আবদুল মান্নান সৈয়দ’র কবিতাগুচ্ছ

Reading Time: 3 minutes

পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো।
এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল।
পদ্মায় গিয়েছে একটি– মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়–
আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ
ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে।
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে
এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে।

 

লোকে জিগেস করে—
তোমার কবিতায় এত বিষন্ন রঙ কেন আজকাল?
কোনো জবাব দিই না।
বলব কি পিকাসোর উত্তরটি?
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে।
পিকাসো প্যারিসে তাঁর স্টুডিও।
স্পেনের একটি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেল জর্মান বোমা বর্ষণে।
গোয়ের্নিকা।
পিকাসো সেই বিধ্বংস গ্রামের ছবি আঁকলেন ক্যানভাসে।
জর্মান সৈনিকরা প্যারিসে ঢুকে পড়ল একদিন।
স্টুডিওতে ঢুকে পিকাসোকে জিগেস করল—
এই ছবি কি তুমি এঁকেছ?
উত্তর দিলেন পিকাসো—
না। এসব এঁকেছ তোমরা।—
—মুশকিল হলো আমি মুখ ফুটে কথা বলতে পারি না।
না হলে বলতাম লোকজনকে—
যে-বিমর্ষতা দেখছ আমার কবিতায়,
তার কারণ এক ভয়ংকর বোমারু বিমান।
আমার শান্ত সবুজ নদী-বয়ে যাওয়া গ্রামটির ওপরে
অহৃদয় বোমার পর বোমা ফেলে
এ রকম তছনছ করে দিয়েছে যে—
তাকে আমি চিনি।
শুধু তার নাম আমি তোমাদের বলব না।
পিকাসোর মতো সাহস নেই আমার।
তখন শুধু সেই শ্যামল গ্রামটির স্মৃতি
আমাকে কষ্ট দিচ্ছে এত।
তাই আমার কবিতায় আজকাল দ্যাখো এত বিমর্ষতা।
আনন্দ কাকে বলে—আজ আর মনে নেই আমার।
আমার সেই গ্রামে তাবৎ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে
শুধু একটি গাছ
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যার ডালে একটিও পাখি বসে না আজ আর।
যার কোনো ফুল ফোটে না।
কোনো ফলও না।
শুধু কী এক গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
আমি সেই গাছ।
সেই গাছ।

 

সোনালির সঙ্গে ডালিয়ার দেখা হয়ে গেল একদিন।
ডালিয়াকে জড়িয়ে ধরল সোনালি।
ডালিয়া বলল—আপনি কে?
সোনালি বলল—আমি সোনালি।
কত নাম শুনেছি তোমার।
তোমাকে তো দেখামাত্র চিনে ফেললাম।
ডালিয়া বলল—কার কাছে নাম শুনেছেন আপনি?
নাম বলল সোনালি।
ছায়া নামল ডালিয়ার দুধের মতো ফরসা মুখমণ্ডলে।
বলল শুধু—ও।
সোনালি বলে—মুখ কালো হয়ে গেল কেন তোমার?
উনি সারাক্ষণই তোমার কথা বলেন।
ম্লান মুখে ডালিয়া বলল—
সে-সব কথা ভুলে গেছি আমি।
আমার কথা বলে লাভ আছে আর?
সোনালির উত্তর—সে-কথা আমিও বলি।
কবিতা লিখে কী হবে?
জীবনে তো…
তারপরই সোনালি বলে—
ওনার আসল কে, চেনো না তুমি।
—কে?—
সোনালি হাসতে থাকে।
—তুমি আমি কেউ না। তার নাম কবিতা।
—কে মেয়েটা?
সোনালি বলে—চলো, কোথাও বসি।
কফি খেতে খেতে তোমাকে বলছি সব।

 


বেগানা সেরেনাদ-২


‘চন্দ্রমল্লিকার অগ্নি কেটে দিচ্ছে রাতের বাতাস, ধ্যানের ঢেউয়ে চড়ে এল জাহাজের মতো বড়ো হাঁস, তারই নাম বস্তুগ্রাস;’ বলে শবে-বরাতের মোমবাতিগুলি চলে গেল লক্ষ বছরের পথ সারে-সারে অর্ন্তগত রক্তপাতে তৃপ্তিহীন নীলকান্ত প্রশ্ন জ্বেলে : ‘কোনোদিন পাবো কি তোমারে? কোনোদিনই পাবো না তোমারে?—

হ’তে পারতাম যদি তোমার হাতের কররেখা, তোমার পিঠের সেই তিলখানি, গ্রীবার বঙ্কিম ভাঁজ, তাহলে কি এড়াতে পারতে, শম্পা?

তোমার চোখের হ্রদে চুরি করে চলে যাব রাজহাঁস, তোমার বাড়ির সুমুখে ফুটপাতে ঝরব মুহূর্তে, তোমার বুকের চাঁদ দেখে মেঘের ভিতর দিয়ে বজ্র চলে যাব—করে দাও মিল্টনের মতো অন্ধ, বেটোফেনের মতো বধির ॥

 


গ্রিনরোড


একদিন কুলিরোড ছিলে।
হাঁটু অব্দি ডোবানো ধুলোয় ছিলে এক নির্জন তাপস।
অড়হর-খেতে একদিন দেখেছিলাম তরুণ খরগোশ
যেন কোন প্রাকৃতিক নিবিড় নিখিলে
বিদ্যুচ্চমক তুলে মিশে গিয়েছিল মটরশুঁটির খেতে।
লাল-কালো কুঁচফল পেড়েছি একদিন সান্দ্র ঝোঁপ থেকে
দেখেছি ধানখেত, কামময়, গভীর খোড়ল, কৈশোরক নিরুদ্বেগে,
কৌতূহলে। তারপর সপ্তর্ষির নৈশ সংকেতে

আমগাছ জামগাছ কাঁঠালগাছের শ্যাম
ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণ বিল্ডিং,
নিভে যাচ্ছে ঘাস, উবে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে যে-পাতার শিকল
ধরিত্রীরই কোনোখানে যে-সব রয়েছে অবিকল—
অনশ্বর, অবিচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম ॥

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>