একটু বেলা হলে বৃষ্টি ধরে এলো। তবে আবুল মাস্টারের উত্তরপাড়ার জমিতে পাট কাটা শুরু হয়েছে, শালার মাস্টার আজ আসবে না। ইস্কুলে গেলে জুত করে ভেলায় চাপা যায়। ইস্কুলের নিচে এবাদত মুন্সির বড় ভেলাটা বাঁধাই রয়েছে, লগির ১২-১৪টা ঠেলা দিলেই একেবারে ধলেশ্বরীর তীর। সাড়ে ১০টার লঞ্চে উঠে কাপড়ের গাঁটের ওপর বসে থাকা প্যাসেঞ্জারদের সামনে সুর করে ‘মা ফাতেমা কাইন্দা বলে বাপ কোথায় আমার হায়রে নবীজির এন্তেকালে দুনিয়া জারজার’ গাইতে গাইতে বাঁ পাটা খুঁড়িয়ে হাঁটলে দুই-আড়াই টাকা জোগাড় করা এমন কিছু নয়। তারপর রামেশ্বরদী ঘাটে নেমে কদম আলীর দোকানে বসে চায়ে ভিজিয়ে বনরুটি খাও, পেয়ারা খাও, গাব খাও, পয়সা থাকলে চাই কি মেঘনা সিগ্রেটও একটা জুটে যায়। ১টা ৫০-এর লঞ্চে বাড়ি ফিরলে মায়ের সাধ্য কী ধরে যে ছেলে তার আধখানা পেটে জামিনের বন্দোবস্ত করে এসেছে।

কিন্তু ওদিকে আকাশ থামে তো জয়নাবের পাড়া ফাটানোর বিরতি নেই। এই মিনিট দশেক হলো একটু জিরান দিয়েছে। এটাই সুযোগ, জয়নাব ফের শুরু করলে তাকে বোঝানো যাবে না। ঝাঁপ তুলে উঠানের কোণে মানকচুর ঝোপ থেকে বড় দেখে একটা মানপাতা ছিঁড়ে মাথার ওপর ধরে এক হাতে স্লেট ও মলাট-ছেঁড়া ধারাপাত নিয়ে ওহিদুল্লা পা বাড়াল। অমনি অনেকক্ষণ একটানা চ্যাঁচানোর পর ক্লান্তিতে হাঁপাতে-থাকা জয়নাব কাতরায়, ‘ওইদুল্লা! ইস্কুলে যাইস না!’

‘আইজ আমাগো পরীক্ষা। না গেলে মাস্টারে মারবো!’

জয়নাব কথা না বলে হাত নাড়ে, এর মানে, মারে মারুক। একটু হাঁপিয়ে, ফের হাত নাড়ে, এর মানে, তবুও যাস না। তারপর হাজেরার হাত থেকে হাতপাখা নিয়ে কোঁকায়, ‘কাগজির পাতা লইয়া আয় তো মা। খালি বমি বমি লাগে। মরার বমি আয়ও না!’ বিছানা থেকে মুখ নামিয়ে সে বমি করার উদ্যোগ নেয়। কেবল শব্দই সার, এক ফোটা রসও বেরোয় না। তখন চিৎ হয়ে শুয়ে কাতরাতে থাকে। এখন হাজেরার পালা। এই ছেমড়িটা আরেক মুরবি্ব। ছনের চালের ফুটো দিয়ে ঝরা পানি সরাতে সরাতে সে ঘরময় কাদাকাদা করে ফেলে আর উপদেশ ঝাড়ে, ‘আম্মা বলে অহন-তহন, তুমি যাও বেড়াইতে?’

ওহিদুল্লাকে তাই মাচার ওপর বিছানায় মায়ের কাছে বসে থাকতে হয়। আম্মার পেট ব্যথা হলে তার কী করার আছে? ব্যথার সঙ্গে স্বর, জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, বুকের ভেতর হাঁসফাঁস, এর ওপর ২৪ ঘণ্টা বমি ভাব—না, তার কিছু করার নেই। তার বাবা গতবার এসে প্রায় দিন পনেরো বাড়ি ছিল। পেটব্যথা, বুকের হাঁসফাঁস তখন ছিল কোথায়? বাজানকে বলে তখন যদি এক বোতল পানি পড়িয়ে রাখে তো তাই দিয়েই একটা বছর শরীরটাকে দিব্যি হাতের মধ্যে রাখা যায়। বাবা তার মৌলবি সাহেব, হাফেজ না হলেও কোরান শরিফ পড়ে পাখির মতো। দোয়া-দরুদ যে কত জানে, তার লেখাজোকা নেই। গাছ লাগানোর সময় গাছ বাঁচিয়ে রাখার দোয়া, ধান-পাটের জমিতে পোকামাকড় মারার দোয়া, বাচ্চাদের পায়খানা হওয়ার দোয়া, পায়খানা বন্ধ করার দোয়া, বাঁজা মেয়েমানুষের বাচ্চা হওয়ার দোয়া, আবার শত্রুদুশমনের বিমারি করার দোয়া—এক দোয়া পড়ে দিলে দুশমন শালা রক্তবমি করতে করতে পাল্টা দোয়া জোগাড় করার সময় পাবে না—আর মায়ের এসব রোগ তো বাজানোর কাছে জলভাত। এখানে, এই বিল এলাকায়, কসিমুদ্দিনের দাম বোঝার মতো লোক কোথায়? বাজান ঠিকই বলে, যেখানে তিন দিন বৃষ্টি হলো তো ডাঙ্গা ও নদীর কোনো ভেদচিহ্ন রইল না, সেখানে মানুষ বাস করে? আর সেখানে? সেই উত্তরে, ইছামতি, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে তিস্তাতীরের গ্রাম খোলামহাটি। গ্রামে আজমত আলী প্রধানের আটচালা টিনের ঘর, তার পাটের গুদাম, তামাকের চাষ। কসিমুদ্দিনের কত দাপট সেখানে। প্রধানের বাড়িতে থাকে, বাড়ির মক্তবে গ্রামের ছেলেমেয়েদের আমপারা-সেপারা পড়ায়, মসজিদে আজান দেয়, ইমাম সাহেব এদিক-ওদিক জেয়াফতে গেলে নামাজও পড়ায়। বকরি ঈদের সময় সেখানে ঘরে ঘরে কোরবানির ধুম, তার বারো আনা জবাই হয় কসিমুদ্দিনের হাতে।

এক বছর পর বকরি ঈদের সপ্তাহখানেক বাদে কসিমুদ্দিন বাড়ি ফেরে তখন তার হাতে মস্ত বড় অ্যালুম্যুনিয়ামের ডেকচি বোঝাই জ্বাল-দেওয়া ৮-১০ সের খাসির গোশ্ত, গোরুর গোশ্ত। মৌলবি বাড়ি এলে জয়নাবের পায়ে পাখা গজায়, তখন খালি ওড়ে, খালি ওড়ে। একটু মনে করে তখন পানি-পড়া রেখে দিলে এত কষ্ট পায়? মা হাজার হলেও আস্ত মেয়েমানুষ, ডেকচি ভরা গোশ্ত দেখলে হুঁশ থাকে না। বছরের একটা মাস গোশ্তের ঝোলের, গোশ্তের ভুনার, কলেজি-গুর্দার সুবাসে এই ছনের ঘরে দালানের চেকনাই আসে। গোশ্তের মৌসুম তখন, গোশ্তের উৎসব! ওহিদুল্লা তার নিজের গোশ্ত-ঝরা চিমসে পেটে আদরে ও করুণায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে দাঁড়ায়। আদর পেয়ে বেতমিজ পেটের ভেতরটা ফোঁস ফোঁস করে।—নাঃ সাড়ে ১০টার লঞ্চ এখনো যায়নি। লঞ্চে ঠাসাঠাসি করে বসা কাপড়ের ব্যাপারিদের কাছ থেকে দুই টাকা-আড়াই টাকা না হোক এক টাকা-দেড় টাকা পেলেও বনরুটি-চা না হোক, এক হালি গাব কী আমড়া খেয়ে মুখ মুছে বাড়ি ফিরলে কেউ কী ধরতে পারে? কিন্তু দাঁড়ানোর সঙ্গে জয়নাবের চিঁহি চিঁহি স্বরে বল আসে, ‘যাইস না!’ ‘মাস্টারে আইজ পাট কাটবো, হ্যায় লগে থাকতে কইছিল!’
জয়নাব হাত নাড়ে, মানে, কউক।
‘না গেলে মাস্টারে মাইর দিব!’
‘মৌলবি মাইনষের পোলা তুই পাট কাটবি ক্যান?’ গোঙাতে গোঙাতে জয়নাব নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য মনোযোগী হয়। কয়েকদিন থেকে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করতে তার খুব পরিশ্রম হচ্ছে। চেষ্টা না করলে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। অনেকক্ষণের জন্য বাতাস টেনে নিয়ে কথা বলতে বলতে শ্বাস ছাড়ে, কথাও বলে মিনমিন করে, পাছে আবার বেশি বাতাস বেরিয়ে যায়; তখন ফের নতুন করে বুক ভরানোর মেহনত করবে কে?

‘ওইদুল্লা, বাবা আমার কালা গাইটা আনতে পারলি না? হাশমত মউরির পোলায় দড়ি ধইরা টাইনা লইয়া গেল, একডা বছর পার হইয়া গেল, একটা দিন দুগা ভাত মাখাইতে পারলাম না।’ এত কথা বলায় তার বাতাসের স্টক শেষ হয়ে যায়, সে ফের হাঁপায়। ওহিদুল্লা তার কথার জবাব দেয় না। এই তো মেয়েমানুষের বুদ্ধি! কাল থেকে শুরু হয়েছে দুধের বায়না। গরু বিক্রি করে দিয়েছে আজ এক বছরের ওপর, সেই গরুর শোক কাল থেকে নতুন করে উথলে উঠছে। এত হাহাকারের আছে কী? গরু যখন ছিল তখনি কী এই মা মাগী ওদের দুধভাত দিত?

প্রত্যেক দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হাশমত মুহরির বড় ছেলে ঢ্যাঙা আশরাফ বা তার ঘরজামাই বোনাই হারুন মৃধা এসে দুধ দুইয়ে নিয়ে গেছে। এর বদলে সাত দিন পর পর বাজারে হারুন মৃধার দোকান থেকে ওহিদুল্লা চাল-ডাল নিয়ে আসত। খালি বছরে একবার কসিমুদ্দিন বাড়ি এলে সেই কটা দিন পোয়া দেড়েক দুধ ঘরে রাখার রেওয়াজ ছিল। ‘হেইখানে কি দুধ পাও?’—স্বামীকে এই কথা বলে জয়নাব ওই কয়েকটা দিন রাতে দেড় পোয়া দুধের সঙ্গে দেড় সের চালের ভাত দিয়ে, গুড় দিয়ে ও একটা শবরি কলা দিয়ে মাখাতো, সেই মাখানো ভাত খেত বাপেবেটা-ঝিয়ে মিলে ছয়জনে। শেষ দুটো লোকমা বরাদ্দ ছিল জয়নাবের জন্য। দুধভাতের হাত ধুয়ে তার গোনাগুনতি ছাগলা দাড়ি কটায় হাত বুলাতে বুলাতে কসিমউদ্দিন মাঝেমধ্যে হাসত, ‘এই শ্যাষ দুইডা লোকমার মদ্যেই ব্যাক সোয়াদ। তুমি খাইতে চাও না, তুমি নিজে না খাইলে এত মজা কইরা মাখাইবা?’ দুধভাত খেয়ে বাজানের মুখ থেকে কী সুন্দর সুন্দর কথা বেরোয়, ‘আল্লাপাকে তোমার হাতের মইদ্যে বরকত দিছে! দেড় সের চাইলের ভাত তুমি দেড় পোয়া দুধ দিয়া মাখাইয়া ব্যাকটির জান ঠাণ্ডা করো! আলহামদোলিল্লা!’

সেই কত দিন আগে-খাওয়া দুধভাতের বাসি গন্ধ চোখা কঞ্চির মতো পেটে ঢুকে পাকস্থলীতে খোঁচাখুঁচি শুরু করলে সে ফের উঠে দাঁড়ায়। টিপটিপ পানি মাথায় করে ঘরে ঢোকে বড়আম্মা আর হাজেরা। এতক্ষণ ঘরে না থাকার জন্য হাজেরাকে কষে একটা চড় মারার সুযোগ ঘটে যাওয়ায় ওহিদুল্লার হাতের তালু খুশিতে নিশপিশ করে, পেটের মধ্যে কঞ্চির তৎপরতার বিরতি ঘটে। কিন্তু হামিদা বিবি এসে বসল জয়নাবের গা ঘেঁষে, তার পাশে হাজেরা। এ অবস্থায় মারধর করাটা মুশকিল। পেট ও হাতের চাপা তৎপরতা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়ে ওহিদুল্লা নাক খুঁটতে শুরু করে।

জয়নাব কী ঘুমিয়ে পড়ল? হামিদা বিবি তার কপালে হাত রাখতেই সে বিড়বিড় করে দুধের কথা বলে। হামিদা বিবির হাত জয়নাবের কপালেই থাকে, ‘মাইজা বৌ, দুধ তো পাই না! তামান গাঁও তালাস কইরা আলার বাপে হপায় আইছে। উত্তরপাড়ার করিম সিকদারের গাইটা দুই একের মদ্যেই বিয়াইবো। নুইলা আমিনুদ্দির গাই বলে কয়দিন থাইকা খালি দাপায়, দানাপানি ছাড়ছে। আলার বাপে ঝাইড়া দিয়া আইল। কী করে, ধরছে, ঝাইড়া দিয়া যাও। তাই দেরি হইল।’

‘দাপাইবো না?’ আলার বাপ দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলে। সে হলো জয়নাবের ভাসুর, ঘরে ঢোকার নিয়ম নেই। ‘গাভীন গাই দিয়া কয়দিন হাল বোয়াইছে, অহন গাইয়ের কী দোষ? আল্লায় ক্যামনে সয়?’

ভাসুরের কণ্ঠস্বর শুনে জয়নাব গায়ের কাঁথা আরো জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তার পায়ের কাছে বৃষ্টির পানিতে ভেজা জায়গাটা আঙুলে লাগলে সমস্ত শরীর শিরশির করে ওঠে। এতে কথা বলার বল পাওয়া যায়, ‘অ বুজান, হাশমত মউরির গোয়ালের মইদ্যে আমাগো কালা গাইটা আছে!’

কিন্তু হাশমত মুহুরির বাড়িতে যাওয়া আলার বাপের পক্ষে অসম্ভব। গতবার খরার সময় হারুন মৃধার দোকান থেকে পাঁচ সের চাল নিয়েছিল, সেই ধার আজও শোধ হয়নি। সে তাই ওহিদুল্লাকে ডাকে, ‘ওইদুল্লা!’

ওহিদুল্লা বেরিয়ে দেখে তার জ্যাঠা টিপটিপ বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে আর পরনের গামছা বারবার নিঙড়ে নিচ্ছে।

‘ওইদুল্লা, কোষাখান লইয়া মালখাপাড়া যা, হাশমত মউরির তিনটা গাই, দুধ লইয়া বাজারে অহনো যায় নাই। মউরিরে হাতে-পায় ধইরা কইস, আমার মায়ের অহন-তহন অবস্থা, একখানা হাউস করছে, আপনের না কওন চলবো না!’

সারা পাড়ায় একটিমাত্র কোষা, সেটা নিয়ে গেল কে? ওহিদুল্লার ভেলাই ভালো। হাশমত মুহরির বাড়ির পৈঠায় ভেলা ঠেকানোর আগেই দেখা যায় পরিষ্কার জামাকাপড় পরা কয়েকটি ছেলেমেয়ে পানিতে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিচ্ছে। সবাই এক সঙ্গে কথা বলে, দেখেই বোঝা যায় শহরের পয়দা, এদের কথা বোঝা যায় না। ওহিদুল্লা ভেলা ঠেকিয়ে ডাঙ্গায় নামে। হাশমত মুহুরির ঘর অনেক উঁচুতে, পা ঠেলে ঠেলে ওপরে উঠতে হয়।

হাশমত মুহুরি বাড়ি নেই, ভোরে উঠে বৃষ্টি মাথায় করে সে গেছে থানায়, কাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তদবির করতে। হাশমত মুহুরির বড় ছেলে ঢ্যাঙা আশরাফ থাকলেও কাজ চলে, তো সে গেছে বাজারে। এই তো কোষা নিয়ে বেরোলো, অহিদুল্লার সঙ্গে তার দেখা হয়নি? হাশমত মুহুরির চাকরিজীবী প্রবাসী ছেলে আলতাফ অনেকদিন পর বাড়ি ফিরেছে, বাজারে না গিয়ে ঢ্যাঙা আশরাফের উপায় ছিল না। ওহিদুল্লা বাড়ির ভেতরে উঠানে দাঁড়ায়। ঘরের পাকা বারান্দায় শহরবাসী ছেলে মস্ত মুড়ির বাটি নিয়ে জলচৌকিতে বসেছে। খাঁটি সর্ষের তেলের ঝাঁজ বড় বারান্দা পেরিয়ে ওহিদুল্লার নাকে ঝাপটা মারে এবং সেই ধ্যাবড়া নাকের সুড়ঙ্গপথে পেটে ঢুকে সুড়সুড়ি দেয়। মুহুরির বৌ ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা অ্যালুম্যুনিয়ামের থালা থেকে গম ছিটিয়ে দিচ্ছে উঠানে।

ওহিদুল্লার আবদার শুনে মুহুরির বৌ অবাক হলো, ‘হায়রে আল্লা!’ তর মায়ের না প্যাটের ব্যারাম? চিরকালের সুতিকার রুগী? হ্যারে তুই দুধ খাওয়াইবি? পাগলা হইছস?’ কিন্তু এই বিস্ময়বোধে তার গম ছড়ানোর কাজ একটুও ব্যাহত হয় না, দাঁতের গোড়ায় পানে-ভারী জিভ ঠেকিয়ে সে ‘টি টি টি টি’ আওয়াজ করলে এক পাল মুরগি এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গম খায়। মুরগির হাঁটা কি! পেটে দানা পড়ায় শালাদের দেমাক কত! ইচ্ছা হয় সব কটার ঠোঁট কামড়ে গমের টুকরা নিয়ে দাঁতে চিবিয়ে ফেলে। কিন্তু এই সাধ পূর্ণ করার জন্য কোনোরকম প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই মুহুরির জামাই হারুন মৃধা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জামার বোতাম লাগায় আর বলে, ‘তর মায়ের প্যাট খারাপ, তগো হইছে মাথা খারাপ!’

ওহিদুল্লা মিনমিন করে, ‘না, হ্যার হাউস হইছে দুধভাত খাইব, মায়ে বলে বাঁচবো না!’ তার গলা কাঁদো কাঁদো করার চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা হয় না। মুহুরির শহরবাসী ছেলের কথা বরং সর্ষের তেলের ঝাঁঝে খোনা শোনায়, ‘দুধভাত খাইলে তর মায়ে ফাল পাইড়া উঠব, না?’

শহরবাসীর স্কুলে-পড়া ফ্রক-পরা কন্যা কামড়ে কামড়ে পেয়ারা খাচ্ছিল, মুখে পেয়ারা নিয়েই সে বলে, ‘দুধ আমার ভাল্লাগে না! দুধ আবার মানুষ সখ করে খেতে চায়? মাগো!’

মুহুরির জামাই তার দোকানে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে বাড়াতে বলে, ‘পয়সা লইয়া ডাক্তার দেখা। ওষুধ দে, ওষুধ দে! তর চাচা না? ওই যে আলোর বাপে তর চাচা লাগে না? আমার চাউলের দামটা অহনো দিল না। অর কাছে থাইকা ট্যাহা লইয়া ডাক্তার দেখা।’

গলাটা কাঁদো-কাঁদো করার জন্য ওহিদুল্লা আরেকবার প্রচেষ্টা চালায়, ‘মায়ের এ্যাট্টা হাউস হইছে, কালা গাইয়ের দুধ দিয়া, গুড় দিয়া, কলা দিয়া’—বলতে বলতে জিভ দিয়ে শব্দগুলো সে চাখে। কিন্তু হারুন মৃধা কালো গরুর কথায় চটে গেল; ‘যা যা! এক কথা!—প্যাচাল পাড়িস না!’ মুহুরির বৌ বলে, ‘কইলাম আমার মাইজা পোলায় আইছে, নাতিপুতিগুলি আইছে বলে দুই বচ্ছর বাদ, দুগা পিঠা করুম, দুধ লাগে আমার চাইর স্যার! আইজ বাজার থাইকা দুধ আরো খরিদ করা লাগে! তর মায়ে—বুইড়া মাগীটার ঢঙের হাউস হইছে দুধভাত খাইব!’ শহরের পয়দা মেয়েটি পেয়ারা কামড়ানো স্থগিত রেখে বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে বলে, ‘নেই কোনো উৎপাত, খায় শুধু দুধভাত!’

শহরে থাকলে পোলাপান কত রঙই না শেখে! কথাবার্তা শুনে কে বলবে যে এরা হাশমত মুহুরির নাতিপুতি?

কালো গরুর কথাটা হারুন মৃধা ভুলতে পারে না, ‘এইগুলির উপকার করতে নাই। খাওন জোটে নাই, চাউলের দাম হইল আগুন, ভাইজানে গরুটা কেনে তয় হ্যাগো চাউল আসে! দানাপানি জোটে! হাটে-বাজারে অহন আলার বাপে কইয়া বেড়ায়, হ্যার ভাই বাড়িত থাকে না, মউরির পোলায় হ্যার গাইগরু লইয়া গেছে। গরু লইছে মাগনা? ক্যারে, গরু তর মায়ে মাগনা বেছছে?’

ওহিদুল্লা ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি একেবারে থেমে গেল। আলার বাপ কাদার পাশে একটা কাঠের গুঁড়িতে হাঁটু ভেঙে বসে আরো দুজন জ্ঞাতির সঙ্গে ভ্রাতৃবধূর রোগ বিষয়ে গুরুগম্ভীর পরামর্শ করে। ওহিদুল্লাকে দেখে আলার বাপ চোখের প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি করলে ওহিদুল্লা বলে, ‘মউরি নাই।’

‘হারুন মিরধা আছিল?’

‘হ্যাগো ইষ্টি আইছে, দুধ লাগব।’ এই খবরে অবশ্য তাদের আলোচনা ব্যাহত হয় না। ‘ডাক্তার আছিলো আমাগো অমরেশ ডাক্তার। খালি জিগাইছে, কও সে বাবা তোমার রুইদ ভালা ঠ্যাহে, না ছ্যাওয়া ভালো ঠ্যাহে? কেউরে কইছে, রাইতে আরাম পাও, না দিনে আরাম পাও? জবাব শুনছে, শুইন্যা ওষুধ দিছে। কী দিছে? চাইরটা-পাঁচটা বড়ি, মধুর লাহান মিঠা, খাইতেও মজা, দুইবার-তিনবার খাও, জ্বরজারি কৈ যাইব, দিশা পায় নাই!’