গীতরঙ্গ: কলকাতার বুকে একটুকরো চিনদেশ । সরিতা আহমেদ
চা, চিনি ও ইন্ডিয়ান চাইনিজ – কলকাতার বুকে একটুকরো চিনদেশ
কলকাতার ব্ল্যাকবার্ণ লেন ধরে হাঁটতে হাঁটতে এ পথে এসে পড়লে আনকোরা পথিককে খানিকটা থমকে যেতেই হয়, এ যেন কলকাতার বুকে একটুকরো বিদেশ– চিনাম্যানতলা। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, বৌবাজার ঘেঁষা অঞ্চলে, ট্যাংরার চায়না টাউনের গলিতে যাঁদের ইতিউতি চোখে পড়ে – গড়পরতা বাঙালি চেহারার সাথে তাঁদের চেহারার সত্যিই কোনও মিল নেই। তবে আরেকটা সত্যি হল, বহু প্রজন্মের বিবর্তনধারায় ভাষা সংস্কৃতির নিরিখে এঁদের মধ্যেও বয়ে চলেছে, আস্ত এক ভারতবর্ষ-আয়েশি বাঙালিয়ানা।
এঁরা ভারতীয় চিনা – ইণ্ডিয়ান চাইনিজ!
নামের মধ্যে এই দ্বৈত স্বত্ত্বা নিয়ে চলা মানুষেরা শোনায় কলকাতার বুকে নিত্য বহমান এক আশ্চর্য ইতিহাস। দু’শো বছরেরও আগে ওঁদের পূর্বপুরুষ চিন থেকে এসেছিলেন ভারতে, প্রাচীন সিল্ক রুট ধরে এই বাংলার মাটিতে পৌঁছে হুগলীর তীরে ঘর বেঁধেছিলেন তাঁরা। ‘মাইগ্রেন্ট’ যাঁরাই হোক, মানুষ কখনো কোথাও একলা যায় না। ছায়ার মত তার সাথে চলে নিজস্ব ভাষা-সভ্যতা-বিশ্বাস-কৃষ্টি ও প্রজন্মের কুলুঙ্গি থেকে পেড়ে আনা ধর্ম। হুগলীর তীরের পলি মাটিতে ভিনদেশী পরিযায়ীরাও আঁচল পাতল, শেকড় ছড়াল। সময়ের সাথে সাথে গভীরে প্রথিত সেই চৈনিক শেকড় সিঞ্চিত হল সুজলা সুফলা বাংলার মৃত্তিকারসে ।
ভারত তথা কলকাতায় চিনেদের আসার মূলে প্রধান কারিগর ছিলেন ইয়াং তা চাও- কিম্বা ‘তাং আচিউ’ যিনি কলকাতায় এসেছিলেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে। কলকাতার কাছে বজবজে নদীতীরে তাঁর বসতি স্থাপিত হল কিছু আত্মীয়বন্ধুর সাথে। কিন্তু শেকড় ছড়াতে হলে প্রয়োজন কর্মসংস্থান । তাং আচিউয়ের সাথে ছিল স্বদেশের চা। সেটিই তিনি উপহার দিলেন গর্ভনর জেনারেল হেস্টিংসকে। অপূর্ব এই পানীয়ের স্বাদে-গন্ধে মুগ্ধ হয়ে ওয়েরেন হেস্টিংস আচিউকে দিলেন থাকার জায়গা ও ৬৫০ বিঘা জমি বার্ষিক ৪৫ টাকায় , ব্যবসার স্বার্থে।
ততকালীন চিনের রাজতন্ত্রে ইউরোপিয়ানদের প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু চিনের বিশাল ভূখন্ডের বৃহৎ বাজারকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির। গভঃ জেনারেল হেস্টিংস তখন কূটনৈতিক স্তরে তীব্বত ও চিনের সাথে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। সেই সময় চিনা ব্যবসায়ী ইয়াং তা চাও –এর ভারত আগমন নিঃসন্দেহে হেস্টিংসের সামনে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক মুনাফার নয়া দিশার সন্ধান দেয়।
অচিরেই বজবজ এলাকায় তাং আচিউ শুরু করলেন আখের চাষ , খুললেন চিনির কল। সেটাই চিনের ভূখণ্ডের বাইরে প্রথম চিনা শিল্পস্থাপন। চিন থেকে এল আরও বহু মানুষ। শুরু হল কলকাতার উপকণ্ঠে চিনের উপনিবেশ বা চিনাম্যানতলা। পরবর্তীকালে আচিউয়ের নামে জায়গাটার নামই হয়ে গেল আচিপুর -আজকের অছিপুর।
তবে তাঁর স্থাপিত চিনি-কল খুব বেশী দিন চলে নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথি থেকে জানা যায় ১৭৮৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে বছর দশেক বাদেই বন্ধ হয়ে যায় চিনি কল। তারপরই বজবজের চিনেরা পাড়ি জমান কলকাতায়। ক্রমশ জমে ওঠে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট , বৌবাজার ও টিরেটো বাজারের চিনা বসতি।
‘চিনা’ শব্দটি হয়ত এনাদের ক্ষেত্রে এখন আর প্রযোজ্য নয়। কারণ চেহারায় সাদৃশ্য থাকলেও এঁরা সবাই এক নন, এক ভাষাভাষিও নন । এঁদের মধ্যে কারো ভাষা– ক্যাণ্টনিজ,কারো হাক্কা, কারো বা সিয়ি। বিশাল দেশ চিন, তার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নানান প্রদেশের মানুষ এসেছিলেন ভারত তথা কলকাতায়। তাঁদের প্রতিভা, পেশাগত দক্ষতা, পরিশ্রমের সামর্থ্য আলাদা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এঁরা কলকাতার বুকে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন।
এদের মধ্যে হাক্কা-দের হাতেই কলকাতায় জন্ম নিল এক ঐতিহাসিক খাদ্যবস্তু, ইণ্ডিয়ান চাইনিজ ফুড! চা ও চিনিকে বাঙালির রান্নাঘরে হাজির করার হোতা তাং আচিউ-এর সমসাময়িক আরেকজন চিনা ব্যাবসায়ী ইয়ান-তাই-চাও-র হাত ধরে এল বাঙালির আরেক প্রিয় খাদ্যবস্ত – চাইনিজ।
১৭৭৮ সালে চিন থেকে প্রথম কলকাতায় পা রাখেন ইয়ান-তাই-চাও ব্যবসার উদ্দেশ্যে ।কলকাতা তখন বৃটিশ ইণ্ডিয়ার রাজধানী। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগও বেশী। ইয়ান-তাই-চাওয়ের সুত্র ধরে বিংশ শতাব্দীতে বহু বছর ধরে চীনারা কলকাতায় এসে গড়ে তুলল চায়নাটাউন, যার সাথে বর্তমানে চীনের কোনও সম্পর্কই নেই। বাংলার জল-হাওয়া-ভাষা-সংস্কৃতিকে নিজেদের জীবনযাপনে মিশিয়ে তারাও আজ বাঙালি। যাদের পালাপার্বনে আমাদের দিব্যিঠাকুর মা-কালীও নিত্য পুজো পান– নুডল, চপসুই, রাইস ইত্যাদি নানাবিধ নৈবেদ্য সহ। এইভাবে পরিযায়ী মানব ইতিহাসের ধারা মেনে ও এডাপ্টেশানের সহজাত প্রবৃত্তি মিশিয়েই জন্ম নিল এক নয়া ব্র্যান্ড – ‘সাইনো-ইণ্ডিয়ান কালচারাল ফিউশান’।
আর বাংলার যেকোনো ‘কালচার’ যে রসনা তৃপ্তির গলিপথ দিয়েই যাত্রারম্ভ করে, তা কে না জানে । ফলে আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে কলকাতার বাবুদের খাদ্যাভ্যাসে এক বিপ্লব নিঃশব্দে পা ফেলল – ধর্মতলার গনেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ে প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ‘ইউ চাও’-এর হাত ধরে। এরপর ‘ফ্যাট মামা’, ‘কিম ফা’ ইত্যাদি লেজেন্ডারি রেস্টুরেন্টের হাতে ব্যবসা জগতে নতুন ছাপ রাখল ইন্দোচায়না ডিশ – যা ‘অগাস্ট মুন রোল’, ‘ফেয়ারি ড্রাগন চিকেন’-এর মত খাদ্যর পসরা নিয়ে পোষাকি নাম নিল ‘ইণ্ডিয়ান চাইনিজ ফুড’!
‘মাঞ্চুরিয়ান’ বলে যে পদটি নামি রেস্তোরাঁ থেকে পাড়ার মোড়ের চাউশপের হট আইটেম – সেটি আদৌ চিনের খাদ্যই না। একেবারেই খাঁটি ভারতীয় । কলকাতার চায়নাটাউন থেকে যে ব্র্যাণ্ডটি সাফল্যের সাথে খাদ্যব্যবসায় নেমেছিল তারই শাখা বোম্বের ‘চায়না গার্ডেন রেস্টুরেন্টে’র এক ভোজনরসিক কাস্টমারের আবদার, ‘মেনুকার্ডে নেই এমন ‘ইউনিক’ চাইনিজ খাদ্য চাই’ -শুনে ততকালীন শেফ নেলসান ওয়াং চিকেনের টুকরোয় কর্ণফ্লাওয়ারের পরত মিশিয়ে,ডিপ ফ্রাই করে, পেয়াজ-রসুন-লঙ্কা-ভিনিগার-সোয়াসস ও একটা সিক্রেট লাল সস মিশিয়ে দিয়ে তৈরি করলেন “ওয়ার্ড অফ মাউথ’ যা আজকের প্রায় সব ভারতীয় চিনা রেস্তোরাঁয় ‘মাঞ্চুরিয়ান’ নামে বিখ্যাত ।
অছিপুর ফেরিঘাটের আগে একটা বাঁদিকের রাস্তা সোজা চলে গেছে বটতলা থেকে চিনেম্যানতলা। এখানেই আছে ইস্টবেঙ্গলের পতাকার রঙে সজ্জিত একটি চিনা-উপাসনাগৃহ। মন্দিরটি পরিচালিত হয় ব্ল্যাকবার্ণ লেন বৌবাজার থেকে। কোনোদিন বেখেয়ালে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গেলে লালের সমাহারে থমকে দাঁড়াতে হয়।
“ আপনাদের সবেতে এত লাল কেন?” – প্রশ্ন করলে ফিসফিসিয়ে একটি লোককথা শোনান কোনও এক বৃদ্ধ পুরোহিত।
“সমুদ্রের তলায় থাকত ভয়ংকর দানব, নি-আন । বছরে এক বার জল থেকে উঠে আসত গ্রামে। পশুপাখি, মানুষ সব সাবড়ে ফিরে যেত। জলদৈত্যের ভয়ে সব মানুষ পালিয়ে যেত আন-ঠাঁইয়ে। এক বার গ্রামে এল এক ভিখিরি। আশ্রয় নিল এক বুড়ির ঘরে। বুড়িকে বলল, ভয় পেয়ো না, আমি আছি তো! লাল রং দিয়ে খুব করে ঘর সাজাল সে। দেওয়ালে লাল, মেঝেতে লাল, সব জিনিসপত্তরে লাল। সেই রাতে যখন নি-আন এল বুড়ির ঘরে, লাল রং দেখে ছিটকে গেল দূরে। সেই মুহূর্তে দেখা গেল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেই ভিখিরি। সে নিজেও লাল পোশাক পরেছে, আর আকাশ জুড়ে ফাটছে শব্দবাজি। নি-আন পালিয়ে গেল ।পরদিন গ্রামের মানুষজন ফিরে এসে বুঝল, দৈত্য যে লাল সইতে পারে না, এত দিন তারা জানতই না তা! সেই থেকে চিনাদের জীবনে লালের রবরবা। রাজনীতির লাল তো এই সে কালের কথা!’’
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই প্রতিবছর কলকাতার চিনেপাড়া সেজে ওঠে। মন্দিরগুলোয় লালের পোচ আরেকটু গাঢ় হয়। চিনা নববর্ষে কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য ভারতীয় চিনারা আয়োজন করেন নানান উদ্যাপন-অনুষ্ঠানের। সেই দিন আমজনতার জন্য উন্মুক্ত হয় চিনা মন্দিরের দরজা – যেখানে পুজিত হন ,তাং আচিউ-এর আনা দুই দেবমূর্তি– ‘খোদা-খুদি’। তবে চিনা মন্দিরে যে শুধু চিন-দেবতাই পূজিত হন তাই নয় , একাসনে সেখানে পুজো পায় বাংলার ‘দক্ষিণরায়’ ও ‘বনবিবিও’। সেই মন্দিরের অদূরেই অছিপুর ইঁটভাটার মাঝে এক খাঁড়ির ধারে অবস্থিত লাল অর্ধবৃত্তাকার সমাধিক্ষেত্র – তাং আচিউ-এর দেহাবশেষ। সেই সমাধিস্থল থেকে বেরিয়ে উত্তরদিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায় দিগন্ত বিস্তৃত কাশবনে– যেখানে একদা ছিল উপমহাদেশের প্রথম চিনি কল।
এইভাবেই বৃটিশ ইন্ডিয়ার সময়কাল থেকে বাংলার জল হাওয়ায় বিরাজমান একটুকরো চিন দেশ – কলকাতার চায়নাটাউন, আমাদের ‘অথেন্টিক’ ইণ্ডিয়ান চাইনিজ – সময় যেখানে অবহেলার বারুদ বুকে চেপে তার নিজস্ব ইতিহাস নিয়ে যেখানে থমকে দাঁড়ায়।
তথ্যঋণ –
আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময় পত্রিকা, ‘আমাদের অছিপুর’ ব্লগ এবং ইন্টারনেট ।