| 19 এপ্রিল 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

সাধু শোনে ধর্মের কাহিনি

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আবুল বাশার

মানববৃত্তির উৎকর্ষ-সাধনই হলো ধর্ম। এভাবেই হিন্দু ধর্মের নবতর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। আরও সহজ ও সংক্ষেপ করে বললে, কথাটা হবে, মানুষ্যত্বই ধর্ম। স্বামী বিবেকানন্দ বললেন, উৎকৃষ্ট মনুষ্যত্বই দেবত্ব। তার মানে, মানুষ আর দেবতার তফাত নেই। মানুষ চাইলে দেবতায় উত্তীর্ণ হতে পারে।

কিন্তু ইসলাম কী বলে?

আচরণের দিক থেকে বা আকারের বা আসলের দিক থেকে ইসলামের স্তম্ভ (খুঁটি) বা ‘রোকন’ পাঁচটি। (১) কলেমা, (২) নামাজ, (৩) রোজা, (৪) হজ, (৫) জাকাত।

ফের ভাব বা চিন্তা কিংবা জ্ঞানমার্গের দিক থেকেও ইসলামের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য—(১) ঈমান, (২) আমান, (৩) ইনসাফ, (৪) ইনসানিয়ত, (৫) ইখওয়ানিয়াত।

এই পাঁচে মিলে ইসলাম।

১) ঈমান—ঈশ্বরে বিশ্বাস (খোদায় আত্মসমর্পণ)

২) আমান—বিবেকসম্পন্ন মানবিক কর্তব্যবোধ

৩) ইনসাফ—ন্যায় বিচার। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচারবোধ। যার বিচার নেই, তার বিবেক নেই।

৪) ইনসানিয়াত—মনুষ্যত্ব বা মানবতাবোধ

৫) ইখ্‌ওয়ানিয়াত—ভ্রাতৃত্ববোধ। মানুষ পরস্পর ভাই-ভাই।

ইসলামের লক্ষ্য সাম্যবাদ। এই ধর্মে পুরোহিততন্ত্র নেই। ইসলামের তৌহিদ (অদ্বৈতবাদ) বা একত্ববাদের লক্ষ্যও মানুষে-মানুষে সাম্য ও মানুষকে নিয়ে বিশ্বভ্রাতৃসংঘের প্রতিষ্ঠা—মানুষকে মানবজাতি রূপে গড়ে তোলা।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেন—এই দুই ভাষাচার্যের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ডক্টর ওসমান গণি, আরবি-ফারসি-উর্দু-ইংরেজি ও বাংলা ভাষার সুপণ্ডিত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক ছিলেন এই মেধাবী মানুষটি—তাঁর ইসলাম চর্চার গুরুত্ব রয়েছে।

ইসলামের মূল স্পিরিটটা তিনি ধরতে পেরেছিলেন। ধর্মের ব্যাপারে ড. গণি ছিলেন বেশ উদারপন্থী পণ্ডিত; ধর্মনিষ্ঠ হয়েও গোঁড়া ছিলেন না।

তিনি কোরানের সারাৎসারকে মাত্র ছ-টি লব্‌জে বিধৃত করেছেন।

লিখছেন (ইসলামের ব্যাখ্যায়) ‘সকল মানুষেরই একমাত্র ধর্ম তার ‘ইনসানিয়াত’ ও ‘ইখ্‌ওয়ানিয়াত’ অর্থাৎ মনুষ্যত্ব ও ভ্রাতৃত্ব।’

বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন, (তাঁর ধর্মতত্ত্ব প্রবন্ধে), ‘মনুষ্যত্ব বুঝিলে ধর্ম সহজে বুঝিতে পারিবে।’

সুতরাং বঙ্কিমের ধর্মতত্ত্বের আলোচনা হলো সারাটা প্রবন্ধ জুড়ে মনুষ্যত্বেরই আলোচনা।

এভাবে মনুষ্যত্বের আলোচনার পথেই বঙ্কিমের হাতে হিন্দু ধর্ম নতুনতর ব্যাখ্যার গুণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মে উন্নীত হয়েছে— ধর্ম হয়েছে মানুষের কালচার।

বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘উদ্ভিদের পক্ষে কর্ষণ যাহা, মনুষ্যের পক্ষে স্বীয় বৃত্তিগুলির অনুশীলন তাই; এ জন্য ইংরেজিতে উভয়ের নাম CULTURE! এই জন্য কথিত হইয়াছে যে, ‘The Substance of Religion is Culture.’ মানববৃত্তির উৎকর্ষণেই ধর্ম।’

ধর্মের সারাংশকেই বলে কালচার বা সংস্কৃতি।

ধর্মকে এভাবে সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।

কিন্তু পরবর্তীকালে ধর্ম থেকে সংস্কৃতিকে আলাদা করা হয়েছে। এ বিষয়ে কাজী আব্দুল ওদুদের চিন্তাভাবনা খুবই যথাযথ— ‘সংস্কৃতির কথা’ নামে তাঁর প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি নেওয়া যায়।

ওদুদ লিখেছিলেন, ‘সংস্কৃতি কথাটা ইয়োরোপে প্রবল হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইয়োরোপে নানা ধরনের বিপ্লব দেখা দেয়— ভাব বিপ্লব, অর্থনৈতিক বিপ্লব, রাষ্ট্রিক বিপ্লব, সবই। সেই বিপ্লবের পরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আসে নূতন সংগঠনের কাল। সেই দিনে অততের ধর্মের স্থান দখলে করে সংস্কৃতি।’

এরপর-পরই সংস্কৃতির আসল সত্য-বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন ওদুদ। তার সংজ্ঞা দেন।

বলেন, ‘সংস্কৃতি বলতে বোঝায় এক বিশেষ সমন্বয়—খ্রিস্টান-অখ্রিস্টান সমস্ত রকমের জ্ঞান ও উৎকর্ষ এর অন্তর্ভুক্ত হয়। এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়—অতীতের শ্রেষ্ঠ ভাব-সম্পদের সমাহার।’

উপরের সংজ্ঞাটি থেকে বুঝতে পারি—(১) সমন্বয় ছাড়া সংস্কৃতি হবে না। (২) খ্রিস্টান-অখ্রিস্টান জ্ঞান ও উৎকর্ষ মানে ভারতবর্ষে হিন্দু ও অহিন্দু জ্ঞান ও উৎকর্ষ। সুতরাং শুধু মুসলমান জ্ঞান ও উৎকর্ষ দিয়ে বা শুধু ইসলাম দিয়ে ঐস্লামিক (বা  মুসলমান) সংস্কৃতি হবে না। (৩) শুধু বর্তমানের জ্ঞানের সমাবেশ ঘটালেই সংস্কৃতি হবে না। অতীতের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানগুলির সমহার চাই।

এককথায় সমন্বয়ই সংস্কৃতি।

এর কারণ হলো, জ্ঞানের উৎপত্তি যেখানেই ঘটুক, তার বিস্তার ঘটে সব দেশে—এমনকী জ্ঞান শ্রেষ্ঠজ্ঞান হলে তা কোনও খণ্ডকালে বাঁধা থাকে না—কাল থেকে কালান্তরে ছুটে চলে জ্ঞান।

হজরত মুহম্মদ তাঁর অনুসারী আরববাসীদের বলেছিলেন, জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যাও। কারণ চীন ছিল প্রাচীন সভ্যতায় উন্নত এক দেশ।

বুদ্ধ মানে জ্ঞানী—সেই জ্ঞানীর দেশেই যাওয়া উচিত বলে মনে করেছিলেন হজরত মুহম্মদ। কিন্তু বুদ্ধদেবের জ্ঞানই নয়, চীন সভ্যতার যাবতীয় শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকেই সন্ধান করতে বলেছিলেন হজরত।

জ্ঞান নিয়ে আরও অনেক চমকপ্রদ কথা রয়েছে হজরতে বাণী বা হাদিসে। যেমন, একজন জ্ঞান-সাধকের দোয়াতের কালি শত শহিদের রক্তের চেয়েও পবিত্র।

ধর্মীয় পবিত্রতাবোধ এ এক অনন্য জাগতিক দৃষ্টান্ত; কথাটা মোটেই আধ্যাত্মিক মার্গের কথা নয়। জ্ঞানকে এইরকম উচ্চতায় তোলবার ফলেই ইসলামে বিচারবাদ হয়েছিল ইসলামের প্রাণ। ইসলাম হলো আরব-সভ্যতার ফলশ্রুতি। আরবের উন্মেষিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত্তিই ছিল তার ধর্মীয় দর্শন ও মূল্যবোধের ভিত্তি।

স্যার সৈয়দ আমীর আলীর ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’ বইটির একটি বিশ্বস্ত বাংলা তরজমা পাওয়া যায়; যেটি ইসলামকে বোঝার পক্ষে অত্যন্ত ভালো বই। সুন্দর অনুবাদ। এই ধরনের বই আজকাল আর লেখা হয় না। ইংরেজিতেও কোনও বাঙালি লেখেন না। বাংলাতেও নয়।

ইসলামের বিচারবাদ কীভাবে খতম হলো, কবে হলো, সে কথাও এই বইটিতে লেখক আলোচনা করেছেন। আমরা যে নিতান্ত আমলবাদী (আচারসর্বস্ব) ইসলামকে দেখি, সেই আচার বা আমল মাত্র নয় ইসলাম। ইসলাম একটি মহৎ দর্শনেরও নাম, তা একটি মিশ্র সংস্কৃতির সমন্বয়। ইসলাম নিজেই একটি সমন্বয়বাদী ধর্ম। এর সামাজিক অবদান অনেক বেশি সত্য। দোজখ-বেহেস্তেই ইসলাম সীমাবদ্ধ নেই। দাস-ব্যবসার অবসান চেয়েছিল যে ইসলাম, সেই ইসলামের চর্চা আজ স্তব্ধ হয়ে গেছে।

আমীর আলী লিখেছেন (অনুবাদ ড. রশীদুল আলম)—‘ইসলাম তার অনুসারীদের কাছ থেকে এক চিরন্তন সত্যের সহজ স্বীকৃতি এবং কতিপয় নৈতিক কর্তব্যের অনুশীলন দাবী করেছিল। অন্যান্য দিক দিয়ে ইসলাম তাদেরকে দিয়েছিল বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ব্যাপকতম স্বাধীনতা। ঐশী একত্ববাদের নামে এই ধর্ম সকল ধর্মমত ও সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরেছিল গণতান্ত্রিক সাম্যের অঙ্গীকার।’

এর ফলে কী হলো?

‘স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক ধর্মের নির্যাতিত বিরুদ্ধবাদীরা হজরতের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলেন, যিনি পুরোহিততন্ত্রের অক্টোপাশ থেকে মানুষের বিচারবুদ্ধির মুক্তি দিয়েছিলেন।’

সুতরাং বিচারবোধ যেখানে মুক্ত, সেখানে বিচারবাদ জয়ী হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আবার বলছি, বিচারবাদ ইসলামের প্রাণস্বরূপ ছিল।

যখন বলা হয়, ইসলাম একটি পূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তখন সেই জীবন-ব্যবস্থা জাগতিক ঘটনা হিসেইে জগৎকে দেখেছে। সেটি কোনও আধ্যাত্মিক ব্যাপার নয়।

ইসলাম শুধু একটা ধর্ম নয়। ইসলাম একাধারে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি।

ইসলামের সাম্যই সকলকে আকর্ষণ করেছিল।

দাসে আর প্রভুতে পার্থক্য করেনি ইসলাম।

ইসলাম বংশ ও বর্ণের পার্থক্য স্বীকার করে না।

দাসপ্রথা উচ্ছেদ ইসলাম ছিল সবচেয়ে আপোসহীন। খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্ম দাসপ্রথার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ তোলেনি। গির্জা স্বয়ং দাস রাখত।

অপরপক্ষে ‘ইসলামে আজ যে দাস কাল সে প্রধান উজির। যে কোনও দুর্নাম ছাড়াই সে তার প্রভুর কন্যার পাণিগ্রহণ করতে পারে এবং পরিবারের প্রধান হতে পারে। দাস রাজ্য শাসন করেছে।’

দিল্লির প্রথম সুলতান, ভারতবর্ষের মুসলমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কতুবউদ্দীন ছিলেন একজন দাস।

ইসলামের প্রথম সন্ধানদানকারী মোয়াজ্জিনও একজন দাস। নামাজের পঙ্‌ক্তিতেই হোক আর রাষ্ট্র পরিচালনায় হোক দাসের জায়গা ছিল মুক্ত। দাসকে মুক্ত করার জন্য জাকাতের অর্থ থেকে অর্থসাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল ইসলামে।

বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব আলোচনায় ইসলামের কোনও উল্লেখই নেই। থাকা উচিত ছিল।

মনে রাখা দরকার, বাংলার বৈষ্ণব ধর্ম ইসলামের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরী স্পষ্টাক্ষরে সে কথা স্বীকার করেছেন।

বাংলার ইসলামি সুফি ভাব-আন্দোলনের প্রভাব, তা ছাড়া পারস্য রেনেসাঁর প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। বাংলার কাব্যে ও গানে। গদ্য-সাহিত্যে আমরা ইউরোপীয়। নজরুল ও রবীন্দ্রগানে অর্থাৎ গানে আমরা পারসিক।

কিন্তু যা নিতান্ত বেদনার কথা, তা হলো, ইসলামের চর্চায় বিচারবাদের আজ আর কোনও স্থান নেই। ধর্মতত্ত্বও যুক্তির জিনিস। আধুনিক উন্নত জ্ঞান-জগৎ থেকে মুসলমান আজ প্রায় নির্বাসিত। যুক্তিকে মুসলমান আজ ভয় পায়।

সংস্কৃতির সংজ্ঞার নবায়ন করেনি মুসলমানসমাজ। ইসলাম সম্পর্কেই এই মুসলমানসমাজের অজ্ঞতার শেষ নেই। নামাজ-রোজার সঙ্গে ‘জাকাত’ কেন রাখা হলো ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভে, তা সে খতিয়ে দেখে না।

দাস-মুক্তিতে জাকাতের কী ভূমিকা ছিল, তা সে কখনও চর্চাই করেনি। সুফি-ইসলামকে গোঁড়া মোল্লার দল ঘৃণা করে। অথচ হজরত মুহম্মদ নিজেই ছিলেন অতীন্দ্রিয়বাদের প্রবক্তা; সুফি।

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের প্রেমতত্ত্ব ইসলামেরই তত্ত্ব। চৈতন্যদেব ভাবে বিভোর হয়ে যে ঊর্ধ্ববাহু নাচ করতেন, সেই নাচ, ‘বেড়ানাচ’ ফকিরের বা ঈশ্বরের বন্ধু আউলিয়ার নাচ।

আমরা এই লেখায় সুফিতত্ত্ব আলোচনার পরিসর পাবো না। ইসলামের বিচারবাদ কীভাবে নষ্ট হলো, সে কথাও ইতিহাস ধরে আলোচনার অবকাশ নেই। ধর্মীয় গোঁড়ামির উৎস কী, সে কথাও তোলা রইল আলোচনার প্রসঙ্গে, তা আগামী দিনে আলোচিত হবে।

আমরা এ রচনাকে আজ একটু অন্যভাবে শেষ করব।

বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্বে ‘প্রীতি’ শব্দটির এক বিশিষ্ট ব্যবহার চোখে পড়ে। মনুষ্যপ্রীতি ছাড়া ঈশ্বরপ্রীতি সম্ভব নয়— এটাই তিনি সমগ্র লেখাটিতে প্রতিপাদন করেছেন। শুধু মানুষ-প্রীতিই নয়, পশুপ্রীতি ছাড়াও ধর্ম হবে না। পশুপ্রীতিতে হিন্দু ধর্মই শ্রেষ্ঠ।

বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘অন্য ধর্মেও সর্বলোকে (পশুও তার মধ্যে পড়ে) প্রীতিযুক্ত হইতে বলে বটে, কিন্তু তাহার উপযুক্ত মূল কিছুই নির্দেশ করিতে পারে না। হিন্দুধর্ম্মের এই জাগতিক প্রীতি জগতত্ত্বে দৃঢ় বদ্ধমূল। ঈশ্বরের সর্বব্যাপকতায় ইহার ভিত্তি।’

কথাটা আরও স্পষ্টতর করে তুলতে বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন— ‘ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। এই জন্য সর্বভূতে সমদৃষ্টি করিতে হইবে। অতএব পশুগণও মনুষ্যের প্রীতির পাত্র।’

এক্ষেত্রেও আমরা ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’ থেকে এ কথা পাই যে, মানুষ ও মনুষ্যেতর প্রাণীর সম্বন্ধ সবচেয়ে উচ্চতায় স্থাপন করেছে ইসলাম।

কোরান বলেছে, ‘পৃথিবীতে এমন প্রাণী কিংবা ডানার সাহায্যে উড়ন্ত পাখি নেই যা তোমাদের কাছে একটি মানবজাতির সদৃশ নয়—তারা তাদের প্রভুর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে।

পশু ও পাখির জগৎ কোরানের চোখে মানবজাতির সমান্তর আদরণীয় জগৎ—সামান্য একটি পতঙ্গও কোরানে ও হাদিসে মর্যাদাবান সত্তা। প্রাণীর জীবন ও মনুষ্যজীবন একই ভিত্তির উপর স্থাপিত।

পশুর সঙ্গে মানুষের ব্যবহার কেমন হবে তা নিয়ে ইসলামী দুনিয়ায় নানা গল্প প্রচলিত আছে। গল্পের সঙ্গে গেঁথে রয়েছ হাদিস।

হজরত মুহম্মদ একটি পাখির ব্যাপারেও কেমন সংবেদনশীল ছিলেন, তা একটি ঘটনায় এভাবে প্রকাশ পেয়েছে—

একবার একজন লোক হজরতের কাছে এলো, তার হাতে একটি পাখির বাসা। সে বলল, ‘হে রসুল, আমি বনের মধ্য দিয়ে যাবার সময় পাখির ছানার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি ছানাগুলো ধরে আমার চাদরের মধ্যে নিলাম এবং ছানাগুলোর মা আমার মাথার চারপাশে গোল হয়ে ঘুরতে লাগল এবং কিচিরমিচির করতে লাগল।’

হজরত বললেন, ‘তাদের ছেড়ে দাও।’

লোকটি যখন ছানাগুলোকে ছেড়ে দিলো, তখন মা-পাখিটা ছানাগুলোর কাছে গেল।

হজরত বললেন, ‘তোমরা কি ছোটো ছানাগুলোর প্রতি পাখির মায়ের ভালোবাসা দেখে অবাক হোচ্ছ? যিনি আমাকে এ সংসারে পাঠিয়েছেন তাঁর নামেই শপথ করে বলছি—ছোটো ছানাগুলোর প্রতি পাখি-মা যতটা স্নেহশীল, বান্দার প্রতি আল্লাহ তার চেয়েও বেশি স্নেহশীল। সুতরাং যে জায়গা থেকে তাদের নিয়ে এসেছে। যেখানেই তাদের ছেড়ে দিয়ে এসো আর তাদের মাকে তাদেরই সঙ্গে যেতে দাও।’

হজরত বলেছেন, ‘ইতর প্রাণী সম্পর্কে আচরণে আল্লাহকে ভয় করে চলবে, যখন পশু আরোহনের উপযুক্ত হবে তখনই তার উপর আরোহন করবে, আর যখন তারা ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখন আরোহন করবে না। ভাষাহীন ইতর প্রাণীর মঙ্গল করার জন্য এবং তাদের তৃষ্ণায় জল দেওয়ার জন্য নিশ্চয় আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পুরস্কার রয়েছে।’

একটি মরু-গণিকা একটি তৃষ্ণার্ত কুকুরের বাচ্চাকে মরুকূপ থেকে বহু কষ্ট করে জল তুলে এনে বাঁচিয়ে তুলেছিল, এর পুরস্কারটি খোদার তরফ থেকে অসামান্য একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছ।

মৃত্যুর পর মরু-রূপাজীবা (ফারসি শব্দ বেশ্যা)-কে খোদা একটি নক্ষত্রে রূপান্তরিত করেন এবং সাঁঝ-তারা রূপে ও ভোরের তারকা হিসেবে আকাশে চিরদীপ্তিমান করেন। ওটিই শুক্রগৃহ।

এটিই কবি জীবনানন্দের চিত্রকল্পে দূরতর দ্বীপের আকাশে বিকেলের নক্ষত্র, যা মানুষের সুচেতনাকে ভাস্বর করে তুলেছে উপমান হিসেবে।

কোরান-হাদিসে পশুকে এমনই গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়েছে যে, মানুষের মানবিকতার প্রকাশে পশুই হয়েছে অবলম্বন। শুধু পশুই নয়, কীট বা পতঙ্গও কোরান-হাদিসে অপরিসীম গুরুত্ব পেয়েছে।

আমার লেখার মধ্যে কোরান-হাদিসের এই পশু বা প্রাণী জগৎ নানান তাৎপর্য নিয়ে এসেছে।

পশু ও প্রাণীর নামে কোরানে বিভিন্ন সূরাহ্ রয়েছে। ‘সূরাহ্‌‌’ হল পরিচ্ছেদ।

দ্বিতীয় সূরাহ্‌টির নামই হল গাভী। ‘বাকারাহ্‌’।

প্রথম সূরাহ্‌ হলো উপক্রমণিকা। ‘ফাতিহা’।

কোরানের দীর্ঘতম সূরাহ্‌ বা পরিচ্ছেদটি অবতীর্ণ হয়েছে গাভীর নামে, সেটি গাভী না হয়ে ছাগল বা দুম্বাও হতে পারে।

ষষ্ঠ সূরাহ্‌টির নাম হলো ‘আনাম’; যার অর্থ হলো ‘চতুষ্পদ জন্তু’। ১৬ নং সূরাহ্‌। নাম নহ্‌ল। অর্থ—‘মৌমাছি’।

১৮ নং সূরাহ্‌টিতে একটি রহস্যময় কুকুরের প্রসঙ্গ রয়েছে, যদিও সেটির নাম ‘গুহা’ (কাহফ)।

২৭ নং সুরাহটির আরবি নাম নমল, যার বাংলা অর্থ ‘পিঁপড়ে’।

২৯ নং সূরাহ্‌টির বাংলা নাম ‘মাকড়সা’— আরবি নাম ‘আনকাবুত’।

১০৫ নং সূরাহ্‌। নাম ‘ফীল’। অর্থ ‘হাতী’।

দেখা যাচ্ছে, কোরানের মোট সূরাহ্‌ ১১৪টি।

মনুষ্যেতর প্রাণীর নামে সূরাহ্‌ ৬টি। এ ছাড়া উদ্ভিদের নামে সূরাহ্‌ আছে। যেমন ‘ডুমুর’ গাছ।

বাতাসের নামে সূরাহ্‌ ‘সাবা’—যার অর্থ ‘পুবের হাওয়া’।

তা ছাড়া একটি সূরাহ্‌-এর নাম ‘কওসর’—বেগম রোকেয়া এর বাংলা তরজমা করেছেন, ‘মন্দাকিনী’।

এভাবে যদি না দেখলাম, তা হলে তো কোরানকে, হাদিসকে দেখা হলো না।

পশুপ্রীতিতে ইসলাম একটি অগ্রগণ্য ধর্ম।

বঙ্কিমচন্দ্র কখনও কোরানের পাতা উল্টে দেখেছেন বলে মনে হলো না।

মানুষের কাছে আসে খোদার প্রত্যাদেশ (অহী)।

পশু বা প্রাণীর কাছে আসে ‘ইলহাস’ (গোপন ইঙ্গিত বা প্রেরণা)।

‘মৌমাছি’ (নাহ্‌ল) পরিচ্ছেদটিতে শুধু মৌমাছির কথাই নেই, আছে গৃহপালিত পশুদের কথাও।

কোরান বলছে, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য শিক্ষা। রয়েছে গবাদি পশুর মধ্যেও।’

কোরান গৃহপালিত পশুদের শুধু উপকারী ভূমিকার কথাই তুলে ধরে না; তার সঙ্গে তুলে ধরে তাদের সৌন্দর্যের কথাও।

কোরান বলছে, ‘তিনি (ঈশ্বর) চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন; তোমাদের জন্য ওই জন্তুর মধ্যে রয়েছে শীত নিবারক উপকরণ (যেমন ভেড়ার পশম) ও বহুবিধ উপকার। এবং ওই জন্তুই তোমাকে বিশেষ আহার্য জোগায় (তুমি আহার করো) এবং তোমরা যখন গোধূলির অস্তরাগে ওদের চারণভূমি থেকে গৃহে নিয়ে আসো এবং প্রভাতে যখন ওদেরকে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তোমরা তার সৌন্দর্য উপভোগ করো।’

সৌন্দর্য বাদ দিয়ে কোরান এক পা-ও এগোতে চায় না।

ড. গণি নহ্‌ল-এর মৌমাছি সংক্রান্ত কথাটির একটি আয়াত এভাবে অনুবাদ করেন—‘তোমার প্রতিপালক (রব্ব বা খোদা) মৌমাছির অন্তরে প্রত্যাদেশ (ইশারা বা ইঙ্গিত) দিয়েছেন।’

ওই কথাটার ড. গণি ব্যাখ্যা (তফসির) দেন এভাবে—আল্লাহ্‌র অহী অর্থাৎ প্রত্যাদেশ তিনি (ঈশ্বর) এক ঘণ্টা যার বয়েস, সেই সব শিশুশাবককেও দেন। কীভাবে সে তার মাতৃস্তন্য পান করবে। কীভাবে পক্ষীশাবক ঠোঁট মেলে হাঁ করবে। কোন ইঙ্গিতে মুরগির ছানা তার মায়ের ইঙ্গিতেই খাবার খেতে শিখবে। আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ বা অনুপ্রেরণা যারা সৃষ্টি জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে আছে। মহান আল্লাহ্‌র গোপন ইঙ্গিত (ইশারা) ইলহাম, প্রকাশ ইঙ্গিত প্রত্যাদেশা নামে অভিহিত। তিনি যে কেবল মনুষ্য জগৎকেই তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা জানান তা নয়, সমগ্র সৃষ্টি জগৎকেই তিনি তাঁর অভিপ্রায় জানিয়ে দেন। পিপীলিকার দল প্রবল বর্ষণের পূর্বেই গর্ত থেকে গাছে ওঠে। কোন অহী কার অহী কাজ করে!’

এখানে বলে রাখা দরকার ড. গণি ‘ইলহাম’ কথাটি এখানে ব্যাখ্যার সুবিধার্থে যোগ করেছেন। কোরানের মূল আয়াতে ‘ইলহাম’ কথাটি নেই। অহী বা প্রত্যাদেশ রয়েছে। অন্য তফসিরকাররা প্রত্যাদেশ কথাটি ব্যবহার করেছেন। আমাদের বিবেচনায়, খোদা তাঁর প্রত্যাদেশ মানুষ, উদ্ভিদ, পাখি, কীট-পতঙ্গ-পশু সবার জন্যই পাঠিয়ে থাকেন—কেননা তিনি তাঁর সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন নন।

পশুপ্রীতির ভিত্তি হিন্দু ধর্মে স্রষ্টা ও সৃষ্টির অভেদ-তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। এটাই বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্য এবং তিনি মনে করেছেন, এ জিনিস অন্য ধর্মে নেই।

আমাদের বক্তব্য হলো, কোরানে আছে।

হাদিস বলছে, ‘আল্লাহ্‌ আপন আকৃতিতে আদমকে তৈরি করলেন।’

কোরানের সূরাহ্‌ রুম বলছে—‘আল্লাহ্‌র প্রকৃতি অনুসরণ করো, যে-প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন।’

নরই নারায়ণ তত্ত্বের স্পষ্ট ইঙ্গিত এখানে।

মানুষ ঈশ্বর-গুণ পেয়েছে, রূপও।

তা হলে আর গেলে কীসের?

কিন্তু কোরানের ব্যাখ্যায় দ্বৈত তত্ত্বের অবতারণা করেছেন কেউ-কেউ ব্যাখ্যাকারীরা।

বলেছেন, খোদা তাঁর গুণের চেয়েও বড়ো। ফলে তিনি মানুষের অনায়াত্ত, তার সঙ্গে প্রেম করবে কীভাবে!

জবাব হচ্ছে, আল্লাহ্‌র প্রকৃত আসন মানব হৃদয়—হৃদয়ের পথ ধরে এগোলে খোদাকে পাওয়া যায়।

ইসলামের সুফিবাদ মানুষে আর খোদার ব্যবধান স্বীকার করে না।

আজকের মতো কথাটা এভাবে শেষ করি—

আল্লাহ্ তিন ধরনের স্বর শুনতে পছন্দ করেন—(১) কোরান পাঠের স্বর। (২) উপাসনার স্তব-মন্ত্র। (৩) পাখির কলতান।— আল হাদীস।

পশু বা পাখি— এমন প্রীতি কি ইসলামে নেই? সাহিত্যসম্রাটকে কুরনিশ করেই বলতে হচ্ছে, আছে।

 

 

 

 

সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৯ পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত