আকাশে ওড়ার দিনগুলো (পর্ব-৩)

Reading Time: 5 minutes
গত পর্বের পরে…
পর্ব-৩ 
দ্য গার্ল ফ্রম টুমোরোর এলানার কথা মনে আছে? অস্ট্রেলিয়ার এই সাই-ফাই টিভি সিরিজটি নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে আমাদের প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের কাছে বিপুল জনপ্রিয় ছিল। ভবিষ্যত থেকে এলানা টাইম ক্যাপসুলে করে বর্তমানে চলে এসেছিল। এলানার সাথে সাথে জেনি আর পিটারও আমাদের প্রিয় দুটি চরিত্র ছিল। কিন্তু সুপারপাওয়ারের অধিকারী এলানাকে আমরা অনেকেই আজো ভুলি নি। এলানার কপালে বাঁধা ব্যান্ডটি কিন্তু আজও আমার কাছে আরাধ্য জিনিস।
১৯ মার্চ সকালে ঘুম ভাঙার পর জানালা দিয়ে বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে সিডনির প্রথম সকাল দেখতে দেখতে আমার বার বার এলানাকে মনে পড়ছিল। বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা দ্বীপ, সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে চোখের পলকে আমি কোন সুদূরে চলে এসেছি! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল সবকিছু।

রোজ হিল রেসকোর্সের পাশে অবস্থিত এপিএক্স হোটেল এপার্টমেন্টসের জানালায় আছড়ে পড়ছিল সূর্যের নবীন আলো। ঝকঝকে সকালের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়েছি আর ভেবেছি আমি নির্ঘাৎ এলানার ভবিষ্যতের পৃথিবীতে চলে এসেছি। হুম, আমি টাইম ক্যাপসুলে করে ৩০০০ খ্রিষ্টাব্দের পৃথিবীতে চলে এসেছি! এ ঠিকঠাক এলানারই দেশ। এত সুন্দর! এত সাজানো। এই ধারণাটা আরও বদ্ধমূল হয়েছিল যখন সিটিতে গেলাম। যাহোক, সে গল্প পরে হবে।


ছবিঃ লেখক

১৯ মার্চ সকালে আমরা সিডনির নতুন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাসের অপেক্ষায় প্যারামাটার এপিএক্স হোটেল এপার্টমেন্টসের নিচে একে একে জমায়েত হচ্ছিলাম। আমার শরীরে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। রাতে ভাল ঘুম হয় নি। ঝুমা বললো, ’আপা এ হলো জেট ল্যাগ, টাইম জোন পাল্টে যাওয়ার ঝক্কি। কদিন থাকবে।‘
বাংলাদেশের সাথে সিডনির সময়ের পার্থক্য ৫ ঘন্টার মতোন, মানে সময়ঘড়িতে অস্ট্রেলিয়ার সময় বাংলাদেশের চেয়ে ৫ ঘন্টা এগিয়ে।
নতুন সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে ফিরে যাবার সময় এসে যাবে সে কথা মনে করিয়ে ঝুমা মিষ্টি করে হেসেছিল। তখন এপিএক্স হোটেল এপার্টমেন্টসের কাছাকাছি বাড়িগুলোর সামনে এক নতুন দৃশ্য দেখলাম। অনেক বাড়ির সামনে বিভিন্ন গৃহস্থালি জিনিস রাখা। এর মধ্যে চেয়ার, রাইসকুকার, ম্যাট্রেস থেকে শুরু করে ফুলদানিও আছে। আমি বললাম, ‘ঝুমা এত ভাল ভাল জিনিস ফেলে দিয়েছে!’ ঝুমা জানালো এরা অপ্রয়োজনীয় জিনিস এভাবেই ফুটপাতে রেখে যায়, কোনো মানুষ তার প্রয়োজন মনে করলে নিয়ে যেতে পারে আর অবশিষ্ট জিনিসপত্র সিটির গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যাবে।
কত কি যে দেখতে হবে ভেবে আমরা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের ৪০ জন সদস্য একে একে বাসে উঠলাম। আমি, ঝুমা, যুগ্ম জেলা জজ জসিম ভাই আর সিনিয়র সহকারী জজ আজাদ এই চারজন ছাড়া আমাদের দলের অন্যান্যরা আমাদের সিনিয়র সহকর্মী ছিলেন। তাই একটা চাপা ভয় আর সতর্কতা কাজ করছিল নিজের ভেতরে। কোন ভুলে কী ভুল হয়ে যায় তা ভাবতে ভাবতে আমরা চলছিলাম ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির প্যারামাটা ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে।

বাসে যাত্রার শুরুতেই নাহিদ ভাই আমাদের জানালেন, এখানে বাসে বা রাস্তায় যত্রতত্র কোথাও কিছু ফেলা যাবে না। এমন কি ক্যাম্পাসের রিসাইকেল বক্স আর রাবিশ বক্স দেখে আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের আবর্জনা নিজেকেই ফেলতে হবে।


ছবিঃ লেখক

প্যারামাটা সাবআর্বয়ের হোপ স্ট্রিট থেকে ক্যাম্পাসে যাবার রাস্তাতে খানিকক্ষণ আমাদের বাসে করেই নাহিদ ভাই দেখালেন-উলওর্থ ওয়ান স্টপ শপিং মল, হ্যারিস পার্ক, হান্ডি মার্কেট, বিল্লুসসহ কিছু জনপ্রিয় খাবার ঘর আর কফি শপ। আমাদের কাছাকাছি এসব মার্কেট থেকে সেদিনই বাজার করার পরামর্শ দিলেন। কারণ, প্রথমদিন তাদের ব্যবস্থাপনাতে খেলেও রাত থেকে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে।
আমাদের সবার চোখ তখন বাসার জানালার বাইরে। দক্ষ গাইডের মতোন নাহিদ ভাই জানাচ্ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার এই সাবআর্বটিতে সবই আছে; স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, শপিং সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার, থিয়েটার, স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম, সুইমিংপুল, পার্ক ইত্যাদি। আমি খেয়াল করলাম এখানকার যেকোন আবাসিক ভবনের বাড়তি সৌন্দর্য হলো প্রতিটি ভবনের চারপাশে খোলা জায়গা আর পরিকল্পিত ভাবে লাগানো বিভিন্ন ধরনের বাহারি গাছ। আর সিডনিতে পা দিয়েই বুঝেছি এখানে জায়গার তুলনায় মানুষের বসতি খুব কম।
নাহিদ ভাই কথা বলছিলেন আর ছোট ছোট একতলা বাগানশোভিত বাড়িগুলো আর ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছিলাম। এখানে দ্বিতল বা তদুর্ধ্ব ভবন হাতে গোনা। প্রায় প্রতিটা বাড়ি একতলা আর বাড়ির সামনে নাম না জানা নানানরকম ফুলের গাছ। রাস্তাঘাটে কোনো কোলাহল নেই। এক টুকরো কাগজ বা প্যাকেটও পড়ে নেই কোথাও।

মাঝে মাঝে নিখাদ সুন্দরের কাছে গেলেও বিষণ্ন লাগে। ক্যাম্পাসে ঢুকতে ঢুকতে আমি বিষণ্ন হয়ে ভাবছিলাম; এত সুন্দর, এত পরিষ্কার, কোলাহলহীন সিডনির এই সাবআর্ব! আহা, গোটা দেশটা না জানি কত সুন্দর!


ছবিঃ লেখক

ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির সাউথ ক্যাম্পাস খুব সুন্দর। ঝুমা জানালো প্রশিক্ষণে আসার আগে ব্রিফিং এ বিকাশ স্যার বলেছেন, ওদের পথঘাটে চলার সময় কোনো শর্টকাট পথ বেছে নেওয়া যাবে না। বাঁধানো রাস্তা ধরেই হাঁটতে হবে। এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় ওঠার সর্পিল বাঁকগুলোর মাঝখানে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল আর পাতাবাহার গাছ লাগানো। ক্যাম্পাসের এসব গাছের গুঁড়ির নিচে কোনো মাটি বা ঘাসের দেখা মেলে নি কারণ গাছের নিচে মাটির ওপরে গাছের বাকল নতুবা কাঠের ঝুরি ছড়ানো। এতে যেমন গাছগুলোর সৌন্দর্য বেড়েছে তেমনি মাটি বা ধূলো ওড়ার আশংকাও কমে গেছে।
বাস থেকে ক্যাম্পাসে নেমেই International Centre for Ocean Governance(ICOG) এর Director দাউদ হাসান স্যারের আন্তরিক অভ্যর্থনা পেয়েছি। আমাদের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ করে দাউদ হাসান স্যার আমাদের বিভিন্ন ক্লাসরুম এবং ICOG এর অফিসকক্ষ ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। সঙ্গে ছিলেন সদালাপী ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির Professor Donna Craig। আমরা যে কদিন ICOG এর অফিসকক্ষে কাজ করেছি, ডোনা হাসিমুখে আমাদের সঙ্গ দিয়েছে।
ডোনা শুধু বন্ধুবাৎসলই না, ওর অনেক গুণ। ও চমৎকার সব গহনা বানাতে পারে। বিভিন্ন রকমের পুঁতি, রিং দিয়ে ডোনা গলার মালা, লকেট ইত্যাদি বানায়। ও জানিয়েছিল, শাড়ি ওর চমৎকার লাগে। ও শাড়ি পরেছিল একবার, ওর দারুণ লেগেছে আমাদের এই পোশাকটি। ডোনার কল্যাণে ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অনেক ধারণা পেয়েছি।
সিডনিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে আসে। বাংলাদেশ থেকে আসা অসংখ্য শিক্ষার্থী সিডনির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। বিচারকসহ অনেক সরকারী কর্মকর্তারাও শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে বর্তমানে সিডনিতে উচ্চতর শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছেন।
প্রশিক্ষণের প্রথম দিনটিতে পরিচিতি পর্ব ও ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির সাউথ আর সিটি ক্যাম্পাস ঘোরাঘুরি করেই কেটেছে। আমি লোভীর মতো চারদিকে তাকিয়ে কেবল সুন্দর দেখছিলাম। ছক করা পরিচ্ছন্ন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভিনদেশী মানুষ দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম।

সিটি ক্যাম্পাসে আমাদের জন্য বুফে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। ভারতীয় আর বাঙালি খাবারের সম্বন্বয়ে নানান উপাদেয় খাবার ছিল মেনুতে। সিটি ক্যাম্পাস থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে Westfield shopping Centre নামের বিশাল শপিং সেন্টার। সেদিন আমি, ঝুমাসহ অনেকেই আমাদের রান্নার সদাইপাতি কিনতে সেখানে গিয়েছিলাম। রাত থেকে নিজেদের রান্না করে খেতে হবে। ঝুমা আর আমি রুম পার্টনার তাই আমরা বাজার পার্টনারও হয়ে গেলাম। চাল, ডাল, মসলা, লবণ, জুস, দুধ ইত্যাদির আর বাচ্চাদের জন্য প্রচুর চকলেট কিনলাম।


ছবিঃ লেখক

সিডনিতে বেশির ভাগ দোকানপাট বিকাল ৫টা থেকে ৬ টার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। Westfield shopping Centre যেটা বৃহস্পতিবার কেবল ৯ টা পর্যন্ত খোলা পেয়েছি। তবে রাতে পাব, ক্লাব খোলা থাকে। এবার কেনাকাটার বিপত্তি বিষয়ে বলি।
অস্ট্রেলিয়ার এক ডলারের মান বাংলাদেশের প্রায় ৬৭ টাকা। প্রথম যেদিন শপিং এ গেলাম, ১৯ তারিখ বিকালে সেদিন কিছু কিনতে গেলেই বুকে আতঙ্ক চেপে বসছিল। কারণ ডলারকে যখনই টাকাতে কনভার্ট করছিলাম তখন প্রতিবারই উচ্চারণ করেছি  ‘হায়, হায় এত্ত দাম!’ ১০০ গ্রামের মতো কাঁচা মরিচ ২৬০ টাকায় কেনার সময় আমি ঝুমা দুজন দুজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। এরপর ঝুমা আমাকে আশ্বস্ত করলো,  ‘আপা, এখানে সবকিছুর দাম এমনই, আপনাকে ভাবতে হবে এক ডলার মানে এক টাকা, এক ডলার মানে ৬৭/৬৮ টাকা হিসাব করলে আপনি কিছুই কিনতে পারবেন না, আর দেখবেন দুদিন পর ডলার খরচ করাটা আর গায়ে লাগবে না।’
সত্যি সেদিন যখন ১০৭ ডলারের শপিং সেরে ব্যাগ টানতে টানতে বাড়ি ফিরছিলাম তখনই নিজেকে মোটামুটি সামলে ফেলেছিলাম। আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি ১৫ দিনের প্রশিক্ষণে খাওয়া বাবদ কর্তৃপক্ষ থেকে আমাকে যে টাকাটা দেয়া হয়েছে তা বাংলাদেশ থেকে রওনা দেবার পূর্বে বিশাল অংকের মনে হলেও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তা কয়েকদিনেই উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই অর্থ দিয়ে এ কদিন এখানে সম্মানজনকভাবে চলা যাবে এবং সদাশয় সরকার আমাকে পর্যাপ্তই দিয়েছেন। অতএব খাওয়াদাওয়া আর ঘোরাফেরায় কার্পণ্য করে লাভ নেই। টাকা পয়সার জন্য অনর্থক হিসেব কষা মানেই হলো জীবন ঠকে যাওয়া। শপিং করতে করতে তাই সেদিন বুকের ভার কমে গিয়েছিল। সেই অনুভূতির স্থায়ীত্ব কতদিন ছিল তা নিয়ে না হয় সামনে আরও নতুন গল্প শোনানো যাবে।
ক্রমশ…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>