আজ ৩০ অক্টোবর অনুবাদক, সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আলীম আজিজের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
ঠিক সন্ধ্যার মুখে মুখে বাড়িটার সামনে পৌঁছালে তুমি। ছোট দোতলা একটা বাড়ি। চারদিক ঘেরা গাছপালায়, নিচের দিকের একটা ঘরে শুধু আলো জ্বলছে। হলুদ আলো। ওই ঘরটাতেই কি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে সে! তুমি দরজার কড়া নাড়ার আগে শাড়িটা খানিক ঠিকঠাক করে নাও। এখন আর কেউ শাড়ি পরে না। ফ্যাশন নেই। কিন্তু তুমি পরেছ। তোমাদের পুরোনো দিনের কথা ভেবেই তো? না, এটা সত্যি না। সত্যিটা ভেবে তোমার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটল। শাড়িতে তুমি দুনিয়ার সেরা অপ্সরী! এই কথা ওই লোকটাই তো তোমাকে বলত একসময়, তোমাদের ইউনিভার্সিটির ছন্নছাড়া দিনগুলোয়। খুবই উত্তেজক-উন্মাতাল এক জুটি ছিলে তোমরা। অন্যদের মতো গাছতলায় বসে বাদাম চিবোনোর মতো ম্যাড়ম্যাড়ে প্রেম তোমাদের মধ্যে ছিল না। গোড়া থেকেই তোমরা শরীর চিনে গিয়েছিলে। ফলে এই বাড়িতে তোমার নিয়মিতই যাতায়াত ছিল, এখানে তোমাদের মেলামেশায় বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না…ওর পঙ্গু মা ওপরতলায় থাকত, কিন্তু সে তোমাদের উন্মাতাল রতিক্রিয়ায়, হইচইয়ে, মাঝেমধ্যে চেঁচিয়ে ওঠা ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না, অনেক সময় ওপরতলা থেকে তার আক্রোশে জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলার আওয়াজ পেতে, চিৎকার শুনতে: ‘আস্তে! আস্তে…ইতরের দল!’ তারপরই, ‘মর! মর!’ বলতে শুনতে। শুরুতে তুমি শরীর বিনিময়ের মাঝপথে এসব কথা, ভাঙচুরের আওয়াজে থমকাতে, শরীর ঠান্ডা হয়ে যেত, পরে আর গা করোনি। অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।
তোমার বন্ধুবান্ধব, কাছের মানুষ সবাই জানত ইউনিভার্সিটি শেষে তুমি ওকেই বিয়ে করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি ওকে বিয়ে করলে না। তুমি বিয়ে করলে এক ভাস্করকে। এক অর্ধ উন্মাদ, বদ্ধ মাতালকে।
কেন করলে এমন? তার উত্তরটা তুমি কোনো দিন দাওনি। কাউকে না। শুধু তা–ই না, বিয়ের পর তুমি ওর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কই রাখলে না। আজ এক যুগ পর তুমি আবার ওর মুখোমুখি হচ্ছ। তোমার কি একটু নার্ভাস লাগছে! শ্রেয়া! লাগছে না?
নাহ্! বরং এই শাড়িটা কি ও চিনবে? ভাঁজ ঠিক করতে করতে ভাবলে তুমি। শাড়িতেই নাকি বাঙালি মেয়েদের প্রকৃত রূপ খোলে। এটাও ওর উক্তি। তীব্র আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে নিরাভরণ করার আগে, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলত ও। মনে পড়ে?
দরজার পাশে জুঁই ফুলগাছটা নেই। কটা চিকন পাতার পাতাবাহার ছিল, একটা লম্বা ঝাঁকড়া মাথার ঝাউ ছিল গায়ে গায়ে, এখন কিছুই নেই। কলবেলটাও বদলেছে, আগে গোল বড় বোতামের মতো একটি সুইচ ছিল, এখন? হাতড়ে হাতড়ে চৌকাঠে, ঠিক আগের জায়গাতেই ছোট চৌকোনা মতো একটা কিছু পেয়ে, টিপে দিলে। তুমি টের পাও, তোমার বুক ধুকপুক করছে। কত দিন পর! বারো বছর। এ কয় বছরে কত কী বদলেছে, তুমি নিজেও কি কম বদলেছ? আগের সেই তন্বী শরীর তো তোমার নেই। ওজন বেড়েছে, আগের চেয়ে পৃথুলাই।
দরজাটা খুলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে টক করে একটা সুইচ টেপার শব্দে আলোও জ্বলে উঠল সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে। সামনে দাঁড়ানো ও। ঠিক আগের মতোই ঝকঝকে দাঁতে হাসছে। মাথার চুল এখনো কালো, শুধু কানের ওপরে দুই দিকের জুলপিতে সামান্য পাক ধরেছে।
এরপরের ঘটনা তোমার কাছে মনে হলো বারো বছর আগের দিনগুলোই যেন তুমি রিওয়াইন্ড করে দেখছ, আগের মতোই কোনো কথা হলো না, সিঁড়ির ল্যান্ডিং, করিডরটুকু যেন উড়ে এলে দুজনে।
তারপর বিছানায়, ঝড় শান্ত হওয়ার পর তুমি এই প্রথম ভালো করে খেয়াল করলে ঘরটা। আগে এ ঘরটা আরও ছোট ছিল। পাশের ছোট লিভিং রুমটা ভেঙে এই ঘরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এটা বিশাল একটা ঘর, প্রায় ছোটখাটো একটা হলরুম। আর বিছানাটা ঠিক মাঝখানে। মনে হলো একটা সুনসান ফাঁকা মাঠের মধ্যে শুয়ে আছো তুমি।
শুয়ে ঘাড় কাত করেই তুমি ব্যাপারটা দেখলে, আস্তে আস্তে প্রবল বিস্ময়ে চোখ কুঁচকে উঠতে শুরু করল তোমার। ঘরের হলুদ ঝিম ধরা সোডিয়াম বাতির আলোয় দেখলে পুরো ঘরে একটা খাট আর টিপয়ের মতো ছোট একটা টেবিল ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। টেবিলটার ওপর কালো মতো কিম্ভূত একটা জিনিস শুয়ে আছে।
আর দেয়ালজুড়ে শুধু ছবি। মানুষের ছবি—শিশু, অল্পবয়স্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, বৃদ্ধ। এ–ফোর পেপার সাইজে অসংখ্য মানুষের মুখ। দরজা বাদে ঘরের চারদিকের দেয়ালজুড়ে শুধু ছবি আর ছবি। সাদাকালো। অসংখ্য নারী আর পুরুষের পোর্ট্রেট। মধ্যে মধ্যে একঘেয়েমি দূর করতে একটি দুটি শিশুর মুখ, পাশাপাশি ঝোলানো।
হঠাৎ গা শিরশির করে উঠল তোমার। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল কি! তুমি দ্রুত শাড়ি, ব্লাউজ গায়ে চড়িয়ে বিছানা থেকে নামলে, পেছনে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা তোমার সাবেক প্রেমিক খাটের তলা থেকে সিগারেট-ম্যাচ বের করে ফস করে আগুন জ্বালল, সিগারেট ধরাল। ঘাড়ের নিচে দুটো বালিশ ভাঁজ করে গুঁজে দিয়ে আয়েশ করে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে, কেমন মুগ্ধতা আর এক আবেশমাখা চোখে তাকিয়ে রইল তোমার দিকে, তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে কৌতুক।
তুমি দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালে, কোনো একটা মুখও কি চেনা? না। কেউ তোমার চেনা না। তাহলে? কেন যেন টিনএজ বয়সে পড়া ওয়েস্টার্ন পেপারব্যাকের কথাই তোমার প্রথমে মনে এল, ওয়েস্টার্ন গল্পে পিস্তলবাজ একটা করে মানুষকে মারে আর তার পিস্তলের বাঁটে দাগ কেটে রাখে। এই অগুনতি মানুষের মুখগুলো কি সে রকম কোনো স্মারক? ধুর! এটা খুবই অবাস্তব, দ্রুত চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে চোখ আরেকটু সরু করে ছবিগুলোর মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করলে, ওই মুখগুলোর মধ্যে একটা দুটো কোনো পরিচিত মুখ বেরিয়ে যায় কি না! তোমার কোনো বান্ধবীর মুখ, কিংবা দুজনেরই পরিচিত কারও মুখ।
কাউকেই পেলে না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলে:
‘এরা কারা? ঘরবোঝাই এত ছবি কেন? তুমি ছবি তোলা শুরু করলে কবে থেকে?’
ঠোঁটে সিগারেট কামড়ে ধরে দিগম্বর ও বিছানা থেকে নেমে এল, ‘এরা কেউ তোমার চেনা না। কেউ না…এরা হঠাৎ দেখা মুখ, কারও কারও সঙ্গে এক-দুই মিনিটের মতো আলাপ হয়েছে কেবল। তারপর আর দেখা হয়নি কোনো দিন।’ বলে হাসল ও।
‘মানে কী? আমি ইউসুফ কার্শের কথা জানি, দুনিয়ার সেরা পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার। কিন্তু সে তো শুধু বিখ্যাত লোকের ছবি তুলত। তুমি এইগুলা কাদের ছবি তুলতেছ?’
তোমার এ কথার জবাব দিতে সময় নিল সাবেক প্রেমিক। মেঝে থেকে দলামুচড়া হয়ে পড়ে থাকা প্যান্টটা ঝুঁকে তুলে নিয়ে পা গলাল, তখনো ঠোঁটে সিগারেট কামড়ে ধরে আছে সে। প্যান্ট পরা শেষে বলে, ‘আমিই কি জানি! আমাকে দিয়ে তুলিয়ে নিচ্ছে। আমি তুলছি।’
‘ওহ্! যে তোমাকে দিয়ে এসব ছবি তোলাচ্ছে সে এগুলো দিয়ে কী করে?’
‘কিছু না। আমি তুলি, তারপর ওয়াশ করে দেখি। তারপর স্মৃতি হিসেবে রেখে দিই।’
‘এখানে কত লোকের ছবি আছে?’
‘কয়েক হাজার।’
‘এত?’
‘আরও আছে, ওপরে ট্রাঙ্কে।’
‘তাহলে এটাই তোমার পেশা এখন? কেমন টাকা দেয়?’
‘কোনো টাকা দেয় না।’
‘তুমি না বললে তোমাকে দিয়ে কেউ ছবিগুলো তোলায়?’
‘হ্যাঁ, সেটা ওই ক্যামেরাটার কথা বলেছি।’ হাতের ইঙ্গিতে টিপয়ের ওপর রাখা কালো কিম্ভূত সেই বস্তুটা দেখায় ও। এই প্রথম তুমি খেয়াল করলে ওর লোমশ বুকের মাঝখানটায়ও সাদা। খানিক আগে বুকে মুখ ঘষার সময় নজরে পড়েনি তোমার। পড়ার কথাও না। তখন কি আর হুঁশ থাকে, চোখ ঠাওরালে তুমি নিজেকে।
কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে টিপয়ের জিনিসটা দেখলে। কালো চারকোনা একটা বাক্সের মতো, পুরোনো, গায়ে ঘষা দাগ। হাত বাড়িয়ে জিনিসটা ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল, মোবাইল ফোন যেমন সাইলেন্ট মোডে থাকলে মেসেজ এলে নিজেই, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেঁপে ওঠে, ঘর্র করে একটা শব্দ করে, তুমি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটা ওই রকম অদ্ভুত একটা ঘড়াৎ শব্দ করে তোমার হাতের নাগাল থেকে যেন পিছলে সরে গেল। তুমি ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে আনলে। লাল–নীল কটা বাতি জ্বলে উঠেছে একই সঙ্গে ওটার।
‘এমা!’
‘আমি ছাড়া আর কেউ ধরলেই এ রকম হয়।’ বলে টিপয় থেকে জিনিসটা তুলে নিল ও, ‘এটাই আমার ক্যামেরা। আজ আমি তোমার ছবি তুলব। এই যে বাতি জ্বলে উঠেছে। ছবি তোলার জন্য ও তৈরি।
এই ক্যামেরাটা, তোমার প্রেমিকের ধারণা ভিনগ্রহের তৈরি। সে এটা কিনেছে কাওরান বাজার জনতা টাওয়ারের সামনে থেকে, ওখানে ফুটপাতে পলিথিন শিট বিছিয়ে এক লোক রাজ্যের পুরোনো, বাতিল জিনিসপত্র বিক্রি করে। মোবাইল ফোনের চার্জার, ভাঙা রেডিও সেট, খেলনা, ওয়াকিটকি, সিআরটি টিভি, কম্পিউটারের মনিটর, রিমোট কন্টোল—এসব জঞ্জাল থেকেই নাকি ওই ক্যামেরাটা কিনেছে ও।
প্রতি সপ্তাহেই, শুক্রবার ক্যামেরা হাতে বাইরে বেরিয়ে পড়ে সে, পথে–ঘাটে ঘুরে ঘুরে লোকজনের ছবি তোলে। তবে মজার বাপার হলো, ও যখন-তখন চাইলেই যে ওই ক্যামেরায় ছবি তুলতে পারে, তা না; এমনও হয়েছে, কোনো কোনো শুক্রবার সারা দিন হাঁটাহাঁটির পরও একটা ছবিও তোলা হয়নি, সে ঠিকই নানাজনের ছবি তুলে গেছে, ক্যামেরা সাড়াও দিয়েছে, কিন্তু বাসায় এসে ওয়াশ করতে গিয়ে দেখেছে, কিচ্ছু উঠেনি। ব্ল্যাঙ্ক পেপার, কিংবা ঝাপসা একটা মুখ। এই ক্যামেরা ছবি তোলে নিজের পছন্দে। সাবজেক্ট সে বাছাই করে ঠিক, কিন্তু ছবি ওঠা, না–ওঠা নির্ভর করে ওই ক্যামেরার মর্জির ওপর। ও বলে ক্যামেরাটার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে। কার ছবি তুলবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্যামেরা নিজেই ঠিক করে নেয়। আজগুবি গল্প। কিন্তু সাবেক প্রেমিকের মুখচোখের সিরিয়াস ভঙ্গিতে তুমি এ রকম সন্দেহ মনে এলেও চেপে যাও। বরং তুমি তার মতো গম্ভীর মুখ করে কথা শুনে যাও। সে শেষ দিকে এসে আক্ষেপের সুরে বলে, ‘আমাকে দিয়ে ওটা ছবি তুলিয়ে নেয়। আর আশ্চর্য ব্যাপার কি জানো, এই ক্যামেরায় শুধু মানুষের মুখের ছবি তোলা যায়, মানুষের মুখই এই যন্ত্রের একমাত্র সাবেজক্ট। কোনো গাছপালা, লতাপাতা বা কোনো প্রকৃতির ছবি তোলা যায় না, অসংখ্যবার চেষ্টা করে দেখেছি।’
সব শুনে তুমি খিলখিল করে হেসে ওঠো। বলো, ‘তাহলে দেখো তো, তোমার ওই রদ্দি ক্যামেরা আমার ছবি তোলে কি না! অবশ্য আমি ভাবছিলাম, তুমি আমার একটা ন্যুড তুলে রাখবে, যাতে আর বিশ বছর আমি না এলেও ওই ছবি দিয়েই তোমার কাজ চলে যায়! হলো না।’ বলে ছদ্ম দুঃখী চেহারা করো তুমি।
কিন্তু তোমার রসিকতায় তোমার প্রেমিক হাসল না, বরং আরও গম্ভীর চেহারায় বলল, ‘তোমার ছবি তোলা যাবে। ক্যামেরাটা সাড়া দিয়েছে। তুমি ধরামাত্র ওটার আলো জ্বলে উঠেছে।’ বলে থামল সে। ক্যামেরাটা হাতে নিল। ‘তোমার ছবি তুলব বলেই তোমাকে এত দিন পর পায়ে ধরে ডেকে এনেছি। কিন্তু আমার যন্ত্র রাজি হবে কি না সেটা নিয়ে একটা শঙ্কা ছিল। তবে এখন আর নেই। ও ছবি তুলবে, তোমার ছবিই তুলবে।’ বলে আচমকা হো হো করে হেসে উঠল ছেলেমানুষের মতো।
‘এই, এত খুশির কী হলো!’
‘ছবিটা তুলি আগে…তারপর তুমি নিজেই জেনে যাবে।’ রহস্যময় গলায় বলল সে।
‘এ রকম আলুথালুভাবে তুলব? একটু গুছিয়ে নেই, ’ ক্যামেরা হাতে ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বাধা দিয়ে বললে তুমি।
‘আরে না, এটা তোমার মুখের ছবি তুলবে শুধু।’ বলে দুঃখী চেহারা করল সে, ‘ইশ্, তোমার বুকের ছবি তুলতে পারলে…’
‘হয়েছে, হয়েছে, তোলো তোলো, আমাকে ফিরতে হবে। ভাস্কর ব্যাটার ফেরার সময় হয়েছে।’ তাড়া দাও তুমি।
‘আচ্ছা, আজ একটা কথার জবাব দাও তো, আমাকে বিয়ে করলে না কেন? আর বিয়ের পর আমার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে কেন?’
‘যদি সত্যিটা না বলি?’
‘না বললে? আফসোস থাকবে, শেষ সময়েও তুমি সত্যিটা বলে গেলে না। এই আর কি!’
‘আমার জরায়ু নেই। আমাকে দিয়ে তোমার সেক্স ছাড়া আর কিছু হতো না। ভাস্করের সন্তান-ফন্তানের কোনো বালাই নেই…’
এরপর অনেকক্ষণ তোমাদের কোনো কথা হয় না। একটা বিষাদের মেঘ ঘিরে ধরে তোমাদের। তার মধ্যেই সংবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো আচমকা উঠে দাঁড়ায় তোমার প্রেমিক, তোমার ছবি তোলা শুরু করে। শেষ ছবিটার সময় সে তোমার পাশে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে, জোর করে হাসির চেষ্টা করে; বলে, ‘এবার এ সময়ের পোলাপানের মতো আসো একটা সেলফি তুলি, দেখি ক্যামেরা ব্যাটা অ্যালাউ করে কি না।’
তুমি হাসি হাসি মুখ করে পোজ দাও, কিন্তু তুমি জানো না এই ক্যামেরায় সেলফি তোলা যায় না। তোমাদের যে কারও একজনের ছবি তুলবে আর্টিফিশিয়াল জ্ঞানের এই ক্যামেরা। তোমার প্রেমিক এটা জেনেও সেটা খোলাসা করে না।
ছবি তোলা শেষে কোলের ওপর ক্যামেরাটা নামিয়ে রেখে মেঝের দিকে চেয়ে, তোমার প্রেমিক কথা বলতে শুরু করে, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো, যেন অনেক দূর থেকে কথা বলছে সে:
‘একটা স্বীকারোক্তি করতে চাই তোমার কাছে। এই যে লোকগুলোর ছবি দেখছ ঘরজুড়ে, তারা সব মৃত। এই ক্যামেরা যাদের ছবি তোলে তারা কেউ বেঁচে থাকে না। বারো বছর পর তোমাকে ডেকে এনেছিলাম একটা খেলা খেলতে, মন–প্রাণ থেকে চেয়েছি ক্যামেরাটা যেন তোমার ছবি তোলে। গত বারোটা বছরের প্রতিটা দিন আমি তোমার মৃত্যু কামনা করেছি। আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। নিয়তি কেমন আজকের দিনটাই ঠিক করে রেখেছিল! নইলে বারো বছরে কতবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি, তুমি সাড়া দাওনি। উল্টো অসম্ভব খারাপ ব্যবহার করেছ। তাতে আমার শুধু ক্রোধই বেড়েছে। কিন্তু আজ আমি শান্তিতে ঘুমাব। বিদায় শ্রেয়া!’
তুমি স্থাণুর মতো বসে আছ। তোমার সাবেক প্রেমিক, যাকে এখনো তুমি ভালোবাসো, তীব্রভাবেই ভালোবাসো, সে পাশের ডার্করুমে তোমার কথিত মৃত্যু–পরোয়ানার প্রিন্ট নিচ্ছে, আর খানিক পরই তোমার ছবি হাতে বিজয়ীর বেশে সে হাজির হবে।
মৃত্যুর জন্য কতক্ষণ সময় পাবে তুমি? তোমার কত কত গোপন কথা ছিল ওকে জানানোর। কিছুই বলা হলো না।
তুমি অপেক্ষা কর। একটা সময় তোমার মনে অবিশ্বাস জন্মে, ও তোমার সঙ্গে রসিকতা করেছে। তোমাকে শুধু শুধু ঘাবড়ে দিয়ে মজা করতে চেয়েছে। ক্যামেরায় ছবি তুললেই মানুষ মরে যাবে কেন! পুরো গাঁজাখুরি।
আরও পরে পায়ে পায়ে ডার্করুমের দরজা খুলে তুমি উঁকি দাও…এবং এই দৃশ্যের জন্য তুমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলে না। তোমার প্রেমিক, আনিস, আনিস রহমান মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার হাতে ধরা একটা এ–ফোর সাইজের প্রিন্ট, তাতে তোমার ছবি নয়, আনিস রহমানের হাসিমুখটা চেয়ে আছে।
আর ডার্করুমের হলদে আলোয় কাঠের টেবিলটার ওপর থেকে দুটো লাল চোখে জ্বলছে, নিভছে। খুনি ক্যামেরা। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে নিঃশব্দে।