| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

প্রবন্ধ: সাহিত্য, সমাজ ও জীবনেরই রক্ষাকবচ । রাজু আলাউদ্দিন

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

‘জীবন, সমাজ ও সাহিত্য’ এই শিরোনামে আহমদ শরীফের একটি প্রবন্ধ পাঠ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। প্রবন্ধটি ছাত্ররা বাধ্য হয়ে একসময় হয়তো পাস করার তাগিদে পড়তেন কিন্তু এর সঙ্গে জীবন ও সমাজের সম্পর্ক তাতে কতটা উপলব্ধি করতেন নিশ্চিত নই। শিরোনামের এই ভিন্ন অর্থের পরস্পর বিচ্ছিন্ন তিনটি শব্দের মধ্যে কোন বাস্তব সম্পর্ক আছে কিনা, এ নিয়ে লেখক শিল্পী ছাড়া অন্যদের ঘোরতর না হোক, অন্তত কিছুটা সন্দেহ তো আছেই। আছে যে তার একটা উদাহরণ আমরা এখনকার সাধারণ ‘জীবন’ ও ‘সমাজ’ থেকে দেয়ার চেষ্টা করতে পারি। সারা পৃথিবীতে শিল্প ও সাহিত্যের কদর এতটাই কমে গেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানবিক শাখায়, বিশেষ করে সাহিত্য বিভাগের তুলনায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্য শাখায় ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা অনেক বেশি। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেহারা এই অর্থে আরও করুণ। আমাদের এখানে সবচেয়ে খারাপ ছাত্রছাত্রীরা সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হতে বাধ্য হন আজকের জীবনে সাফল্যদায়ী অন্য বিভাগে ভর্তি হতে না পেরে। বাবা-মা’রা এমন সব বিষয়ে সন্তানদের পড়তে এবং ভর্তি হতে উৎসাহ দেন, যা তাদের দ্রুত আর্থিক সাফল্য ও নিশ্চয়তা দেবে। সাহিত্য যে জীবনে এবং সমাজে প্রয়োজন সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা তো নেই-ই, এমনকি থাকলেও, যেহেতু সাহিত্য পাস করে কোন মোটা অংকের চাকরি পাওয়া যাবে না, অতএব এই বিষয়ে তাদের আস্থাও নেই। সুতরাং সাহিত্য সম্পর্কে প্রায় লোক দেখানো একটা শ্রদ্ধা থাকলেও জীবনে এর প্রবেশকে মোটামুটি রুদ্ধ করে রেখেছেন এই ভয়ে যে সাহিত্য জীবনকে কোন কিছু দিতে তো পারেই না, বরং জীবনকে নিঃস্ব করে দেয়। এ রকম বিশ্বাসের বহু মানুষ মিলে যে সমাজটি আমাদের দেশে বিরাজ করছে তার চেহারা এবং মর্মটা আমরা আন্দাজ করে নিতে পারি সহজেই। যেহেতু সমাজ একটা বিমূর্ত জিনিস, তাই অনুমান করা ছাড়া আর উপায় কি। তবে এই অনুমান বিমূর্ত হলেও অবাস্তব নয়।

পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করে সাহিত্য সমালোচক ও দার্শনিক জর্জ স্টেইনারের একটা পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত করে ঔপন্যাসিক মারিও বার্গাস যোসা তার এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন যে,  The humanities now only attract mediocrities and the dregs of the university, while talented Young People flock to study the sciences. And the Proof of this is that the entrance requirements, for humanities departments in the best academic centers of England and United States have dropped to unseemly levels. (Mario vargas Llosa, The language of passion, Picador. 2003, P-114).

উপরোক্ত এই উদ্ধৃতিতে যে চিত্রটি আমরা পশ্চিমের শিক্ষাজগতে দেখতে পাচ্ছি তা কিন্তু আমাদের এখানকার শিক্ষাজগত থেকে ভিন্ন কিছু নয়। বিশ্বব্যাপী পুঁজির বাণিজ্যমুখী প্রবণতা মানুষের মনজগতে যে গভীর প্রভাব ফেলেছে তারই এক চিত্র আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। নগদ ও দ্রুত মুনাফার আকাক্সক্ষা মানুষের জীবনে এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে এখন মানবিক শাখার সব রকম প্রয়োজন হয়ে পড়েছে গুরুত্বহীন। এর ভয়াবহ ফলাফল হচ্ছে মানুষের মধ্যে মানবিক অনুভূতি ও সংবেদনশীলতার তীব্র সংকট। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নৈতিক মূল্যবোধের অভাব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক শাখার গতি এতটাই কম যে তা প্রায় চোখেই পড়ে না।

শিল্প ও সাহিত্য মানবিক শাখারই একটি অংশ। যদি শিল্প ও সাহিত্যের চোখ দিয়ে আমরা আজকের এই অবস্থার দিকে তাকাই তাহলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই একমুখী গতি আসলে মানুষের সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নে এক ধরনের স্থবিরতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্থবিরতা, কারণ সে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়’, একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু সে একা, তার সঙ্গে মানবিক শাখার দর্শন শিল্প ও সাহিত্য নেই। সাহিত্য আমাদের বর্তমানের অন্তর্নিহিত সংকট ও ভবিষ্যতের বিপর্যয়গুলো সম্পর্কে সতর্ক করে দেয় তার সংবেদনশীল মনের অ্যান্টেনায় প্রতিফলিত দৃশ্যের মাধ্যমে।

কাফফার বিচার উপন্যাসের জোসেফ কে’ চরিত্রটির কথাই ধরা যাক, যাকে গ্রেফতার হয় কিন্তু সে জানে না কোন অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হল। কিংবা তার রূপান্তর নামক বড় গল্পটিতেও আমরা দেখব যে গ্রেগর সাম্সা এক সকালে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে দেখে সে এক বিরাট পোকায় রূপান্তরিত হয়ে আছে। এই উদাহরণগুলোকে আমরা নিছক গল্প হিসেবে পড়ে নিশ্চয়ই বিপুল আনন্দ পাই। কিন্তু এই গল্পগুলো মানুষের ও সমাজের গভীর সমস্যাগুলোর ইঙ্গিত ধারণ করে আছে। আমরা সাহিত্য বা শিল্পকে যখন নিছকই বিনোদনের উপায় হিসেবে দেখি তখন এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটিকে এড়িয়ে যাই।

সাহিত্যের প্রবল পৃষ্ঠপোষক জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার মানুষের জীবনে ও সমাজে কবিতার প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন খুব গুরুত্বের সঙ্গে। আমরা সাহিত্যচর্চাকে যতই উদ্দেশ্যহীন কর্ম বলে মনে করি না কেন আসলে তা নয়। হাইডেগরের ভাষায় Poetry, however, is not an aimless imagining of whimsicalities and not a flight of mare notions and fancies into the realm of the unreal (Martin Heidegger. Poetry, Language, thought, Harper perennial, 2001-p-70)

যেমনটা ভাবা হয়ে থাকে যে সাহিত্য বা শিল্প এক ধরনের কর্ম যার কোন সামাজিক মূল্য নেই। কারণ সে সমাজের প্রত্যক্ষ কোন প্রয়োজনকে মেটায় না। সাহিত্য সম্পর্কে একেবারেই ভাসা ভাসা ধারণার কারণে আমাদের মধ্যে এসব ভুল বিশ্বাসগুলো গভীর হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক শাখাগুলোর কারবার যেহেতু বস্তুভিত্তিক প্রয়োজনকে ঘিরে, তাই মানুষের আÍিক সংকট ও বিপর্যয়গুলো সম্পর্কে লেখকরা আমাদের সতর্ক ও সজাগ করে দেন তাদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে। সাহিত্যের কাজ মানুষের সংবেদনশীলতাকে তীব্র করে তোলা, অনুভূতিকে প্রবল করে তোলা এবং নতুন নতুন সংবেদ ও মূল্যবোধকে সামনে নিয়ে আসা। স্বজ্ঞা ও কল্পনার মাধ্যমে লেখক এই কাজগুলো এমনভাবে করেন যাকে কখনও কখনও পাগলামি বলে ভ্রম হয়, যার তাৎক্ষণিক মূল্য নেই সমাজে ও জীবনে। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্য যে কোন শাখার চেয়ে সাহিত্যই সবচেয়ে বেশি সমাজ ও জীবন থেকে উৎসারিত। সমাজ ও জীবন সম্পর্কে সেই সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। আর পরিহাসটাও এই যে সাহিত্যই বেশি উপেক্ষিত মানুষের কাছে ।

বহু আগে সাহিত্যের পণ্ডিত ও গবেষক প্রয়াত আহমদ শরীফ তার ‘জীবন, সমাজ ও সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে এই কথাগুলো বিস্তারিত বলেছিলেন। শিল্প বা সাহিত্য যে জন্ম লগ্ন থেকেই মানুষের, সমাজের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে ব্যবহৃত হয়ে আসছে তা তিনি বলতে ভোলেননি। শিল্পকলা চিরকালই জীবন স্বপ্নের রূপায়ণ ঘটিয়েছে, জীবনের প্রয়োজনই মিটিয়েছে।

সাহিত্য যে মানুষের প্রয়োজনের বাইরে অবস্থান করে না তাও আহমদ শরীফ সংবেদনশীল মন দিয়ে বুঝেছিলেন। তিনি একই প্রবন্ধে আমাদের সে কথা জানাচ্ছেন এইভাবে :

‘কেননা মানুষের কোন কর্ম বা আচরণ প্রয়োজন নিরপেক্ষ হতে পারে না। এ প্রয়োজন অবশ্যই মানস অথবা ব্যবহারিক হবে। এ প্রয়োজন নিয়ম-নীতি-নিয়ন্ত্রণ মানে না।’

তার মানে সাহিত্য ‘নিয়ম-নীতি-নিয়ন্ত্রণ’পূর্ণ একটি সমাজ থেকে সৃষ্টি হওয়া এমন এক জিনিস যা উৎসের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যায়। যদি তা না ঘটত তাহলে সাহিত্যের কোন প্রয়োজন হতো না সমাজের। একটা সমাজ যখন নিয়ম-নীতির দাসত্বে অন্ধ অনুকরণ হয়ে পড়ে তখন তার মধ্যে জš§ নেয় কাফকার গ্রেগর সাম্সা। সাম্সা কেবল বিশাল আকারের এক পোকাতেই রূপান্তরিত হয়নি, এমনকি সে পোকায় পরিণত হওয়ার পরও তার যে অফিসে যাওয়া প্রয়োজন তাও সে ভুলতে পারে না। কাফকা এই সাম্সার মধ্য দিয়ে আমাদের এমন এক জীবন ও সমাজের ছবি এঁকেছিলেন যেখানে অদৃশ্য এক জাদুবলে আমরা পোকা ও চিন্তাভাবনাহীন এক প্রাণীতে পরিণত হয়েছি। সাহিত্য মানুষকে পোকা হয়ে ওঠা থেকে রক্ষা করতে চায়। সমাজকে সে নিপীড়ক এক অদৃশ্য যন্ত্র হওয়া থেকেও বিরত রাখতে চায়। এই কারণে সাহিত্য সবসময় আমাদের জন্য দরকারী। আহমদ শরীফ সাহিত্যের এই প্রয়োজন এবং জীবন ও সমাজের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্কটি খুব পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন। এই কারণে তার প্রবন্ধটি আমাদের কাছে আজও প্রাসঙ্গিক।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত