীর্ঘ ছায়ার নিচে চলার কারণে ‘উঞ্ছবৃত্তি’র সঙ্গে যুক্ত তাঁর অন্য সব পরিচয় মুছে গিয়েছে। তিনি বাংলাদেশে পরিচিতি পেয়েছেন কবি হিসেবে।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসের তৃতীয় প্রজন্মের কবি। প্রথম প্রজন্মের মধ্যে থাকবেন শাহাদাৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্‌দীন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল প্রমুখ। দ্বিতীয় প্রজন্মে থাকবেন আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, আবদুল গণি হাজারী, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, তালিম হোসেন, সিকান্‌দার আবু জাফর প্রমুখ।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর আগের দুই প্রজন্মের কবিদের অধিকাংশের কবিতায় চল্লিশের দশকে এসে প্রধান হয়ে উঠেছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন-সাধ-তৃপ্তি। এই প্রবণতার কবিতা অধিকাংশ কবির কাব্যগ্রন্থে স্থান না পেলেও সমকালের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তখনকার বাঙালির ভাবজগতের ফেনায় ফেনিল সে সময়ের কবিতা। কিন্তু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহদের প্রজন্মে এসে বাংলাদেশের কবিতায় দেখা দেয় একঝাঁক তরুণ কবি, যাঁরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চাপ মাথায় নিয়ে বেড়ে ওঠেননি। তাঁরা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সাহিত্যের আলো পেয়েছিলেন পূর্ণ মাত্রায়। ফলে বুর্জোয়া চেতনায় তাঁরা ধাতস্থ ছিলেন। উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর ধর্মনিরপেক্ষতার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। সংগত কারণে কলকাতার ত্রিশের দশকের কাব্যরুচিও তাঁদের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল বেশ শক্তভাবে। এই প্রজন্মের শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে হাসান হাফিজুর রহমান পর্যন্ত অধিকাংশের মধ্যে এই প্রবণতা অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আর ১৯৫৪ সালের নির্বাচন তাঁদের সে পথে বেশি দিন থাকতে দেয়নি। এই দুই ঘটনা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নানা হঠকারী তৎপরতা তাঁদের চেতনার চুলের মুঠি ধরে নামিয়ে এনেছে স্বদেশের কোলের মধ্যে। তাঁরা খুব দ্রুতই স্বদেশনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, অনেকে রাজনৈতিক হয়ে উঠেছেন। ফলে তাঁরা নজর দিলেন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে, সাহিত্যিক ঐতিহ্যে, গ্রামীণ প্রকৃতির শোভা-সৌন্দর্যে আর ভাষার উদারীকরণে। এককথায় কবিতায় ধারণ করলেন জাতীয়তাবাদী চেতনাকে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলাদেশের কবিতার এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ কবি।


আরো পড়ুন: স্বাধীনতা নিয়ে বিখ্যাত ছয়টি কবিতা

পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে যাঁদের কাব্যগ্রন্থ খুব আগে প্রকাশিত হয়েছে, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁদের একজন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাতনরী হার প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে।এই কাব্যের কবিতাগুলোতে পাওয়া যায় ওই সময়ের পূর্ব বাংলার একটা খাঁটি কবিমনকে। কবিতাগুলোর ছত্রে ছত্রে বাংলার লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম ঐতিহ্য ছড়ার ছাপ পড়েছে। শুধু আঙ্গিকে নয়, ছড়ার নানা লাইন উচ্চারণের মধ্যেও এই ছাপ লেগে আছে।পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে পাকিস্তানবাদী সাহিত্যের ঘোরতর আলোড়নের মধ্যে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর এই কবিতা নতুন এবং একপ্রকার সাহিত্যতাত্ত্বিক রাজনীতির পরিচয়বাহীই বটে। সাতনরী হার কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর মধ্যে কবির একটা আধুনিক মনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার লোকজীবনের প্রাণভোমরাটিও ইতিউতি উঁকিঝুঁকি দিয়ে উঠেছে। কিন্তু ১৯৫২–এর ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার অন্য অনেক কবি–সাহিত্যিকের মতো আবু জাফর ওবায়দুল্লাহকেও একটা ঝাঁকুনি দেয়। এর স্বাক্ষর আছে হাসান হাফিজুর রহমানের একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৫৩) সংকলনে লেখা তাঁর কবিতার মধ্যে। এই কবিতা তাঁর আগের কবিতা থেকে আলাদা। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর তিন পয়সার জোছনা বইয়ে বলেছেন, ‘সেদিন খাওয়াদাওয়া শেষে জুত করে সিগারেট ধরিয়ে ওবায়দুল্লাহ পকেট থেকে তাঁর সদ্য লেখা কবিতাটা বের করে পড়ে শোনালেন। সেই কবিতা, ‘‘কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা’’—শুনে আমি খুব অবাক হলাম, ওবায়দুল্লাহ এত দিন পর্যন্ত তাঁর সব কবিতাই ছড়ার আঙ্গিকে লিখেছেন, এতেই তাঁর প্রসিদ্ধি, কিন্তু এ কবিতা যে নিপাট গদ্যে লেখা। এই কি তাঁর সেই অভ্যেস থেকে সরণ, যার পরিণামে আমরা বহু বছর পরে দেখে উঠব তাঁরই কলমে এমন অবিস্মরণীয় কবিতা, ‘‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’’, কিংবা ‘‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্যে প্রার্থনা!’’

সাতনরী হার (১৯৫৫) কাব্যগ্রন্থের পর দীর্ঘ বিরতিতে প্রকাশিত হয় প্রায় একই মেজাজে রচিত কখনো রং কখনো সুর (১৯৭০) এবং কমলের চোখ (১৯৭৪)। মাঝখানে কেটে গেছে এক যুগের বেশি সময়। বলা যায়, এটাই বাঙালির সবচেয়ে সংকট আর আত্মপ্রতিষ্ঠার সময়। এ সময়ে কবিতায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর অনুপস্থিতি একটু বিস্ময়কর বৈকি! তবে কি ‘উঞ্ছবৃত্তি’ তাঁকে নিবৃত্ত রেখেছিল ১৯৬২–এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬–এর ছয় দফা, ১৯৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থান আর পাকিস্তানি শোষণ-নির্যাতনকে কবিতায় ধরতে! তাই হবে হয়তো। কারণ, তখন তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা। তাহলে খুব সহজেই প্রশ্ন ওঠে, স্বজাতির দিকে দরদি আর দ্রোহী সত্তা নিয়ে তাকানো ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতার আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ স্বদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন! প্রত্যক্ষভাবে দেখতে গেলে হয়তো তাই-ই। সরকারি চাকুরে হওয়ায় তাঁর লেখালেখি যে বাধাগ্রস্ত হয়, এ কথা তিনি বিভিন্ন কবিতায় বিভিন্ন সময় বলেছেনও। আমার সময় (১৯৮৭) কাব্যের ‘আমি এখন যাবার জন্যে তৈরি’ কবিতায় যেমন বলেছেন, ‘জল যেমন ঢালুর মধ্যে গড়িয়ে পড়ে/ হাওয়া যেমন পাতার মধ্যে কাঁপন তোলে/ আমি তেমন অনায়াসে/ লিখতে পারি না,/ ভাবনা আমার চোখকে ঝাপসা করে দেয়।’ কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে, তিনি যখন চাকরিগত কারণে জাতির দরকারি কবিতাগুলো লেখেননি, তখনো তিনি ভেতরে ভেতরে মস্তিষ্কের অদৃশ্য খাতায় লিখেছেন জাতির মর্মের কথা। আনুষ্ঠানিক লেখা হলো একটু পরে;‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ (১৯৮১) এবং বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা (১৯৮৩)। ষাটের দশকের কবিতা তিনি যেন লিখলেন আশির দশকে। ষাটের দশক থেকে ভেতরে গুমরে গুমরে কাঁদা কবিতাগুলো কি দীর্ঘ অবরুদ্ধতায় আশির দশকে এসে মন্ত্রের মতো হয়ে উঠেছে! শক্তি চট্টোপাধ্যায় ওবায়দুল্লাহর‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ পড়ে অন্তত তাই বলেছিলেন, ‘মন্ত্রের মতো অমোঘ উচ্চারণ। এমন কবিতা বাংলা ভাষায় লেখা সম্ভব আমার জানা ছিল না।’ একটু চেখে নেওয়া যাক মন্ত্রোপম কিছু উচ্চারণ, ‘যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করল/ তখন আমরা প্রাচীন সংগীতের মতো/ ঋজু এবং সংহত হলাম।/ পর্বতশৃঙ্গের মতো/ মহাকাশকে স্পর্শ করলাম/ দিকচক্রবালের মতো/ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;/ এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে সমূলে উৎপাটিত করলাম।/ তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো/ উজ্জ্বল এবং প্রশান্ত হলাম।’ স্বজাতির ইতিহাসকে ধারণ করা এ এক মন্ত্রোপম উচ্চারণই বটে।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ছিলেন ভাষা আন্দোলন প্রজন্মের কবি। এ কারণে তাঁর কবিতায় সব সময় একজন স্পষ্ট বক্তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। এই বক্তা তাঁর উচ্চারণের মধ্যে সব সময় দেশ ও দশসহ ঘোরাফেরা করে। কবিতায় সে কখনো ফুঁসে ওঠে পদ্মার মতো, কখনো মধুভরা ফুলের মতো নম্রতায় টুলটুল করে। এই ফুঁসে ওঠা পদ্মার ক্রোধ যেখানে আছড়ে পড়ে অথবা টুলটুলে ফুল যেখানে ঝরে পড়ে তা কবির স্বদেশ; বাংলাদেশ। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ হচ্ছেন সেই জাতের কবি, যিনি আমৃত্যু স্বদেশের সুগন্ধি বুকে নাক গুঁজে কবিতার শ্বাস নিয়েছেন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>