এক
চিনিবাসের নাতি সুধান গুঁড়ি নৌকায় বসে অসরের নমাজ পড়ছে। ‘অসর’ বৈকালিক নমাজ। নমাজে এত ভক্তি সচরাচর নিকিরি সমাজে দেখা যায় না। সুধান ভক্তিমান, দাদা-নানার মতো আউলা-বাউলা নয়। দাদা-হুজুর ছিলেন বারুই-ওঝা, সুন্দরবনের চাকলায়। ওঝা চিনিবাস বারুই। বারুই হল পানচাষি, বরজের ডিহিদার এবং চিনিবাসই ছিলেন বিষহরির গায়েন ওঝা। অবশ্য মায়ের তরফে ধরলে নানা-হুজুর ছিলেন হেকিম ধানীলাল বৈদ্য, তেনার তো জড়িবুটি-তাবিজ-কবজের ব্যবসা। আর বাপ মধুবাস হয়েছিলেন ফটাস জলের ব্যাপারি।
শোনা যায় সুন্দরবনের ব-দ্বীপ ডোবে এবং ভেসে ওঠে মানুষের জীবিকার মতো। তলিয়ে ভেসে উঠলে দ্বীপকে চেনা যায় না, মানুষকেও না। তবে বাঘের থাবা খেলে বয়ান আরও দুস্তর বদলে যায়— মধুবাসের বেলায় যেমন হয়েছিল। সেই মুখমণ্ডলটাই আর রইল না।
মধুখালির মধুবাস— কী তেঁতো নাম! বাঘের থাবায় মুখ হল কদাকার-কুৎসিত। লজ্জায় আর যন্ত্রণায় ব্যাপক মানপাতায় মুখ ঢেকে পড়ে রইলেন মধু বারুই কাঁঠাল গাছের তলে। ফলত, যে-বরজে বাঘিনী পড়ে জীবন ছারখার হল, সেই বরজ গেল শুকিয়ে। এখন উপায়?
মানুষের চেহারা হল খোদার কারিগরি। সেই চেহারায় হাত পড়ল সোঁদরি বাঘের, ভেস্তে গেল রূপবানের রূপ। শত জনমের কান্নাতেও আর সেই রূপ ফিরবে না। এখন চাই কোনও মতে সহনীয় একটা মুখ। মানপাতার আড়ালে সেই মুখ গড়লেন কয়রা চোখের এক সুলেমানি বৈদ্য, বাবা গফুর।
গফুরের হিফাজত পেয়ে মধুবাস ফটাস জলের হকারি করতে ধামুয়া স্টেশনে নেমে বুঝতে পারলেন, খদ্দের তাঁর হাতের বোতল নিতে ঘৃণা করছে। বাচ্চারা ভয় পাচ্ছে। ভদ্রলোকেরা সরে যাচ্ছে। একটা বাচ্চা তো ভয়ে চিৎকার করে উঠল, তখন বাচ্চার মা ভয় আর কান্না জুড়াতে কচির মুখে দুধভরা স্তন গুঁজে দিয়ে পিঠে চাপড় দিতে লাগল। মুশকিল-আসান ফকিরটা পর্যন্ত কেমন দোনামনা করে তবেই হাত বাড়াল পচা কোম্পানির ফটাসে। পঞ্চানন ওরফে পচার জলই ফটাস।
সুধানের বাবা মধুবাস বারুই আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। কোথায় মুখ লুকোবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কী ভাবে জল বেচবেন মাতলা নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে জোয়ারের ফোঁসানি দেখতে দেখতে ভেবেছিলেন। তার পর ফটাস ছেড়ে জোয়ারি নদীর নৌকায় বৈঠা-হালের মাঝিগিরির অ্যাসিস্টান্ট হলেন। মাতলায় মাঝির ব্যবসায় সহকারিতা করে ক’পয়সা উপার্জন? ছাড়তে হল বৈঠা। তা ছাড়া ওই পারাপারের বেলাতেও মধুর মুখ দেখে প্যাসেঞ্জারের মুখ বেজার হত।
মধু ক্যানিং বাজার থেকে মগরাহাট পর্যন্ত ফটাস কাঁধে ঘুরেছেন। মীনের ব্যবসা ধরবেন ভেবেও সাহস পাননি। দু’মাস রামচন্দ্রপুর থেকে দিশি ডিম এনে সোনারপুরের স্টেশনে ঝুড়ি নিয়ে বসতেন। ডাক্তারের এক ওয়াইফ ডিমের দিকে হাত বাড়িয়েই আঁতকে উঠে সরে গিয়ে বললেন, ওহ্ গড! একে বোধহয় বাঘে খেয়েছে। এর কাছে জিনিস নেব কী করে! হরিব্ল ভাই কনীনিকা, লেটস গো।
মধু নানান চেষ্টা করেছেন। ঘুটিয়ারি শরিফের হাতায় দু’তিন হপ্তা এক রূপাজীবার দালালি পর্যন্ত করেন, সব চেয়ে ছোট সাইজের গণিকা ছিল সেটি। তার সঙ্গে সাঁটে থাকবেন ভেবেও দেখলেন, ওই বেচারির টিবি। ওই বাজারে পানিফল বেচতে গিয়েও নিরাশ হন মধুবাস বারুই। তার পর তাঁর মাথাটা আর চলতে চাইল না। কী যে হল, এক দিন ক্যানিং-এর বাজারে এসে লাল মহম্মদ ক্লথ হাউস-এ মধুবাস নিজের জন্য কাফন চাইলেন।
লাল মিঞা বললেন, কাফনের থান খতম হইছে মধু, নতুন করি কাড়ি, তার পর এসবে। জিন্দা থান থেকি তো আর মুর্দার লেবাস দিতি পারি না।
নৌকা ভাসছে পদ্মায়। এক দফা ছাঁটবৃষ্টি হয়ে গেছে, তার পর মেঘ সরে গিয়ে টলটলে সাফা আসমানে আলপনা দিয়েছে রামধনু। পদ্মার উপর একটা যেন ঝুলন্ত সেতু দিয়েছেন খোদা। নদী এখন ওই রামধনুর মাঝ বরাবর ঢুকে গিয়ে দিগন্তে দফা হয়ে গিয়েছে। নৌকা চলেছে পশ্চিম বাগে, সিজদা দিলে সিধে নৌকোটা গলুইসুদ্ধ কাবা ঘরে সেঁধিয়ে পড়বে যেন বা। নৌকোর তাই পুব-পশ্চিম তাক রাখা জরুরি। পবন গুঁড়ি সাবধানে হাল ধরে বসে। পদ্মার গতি এখানে পশ্চিমমুখো। অবশ্য নদীর বুকে কাবা-শরিফের কল্পনা সুধানই প্রথম ওই রামধনুর রঙের উত্তেজনায় মাথা খাটিয়ে করতে পেরেছে।
মধুবাস কল্পনা করতেন অন্য রকম। সাদা মোলায়েম থানপরা এক বিধবাকে দেখতেন হামেশা মনের মধ্যে। বাঘের থাবা খেয়ে ওই রকম হল। ফটাস হল না, পানিফল হল না, রাজরোগে শীর্ণা ছুটকি পতিতার দালালি পোষাল না, বৈঠা মেরে উদর ভরল না। গুনেহ্গার হলেন মধুবাস। তার পরই ওঁকে মনোগত বিধবা-মূর্তি তাড়া করে ফিরতে লাগল। মগরার বদি মওলানা বললেন, বনবিবি খোয়াব দিতিছেন মধু, গোসাবার বেধবাপল্লিতে যেওনি, বদহাওয়া তোমারে খেইছে বাবা।
—ক্যান খেইছে হুজুর মওলানা?
—বাঘে খেলি পর মান্ষের বিকার হতি পারে। দক্ষিণরায় চোট দিলে সোয়ামি নষ্ট হয় বাবা। নারীলোক বেধবা হয়। পাড়াময় বেধবা, দেইখে দেইখে বিকারে পইড়ে ধন্দ নাগে বাবা। কী কইরবা, দেশত্যাগী হও। মধু আর বাঘের দ্বীপ ছেড়ি পদ্মার ডাঙালে ভড় ইলাকায় বসত দাও। বন্দোবস্ত আছে। ছিলে বৈদ্য-বারুই, হইবা গুঁড়ি।
—জি।
—তবে হ্যাঁ, তোমার পদবি হইবে মক্তবি। আজ থেকি তোমারে জামাতে সামিল কইরে হারুডাঙায় ভেজতিছি। চরের মক্তবে খাদেম হলে মান পাইবা, হামেশা সাথে একখানি কাফন রাখবা মধুবাস। কাফন রাখলে খুদা গুনাহ্ মকুব দিবেন। ভেবি দেখ, পদ্মার গুঁড়া মাছে জীবিকা আছে, মন্দ কী?মধুবাস ভেবেচিন্তে বললেন, ভাল।
এক জন মানুষ কাফনের লেফাফা আর ইজের সর্ব ক্ষণ সঙ্গে রেখেছেন, এ ভারী আশ্চর্যের কথা। হারুডাঙার মক্তবে এমনই এক বান্দাকে জুটিয়ে দিয়ে জামাতে গেলেন বদি মওলানা। কিন্তু দোখনো এই বান্দাটি নমাজটাও জুত করে পড়তে পারেন না। কেবল ‘আল্লাহক’ বলে সিজদা দেন। জিভ অদ্ভুত আড়ষ্ট, স্মৃতিক্ষমতা নিতান্ত দুর্বল।
মধুবাস তাই হয়ে গেলেন কদর্য চেহারার এক জন মক্তবি ঝাড়ুদার খাদেম। শুধুমাত্র ‘আল্লাহক’ তাঁর পুঁজি। ফজর অর্থাৎ ভোর এবং মগরিব অর্থাৎ সন্ধ্যা, মক্তবে ঝাড়ু দিতেন মধু। মাছের গন্ধ তাড়াতে সানলাইট সাবান মাখতেন গায়ে— ফজর-চান দিতেন। কিন্তু কী কারণে চর-বসতের সেই মক্তব উঠে গেল। তখন মধুবাস শেখপাড়ায় এক মসজিদে এসে হিল্লে নিলেন। সঙ্গে কাফন।
বদি মওলানা বলেছিলেন, দক্ষিণরায় বেশুমার থাবা দিইছে তো, তাই ওই রকম বেহুদা বুদ্দি, জ্ঞান নাই। ভাবতিছে গুনাহ্ হইল, ক্যাফন রাখো সঙ্গে, গোরে দিবা অঙ্গে।
মধুবাস আমল তত পারতেন না, কিন্তু ইমান ছিল মজবুত। কদাকার মুখে খোদার নূর এসে পদ্মার ঢেউ মাফিক ‘উছল’ হয়ে পড়ত। যদিও কাফন এক প্রবল মৃত্যুবোধ ছাড়া কিছু নয়— মধু মনের ভিতরে দেখতেন গোসাবার থানপরা এক বিধবা-মূর্তি কিছুতেই নড়ছে না— বরজে লাফ দিয়ে পড়ছে মানুষের রক্তখেকো বাঘিনী। খোদার উদ্দেশে দু’হাত তুলে ভয়ার্ত স্বরে মধু বিড়বিড় করতেন পদ্মার জলে নৌকায় ভাসতে ভাসতে, আমারে সুন্দর করো দয়াময়।
পদ্মাজলের একটি গুঁড়ো মাছ মধুকে জলে লাফ দিয়ে উজ্জ্বল কিরণ ছড়িয়ে বলেছিল, তুমি এখনও সুন্দর মধুবাস, জেকের কর আল্লাহক। জেকের মানে নামজপ।
আজ চরপার থেকে নৌকায় এসে উঁচা গলুইতে আসন নিলেন ফরিস্তা মাফিক এক জন জ্ঞানী মানুষ। নৌকা তৈয়েরির তাবত খচ্চা এঁনারই দান। মধুবাসের আর্ধেক জিন্দেগি এই মির সাহেবের জেবে বন্দক পড়ে। এঁকে দেখলেই বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে। মানুষটার গুমোর কখনও বুঝে পায়নি সুধান। ইনি তো সুদি মহাজন না, নাও দিয়েছেন গুঁড়িকে, খচ্চা শোধ নেন নাই। খুচরা-গুঁড়া মাছ দিলে বেগুন-পুড়পুড়ি করে খান।
মিরের গলায় মিঠে রহস্য জড়ানো। বললেন, বাপের ধারাই পেয়েছ সুধান। পানির উপরেই নমাজ কর। পানি-কাবায় সিজদা। তা, ইমানটাই তো আসল। ইমানে মিলায় বস্তু আমলে বহু দূর। কত দূর জানো? জানো না। সুন্দরবনের মধুখালি থেকে মুর্শিদাবাদের মধুরকূল। বদি মওলানা মধুবাসকে এই চরে এনে ফেললে আমল করাতে, মোমেন বানাতে, মক্তবি খাদেম করবে ভেবে। কিন্তু ওই নিকিরির ‘আল্লাহক’ ছাড়া কিছুই যে জুবানে আসত না হে সুধান।
—জি মির বাবা।
—তো, কী করবে বেচারা! বৈদ্য-বারুই কাফন সম্বল করে এই নৌকা নিয়ে পদ্মায় ভেসে পড়ল কিনা! মধু অবিশ্যি সাঁতার জানত অল্প। জলকে ভয় পেত বাঘের মতো। বলত, এই পানিমহলে না, মুই ডাঙালে মরতি চাই বাবাজীবন। করতাম মাস্টারি, ধর্মে কিঞ্চিৎ ব্যগ্রতা ছিল। তাই এই একটি নৌকার ব্যবস্থা হল। পানিতে জালের খেপ মেরে কোমর হেলায়ে মধু জানতে চাইলে, পানির সিজদা কাবায় কী পড়ে বাবা? আতরের তুলা কানে গুঁজলে গুঁড়ির গায়ের গন্ধ কি যায় বাবা? শুনিছি, কপালে সিজদার ধুলোট দাগ পড়লি পর মাইনষে রে সুরতদার নাগে। খোদা করলে রূপ কি ফিরে মিরজাদা? ফিরে না? কী কষ্টের কথা!
—জি। অধোমুখে হাল টানে সুধান।
মির বললেন, এই নৌকায় মধুবাস কাফন কোলে বসে থাকত ওই ও পারে তাকায়ে, দেশত্যাগী মানুষ। এক দিন খেপ দিতে দিতে ঝুপ করে পানিতে পড়ে গেল, ব্যস। নৌকার খোলে রয়ে গেল কাফন। ডাঙায় কবর নসিবের ব্যাপার। হল না। লোকে বলল, কাফন বুকে নিয়া নাও ভাসছে মির সাহেব। কী করবেন?
—কী করলেন?
—কী আর করব?
নৌকার মহাজন আমি। বললাম, নাও পাকড়াও। লোকে বললে, কাফনের কী হবে! ভেবেচিন্তে বলতে হল, বদি মওলানাকে ডাকা হোক। বদি এল, এসে বললে, আপনিই রাখেন কাফনখানা, কাফন কি ফেলা যায় মাস্টার সাহেব? বললাম, তুমি এমন কেন করলে বদি মিঞা? তুমি না মওলানা! বদি গলা খাটো করে অদ্ভুত এক বেত্তান্ত শোনালে বাবা। বললে, হুজুর-আল্লা জানেন, মধুবাসের মা বিনি শাদির বেধবা ছিলেন মির সাহেব। চিনিবাসের বরজের ঠিকে-মুনিষ তওবা মিদ্যা শাদির লোভ দেখায়ে শফিতনরে ফুসলায়ে গর্ভ বাধালে, তার পর জঙ্গলে গেল মধু ভাঙতে বরজের কলসি নিয়ি। তওবা মিদ্যার জান দক্ষিণরায়ে কবলালে বাপজি। তখন চিনিবাস দুঃখে গলা কেতরে বইল্লে, এই বেওয়া শফিতনকে বেধবা-পাড়ায় আমার নামে রাইখ্যা দেও। আসলে চিনিবাস মধুবাসের কেউ না জনাব। শফিতন তখন বিয়োনো বাচ্চা নিয়ি হরিতন আর রুহিতনের চারচালি বেধবা-মোকামে রইলেন। মধু সেয়ানা হলি পর চিনিবাসের বরজে কাম নিয়ি বারুই হইল। সুতরাং মধু গুনাহের পয়দেশ, একটি জারজ। বাঘে ভয়ংকর চোট দিলি পর বে-নমাজি মধুবাস আমার কাছে আসে মাস্টারজি, আধবোজা আঁশু গলায় নিয়ি কয়, আমাগে মিদ্যার বাঘে নষ্ট কইরেছে, মওলানা সাহেব। আমাগেরে বাঁচনের কি কুনো ‘মছলা’ নাই বাপ? কয়ি দিলাম, আছে। বন্দোবস্ত আছে।
শুনতে শুনতে বাইশি যুবক সুধানের দু’গাল বেয়ে নিঃশব্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল পদ্মার পানিতে। পদ্মার লা-মোকামে সিজদা দেওয়ায় এই অপরাহ্নে লা-লা-আল্লা-আল্লা করছে জল। সে তা হলে কে?
দুই
মির ফিরলেন চর রাজাপুর থেকে। ইসমাইল লুঙ্গি আর সাদা কলিদার আর কাঁধে সুদৃশ্য কাপড়ের থলে। চৈত্রপদ্মার বুকে চর জেগেছে। ওই চর থেকে এ দিকের ডাঙালে ছইনৌকা ভেড়াল সুধান। মির নেমে গেলেন। হঠাৎ সুধানের খেয়াল হল, মির তাঁর থলেটা ছইয়ের পাটায় রেখে ভুল করে নেমে গেছেন। কিন্তু থলেয় কী আছে? এক চিরুনি আর গোল আয়না এবং একটি ডায়েরি। সঙ্গে সাদা থানে জড়ানো পকেট-কোরান-শরিফ। কী আশ্চর্য! এই সেই কাফন নিশ্চয়।
মনে হল, মির ইচ্ছে করেই ফেলে গেছেন। ডায়েরিতে কী লিখেছেন মহাজন? থান-আয়না-কাফন-চিরুনি রেখে ডায়েরি খোলে সুধান। লিখেছেন, এই কাফনের লিফাফা আমার নয়। যা আমার নয়, কেন তাকে বয়ে বেড়াচ্ছি হে মালিক-উল-মৌৎ? আমি এখন বুদ্ধিমান পশুর ন্যায় মৃত্যুকে দেখতে পাই। হাতি তো বটেই, বাঘও নিশ্চয়, এমনকী ক্ষুদ্র বিড়ালও নিজের মৃত্যুকে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করে। তাই তারা মৃত্যুর আগে আগে মরণের জায়গা বেছে রাখে এবং মৌতের প্রতীক্ষা করে এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর সঙ্গে ছায়ার মতো জড়িয়ে যায়। প্রাচীন মানব মৃত্যু দেখতে পেতেন, আমরা পাই না। কারণ আমরা পাপ করি। হজরত ঈশা নিজের মৃত্যুর ক্রুশ নিজে বহন করেন। হজরত ইসমাইল হজরত ইব্রাহিমকে বলেন, হে পিতা! চোখে পটি বেঁধে আমাকে উৎসর্গের জন্য হত্যা করুন, তা হলে আপনার কষ্ট কম হবে। কিন্তু আমার কষ্ট কোথাও কম হল না।
মধুবাস মুখে কাঁধে গামছা জড়িয়ে গুঁড়ি মাছ ধরত। লজ্জা আর শরমে। তার স্ত্রী জাহিরা রূপবতী। কদাকার স্বামীকে দেহ দিতে চাইত না। আমার গোয়ালে গোবর ঠেলত বউটা। তাকে আমি মধুর ঘরে রেখেই রাখনি করি। পাপ উভয়ত সম্পন্ন করেছি। ফলত মধুবাস পদ্মার পানিতে আত্মহত্যা করে। তার মাকে রাখেন চিনিবাস। স্ত্রীকে রাখেন মির। এই কাফন তা হলে কীসের? হা খোদা! রোজ রাত্রে মধুবাস আমার কাছে কাফন চাইছে। বলছে, খুয়াবে আছেন মিরজাদা, জাগেন! ইজার দেন, না পারলে হক্কের লিফাফা দেন, কুর্তা নাই বা দিলেন। জাগেন মালিক!
পড়তে পড়তে শিউরে উঠল সুধান। চোখ তুলে আকাশে চাইল। ইস্কুলের সহপাঠী বিলাল বলত, তার নানাজি মাস্টার-মহাজন মির সুলতান হোসেন এক জন লিপিকর। বাসনে-কোসনে-ইন্দারায়-মোকামে-কবরে আল্লা-রসুলের নামে ছড়া লিখে দেন। রুমালে নানান বাণী লিখেন। ইসলামি পত্রিকায় লিখা বাহির হয়। দিনলিপি লিখার অভ্যাস তেনার। ধর্মে ব্যগ্র, ফরিস্তা মাফিক এই মানুষ।
আকাশ থেকে দিশেহারা চোখ লিপিতে নামায় সুধান। মির লিখেছেন, কাফন হল জেব আর আস্তিনহীন কবরের পোশাক। গরিব হয়তো লিফাফাটুকুনই জোগাড় করতে পারে। কিংবা ইজেরই যথেষ্ট হল। এই পোশাক লাশকে পরানোর আগে লাশের গোসল দিতে হবে। সাধারণত নারীকে নারী, পুরুষকে পুরুষ ধুইয়ে দেয়। স্ত্রী অবশ্য স্বামীকে ধোয়াতে পারে— স্বামীর গোপন অঙ্গে হাত দিতে পারে— এইটে চমৎকার। মৃতের স্নান এক আশ্চর্য শায়েরি। এই ব্যাপারে আমার একটি খোয়াইশ অর্থাৎ বাসনা আছে। সমাজ যাতে পারমিট করে, তাই ইত্যাকার কথা লিখে রাখলাম।
আমার বিবি কুরূপা। মধুবাসের বেওয়া জাহিরা রূপবতী, অকাট্য আগুন। জিনার পাপে আমি জিসম্-এ খুয়াইশের গম্বুজ খাড়া করেছি। মধু গুঁড়ি কদাকার ছিল। মানা কি যায়, কদাকারের বিবি অত রূপসী হবে! ইচ্ছা, জাহিরাই আমার লাশে গোসল দিবে।
ডায়েরি আর পড়তে পারে না সুধান। ঘাটে নৌকো বেঁধে বদি মওলানার কাছে আসে। তার কলিজা এবং আত্মা শুকিয়ে গেছে। গায়ে পদ্মাপানির ক্ষার, চোখে মাতলা-বিদ্যাধরীর নুন।
তাকে দেখেই বিনে ভূমিকায় বদি বললেন, বাপের কাফন ছাওয়ালরে ফিরত্ কইরেছেন মির। দাফনের আয়াত দিয়ি পদ্মায় ফেলি দেও সুধান, বাপে চাইতেছে। আর শুনো, আষাঢ়ের পয়লা বরিষে মিরে-মিদ্যায় নিকাহ্ ইজাব-কবুল হবে। চরে মৌতের ছায়া দেখার পর এই খোয়াইশ খাড়া হোয়ছে বাপ। বেজার হোয়নি, যাও। আর শুনো… ফিরা শুনো, পাছুনে মৌৎ, সামুনে বিহা, চরের ধাঁধোশ আব্বা।
—জি, মওলানা। কবরে লাশ দাফনের, মাটি দিবার আয়াত। মাটির আয়েত পানিতে যাবে হুজুর মওলানা। বলেই থরথর কাঁপতে থাকে সুধান গুঁড়ি।
বদি বললেন, নিকাহের আগে কাঁসার বড় থালায় জোঁয়ালি কাঁঠালের পাতভর্তি কোয়া খেতি বাস্না কইরেছে জাহিরা। মির বলতিছেন, তাই দিব। জোঁয়ালি গাছে কাঁঠাল পাকলে নিকাহ্, অনুমান আষাঢ়ের পয়লা। ওই গাছতলায় মানপাতা ইত্যাদি ঢাকা পড়ি গেল বাবা। মিনহা খল্ক নাকুম, অ ফিহা নইদু কুম, অ মিনহা নোখরো জুকুম। তারাতন উখরা। ডাঙালে মরতি চাইত মধুবাস।
পয়লা আষাঢ় কাফনের লিফাফা পদ্মার পানিতে সমর্পণ করল সুধান। দাফনের আয়াতের অর্থ সে জানে। এই মাটিই তোমার দেহ, এই মাটিতেই (কবরে) রাখা হল তোমাকে। ফের তোলা হবে এবং পুনর্জীবিত হবে। সুধানের টাকরায় আটকে গেল আয়েত। সে কাঁদতে পর্যন্ত পারছে না।
কিন্তু স্পষ্টত সুধান দেখল, বাপের একটা হাত হঠাৎ জলের উপর খাড়া হয়ে উঠে পদ্মার পেটে টেনে নিল কাফন। তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি বাধিয়ে দিলে পদ্মার জলের তলায় বাঘ আর বাঘিনী। সাদা থানের মতো বৃষ্টি নামল। সুধান বলল, তারাতন উখরা, বাপ জাগো হে!
জলের তলায় বাঘে খাচ্ছে একটা জ্যান্ত লাশ।
লেখক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের, মুর্শিদাবাদ জেলার হামারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাশার বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত। সাধারণ মানুষের জীবনকে তিনি তাঁর সাহিত্যে বিশেষ ভাবে স্থান দিয়েছেন।
তার বই ভোরের প্রসূতি অবলম্বনে ২০১৯ সালে সিতারা চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।[১] তার রচিত গ্রন্থগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হল:
- ফুল বউ
- ভোরের প্রসূতি
- সুরের সম্পান
- জল, মাটি, আগুনের উপজেলা
- ধর্মের গ্রহণ
- ভোর পেটি তারা
- অগ্নিবলাকা