| 24 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

গল্প: মরিবার হল তার সাধ । আহমাদ মোস্তফা কামাল

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

[আহমাদ মোস্তফা কামাল বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক। তার লেখালেখির শুরু ১৯৯০ দশকের শুরুতে। প্রথম গল্পগ্রন্থ দ্বিতীয় মানুষ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। এরপর আরো ৯ টি গল্পগ্রন্থ, আটটি উপন্যাস, একটি নভেলা, চারটি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং দুটি মুক্তগদ্যের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন আরো ১১টি গ্রন্থ। পেয়েছেন প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার, কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কার এবং সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার। আহমাদ মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলায়। আজ তাঁর জন্মতিথি ইরাবতী পরিবার তাকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা। ]

কেউ যদি মরতে চায়, তাহলে সে মরবার জন্য কোনো একটা পদ্ধতি বের করে নেবেই, মুরাদের খবরটা শুনে এই কথাটিই আবার মনে হলো আমার। বাঁচতে চেয়েও বেঁচে থাকতে পারেনি জগতে এরকম উদাহরণ অসংখ্য, কিন্তু আন্তরিকভাবে মরতে চেয়েও মরতে পারেনি এরকম উদাহরণ নেই বললেই চলে। সত্যি বলতে কী, মুরাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে এবং সে বিনা-দ্বিধায় এই রায় মেনে নিয়েছে, এমনকি উচ্চ আদালতে আপিল জানাতেও রাজি হয়নি–এসব খবরের কোনোটাই আমাকে বিস্মিত করেনি।
এরকমই হবে, তা-তো জানাই ছিলো, অন্যরকম হবার কোনো সুযোগ মুরাদই রাখেনি। ঠাণ্ডা মাথায় একটা খুন করেছে সে, নিজেই থানায় গিয়ে ঘটনাটা পুলিশকে জানিয়েছে এবং পুলিশ ও আদালতের জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার অনুপূঙ্খ বিবরণ দিয়েছে–ফাঁসি দেয়া ছাড়া জজ সাহেবের সামনে তো কোনো পথই খোলা ছিলো না! আমি এ-ও জানতাম, ফাঁসি কার্যকর করার আগে ওকে যখন শেষ ইচ্ছে পূরণের সুযোগ দেয়া হবে, মুরাদ তখন আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে। হলোও তাই। জীবনের অনেকগুলো দিন, বিরোধপূর্ণ স্বভাব নিয়েও, আমরা পাশাপাশি কাটিয়েছি। যাবার আগে সে কি আমার সঙ্গে শেষ কথাগুলো না বলে যেতে পারে! অবশ্য আমি খুব বেশি কৌতূহল বোধ করছি না। ওসব কথা জানলেই কী, না জানলেই কী, কোনোটাতেই কিছু যায় আসে না। তবু আমি ওকে দেখতে যাবো, ওর কথা শুনবো। আমাদের দুজনের মধ্যে সে চিরকাল কথক আর আমি শ্রোতা–সারাজীবন সে কেবল বলে গেছে আর আমি শুনে গেছি। ওর তাই বলার অধিকার জন্মেছে আর আমার হয়েছে শোনার স্বভাব। ওই যে বলেছি–আমরা প্রায় বিরোধপূর্ণ স্বভাবের লোক। সেটাও আজকে থেকে নয়–সেই ছোটবেলায়, ওর সঙ্গে পরিচয় হবার সময় থেকেই ব্যাপারটা এরকম। সে ছিলো ভীষণ দুরন্ত, আর আমি শান্ত-শিষ্ট-গুডি বয়। অবশ্য আমাকে বাধ্য হয়েই ওরকম হতে হয়েছিল–আমি ছিলাম রোগে ভোগা জীর্ণ-শীর্ণ দুর্বল বালক, আর মুরাদ স্বাস্থ্যবান-উচ্ছ্বল। ওর মতো আমারও দুরন্তপনার ইচ্ছে জাগতো, পারতাম না, শরীরে সহ্য হতো না, অল্পে হাঁপিয়ে উঠতাম, জ্বর-টর এসে একাকার হয়ে যেত। বড় হয়েও অবস্থা পাল্টায়নি। আমার অসুস্থতা কমেনি, বরং পত্রপল্লবে বিকশিত হয়েছে, আর মুরাদ হয়েছে আরও স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন, সুপুরুষ। জীবনকে সে ইচ্ছেমতো ভোগ করেছে, আকণ্ঠ পান করেছে যাবতীয় গরল ও সুধা। আমি এসবের কিছুই পারিনি। তবু আমার মনে হয়, এতসব ভিন্নতা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে গভীর কিছু মিল আছে। এই যেমন, মুরাদ যা যা করতো আমারও সেগুলো করতে ইচ্ছে হতো, পারতাম না সেটা ভিন্ন ব্যাপার। আমার মতো ওরও রাগ-অভিমান-আবেগ-ভালোবাসা খুব তীব্র, পার্থক্য শুধু এই যে, সে সেগুলো প্রকাশও করে তীব্রভাবেই, আর আমি একেবারেই প্রকাশ-অক্ষম।

একটা ঘটনা বললে ওর এই তীব্র আবেগের ব্যাপারটা বোঝা যাবে। আগেই বলেছি–ছোটবেলা থেকেই আমি রোগে-ভোগা মানুষ, এজন্য মুরাদ আমার প্রতি খুব খেয়াল রাখতো। আমার অনেক রোগের একটা–আমি মাঝে মাঝে মাইগ্রেনে আক্রান্ত হই। তীব্র মাথাব্যথায় আমার সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়, গভীর এক আচ্ছন্নতা আমাকে ঘিরে ধরে, আলো-শব্দ অসহ্য বোধ হয়, এবং প্রচুর বমি হয়। তো, একদিন এরকম আক্রান্ত অবস্থায় আমাকে বাইরে থেকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য আমার সঙ্গে আসছিল মুরাদ। কিন্তু পৌঁছানোর আগেই পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটে–আমি একজন লোকের গায়ের ওপর বমি করে দেই। অনিচ্ছাকৃত, বলাইবাহুল্য। কেউ কি ইচ্ছে করে কারো গায়ের ওপর বমি করে? সামলাতে পারিনি বলে দুর্ঘটনাটা ঘটে গেছে। কিন্তু লোকটা তা বুঝতেই চায় না। আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে গিয়ে যতই তার কাছে দুঃখপ্রকাশ করি, যতই বিনয়ে গলে গিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করি সে ততই রাগতে থাকে। মুরাদ আমার অসুস্থতার কথা বলে তার মন গলাবার চেষ্টা করে, ওর কণ্ঠেও মিনতি, ক্ষমাপ্রার্থনার সুর, কিন্তু লোকটির রাগ বেড়েই চলে। একসময় রাগ সামলাতে না পেরে সে এসে আমার গালে প্রচণ্ড জোরে চড় লাগায়। এমনিতেই দুর্বল লোক আমি, তার ওপর মাথাব্যথায়-বমিতে অবসন্ন, ওই ভয়াবহ চড় খেয়ে তাই মাথা ঘুরে পড়ে যাই। জ্ঞানও হারিয়ে ফেলি তৎক্ষণাত। যখন জ্ঞান ফেরে, দেখি, লোকটিও আমার পাশে শুয়ে আছে, তার মুখমণ্ডল রক্তাক্ত আর মুরাদ তার গলার ওপর পা রেখে ভয়ংকর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দুর্বল কণ্ঠে ‘মুরাদ’ ‘মুরাদ’ বলে ডাকতেই আমার দিকে ঝট করে তাকায় সে, যেন এতক্ষণ আমার কথা ভুলেই ছিলো এমন ভঙ্গিতে পাগলের মতো ছুটে এসে আমাকে তুলে নেয়। উঠে দাঁড়াতেই দেখলাম, চারপাশে জনতার ভিড়, এমন ঘন হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়েছে যে, বেরুনোর উপায় নেই। মুরাদ জনতার উদ্দেশ্যে প্রকাণ্ড এক ধমক লাগায়, লোকজন সভয়ে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়, আর আমি ওর সাহস দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। মনে হয়, জনগণ ওর মতো সাহসী মারদাঙ্গা স্বভাবের মানুষকে ভয় পায়, সমীহ করে–আমার মতো অসহায়, দুর্বল লোককে করুণাও করে না। যাই হোক, এই ঘটনাটি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল–ওর রাগ কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, আর আমার জন্য ওর ভালোবাসা কত তীব্র!

মানুষ যে কেন তার বিপরীত স্বভাবের লোকদেরকে এত পছন্দ করে, ভালোবাসে–আমি এখনও সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। নিজের মধ্যে যা নেই, বিপরীত স্বভাবের লোকটির মধ্যে সেগুলোর উপস্থিতি দেখতে পায় বলে? বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ-ভালোলাগা-প্রেমও কি ওই একই কারণে? যাহোক, মুরাদকে নিয়ে এরকম ঘটনা আরো অসংখ্য, বলে শেষ করা যাবে না, তারচেয়ে বরং ওর এই পরিণতির কথা বলি। ছোটবেলা থেকেই সে দুরন্ত ছিলো সেটা তো আগেই বলেছি, কৈশোরোত্তীর্ণ সদ্য যৌবনে সেটা পরিণত হলো অস্থিরতায়। কোথাও যেন থিতু হয়ে দুদণ্ড বসতে পারছে না, এমনই ছিলো ওর হাবভাব। আমি ছিলাম ঘরকুনো স্বভাবের, আর ও ঘরে থাকতেই পারতো না। আমাদের বাসায় এসে প্রায় জোর করেই আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তো–তারপর উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো, অবিরাম, দীর্ঘ সময় ধরে। কোথাও একটু বসতোও না সে, সম্ভবত ওর যাবার কোনো জায়গাও ছিলো না, কিংবা কোথাও যেতেই চাইতো না–একটু দার্শনিকভাবে বলা যায়, ওর কখনো কোনো গন্তব্য ছিলো না, তাই এমন ছুটে বেড়ানো। কোনোকিছুই কি ওকে আকর্ষণ করতো না–পরে আমি এ কথা অনেক ভেবেছি। অবশ্য সে অনেক পরের কথা, ততদিনে আমি ঘরে বসে থাকতে থাকতে ভাবাভাবি ছাড়া আর কোনো কাজ না পেয়ে প্রায় ভাবুকে পরিণত হয়ে গেছি। তো, এভাবে অস্থিরচিত্তের মতো ঘুরতে ঘুরতেই, কখন জানি না, মেয়েরা মুরাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়। কিন্তু সেখানেও সেই অস্থিরতার গল্প। কারো সঙ্গেই তার সম্পর্ক বেশিদিন টেকে না। কিছুদিন কোনো একজনকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে, এমন এক বিপুল আবেগে ভেসে যায় যে মনে হয় এমন করে কেউ কোনোদিন কারো প্রেমে পড়েনি, তারপর একদিন অবধারিতভাবে সব সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘোষণা করে আমার সঙ্গে গল্প করতে আসে। মেয়েটার সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা থেকে শুরু করে সমাপ্তি পর্যন্ত আদ্যোপান্ত আমাকে বলে যায়–আমি আদৌ শুনতে চাই কী না তার তোয়াক্কা না করেই। তবে আমার শোনার আগ্রহ ছিলো নিশ্চয়ই, এবং সে সেটা বুঝতেও পারতো। আমার জীবনে প্রেম নেই, ওর দুর্দান্ত সব গল্পে এক ধরনের নিষিদ্ধ আনন্দ যে পেতাম না, তা বলা যায় না। আর ওর বর্ণনা ছিলো দৃশ্যবহুল–এমনকি শারীরিক সম্পর্কগুলোর কথাও সে বলতো দ্বিধাহীনভাবে, রাখঢাক না করেই। সবার সঙ্গেই শরীর বিনিময় করতো মুরাদ–ওর এই স্বভাব দেখে অনেকবার ভেবেছি, ওর প্রেম কি তবে কেবলই শরীরকেন্দ্রিক ছিলো? আমার এরকম ভাবনার পেছনে কারণ আছে। ওর সংখ্যাহীন প্রেমের মধ্যে বেশ কয়েকটি পরকীয়া। আমার ধারণা, এদেশে পরকীয়া প্রেম গড়ে ওঠে শরীরকে কেন্দ্র করেই। এ ধরনের প্রেমের ক্ষেত্রে মেয়েদের ভাবনায় কী থাকে আমি জানি না, সম্ভবত সেখানে শরীরটা মুখ্য নয়, হয়তো তাদেরকে গতানুগতিক অসুখী দাম্পত্য জীবনের গ্লানি থেকে সাময়িক মুক্তি এনে দেয় এই প্রেম, এবং বিনিময়ে সে প্রেমিককে উপহার হিসেবে দেয় তার মহামূল্যবান ‘সতীত্ব’ এবং শরীর, কিন্তু ছেলেদের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে কেবলই মেয়েটির শরীর, অন্যকিছু নয়। মুরাদের প্রেমগুলোও ওরকমই ছিলো। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন আবার আমার পরিচিত। মুরাদ যখন সেইসব আকর্ষণীয় রূপসীদের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের প্রায় সচিত্র বিবরণ দিতো, আমি ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফেটে পড়তাম, আর–বাঙালি ছেলেরা যা করে–অবদমনের নামে নিজেকে বইয়ে দিতাম। কিন্তু এভাবে কতদিন অবদমন করা যায়? আর তাছাড়া জীর্ণ-শীর্ণ-দুর্বল হলেও আমি তো জৈবিক চাহিদাসম্পন্ন মানুষ, পারিবারিক চাপও অবশ্য একটা কারণ, তাই একসময় বিয়ে করে ফেললাম। আমার বিয়ের ঘটনাটি খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়, অনেক বদ্ধ উন্মাদকেও তো বিয়ে করতে দেখেছি–যাদের হয়তো পাগলাগারদে থাকার কথা তাদেরকে দিব্যি সন্তান উৎপাদন করতে দেখেছি, সেই তুলনায় আমি তো রীতিমতো সুপুরুষ! কিন্তু আমার জন্য বিস্ময়কর ছিলো মুরাদের বিয়ে করার ব্যাপারটি। শারীরিক প্রয়োজনে বিয়ে করার কথা নয় ওর, একের পর এক শরীর সে পেয়ে যায়, যাকে চায় তাকেই পায়। তাহলে বিয়ে করলো কেন? তা-ও হঠাৎ করে? নাকি কোনো ট্র্যাপে পড়েছিল? জীবনে কোথাও যাকে স্থির হয়ে দুদণ্ড বসতে দেখিনি, সে ঘরকুনো মানুষের মতো ঘরসংসার করবে, চাকরি করবে (অবশ্য তার চাকরি না করলেও চলে, খুবই স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে সে, বাপের হোটেলে সারাজীবন খেলেও এতটুকু কমবে না), বাজার-সদাই করবে, সন্তান উৎপাদন করবে–এ তো ভাবাও যায় না। বিয়ের পর ওর বাসায় গিয়ে অবাক হয়েছি। রীতিমতো সংসারী মানুষের মতো গুছিয়ে বসেছে–এমনকি আমার বাসায় আসাও কমিয়ে দিয়েছিল মুরাদ। কখনো এলেও সংসার নিয়ে, বউ নিয়ে এমন উচ্ছ্বাসময় আবেগ প্রকাশ করতো যে অবাক হয়ে যেতাম। ওর মধ্যেও এমন একজন সংসারী মানুষ লুকিয়ে ছিলো, তা কে জানতো! ওর এমন এক্সপ্রেশন দেখে আমি অবশ্য অভ্যস্ত। সে আমার কাছে তার যতগুলো প্রেমের কথা বলেছে, সবগুলোর ব্যাপারেই তুমুল উচ্ছ্বাস আর গভীর আবেগ প্রকাশ করেছে। যেন প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম, প্রতিটিই নতুন, আনকোরা। কিন্তু সেগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী প্রেম, দ্রুত পুরনো হয়ে গেছে। কামনা করতাম বউয়ের সঙ্গে ওর প্রেমটা যেন স্থায়ী হয়, যদিও বউয়ের সঙ্গে স্থায়ী প্রেম পুরুষদের পৃথিবীতে দুর্লভতম ঘটনা বলে আমার ধারণা।

তো, এভাবেই চলছিল। অবশ্য কীভাবে চলছিল তা ঠিক জানি না, কারণ আমি নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। তাছাড়া, ঘরকুনো স্বভাবের বলেই হয়তো ওর বাসায় বহুদিন যাওয়া হয়নি, মুরাদও আসেনি, এমনকি ফোনেও কথা হয়নি। আমার ফোন-ফোবিয়া আছে, ফোনে কথা বলার চেয়ে পাহাড়ে ওঠা আমার জন্য সহজ। মুরাদের এই না আসাটা অস্বাভাবিক হলেও–আমার কাছে না এসে সে বেশিদিন থাকতে পারতো না–অবাক হইনি। ভেবেছি, সংসারে মজে গেছে, মজেই থাকুক। কিন্তু একদিন সকাল বেলা এসে হাজির হলো সে। ছুটির দিন ছিলো, ছুটির দিনে আমি একটু দেরি করে উঠি, ও এসে ঘুম ভাঙালো। ওর লাল টকটকে চোখ আর উসকোখুসকো চুল দেখে মনে হলো, সারারাত ও ঘুমায়নি, এবং কিছু একটা ঘটেছে। আসলেই তাই। ড্রয়িংরুমে ’আমার মুখোমুখি বসে ও বললো, ‘কাল রাতে রীনাকে খুন করেছি।’

(রীনা, ওর বউ)। আমি অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘ও আচ্ছা।’

ও আচ্ছা মানে? তুই বুঝতে পারছিস, আমি কী বলছি?

হ্যাঁ পারছি। তুই বলছিস, গত রাতে তুই রীনাকে খুন করেছিস।

হ্যাঁ।

এরপর আর কী কথা থাকে? আমরা দুজনেই তাই বহুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর সে নিজেই আবার বললো–কেন খুন করেছি জানতে চাইলি না!

আমি চুপ করে রইলাম।

অনেকদিন ধরেই ওকে খুন করতে ইচ্ছে করছিল–মুরাদই আবার বলতে শুরু করলো–আমার বহু ধরনের অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু খুন কখনো করিনি, কাজটা করতে কেমন লাগে সেটা খুব জানতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কীভাবে যে সেটা করা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না, মাথা থেকে চিন্তাটা সরাতেও পারছিলাম না। কালকে রাতে তাই কোনো ভনিতা না করে ওকে বললাম, তোমাকে খুন করতে ইচ্ছে করছে।

ঝগড়া হয়েছিল? –কিছু বলবো না ভেবেও মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।

আরে না। আমাদের কোনোদিনই ঝগড়া-টগড়া হয়নি, আমাদের দাম্পত্য জীবন খুবই মনোটোনাস ছিলো, বুঝলি–একেবারেই উত্তেজনা ছিলো না। (আমি আবারও ওর সঙ্গে আমার মিল খুঁজে পেলাম, আমারও কখনো বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয় না, আমাদের দাম্পত্য জীবনও খুবই মনোটোনাস, বিরক্তিকর, ক্লান্তিকর–একেবারেই উত্তেজনা নেই!) তো, আমার কথা শুনে ও বললো, ইচ্ছে করলে কর। আমি আর দেরি না করে ওর গলা টিপে ধরলাম–খুন করার আর কোনো পদ্ধতি তো জানি না, ভাবিওনি–ধরেই থাকলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না ওর শরীর এলিয়ে পড়লো। অসাধারণ অভিজ্ঞতা, বুঝলি। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ভাবলেও প্রতিটি রোমকূপ কেঁপে ওঠে। তারচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, রীনা তো প্রায় কুৎসিতই ছিলো, অথচ মৃত্যুর পর অসম্ভব সুন্দর হয়ে উঠলো। আমার কী মনে হচ্ছে জানিস? মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে মৃত্যুর মতো সুন্দর কোনোকিছু নেই, আর নিজে সুন্দর বলেই সে যাকে স্পর্শ করে তাকেও সুন্দর করে তোলে। তুই দেখবি রীনাকে? দেখবি, ওকে কী সুন্দর লাগছে!

না।

মুরাদের কথা আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। যে মানুষ এমন তুমুল প্রেমে পড়তে পারে, তার পক্ষে খুন করা সম্ভব নয় বলেই আমার ধারণা ছিলো। আর যদি সত্যিই ও খুন করে থাকে, তাহলে বলতে হবে–ও পুরোপুরি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কাছে খুন করার অভিজ্ঞতাকে রোমাঞ্চকর মনে হতে পারে না। আমার ‘না’ শুনে আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে উঠে দাঁড়ালো সে–‘যাইরে।’

কোথায় যাচ্ছিস?

থানায় যাই। ব্যাপারটা আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। এটা এখন পুলিশের ব্যাপার। তুই যাবি আমার সাথে?… না থাক, তোর এসব ঝামেলায় জড়িয়ে কাজ নেই।

আমি হয়তো যেতাম। কিন্তু তখন পর্যন্ত আমি মুরাদের কথাগুলো বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি, কৌতুক করছে–ওর যা স্বভাব। নিশ্চয়ই রীনার সঙ্গে যুক্তিপরামর্শ করে আমাকে বোকা বানাবার জন্য এই সাতসকালে এসে হাজির হয়েছে! ওর সঙ্গে বেরুলে নির্ঘাৎ বাসায় নিয়ে যাবে এবং রীনা আর মুরাদ মিলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। কিন্তু ঘটনাটা সেরকম ছিলো না।

মুরাদ আমার বাসা থেকে বেরিয়ে সত্যি থানায় গিয়ে ঘটনাটি জানায় এবং অপরাধ স্বীকার করে। পরদিন খবরের কাগজে ছবিসহ তার খবর বেরোয়। অবশ্য কাগজওয়ালারা ব্যাপারটা নিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেনি, ঘটনার সঙ্গে কোনো স্ক্যান্ডালের যোগসূত্র না পাওয়ায় তাদের সম্ভাব্য ব্যবসা মার খেয়ে যায়। তারপরের ঘটনা তো বলেছিই।

এখন সে ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছে। দিন ঘনিয়ে এসেছে। তার ভাষায় ‘সুন্দর মৃত্যু’ তাকে স্পর্শ করবে।

আমি একদিন দেখা করতে গেলাম। এটা ছিলো আমার জন্য এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আমি এমন একজন মানুষের সঙ্গে দেখা করতে গেছি যে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। মানুষ তো তার অনিবার্য মৃত্যুর কথা ভুলেই থাকে, মৃত্যুমুহূর্তেও বেঁচে ওঠার চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে কেমন হয় তাদের অনুভূতি যারা জানে আর মাত্র কয়েকদিন বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে মরতে হবে? ওর সামনে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলাম, মুরাদ–তোর মন খারাপ নাকি–এ কথা জিজ্ঞেস করার আগ পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি যে, আমার মন খারাপ লাগছে। নিশ্চয়ই চোখেমুখে মন খারাপের ছাপ পড়েছে, নইলে ও বুঝলো কীভাবে? আমার জানতে ইচ্ছে করছিল অনেককিছুই, বলতে ইচ্ছে করছিল অনেক কথা, কিন্তু স্বভাবসুলভভাবেই আমি চুপ করে ছিলাম।

তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল–মুরাদ বললো–তোর কাছে এখনও আমার অনেক কথা বলার আছে।

সেই অনেক কথা শুনে আমার লাভটা কী, সেকথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না, বরাবরের মতো ওকেই কথা বলতে দিলাম। আমাদের দুজনের মধ্যে একটা খেলা চলছে, সেই খেলায় কার কী ভূমিকা সেটা আমাদের জন্মমুহূর্তেই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, এতদিন পর এসে সেই ভূমিকা পাল্টানো যায় না, খেলার নিয়মও ভাঙা যায় না।

আমি কেন এমন একটা কাজ করলাম, এ নিয়ে তুই কিছু ভাবিসনি?

না।–মিথ্যে কথা, বলাইবাহুল্য। আমি পারিই শুধু ভাবতে। ভেবেছিও অনেক, কোনো সদুত্তর পাইনি।

কখনো ভাবিসনি, কেন আমি এমন একটা অস্থির-অস্বাভাবিক জীবনযাপন করে গেলাম?

এসব প্রশ্ন করছিস কেন?

কখনো করিনি তো! তুইও কখনো কিছু জানতে চাসনি। আমি যে তোকে এত কথা বলতাম, তোর মধ্যে এসব নিয়ে কোনো কৌতূহল ছিলো বলে মনে হয় না।

আমি চুপ করে রইলাম।

তাহলে শোন–ও বলে চললো–জীবন থেকে আমি সবসময় পালাতে চেয়েছি। জীবন যে একটা ফাঁদ সেটা আমার অনেক আগে থেকেই মনে হতো, মিলান কুন্ডেরা পড়ে সেটা আরও পরিষ্কার হলো, ফাঁদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অবিরাম চেষ্টা করে গেছি এরপর। কিন্তু দেখেছি, এ থেকে মুক্তি নেই, জীবন জুড়ে একের পর এক ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। এক ফাঁদ থেকে পালালেও মানুষ অন্য একটাতে গিয়ে পড়বেই। বহুবার মরতেও চেয়েছি আমি। কিন্তু আত্মহত্যা করার মতো সাহস আমার ছিলো না। আত্মহত্যার সবগুলো পদ্ধতিকে মনে হতো ভয়ংকর, বীভৎস। আমি আসলে ভীতু প্রকৃতির মানুষ। পৃথিবীতে সে-ই সবচেয়ে সাহসী, যে আত্মহত্যার সাহস রাখে, সে-ই সবচেয়ে ভীতু যে সাহসটা রাখে না। রীনাকে যে খুন করলাম সেটা ভেবেচিন্তে করিনি, আমার পরিণতি কী হবে সেটা একবারও মাথায় আসেনি। কিন্তু ও মরে যাবার পর মনে হলো–আমার সামনেই অবধারিত, নিশ্চিত মৃত্যু অপেক্ষা করছে। সত্যিই তো তাই হলো! এখন আর আমার ফেরার পথ নেই, মরতে আমাকে হবেই। এত সহজে মৃত্যুর দেখা পাবো কখনো ভাবিনি। বেঁচে গেলাম, বুঝলি, দীর্ঘ জীবন বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা থেকে বেঁচে গেলাম। ক-ত-দি-ন ধরে এ জীবন বয়ে যাচ্ছি, আর সহ্য হচ্ছে না। বুঝতে শেখার পর থেকেই, জানিস, আই ওয়াজ…অ্যান্ড স্টিল আই অ্যাম টায়ার্ড অফ এভরিথিং…এভরিথিং…এভরিথিং…।

মুরাদ এমনভাবে এভরিথিং এভরিথিং বলতে লাগলো যে, মনে হলো আমিও ওই এভরিথিংয়েরই অংশ। আমি আর না দাঁড়িয়ে চলে এলাম। এবং আসতে আসতে–‘রীনা কেন মরে যেতে রাজি হয়েছিল’–দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়ানো এই প্রশ্নটিরও উত্তর পেয়ে গেলাম যেন। রীনাও, সম্ভবত, এইসব থেকে বাঁচতেই চেয়েছিল। যে জীবন সে যাপন করছিল তার থেকে মুক্তির জন্য এরচেয়ে ভালো পদ্ধতি আর কী হতে পারে? সম্ভবত সে-ও মুরাদের মতোই আত্মহত্যায় অপারগ ছিলো, তাই সুযোগ পাওয়া মাত্র গলাটা বাড়িয়ে দিয়েছিল মুরাদের খুনি হাতের সামনে। তাহলে, আর কী!

ওরা দুজনে মিলে যা করলো সেটাকে সমর্থনযোগ্য বলেই মনে হচ্ছে আমার। যার যেভাবে ইচ্ছে বাঁচুক, যেভাবে ইচ্ছে মরুক। এ ছাড়া আমার আর কী-ই বা বলার আছে!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত