Categories
‘পরকীয়া’ বাঙালির একেবারে ধাতের জিনিস
আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
আবুল বাশার
ঘর চিকন হয় লেপনে পুছনে,
চাষা চিকন ধানে।
পরপুরুষে নারী চিকন হয়,
নদী চিকন হয় বানে।।
—লোকছড়া।
এই ছড়াটি আমি একটি উপন্যাসে ও একটি ছোটোগল্পে ব্যবহার করেছি। উপন্যাসটি একটি নিম্নবর্ণ নায়কের আত্মকথা, যাতে একটি প্রধান উপাদান পরকীয়া। বলা বাহুল্য, মধ্যবিত্তের পরকীয়া নিয়ে পুবের হাওয়ার চেয়ে দিগন্ত প্রসিদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্যের লু। ফলে জিভে ছাতা পড়ে গিয়েছিল। মধ্যবিত্ত নয়, এমন-একটি জীবনে সন্ধান করছিলাম পরকীয়া।
‘পরকীয়া’ বাঙালির একেবারে ধাতের জিনিস; পাঠক মনে রাখবেন, আমি নিজেও একজন বাঙালি; ‘মুসলমান-লেখক’ বলে-টলে লজ্জা দিবেন না— ধর্মকে সাহিত্যে উপাদান হিসেবে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে পর্যাপ্ত; ধর্ম উপাদান হলেও সাহিত্যটা বাংলা ভাষায় রচিত হয় বলে একজন লেখককে বাঙালি লেখক বলা হয়। তার ধর্ম, মানে আচরিত/অনাচরিত ধর্ম যাই কেন হোক।
আমার এক সাহিত্য ও শিল্প-আলোচক অগ্রজ বন্ধু ছিলেন, সন্দীপ সরকার, তাঁকে বলা হত কলা-সমালোচক, প্রাণের বন্ধু ছিলেন তিনি; আমার সবচেয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাপ্রবণ উপন্যাস ‘মরুস্বর্গ’ আমি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলাম; ওই উপন্যাস গড়ে তুলতে অনেক খ্রিস্ট মিথ (বাইবেল থেকে নেওয়া মিথ ও বাইবেল-ভিত্তিক ইতিহাস আমাকে চর্চা করতে হয়েছিল, এ ব্যাপারে সন্দীপদা আমাকে আন্তরিক সহযোগিতা করেছিলেন) ব্যবহার করতে হয়; সন্দীপদা ছিলেন খ্রিস্টান বাঙালি। ‘মরুস্বর্গ’-এ খ্রিস্ট ও ইসলামিক মিথের বিচিত্র সম্মেলন ঘটেছে, ‘মরুস্বর্গ’-ই সম্ভবত প্রথম বাংলা উপন্যাস, যেখানে ঐস্লামিক লোককথা এবং হাদিস ও বাইবেল অপূর্ব কায়দায় মেশানো হয়েছে। আমার সাহিত্যে কৃষি পরণকথা, কৃষ্ণকথা, খ্রিস্টকথা, ইহুদি মিথ, ওল্ড টেস্টামেন্ট, কোরান ও হাদিস মিশে গিয়েছে। কিন্তু সব মিশিয়ে দেওয়ার পর আমি হয়ে উঠেছি প্রকৃত বাঙালি। আমি দৌলত কাজীর একজন খাঁটি উত্তর-সাধক। ‘লোর-চন্দ্রাণী ও ময়নামতী’ তো দৌলতের পরকীয়া প্রেমের ধর্মনিরপেক্ষ কাব্য। তাঁর কাব্যের পাত্রপাত্রী হিন্দু। দৌলত কিন্তু বড়ো মাপের পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, তাঁকে কাব্য সৃষ্টি করতে গিয়ে দেবতার খোলস পরানো মানব-মানবীকে উপস্থাপন করতে হয়নি— তিনি ছিলেন মধ্যযুগের একজন বলিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান— সে যুগে বাংলার মুসলমান এত কাঙাল হয়ে পড়েনি। মুসলমানের জীবনে বিভীষিকাপূর্ণ দারিদ্র দেখা দেয়নি। দৌলত ছিলেন অগ্রসর চেতনার একজন খাঁটি বাঙালি।
সাহিত্যের পণ্ডিত ও মাস্টারমশাইরা দৌলতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবধর্মের শক্তি পুরোটা বোধ হয় আজও আন্দাজ করতে পারেননি। মনে রাখতে হবে, ইসলাম ধর্মে আর যাই থাক, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা নেই— কোরানে নক্ষত্রপূজক গোষ্ঠীর মানুষকেও স্বর্গে প্রবেশকারী জনগোষ্ঠীর মানুষ হিসেবে সম্মান জানানো হয়েছে। একজন মোল্লা গোঁড়া হন; সাম্প্রদায়িক হন না। কথা হচ্ছে, বাঙালি হিসেবে আমি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের প্রেমধর্মের উপাসক; কারণ ইসলামের সুফিবাদে, যা কোরান থেকে উৎসারিত, তা খোদা ও মানুষের অভিন্ন প্রেমতত্ত্ব।
আমার মধ্যে বৈষ্ণব উপাদান ফল্গু হয়ে বইছে— বাঙালি বলেই পরকীয়াকে ঘৃণা করতে শিখিনি। কিন্তু আমার খোঁজটা ছিল লোকস্তরে পরকীয়ার অঙ্গরাগ কী মাধুর্য রচে দেয় সংসারে! পরকীয়াবাদ বৈষ্ণবের গূঢ় তত্ত্ব— এই তত্ত্বই আধ্যাত্মিক কষের প্রলেপ দিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লৌকিক জাগতিক প্রেমকে অযথা জটিল করেছে। ফের তত্ত্ব বাদ দিলে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নদীয়ায় প্রেমের বান ডাকাতেন কী করে? কেউ যদি প্রশ্ন করেন, রসের ব্যাপারে সবচেয়ে দুর্বোধ্য ও জটিল তত্ত্বটি কী বল তো। বলব, নিমাইয়ের একই অঙ্গে রাধাকৃষ্ণের অঙ্গরাগ ও আকুতি।
পরকীয়াবাদের পথ ধরেই সাহিত্য আধুনিক হয়েছে। উপন্যাস হয়েছে জটিল শিল্পরীতির সামগ্রী; আধুনিক উপন্যাসের জনক বলা যায় যে-উপন্যাসটিকে, সেটি হল গুসতাভ ফ্লোবেয়ারের ‘মাদাম বোভারি’। এই বাংলায় ফ্লোবেয়ার-চর্চা করেছেন ইংরেজি-ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপিকা, এক সময়ের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এবং ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য-বিশেষজ্ঞ সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়— তাঁর হাত থেকেই ২০০০ সালে ‘মাদাম বোভারি’ বাংলা-অনুবাদ উপহার পেয়েছিলাম— তখন আমি ‘দেশ’ পত্রিকা দপ্তরে চাকরি করি— নতুন বই বেরোলে, ভালো বই হলে যে ভাবেই হোক আমার হাতে চলে আসত— ‘দেশ’ পত্রিকায় চাকরি করার এই এক বিশেষ সুবিধা ছিল। আমি সুরভির বাংলা গদ্যের অনুরাগী। আমি দু’ভাবে মাদাম বোভারি পড়েছি— ইংরেজি অনুবাদে আর ফরাসি থেকে সরাসরি করা সুরভির অনবদ্য বাংলা অনুবাদে।
অনূদিত বইটির একটি সুলিখিত ভূমিকা দিয়েছেন সুরভি। সেখানে একটি চমৎকার তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যটি হল, একটি লব্জো। বোভারিজম। এই বোভারিজমের কবলে পড়েই উপন্যাসের নায়িকা এমা, যে-কি না বিয়ের পর হয়ে উঠবে মাদাম বোভারি, সে আত্মহত্যা করে— এ এক অতৃপ্তি ও বিষাদের অসুখ— অস্থিরতার অসুখ। পরকীয়াতেও সুখ পায়নি এমা রুয়ো— বিয়েতে নয়, পরকীয়াতেও নয়। মনের এই সংকট-জর্জর নৈরাশ্যই বোভারিজম। বোভারি থেকে বোভারিজম— এই শব্দটি সব পাশ্চাত্য সাহিত্যেই সঞ্চালিত হয়েছে।
সুরভি জানিয়েছেন, ‘১৮৫১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এক সন্ধ্যায় ফ্লোবেয়ার ‘মাদাম বোভারি’ উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। ১৮৫৬ সালের মে মাসের শেষ দিনটিতে তিনি তাঁর বন্ধু ম্যাকসিম দ্য ক্যাঁ-এর কাছে চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপিটি পাঠান। ‘রভু দ্য পারি’-তে ছাপার জন্য। টানা পাঁচ বছর লেগেছিল উপন্যাসটি শেষ করতে।’ পাঁচ বছর কেন? কারণটা এ রকম— ‘ফ্লোবেয়ার উপন্যাসটি লিখেছিলেন ক্রোয়াসে-তে। একান্ত নির্জনতায়। সারা দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে আয়াসসাধ্য লিখনকর্ম, খসড়া, কখনও ‘চারদিনে পাঁচটি পাতা’ (১৬ জানুয়ারি, ১৮৫২, কোলে-কে লেখা চিঠি), কখনও বা সারা সপ্তাহে ‘মোটে পাঁচটি পাতা’ (২৬ জুন, ১৮৫২, কোলে-কে), আবার কখনও বা ‘সপ্তাহে একটি পাতা’ (৩ জুলাই, ১৮৫২, কোলে-কে), আবার এই পাতাগুলোও চূড়ান্ত রচনা নয়।’
যদিও বাংলা লেখককে কম লিখতে বললে, অসম্ভব রেগে যায়। দুঃখ এই যে, পেটের দায়ে আমাকে বেশি লিখতে হয়। বহু-প্রজতা সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো গুনাহ্। যা হোক। কোলে নাম্নী মহিলাটি কে, এ কথা জানিয়ে আমরা সাহিত্য প্রসঙ্গ ছেড়ে, ‘বোভারিজম’ তাক-এ সরিয়ে রেখে লৌকিক জীবনে প্রবেশ করব।
সুরভি জানিয়েছেন, ‘বইটি (মাদাম বোভারি) লেখার সময় ফ্লোবেয়ার-এর সৃষ্টি-যন্ত্রণার শরিক ছিলেন দু’জন। প্রথম জন তাঁর রুয়োঁ স্কুলের বন্ধ লুই বুইহে, তাঁকে তিনি প্রতি রবিবার নিজের লেখা পড়ে শোনাতেন। দ্বিতীয়জন ছিলেন লুই কোলে— ফ্লোবেয়ারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এবং রক্ষিতা (যিনি নিজেই একজন লেখক ও কবি ছিলেন) কোলে-কে ফ্লোবেয়ার ১৮৫১ সাল থেকে ১৮০টি অনবদ্য চিঠি লেখেন। এই চিঠিগুলি তাঁর সৃষ্টির কষ্টকর প্রক্রিয়ার জীবন্ত অভিলেখ। তাঁদের দু’জনের সম্পর্কের ছন্দে অনেকটাই এই উপন্যাস লেখা হয়েছিল।’
এই সম্পর্কও তো পরকীয়ার মতোই বিশেষ অবৈধ। বন্ধু-রক্ষিতা তো আর স্বকীয়া নয়। পৃথিবীর মহত্তম উপন্যাসটি জন্ম নিচ্ছে এমনই পরকীয়া ছন্দে। যে-উপন্যাস প্রভাবিত করেছিল কাফকা-প্রুস্ত-জেমস জয়েসকে। ঘরে-বাইরে উপন্যাসের নায়িকা বিমলার অতৃপ্তি এমার অতৃপ্তির তুলনায় কম জটিল নাকি বেশি— সে আলোচনা তাকেই আপাতত তোলা রইল। বোভারিজম কেন বিমলার নেই, সেই আলোচনাও থাক।
বোভারিজম যাকে মোটে স্পর্শ করেনি এমনই চিকন নারীর নাম নুকতা খাতুন। জুবের মণ্ডলের বউ। জুবেরের বন্ধু সাদ সরকার। সাদের বিয়েতি বউ মহুয়া। কিন্তু জুবের আর সাদের মাঝখানে রয়েছে নুকতা।
জুবেরের ব্যবসা বিড়ির। সাদ গরিব অবস্থার চাষি। তা ছাড়া রবি-খন্দের খুব ছোটো ব্যবসাও আছে। জুবের বিড়ি বাঁধে। কিন্তু দু’জনই বেশি কিছু লেখাপড়া জানে না। জুবের ক্লাস থ্রি পর্যন্ত উঠেছিল। প্রাইমারি টপকাতে পারেনি। সাদ সিক্স পর্যন্ত এবং হঠাৎ স্কুল ছুট হয়ে লাঙল ঠেলতে শুরু করে। দু’জনেরই বাল্যে বিয়ে হয়ে যায়। যখন ওরা সাবালক হল তখন ওদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হল। পত্নী প্রেমের চেয়ে বন্ধুত্ব বড়ো হয়ে দেখা দিল। সাদের দু’টি ছেলেমেয়ে হল। ওরা বড়ো হতে লাগল। কিন্তু নুকতার কোনও বাচ্চা হল না দীর্ঘকাল। অবশ্য তা নিয়ে হা-হুতোশ শোনা গেল না জুবের-নুকতার গলায়। সাদ বলত, ‘খুদা চাইলে হবে, ভেব না দোস্ত।’
ওরা বিকেল গড়ালে জুবেরের বাড়ির বাইরের ছোটো বৈঠকখানায় তিনজনে বসত গল্প করতে। নুকতা চান করে, গন্ধ মেখে, টিপ পরে, পান খেয়ে তৈরি থাকত; মাঝখানে নুকতা; তার দু’পাশে দুই পুরুষ। নুকতা বড্ডা হাসতে পারত। হাসতে হাসতে কখন স্বামীর দিকে আর কখন-যে স্বামীর বন্ধুর দিকে ঢলে পড়ত তার কোনও ঠিক ছিল না। জুবেরের বাড়ি ছিল গ্রামের প্রান্তিক। লোকে দেখত, পরকীয়াই চলছে বটে, কিন্তু জুবেরের কোনও অসন্তোষ, অবিশ্বাস, অভিযোগই নেই। ওরা দুই বন্ধুই নুকতাকে ভালোবাসত। নুকতার সৌন্দর্য ঢলঢল করত। নুকতার চেয়ে সুখী কেউ সংসারে ছিল না। শেষে নুকতার একটি মেয়ে হল। বুলবুলি। ওর মায়ের চেহারা পেল মেয়েটি। লোকে জানল বুলবুলি সাদের ঔরস। কিন্তু বুলবুলি মায়ের আড়া পেয়েছে বলে লোকে প্রমাণ করতে পারল না বাচ্চার বাপ আসলে কে। ওরা তাই ভেবে, দুই বন্ধু আর নুকতা হাসিতে বেতসের মতো দুলে দুলে পড়তে থাকল এ ওর গায়ে— একবার স্বামীতে, আর একবার স্বামীর বন্ধুতে ঢলতে থাকল বউ।
