| 20 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা বিশেষ রচনা: নবপত্রিকার ধারাস্নান – গীতবাদ্যে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত 

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

পুজোর গান মানে আমরা সাধারণভাবে বুঝি দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে গান গাওয়া হয় সেইসব গান যেমন মহালয়ায় ‘বাজল তোমার আলোর বেণু!’ বা ‘ওগো আমার আগমনী আলো!’ বা এখনকার গান যা লোকের মুখে মুখে ফেরে ‘দুগগা এলো দেখে যা লো’ ইত্যাদি!

একটু বর্ষীয়ান মানুষরা বলেই থাকেন “আজকাল আর পুজোর গান হয় কই? ছিল সে আমাদের কালে, এইচ এমভি শারদ অর্ঘ্য বেরোত। কী সব সেই গান!”

দুর্গাপূজার বিভিন্ন স্তব বা চণ্ডীপাঠ অনেক সময়ই সুর সহকারে পাঠ করা হয়। অনবদ্য সেই চণ্ডীপাঠ মানেই আমাদের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের কথা মনে হয়। কিন্তু সে পাঠ রাগভিত্তিক নয়, সুসংবদ্ধ পাঠমাত্র। 

আবার ঢাকের বোল ছাড়া কি আর দুর্গাপুজো হয়? ঢাক ঢোল কাঁসর এ তো দুর্গাপুজোর অঙ্গ। ঢাকে কাঠি পড়া মানেই মা দুর্গা এলেন!

অবশ্যই তাই! ঢাকের বাজনা আর মায়ের আগমন যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

 

তবে প্রাচীনকালে জগন্মাতার পুজোর বিশেষ একটি অঙ্গ বা আচার পালনে ভারতীয় মার্গ সংগীত আর তার রাগ রাগিণীর অনন্য ভূমিকা ছিল। 

কী সেই আচার আর কীভাবে সেই আচারে রাগ রাগিণীর ব্যবহার করা হত সেটাই এই প্রবন্ধে আলোচনার বিষয়।

 

সপ্তমীর সকালে নব পত্রিকা বা কলাবউ স্নান করানোর কথা তো সবার জানা। বারোয়ারি পুজোতে সম্ভব না হলেও কিন্তু বাড়ির পুজোগুলিতে সমারোহের সঙ্গে এই আচার পালন করা হয়। 

এই নব পত্রিকা নদী বা পুকুরে স্নানের পর যখন গৃহে প্রবেশ করবেন তখন আবার অষ্ট কুম্ভ বা আটটি কলসের জল দিয়ে তাঁকে ধারাস্নানের বিধি বর্ণিত আছে কালিকা পুরাণে। এই বিধির উদ্দেশ্য ছিল যে নবপত্রিকাকে প্রতিমার সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে আট প্রকার পবিত্র বারি ধারার পূত ধারারসে সিঞ্চিত করে শুদ্ধ ও পরিশীলিত করে নিতে হবে। 

এই আটটি কলসের জলই শক্তিময়ী বারিধারারূপে বিবেচিত হবে আটটি স্তবের মাধ্যমে আর, এই স্তবের সঙ্গে আটটি ভিন্ন ভিন্ন রাগিনীতে বাজবে বাদ্য। 

আসুন জেনে নেওয়া যাক একে একে। 

 

প্রথম কলসে যে জল আছে তা স্বর্গ গঙ্গার। মালব রাগে বিজয় বাদ্য মানে ঢাক কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর দেবগণকে আহবান জানানো হয় তাঁরা যেন এই স্বর্গ গঙ্গার জল দিয়ে নবপত্রিকাকে পবিত্র করে তোলেন!

দ্বিতীয় কলসের জল মেঘ নিঃসৃত বারি বা বৃষ্টির জল। দুর্গাস্তবে বর্ণিত আছে ললিত রাগে দুন্দুভি বাজিয়ে ভক্তিভরে মরুৎগণ দেবী সুরেশ্বরীকে সিঞ্চিত করুন। 

তৃতীয় কুম্ভ পরিপূর্ণ পূত সরস্বতী নদীনীরে। বিভাস রাগে দুন্দুভি বাজবে তখন নবপত্রিকা সিক্ত করবেন বিদ্যাধরগণ সেই ধারাজলে।

চতুর্থ ঘটে আছে সমুদ্রের জল। ভৈরব রাগে ভীম বাদ্য রণিত হবে আর ইন্দ্রসহ সমস্ত লোকপালক অর্থাৎ রাজারা নবপত্রিকাকে সযত্নে সিঞ্চিত করবেন সেই জলে।

কেদার রাগে দেবরাজ ইন্দ্রের অভিষেকের সময় যে বাদ্য বাজে সেই বাদ্য সহযোগে পদ্ম পরাগ মিশ্রিত পঞ্চম কলসের জল দিয়ে স্নাত হবেন নবপত্রিকা নাগগণের দ্বারা। 

ষষ্ঠ যে কলস, যা পরিপূর্ণ আছে ঝরনার জলে সেই বারি দিয়ে হেমকূট হিমবৎ এই সব পর্বত নবপত্রিকাকে সিক্ত করবেন। এই সময় বড়াটি রাগিণীতে বাদ্য বাজানো হবে ।

সপ্তম কলসটি পরিপূর্ণ তীর্থ বারি দিয়ে, সকল তীর্থ হতে সংগ্রহ করা হয়েছে যে পবিত্র বারি, তাই রয়েছে সপ্তম কলসে। বসন্ত রাগে পঞ্চশব্দ ধ্বনিত হবে। সপ্ত ঋষিগণ নবপত্রিকারূপী দেবী সুরেশ্বরীকে সিঞ্চিত করবেন।

ধানসী বা ধানেশ্রী রাগ অবলম্বনে বিজয় বাদ্য বাজবে-  অষ্টম অর্থাৎ শেষ কুম্ভটি যা শুদ্ধবারি দিয়ে পরিপূর্ণ, সেই পুণ্যবারিতে অষ্টবসুগণ মা দুর্গাকে অভিষিঞ্চিত করবেন। 

এই স্তবগুলিতে মোটামুটিভাবে মোট ছয় প্রকারের বাদ্যের উল্লেখ আছে। 

বিজয় বাদ্য 

দুন্দুভি বাদ্য

ভীমবাদ্য

ইন্দ্রাভিষেক বাদ্য

শঙখ ও পঞ্চশব্দ বাদ্য।  

পঞ্চশব্দ আসলে পঞ্চমহাশব্দ, যা সে যুগে কেবলমাত্র একচ্ছত্র সম্রাট ছাড়া কেউ ব্যবহার করতে পারতেন না।

এই পাঁচটি শব্দ হল,

স্বরজ -মানুষের স্বরের সাহায্যে উৎপন্ন সুর বা গান

ধাতব -কাঁসা বা পিতলের বাদ্য যেমন কাঁসি, ঘন্টা ইত্যাদির ধ্বনি

ভেরী -চামড়া দিয়ে তৈরী বাদ্যযন্ত্র ঢাক ঢোল ইত্যাদির শব্দ

আর তূর্য মানে বাঁশি সানাই এর সুর।

কয়েকটি রাগ অধিক পরিচিত নয়। অনেকগুলিই বিশ্রুত। যেমন মালব বরাটি ও ধানেশ্রী।

বাকি রাগগুলির সম্বন্ধে ধারণা দিতে এক একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপমা রাখছি, তাহলে সাধারণ পাঠকের মনে কিছুটা ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। 

বিভাস    হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ভেসে যায়

ললিত    পুষ্পবনে পুষ্প নাহি

ভৈরব    ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর-মাঝে

কেদার   আমার মুক্তি আলোয় আলোয় (মিশ্র কেদার) 

 

দুর্গাপূজা করতেন রাজা রাজড়ারা। তাই এই সমস্ত আচার এবং উপচার সমস্ত কিছুই নিঁখুতভাবে নিপুণতার সঙ্গে পালন করা হত। 

ভারতের সঙ্গীতে রাগসাধনার ঐতিহ্য প্রাচীন। তাই মহামায়ার পূজার্চনায় সেই সুরমাধুরীর ব্যবহৃত হবে এটা নিশ্চিত। তাই পূজায় উপাসক পুরোহিতই রাগরাগিণীর গায়ন ও বাদ্যের সুচারু ব্যবস্থা করতেন। কালের নিয়মে পৌরোহিত্যের সে মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে আবার অর্থাভাবে পূজা আয়োজনও সঙ্কুচিত হয়েছে। তাই সে অনুপম পূজা আয়োজন থেকে আমরা আজ বঞ্চিত।

 

তথ্যঋণঃ.১। কালিকা পুরাণ

             ২। বন্দ্যোপাধ্যায় অর্ধেন্দুকমার। দুর্গাপূজায় সঙ্গীতের স্থান।

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত