Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Akashvani All India Radio Radio company

ইতিহাস: আকাশবাণীর গোরা সাহেবের ভূত । অন্বয় গুপ্ত

Reading Time: 4 minutes

বহুজনেই জানেন এই আকাশবাণীর ভূতের কথা! কিন্তু আমি নিজে এটা নিয়ে বিভিন্ন লেখা পড়লেও ব্যাপারটা একেবারেই মাথা থেকে চলে গেছিল ! আকাশবাণীতে আমার প্রথম ডিউটি পড়েছিল দোলের দিনে ! বাস-টাস সেভাবে চলছিল না বলে আমি সেদিন অতি তাড়াতাড়ি মানে সাতটারও মধ্যে এসপ্ল্যানেডে পৌঁছে যাই।তখন সময় কাটানোর জন্য গঙ্গার ধারে পায়ে হেঁটেই চলে যাই ! হোলি – গঙ্গা একটা অন্যরকম মাদকতা! আকাশবাণীতে ঢুকে ফোন অন করতেই হুড়মুড় করে বন্ধুদের মেসেজ ঢুকল! সবার ঐ এক কথা- ‘ আকাশবাণীতে কিন্তু ভূত থাকে… তোর ভয় করছে না?’ সত্যি বলতে আমার ভয়ডর একটু কম ! শ্মশানে রাত কাটানো আর প্ল্যানচেট দেখা- দুই অভিজ্ঞতাই আমার আছে ! ইয়ার্কি মেরেই উড়িয়ে দিলাম!

তখনকার ‘ক্যালকাটা’, ষোড়শ শতকের ব্রিটিশ শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানকার শতাব্দীপ্রাচীন যত দেওয়াল আর কাঠামোগুলোর আড়ালে লম্বা লম্বা ইতিহাস লুকিয়ে আছে। কলকাতার চারপাশে এমন এমন জায়গা রয়েছে যা অস্বাভাবিক কথা বলে এবং যেখানে ছায়াময় অশরীরী ঘুরে বেড়ায়, এসব জায়গা ভয় খাওয়ানোর মতোই| এমনই একটি স্থান হলো ‘পুরোনো আকাশবাণী ভবন”,যা অলটাইম হন্টেড হাউসের তালিকায় থাকে।
কলকাতার নতুন ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও সেন্টার’ ময়দানে অবস্থিত| কিন্তু পুরোনো ‘আকাশবাণী ভবন’ ছিল গারস্টিন প্লেসে। রবি ঠাকুর ‘আকাশবাণী’ নাম দেওয়ার আগে নাম ছিল ‘ ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কম্পানি লিমিটেড।’

একটি ঘটনার কথা শোনা যায় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজের স্মৃতিচারণায় । সৌমিত্রবাবু তখন ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঘোষক ছিলেন। একরাতে তিনি ওপরতলায় একটি ঘরে গানের ট্র্যাক বাজাচ্ছিলেন । তখনকার কালে, ট্র্যাক প্লেয়িংয়ের আগে, মাইক্রোফোনের ভলিউম কম ক’রে দেওয়া হতো, যার ফলে সামান্য গোলমালও মাইক্রোফোনে ধরা প’ড়ে যেতো। সৌমিত্রবাবু মাইক্রোফোনের ভলিউম কমানোর পর হঠাৎ লক্ষ্য করলেন একজন লোক ঘরের দরজায় ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসার চেষ্টা করছে । লোকটির অকস্মাৎ এইরূপ আবির্ভাবে স্বাভাবিকভাবেই সৌমিত্রবাবু প্রথমটায় চমকে ওঠেন| পরক্ষণেই লোকটির ওপর অসম্ভব বিরক্তিও বোধ করেন।এইসময় সামান্য শব্দ মাইক্রোফোনে ধরা প’ড়ে যাবে এই আশঙ্কায় লোকটির ওপর একটি ক্রূদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন তিনি। ভালো ক’রে তাকিয়ে দেখেন লোকটি একজন গোরা সাহেব। সৌমিত্রবাবুর মুখে হতাশা ও বিরক্তি দেখে সাহেবও আর না দাঁড়িয়ে হঠাৎই ওখান থেকে চলে যান| কিন্তু সৌমিত্রবাবু নিজের কৌতূহল- বিরক্তি চেপে রাখতে পারলেন না| সুযোগ বুঝে একফাঁকে নীচে রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,যে কাকে উপরতলায় তাঁর ঘরে পাঠানো হয়েছিল । উত্তরে যা শুনলেন তাতে তিনি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। “আমরা তো কাউকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখিনি দাদা, কাউকে এখান থেকে পাঠানোও হয় নি”। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো নিচের তলাটি ইংরেজ আমলে একজন ওয়াইন বিক্রেতার দখলে ছিল,… হয়তো সে সেই গোরা সাহেব যাকে সৌমিত্রবাবু দেখেছিলেন !

শুধু এই একটাই ঘটনা নয়, একবার সকালের গানের একটি অনুষ্ঠান চলাকালীন বিখ্যাত একজন ঘোষক হঠাৎ অনুভব করেন ঘরে অন্য কারুর অদৃশ্য উপস্থিতি !গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বেরিয়ে রিসেপশনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ওই সময়ে ওই একই অনুভূতি এর আগেও অনেকেরই হয়েছে।

গারস্টিন প্লেসে আকাশবাণীর সাথে যুক্ত কম-বেশি অনেকেরই ভূত দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল! কেউ কেউ দেখতেন কোট-টুপি পরা সিগারেট মুখে কোনো এক সাহেব ভূতকে, যে যখন-তখন ঘরে ঢুকে ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতো, মনে হতো এ যেন তার নিজের অফিস !অনেকে দেখেছে মধ্যরাতে রেকর্ডিং রুমের বাইরে আবছা আঁধারিতে ব’সে কেউ গান শুনছে !শুধু তাই নয়, অনেক রাতের দিকে বিভিন্ন স্টুডিওগুলি থেকে ভেসে আসতো সুরেলা যান্ত্রিক সুর| বলাই বাহুল্য, যন্ত্রগুলো কোনো মানুষ বাজাতো না শুনতে-শুনতে শিহরণ বয়ে যেত অনুষ্ঠান পরিবেশক বা পরিবেশিকাদের!

ভূত নিয়ে মজার গল্পও আছে ! ‘মহিলামহল’ এর কিংবদন্তি শিল্পী বেলা দে কে নিয়ে তাঁর এক সহকর্মী লিখেছেন -”বেলাদি কিন্তু দিব্যি ছাদে বসে অনেক সময় লেখালেখির কাজকর্মও সারতেন। ফাঁকা শান্ত জায়গা। বিশেষ কেউ যায় না। তাই বোধ হয় ভালই বাসতেন ছাদটা।

এমনই এক দিনে পিয়ানোর টুংটাং আওয়াজ শুনতে শুনতে উনি লিখছেন। নীচ থেকে নীলিমাদির তারস্বরে চিৎকার, ‘বেলা নেমে এসো। শুনছ না, ভূতে পিয়ানো বাজাচ্ছে!’

বেলাদি লেখা ছেড়ে হেলতে দুলতে উঠে দেখেন একটা কুকুর পিয়ানোর ওপর হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে, তাতেই টুংটাং শব্দ। বেলাদিকে দেখে সে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে কবরখানার দিকে পালিয়ে গেল।… এর পরও বেলাদির ছাদ-প্রীতি ছিল কি না, বলতে পারব না। কিন্তু ওটুকু ঘটনাও বা কম কী সে!”

পুরনো আকাশবাণীতে স্টুডিওর ঠিক পাশেই পুরনো সব রেকর্ড জমা করে রাখবার জন্য ছোট্ট একটা ঘর ছিল। একদিন দুই কর্মী গেছেন রেকর্ড আনতে । একজন রেকর্ড বাছছেন,অন্যজন তা গুছিয়ে রাখছেন। হঠাৎ রেকর্ড বাড়িয়ে ধরার আগেই কে যেন সেটা কেড়ে নিল! দু’জনেই দেখলেন পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন এক সাদা সাহেব। কেউ কিছু বোঝার আগেই তিনি মিলিয়ে যান! ওই ঘটনার পরেই নাকি প্রায়ই টের পাওয়া যেতে লাগল সাহেবের অস্তিত্ব। সন্ধ্যেবেলায় রেকর্ডরুমের আশেপাশেই !
ব্যাপারটা প্রথম ভাঙলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ঐ ‘সাহেব ভূতের’ সঙ্গে নাকি অনেক বড় তারকার মোলাকাত আগেও হয়েছিল । বিকাশ রায়ের স্মৃতিচারণায় জানা যায় ভুতের কথা- ” আমাদের সঙ্গে এক অপূর্ব সহাবস্থান করেছিল এক সাহেবভূত । তার নাম গ্যারিসাহেব। সাহেবভূত কাউকে কিছু বলত না।বরং মাঝেমাঝে কাজের সময় আলমারি ধরে টানাটানি করলে বীরেনদা,মানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বকাবকি করতেন । ভূত ভয় পেয়ে চুপ করে যেত ।একবার শুধু একটা বেয়ারাকে পিছনের ঘোরানো সিঁড়িতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আমরা সাহেবের ওই সহযোগিতার জন্য খুব খুশি হয়েছিলাম।কারণ, ওই বেয়ারাটি ছিল ইউতিকারউল্লা সাহেবের খাস বেয়ারা।”

অনেকেই বলেছেন ,আকাশবাণী অফিসের পাশেই ছিল এক সিমেট্রি। সেখানকারই এক সঙ্গীতপ্রেমি সাহেব বেতর অফিসে আস্তানা গাড়েন। রাতের অফিসে অনেকেই শুনেছেন ভূত গ্যারিসাহেবের পিয়ানো বাজানোর শব্দ!
অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি করার সময় এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল লীলা মজুমদারেরও । স্টুডিওয় অ্যানাউন্সারের চাকরি নিয়ে এসেছিলেন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে। রাতে তিনি একবার ঘোষণা করার ঘরে যতবার ঢুকতে যাচ্ছিলেন,ততবারই তিনি দেখছেন,কেউ একজন পায়চারি করছেন,কিন্তু কোনো কাজ করছেন না! খোঁজ নিয়ে ভদ্রমহিলা জানলেন ওটা একটা সাহেবভূত ,সেই যে তিনি পালালেন,আর এলেনই না! মাসমাইনে নিতেও নয়!

অন্ধকার রাত্রে হাড় জিরজিরে ঘোড়া নিয়ে তার মালিককে যেতে দেখলেই আরেকটা শোনা কথা মনে পড়ে ! ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব খ্যাত রেসকোর্স ময়দান রেসের সময়ে জমজমাট থাকে। যত সমস্যা নাকি সেখানে রাতে। কে বা কারা যেন ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটে বেড়ায় এখানে। স্পষ্ট দেখতে পাওয়া ঘোড়া পলকেই বাতাসে উবে যায়। শোনা যায় রয়্যাল পরিবারের ব্রিটিশরা এখানে ঘোড়া চালাতেন। একবার জর্জ উইলিয়ামস নামে এক ব্রিটিশ তাঁর বিখ্যাত সাদা ঘোড়া নিয়ে ময়দান চষে বেড়াতেন। সৃই দুর্দান্ত সাদা ঘোড়াটর নাম ছিল প্রাইড। প্রচুর রেস আর ট্রফি জেতার সুবাদে প্রাইডকে তখনকার সময় এক নামেই চিনত। উইলিয়ামস তাঁর ঘোড়াকে নিজের প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন। কিন্তু একবার অ্যানুয়াল ট্রফি টুর্নামেন্টের আগে আচমকা প্রাইড অসুস্থ হয়ে পড়ে। উইলিয়ামস প্রাইডের প্রচুর যত্নআত্তি করলেও কোনো লাভ হয়নি। তিনি অ্যানুয়াল ট্রফি হেরে যান। এরপরই একদিন সকালে জর্জ দেখে, খোলা ট্রাকের ওপরে মরে পড়ে আছে তার প্রিয় সাদা ঘোড়াটি। প্রাইডের শোক আর মায়ায় জর্জও বেশিদিন পৃথিবীতে ছিলেন না। কিন্তু এখনো নাকি প্রত্যেক শনিবার পূর্ণিমার রাতে দেখা যায় জর্জ ও প্রাইডকে। রেসকোর্স জুড়ে সে বীর বিক্রমে পরিক্রম করে। প্রাইড এখনো জীবিত রেসকোর্স ময়দানে, এমনকি কলকাতাবাসী তাকে উইলিয়াম সাহেবের সাদা ঘোড়া হিসেবেই চেনে।

আমি চাই প্রোগাম চলাকালীন একদিন বীরেনবাবুর ভূত আমার উপরে চাপুক ! একটা দিনের প্রোগ্রাম অন্তত শ্রেষ্ঠ হবে !

আর বাইরে থেকে আকাশবাণীর অফিসে যে কোনোদিন যে কারুর আত্মা ঢুকে পড়তে পারে । ঐরকম গাড়িঘোড়ার ডেঞ্জারাস রাস্তা… প্রাণ হাতে করে পেরোতে হয়… সে রাস্তা পেরোতে গিয়ে যে কোনোদিন কারুর বডি পড়ে যেতে পারে ! বডি রাস্তায় কিন্তু আত্মা রুটিনমাফিক অফিসে…

এসপ্ল্যানেডের রাস্তায় যাঁরা চলাচল করেন,তাঁরা বুঝবেন!

One thought on “ইতিহাস: আকাশবাণীর গোরা সাহেবের ভূত । অন্বয় গুপ্ত

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>