গীতরঙ্গ: আধুনিক বাংলা গানে কলকাতা । তরুণ মুখোপাধ্যায়
বাংলা কবিতায় কলকাতার উজ্জ্বল ভূমিকা কি,জানিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রত্তোর যুগের অন্যতম কবি বুদ্ধদেব বসু।লিখেছিলেন,”কলকাতা ঝরে এক ফোঁটা মধু /অসীমের শতদলে।”(কলকাতা)
তিনি আরও বলেন–“আমার কাজ,আমার বৃত্তি,আমার জীবন–সব,সব আমি পেয়েছি তোমাকে পেয়ে কলকাতা।”কলকাতাকে ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’ বলেন জীবনানন্দ দাশ।যদিও উনিশ শতকে কলকাতা নিয়ে জনমানসে মিশ্র উপলব্ধি ছিল।
ক.জাল জুয়াচুরি মিথ্যা কথা
এই তিন নিয়ে কলকাতা।
খ.বেশ্যা মাটি মিথ্যা কথা
এই তিন নিয়ে কলকাতা।
কালে-কালোত্তরে কলকাতার পরিবেশ বদলেছে।বদল ঘটেছে মানুষের স্বভাবে,আচরণে।তবু এক স্মৃতিময়তা জেগে থাকে।কলকাতা স্ত্রীবিকার, আর বহুজনতার সঙ্গমক্ষেত্র আজও সত্য।আধুনিক বাংলা গানে তাই কখনো আড্ডার মেজাজ আনে কলকাতা;কখন ভিড়,ব্যস্ততা,শঠতা,লেনদেন,রিরংসা,হিংসার আশ্চর্য সহাবস্থানে বিতর্কিত শহর হয়ে ওঠে।দিনেন্দ্র চৌধুরীর গানে শুনি–“হায়,কইলকাতা বনাইল মোরে বোকা।/তিনশ বছর হয় রূপসীর চক্ষে লাগে রে,ধোঁকা।/খানাখন্দে ভইরা আছে পথ ঘাটের কী দশা/দিনের বেলায় গাঁইট কাটা যায়,রাইতে কামড়ায় মশা।”
আমাদের মনে পড়ে উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও বলেছিলেন,–“রেতে মশা দিনে মাছি/এই নিয়ে কলকেতায় আছি।”
ফ্ল্যাট-অধ্যুষিত কলকাতাকে দেখে নচিকেতার গান,”ভিড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে/চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনা রোদ।”এই কংক্রিটের জঙ্গলে একটু সবুজ তাই বড়ো দামি।শিলাজিৎ ও দেখতে পান–“শাসন রেশন কাপড় চাল/
রাজনীতিতে নোংরা চাল/ধুলো-ধোঁওয়া এ জঞ্জাল /তবুও হাল ছাড়ছি না।”
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘শোনো বন্ধু শোনো,প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’ গানটিতে (শাপমোচন সিনেমা ) কংক্রিটে বন্দী কলকাতার মর্মব্যথা খুঁজে পাই।
আবার কবীর সুমন দেখেছেন অধিকাংশ নাগরিক জীবনযাত্রা ‘দশফুট’ বাই ‘দশফুট’ ঘরে বন্দী।তবে মান্না দে-র গানে ও গলায় (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা) ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ অত্যন্ত নস্টালজিক, সেইসঙ্গে কলকাতার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিশ্বস্ত ছবি।যেমন–“একটা টেবিলে তিন-চার ঘন্টা/চারমিনার ঠোঁটে জ্বলত,/কখনো বিষ্ণু দে কখনো যামিনী রায়/এই নিয়ে তর্কটা চলত।”
সুমন চট্টোপাধ্যায় ওরফে কবীর সুমনের সাথে কলকাতার নানা চিত্র,ঘটনা স্থান পেয়েছে।অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ সেইসব বর্ণনা,কথা।
১.দরজায় আছে নশ্বর লেখা
তাই দেখে দেখে ঠিকানাটা শেখা
যদিও বাসার আসল ঠিকানা
দশফুট বাই দশফুট।
২.গড়িয়াহাটের মোড়
মিনি মিনি বাস বাস
বাসের টার্মিনাসে
মনমরা সারি সারি
মুখ চোখ নাক হাত
রোগা রোগা চেহারার কন্ট্রাক্টর সব
আমাদের জন্য।
তাঁর অনুসরণে বাংলা গানে জীবনমুখী ভাবনা এনেছিলেন নচিকেতা,শিলাজিৎ,অঞ্জন দত্ত,অনুপম রায় প্রমুখ শিল্পী।
শিলাজিৎ লেখেন–
১.ব্রিগেডের বিক্ষোভে বি-গ্রেড নেতার ঘ্যানঘ্যান বুকনি
ডালহৌসিতে পচা ছানার সন্দেশ হাফ বয়েল ঘুগনি
ভিক্টোরিয়াতে খাকি পোশাকে ছেলেধরাদের রাজ
২.প্রোমোটারের জ্বালচ উঠছে ভোরবেলা
ব্রিগেড করে দাও বৃন্দাবন।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যাণ্ড-খ্যাত গৌতম চট্টোপাধ্যায় আরেক নতুন সুর ও স্বর নিয়ে আসেন।যাঁর উত্তরসূরি চন্দ্রবিন্দু ইত্যাদি।
গৌতমের গানে পাই–
ফুটপাত ঘেঁষা বেলুন বাড়ি
সুতো বাঁধা যত লাল আর সাদা।
ওরাই আমার থতমত এই শহরের রডোডেনড্রন
তোমায় দিলাম।
কিংবা বলেন,
নীল আলো চেনালো কলকাতা
হাওয়া আর মন্ত্র দিল কানে,
তোমায় নিয়ে বিপদ বড়
কোথায় তোমায় খুঁজি।
‘চন্দ্রবিন্দু’ কলকাতার মশা মাছি,পুলিশের হ্যাপা নিয়ে গান বাঁধে ‘আমার শহর’।–
জুড়ি গাড়ি হাঁক জমে যাবে জাঁক
কলকাতা কলকাতাতেই আমার শহর।
কলকাতার জন্মের তিনশ বছর পূর্তিকে অভিনন্দন জানিয়ে বেশ কিছু গান লেখা ও গাওয়া হয়েছিল।যেমন,
১.বুকের মধ্যে কুলুকুলু গঙ্গা ভাগীরথী
এই আমাদের কোলকাতা
প্রিয়তমা কলকাতা (গায়ক-ভূপেন হাজারিকা)
২.কোলকাতা,কোলকাতা,কোলকাতা
তিনশ বছর ধরে করলে লালন
স্নেহময়ী তুমি মা মমতাময়ী জননী
সবার আপন সবার স্বজন।
(পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গানটি সমবেত গীতে)
৩.কিছু প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা দিয়ে পড়া
আধুনিকতা রূপকথা
কোলকাতা কোলকাতা।(গায়িকা-ইলা বসু)
ঊষা উত্থুপও গেয়েছিলেন ‘সুন্দরী কলকাতা’ গান,কবি শ্রীজাত প্রেমের অনুবাদে কলকাতার পটভূমি এনেছেন সুন্দরভাবে–
চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন,
আর কবিতায় শুয়ে কাপপ্লেট।
কবি ও শিল্পীদের কাব্যে,গানে আজও কলকাতা চিরযৌবনা,অফুরন্ত আবেগ।
[সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
তরুণ মুখোপাধ্যায় জন্ম ১৯৫৬ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার ইন্দ্রাণী গ্রামে।স্কুল ও কলজের পাঠ নিয়েছেন বহরমপুরে।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক সহ বাংলা সাহিত্যে এম. এ।অধ্যাপক অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে ‘বাংলা কাব্যনাট্য:রূপ ও রীতি'(১৯৯১) বিষয়ে পি.এইচ.ডি উপাধি অর্জন।পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা সাহিত্য বিভাগের প্রধান হিসাবে।সত্তরের দশকের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও প্রাবন্ধিক ও সমালোচোক হিসাবে তাঁর প্রতিভা ঈর্ষণীয়।শিক্ষক ও বাগ্ণী হিসাবেও তিনি নন্দিত।সমকালীন সাহিত্যিক দের নিয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন।কবিতা,গল্প,উপন্যাস,নাটক,প্রবন্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা দ্বিশতিধিক।আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন স্বর্ণপদক,আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় স্মারক সম্মান,মহাদিগন্ত সম্মান,বিনয় মজুমদার স্মারক সম্মান,বাসভূমি জীবনকৃতি পুরস্কার তাঁর সাহিত্য চর্চার স্বীকৃতি।
ঋণ:’এবং অধ্যায়’]
