| 29 মার্চ 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

অমর মিত্র সংখ্যা: গল্প : মেলার দিকে ঘর । অমর মিত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 21 মিনিট

তিনদিন পর সন্ধ্যেয় সহদেব ঘরে ফিরে তার চোদ্দ বছুরে যে মেয়েটা ঘরের কোণে খিদেয় এলিয়ে ছিল তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কাল যাবি’?

মেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাপের দিকে তাকানোয় সহদেব এক গাল হেসে বলে, ‘সি. সিই মেলায়, আষাঢ়ী দ’র উপারে বড় মেলা দিখত্যা, সিবার বায়না ধরিছিলি, ইবার যাবি’?

বাপের কথা শুনে মেয়ে অবাক হয়ে নড়ে বসে। বাপের তার হ’লো কী, দিন তিনাক ধর‍্যা প্যাটে আগুন আর মিলা দেখার কথা কয়!

‘ই থলিতে চাল আছে রাঁধ, তুর মা কুমায়’?

এই বাক্যের সঙ্গে ক্ষুণ্নিবৃত্তির সঠিক সম্পর্ক থাকার দরুণ মেয়ে উঠে বসে, ছেঁড়া খোবড়া কাপড় দিয়ে উঠতি শরীর এদিক ঢাকে তো ওদিক আলগা হয়, অতঃপর বাপের দিকে নিঃসাড়ে চেয়ে থাকে।

সাধ করে মেয়ের নাম রেখেছিল লক্ষ্মী। সেই লক্ষ্মী এখন লক্ষ্মীছাড়া। দেহের আচ্ছাদনটি গামছার সমগোত্রীয়, বহরে যা একটু বড়। তা দিয়ে খোলামেলা দেহের পুরোটা ঢাকা হয় না সেহেতু চোদ্দ পার হওয়া পনেরো ছুঁই ছুঁই মেয়ের বাপের কাছে লজ্জা করে আর বাপেরও অস্বস্তি হওয়ার দরুণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে হয়। এইভাবে কিছুক্ষণ কাটার পর আঁধার ফুঁড়ে আর একটি জীবের আবির্ভাব হয়। সে সময় লক্ষ্মী উনানে আগুন লাগায়, বেশ কয়েকদিনের বাসি উনানে আবার রাঙা আগুন নড়েচড়ে। দুগ্‌গা জল নিয়ে ফেরে। অবস্থা তার কন্যারই মত। অবশ্য পাঁচ সন্তানের জননী হওয়ার দারুণ লাজলজ্জার বালাই নেই, সামান্য কটি বস্ত্রই যেন তার যথেষ্ট মনে হয়, শুষ্ক কোঁচকান বুক তেমনভাবে ঢাকার প্রয়োজন বোধ করে না বস্ত্রাভাবে। উনানে আগুন দেখে মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকানোয় লক্ষ্মী বলে, ‘বাপে এন্যাছে’ দুচোখ চকচক করে।

তিন তিনটে উলঙ্গ শিশু আর বছর দশেকের একটা উলঙ্গপ্রায় মেয়ের পাশে সহদেব বসে। দাওয়া মাটির সঙ্গে এক হয়ে গেছে, ঘরের চালের বাঁশ ঝুঁকে পড়ার ফলে ছাউনি নেমে এসেছে অনেক। শুকনো শন বাতাসে ওড়ে। এ বর্ষায় আর এ ঘর রক্ষা পাবে না এটা স্থির কেননা ধারালো দিনের আলো এখনই উঁকি ঝুঁকি মারে ফুটো চালের মধ্য দিয়ে।

‘তিন তিনটে দিন ছিল্যা কুথায়’? দুগ্‌গা জিজ্ঞেস করে।

‘ধান্ধায় ঘুরত্যা ঘুরত্যা আষাঢ়ী দ’র মেলায় চল্যা গিলাম, তুদের খাওয়া হইছে ই-কদিন।?’

থাকতিই দশদিন উপোস আর—দুগ্‌গা কথা শেষ করে না। শরীর অবসন্ন, খিদের জ্বালায় নেতানো, কথা বলতে কষ্ট হয়। ‘আর দুঃখু থাকবেনি, ট্যাকা জুগাড় হইছে, চাল এন্যাছি ভাত রাঁধ।’

‘ট্যাকা দিল কে?’ দুগ্‌গার জিহবায় তিক্ত স্বাদ, প্রশ্নেও।

‘অ জুটেছে ইক রকম, তো নক্ষীরে নি আষাঢ়ী যাব।’

‘কেনে?’

দুগ্‌গার প্রশ্নে সহদেব থতমত খায়, ‘না, ইমনি মেলা দিখার জন্যি।’

‘ইবার ই অবস্থায় মেলা হছে, কে যেন কয়ছিল হবেনি।’

এ কথায় সহদেব থমকায়, পর মুহূর্তে বলে, ‘ মুই ঘুইর‍্যা ইলাম আর মাইন্‌ষে কয় মেলা হচ্ছেনি।’ দুগ্‌গা নিশ্চুপ হয়ে শুনে যায়, প্রশ্ন করতে চায় না কেননা ক্রমাহত অন্নহীন থাকার পর মানুষের কৌতূহল লোপ পায়। অন্নের ভাবনা ছাড়া ভাবনা নেই।

সহদেব স্ত্রীর কাছে মালার গল্প করে, কদিন ধর‍্যা চলছ্যা সি মেলা, মুই ই-কদিন সিখেনে ছিলাম, সিখান থিকেই তো টাকা জুগাড় হ’লো। সিখেনে হরেকরকম মজা, রঙ বিরঙের জিনিশ, চুড়ী ডুড়ে শাড়ি, মণ্ডা মিঠাইর বাসে চাদ্দিক ম-ম করে, খেলাই বা কত রকমের, মরণ কূপ দিখে ডর লাগে, গা গতর ঠাণ্ডা মের‍্যা যায়, আন্ধারে উর তল দিখা যায়নি, পাগড়ি পরা মানুষ ঝপ কর‍্যা লাফ দিচ্ছে আবার হাসত্যা হাসত্যা উঠ্যা আসছ্যা উপরে, দুটো বাঘ আর ভল্লুক লিয়া সার্কেস আস্যাছে, হুরিপরি মেয়্যার দল ইকটুখানি পুষাক পর‍্যা কত ভয়ের খেলা দিখায়, নক্ষী দিকে মজা পাবে খুব, কত মজার খেলা!’

দুগ্‌গা চুপ ক’রে থাকে কেননা এ গল্প তার বহুবার গাঁয়ের নানান লোকের কাছে শোনা। যেতে ইচ্ছে হয় কিন্তু কোনোবার যাওয়া হয় না। সে বলে, ‘নক্ষী থাক বরং মুই যাই।’

সহদেব হা-হা ক’রে ওঠে, আরে না না উরে ক-বার কত্যাছি, পরের বার বরং তু যাস।

দুগ্‌গা আহত হয়, চুপ ক’রে ব’সে থাকে, অবশেষে বলে, উ যাক, ই ঘরে তো আর থাকবেনি বেশী দিন, সম্বন্ধ দিখার দরকার ইখন থিকে।

সহদেব কথা বলে না। চাদ্দিকে পাথর জমা অন্ধকার আর নৈঃশব্দ; দুইয়ে মিলে অন্ধকার গাঢ় এবং ভয়াবহ মনে হয়। কখনো বা দূরাগত কণ্ঠধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়। অন্ধকারে ব’সে থাকে সহদেব আকাশে চোখ রেখে দাওয়ার খুটোয় হেলান দিয়ে। ভাঙা উনানে জ্বালানো আগুনে আলো এসে কাঁপছে দাওয়ায়। ক্ষুধার্ত শিশুর দল উঠে উনান ঘিরে দাঁড়িয়েছে । তারা অবাক হয়ে ভাতের ভুট দেখে, আবছা গন্ধ ভেসে বেড়ায় সামনে পিছনে। গাঁয়ে আলো জ্বলে না সন্ধ্যেয়, মানুষজনও উধাও হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিরন্নের দল গাঁয়ের ধূলোয় পদচিহ্ন রেখে কোথায় চ’লে যাচ্ছে। যারা থাকছে তারা থাকবে কেননা সে কয়েকজনের গোলায় জমা আছে সারা গাঁয়ের মানুষের বছরের ধান। তারা কখনো মানুষ ভালো কেননা অসময়ে নিরন্ন মানুষকে দু-এক পালি ধান দিয়েও সাহায্য করে, যখন মর্জি হয় শোধ নেয় সুদে আসলে। আসল সুদের ঘায়ে পাহাড় হ’লে মানুষ হয় চার পেয়ে। সহদেবের ঘর শূন্য মাস দুয়েক আগে, এই প্রখর গ্রীষ্মে সে বুকে হাঁটা সরীসৃপ,। মজুরীহীন অন্নহীন মানুষ ক’দিন বাঁচে? ভাগের জমিতে বাবুর মজুর, লাঙ্গল ধরবে তারা। আর সে এখন এ-গাঁ সে-গাঁ দূর ওঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ায়—অন্ন চাই।

অন্নহীন পরিবারে বহুদিন পর অন্নের ছোঁয়া, তার গন্ধে সহদেবের স্ত্রী পুত্র কন্যা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। লোলুপ দৃষ্টিতে ফুটন্ত ভাতের দিকে তাকিয়ে।

‘মেলায় কাল হরেনের সঙ্গে দিখা, উ উখেনে বিড়ির কারবার ধরিছে, পয়সা হইছে বেশ, উ তুরে এটটা কাপড় দিল।’ সহদেব স্ত্রীর সামনে ভাঁজ করা কাপড় মেলে ধরে।

কাপড়ে লাল ডুরে। দুগ্‌গা ঝুঁকে পড়ে, আলো অপ্রতুল, আবছা আগুনে আলোয় কাপড়ের স্থানে স্থানে আগুনে রঙ ধরে। বোঝা যায় না স্পষ্ট কিছুই। দুগ্‌গা উলটে পালটে দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, অতঃপর বুকের উপর মেলে ধরে আধা ভাঁজ কাপড়।

‘ইডা পর‍্যা উ কাল মেলায় যাবে, কি কস তু?’ সহদেব স্ত্রীকে প্রশ্ন করে।

এ কথায় মেয়েমানুষটা চমকায়? ধড়ফড়িয়ে ওঠে। কাপড়টা কোলের কাছে পড়ে যায়। সহদেবের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে। নিরন্ন স্ত্রীলোকের সামনে পর্যাপ্ত সুখ। চারপাশে ফুটন্ত ভাতের গন্ধ, টগবগানো শব্দ, সে মাথা নামিয়ে সম্মতি জানায়। তবুও মেয়েমানুষের ভাবনা সহজে শেষ হয় না, সে উনানের কাছে বসা মেয়েকে দেখে, অবশেষে সহদেবকে উত্যক্ত করে প্রশ্নে, ‘তো হরেন ইতো ভাল হল কবে থিকে? পয়সা হলে তো মানষের মন ফিরে না, ইতো মনা হয়।’

সহদেব উত্তর করে না, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেমেয়ের মাকে দেখে, দুগ্‌গা ছটফট করে, অবশেষে আবার কথা বলে, ‘ ইত কষ্টের সময়ে আর মেলা দেখতি হবেনি, পয়সা থাক ঘরে।’

‘কেনে পয়সার অভাব তো আর হবেনি, হরেন উরে দেখতে চেয়্যাছে, বলল কত ছোট দিখেছি কত ডাগর হ’লো নক্ষ্মী।’

এই কথায় দুগ্‌গা নিশ্চুপ, দুহাত দিয়ে মাথার জট ছাড়ায়, চুল্কোয়। তার ভাবনা আসে না, খিদেয় শরীর টালমাটাল, চাদ্দিকে ভাতের গন্ধ গভীর হয়ে এসেছে। সহদেব স্তব্ধ হয়ে ব’সে থাকে। চতুর্দিকে এখন আঁধার গভীর, গাছপালায় দাঁত চাপা কাঠিন্য, বাতাস আসে না।

খাওয়ার সময় সুদেব লক্ষ্মীকে বলে, ‘খা খা বেশী ক’রে খা।‘

‘মুই বুঝিনি বাপু তুমার মতিগতি, প্যাটে ভাত জুটছেনি আর তুমি মিল্যা দিখার কথা কও,’ দুগ্‌গা মিন মিন করে করে।

‘তু থাম, বড্ড টকর মারিস, গিলছিস গিল’, সহদেব অধিকতর রুক্ষ।

খেতে খেতে সহদেব নিজের পাতের ভাত তুলে দেয় লক্ষ্মীর পাতে। দুগ্‌গা দেখে বলে না কিছুই। হাড়ে চামড়ায় আবদ্ধ বুক ধকপকায়, ভারী ঠেকে মাথাটা।

ভোর না হতেই দুগ্‌গা মেয়েকে সাজায়। লাল ডুরে শাড়ি পরায়, মাথায় বেড়াবিনুনী ক’অরে চুল বাঁধে। পুরনো বাক্সের কোণে একটা ইঁদুরে কাটা হলুদ ব্লাউজ ছিল, সেটাও পরায়, দুপায়ে গাঢ় করে আলতা দেয় আর ছোট্ট কপালে লাল টিপ যা আলতারই। তখন পুবের পৃথিবীতে গাঢ় লাল করে সূর্য ওঠে ঠিক যেন লক্ষ্মীর কপালের টিপ। অতি কোমল আলোয় লক্ষ্মীকে প্রতিমার মত দেখায়, সহদেবের ভাঙা ঘরে ছোট্ট কপালে লাল টিপ আর দুপায়ে গাঢ় আলতা পরে নবীন আলোয় দু;খী মেয়ে পৃথিবী হয়ে যায়, ভোরের পৃথিবী।

‘মেয়্যারে দিখায় বেশ।‘

‘হ্যা’ সহদেবের উত্তর।

‘বিয়ার দিন হইছে, ইরে ষোল সতেরো দিখায়, জন্ম তো সি সিই বড় বন্যার সময়, ইখেনে ম্যাজিসটিরি সাব এইছিল, তা চোদ্ধ পনেরো সাল হব্যা।’

সহদেব মাথা নাড়িয়ে দুগ্‌গাকে সমর্থন জানায়।

অন্নহীনের দেশে এমন চেহারা ক’জনের আছে! বাপের সঙ্গে লক্ষ্মী চলে মেলা দেখতে। উঠোনের ধূলোয় তার ছোটো নরম পায়েরর ছাপ পড়ে। এঁকে বেঁকে সামনে চলে যায় লক্ষ্মীর পদচিহ্ন; নরম ধুলোর পরে বৈশাখের আকাশতলে তার পদচিহ্নের আল্‌পনা আঁকা হয়।

‘হাঁটতি পারবনি?’ বাপের প্রশ্নে লক্ষ্মী সম্মতি জানায় মাথা নামিয়ে। দুগ্‌গা জীর্ণ কুটীরের সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে পথের দিকে, বুকটা তার ভার হয়ে আছে। কেমন যেন লাগছে! লক্ষ্মীর মাথার টিপ্‌—কমলা রঙের বিরাট বলয় পূবে রঙ ছড়াচ্ছে, সূর্য দেরী করে উপরে উঠুক না হলে তার মেয়ের কষ্ট হবে। তার লক্ষ্মী মেলা দেখতে যাচ্ছে।

বাঁধে বাঁধে রাস্তা। দু’পাশে আদিগন্ত অনাবাদী ধানী জমি, জলের জন্য আকাশের দিকে চেয়ে। সূর্য উঠেছে পূবের ঘন জঙ্গল ছাড়িয়ে প্রায় এক হাত। রাস্তার মাঝে মাঝে কোথাও বিশাল বট অশ্বত্থ দাঁড়িয়ে, সেখানে নরম ছায়া অতঃপর আকাশতলে হাঁটা। মাঠে লাঙ্গল নিয়ে যাচ্ছে দু’একজনা, তাদের কেউ হাঁকে, ‘ উ স’দেব চললি কুথায়, কুটুমঘর?’

সহদেব হাসে, জবাব দেয় না। লক্ষ্মী মাথা নামিয়ে হাঁটে। লাঙ্গল যারা ধরেছে, এখন তারা বাবুর বাড়ির লোক, পয়সার অভাব নেই। ‘শ্যালো এটটা থাকল্যা চাষ দিখায় দিতাম’, সহদেব আপন মনে বলে। বাবুরা শ্যালো পাম্প দিয়ে পাতালের জল জমিতে তুলবে আর হরিণা-ডাঙ্গি, মানিপুর, চন্দনপুর, আকালপৌষের অন্নহীন ভূমিহীনের দল মজুরির খোঁজে পরিবার অভুক্ত রেখে রাস্তায়।

‘সি-সিইযে তালগাছ দিখছিস, সি তালগাছের উপারে মানিকপুর, সিখেনে যাত্রা হইছিল, মনা আছে?’

লক্ষ্মী কোমল দুচোখ ফেলে দূরে—বহুদূরে মাঠ পার হয়ে আবছা কালো ছায়া ভেসে আছে তালগাছ বরাবর অনেক পিছনে। ঐ কালো ছায়ায় মানিকপুরের সীমা। সে হাঁটতে হাঁটতে দেখে পিতলরঙা রোদ উঠেছে চারপাশে। সে বলে , ‘মনা আছে, মুই যেছিলেম, ইবারেও যাব।’

সদেব দ্রুত হাঁটে, সুতরাং লক্ষ্মীও।

সহদেব বলে, জোরে হাঁট রোদ চড়া না হতি লোয়াদা পৌছাতি হব্যা, স্যখেন থেকে আরো কোশ দুই পথ।’

লক্ষ্মীর চারদিক পিতলরঙা রোদ আছে, বাতাসও, ফলত কষ্ট তেমন অনুভূত হয় না।

সহদেব বলে, ‘ই দেখ গরমিন্ট ইলিকটিরির তার লাগায়ছিল শাল খুঁটি পুত্যা, তো নাইট তো এলোনি– কারা সি তার কেট্যা নি গেছে।’

লক্ষ্মী দেখে লম্বা লম্বা শালের খুঁটিগুলো মাঠের মাঝে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে, মাথায় মাথায় জোড় তার উধাও। এইসব দেখতে দেখতে দ্রুত বাপের সঙ্গে তাল রাখতে রাখতে লক্ষ্মী মাঝে মধ্যে বেসামাল, ছোট্ট আঁচল সামলাতে হিম্‌সিম্‌। অনেক পথ পিছনে চলে যায় অতিদ্রুততায়।

‘ই দেখ সি মন্দির, মা তালন্দা, শেতলা মারে পেন্নাম কর।’

পথের ধারে উদ্ধতের মত দাঁড়িয়ে বড় মন্দির। চূড়ায় চূড়ায় তার রোদ আটকে থাকে। লক্ষ্মী গলায় আঁচল জড়িয়ে গড় হয়ে প্রণাম করে। সহদেব এক পলকে দেবীকে প্রণাম ঠুকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে, বিড়বিড় ক’রে বলে, ‘বড় জাগন্ত দেবী ইনি বুঝলি, যা পাবি তাই পাবি।’

মন্দির ছেড়ে দু’জনে আবার পথে। বাজারে একটা মানুষও নেই, শুধু কয়েকটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝিমোয়। রোদে রূপার বর্ণ ধরেছে। বাপে মেয়ে পা চালায় জোরে। লক্ষ্মী দেখে সহদেব দেখায়, ‘ই দেখ ই হ’লো শীষগেড়্যা পোস্টাফিস, ইখেনে পত্তর যদি ইকবার ফিলা যায় তবে বিলাতও চল্যা যায়, ইমনি কিরামতি মাস্টারবাবুর, উ দেখ দাঁড়ায়ে।’

লক্ষ্মী অবাক হয়ে মাস্টারবাবুকে দেখে পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে লুঙ্গীর কষি বাঁধতে বাঁধতে এদিকে তাকিয়ে। সে লজ্জা পায়, দু হাত বুকে চাপা দিয়ে জোরে হাঁটে। শীষগেড়্যায় হলুদ রঙের পোস্ট অফিস্‌ পার হয়ে অনেকদূর এগিয়ে যায়। এগোতে এগোতে লক্ষ্মী হঠাৎ দাঁড়ায়, এবার সে তার বাপ্‌কে দেখায়, ‘উ দেখ ঢ্যামনা সাপডা মাছ ধরিছে, উঃ গা কিমন করছ্যা!’

সহদেব দেখে পাশের কর্দমাক্ত ডোবা থেকে কালো সরু সাপটা শুকনো ডাঙায় উঠে মাছটাকে গেলার চেষ্টা করছে। সে বলে, ‘ ধুর তুর ইতেই ভয়, মেয়্যামানুষতো, উ সাপ্‌ তো মাছ ধরব্যাই।’

লক্ষ্মীর সমস্ত দেহে শিহরণ লাগে, সে হাঁটতে শুরু করে, ‘মাছটা ট্যাংরা হলি বেশ হত, মজা বুঝত উ ঢ্যামনা’, চলতে চলতে লক্ষ্মী বলে।

এই ভাবে তারা দু’জনে কত পথ পার হয়ে যায়। উজ্জ্বল আলোয় লক্ষ্মী চারপাশ দেখে অবাক হয়। এমন ভাবে এদিক দেখেনি সে; গেছে যা দু’একবার যাত্রা দেখতে সে তো রাতে হরিণাডাঙ্গীর পথে মাঠ ভেঙে। তখন তো সব আঁধার আর আঁধার।

‘ই দ্যাখ সি কিলাপ, ইখেন থিকে সিবার বন্যের সময় রিলিফ নিতা আসতাম, মনা আছে?’ সহদেব কন্যাকে আকালপৌষের সেই জীর্ণ ক্লাব ঘর দেখায়, রাস্তার ধারে বড় নিঃসঙ্গ।

‘সি কিলাপ!’ লক্ষ্মী অবাক হয়, ‘সি রাস্তা ই নাকি, চিনাই যায়নি!’

‘চিনবি কি কর‍্যা তখন তো সব জলে এক।’

‘ইবার দিবে?’ লক্ষ্মী সাগ্রহে প্রশ্ন করে।

‘হ বন্যে তো হবেই আর দিবেও বুধয়, উ খালটার মুখ কেট্যা দিলা সব চুক্যা যায় তা গরমিন্ট তো আর কাটবেনি।’

ওরা হাঁটে, বহুদূরে এগোয় লক্ষ্মী। এসব অচেনা, দুপাশে অনাবাদী ধানী মাঠ মাঝে উঁচু ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা, গাঁয়ের লোক বলে বাঁধের রাস্তা, এক হাঁটু ধুলো, দরদরিয়ে ঘাম ঝরে। সুর্য উপরে উঠেছে, রোদ হয়েছে গাঢ়, রাস্তার ধারে বড় একটা বকুল গাছের তলা বকুল ফুলে ছেয়ে আছে। বাতাসে ফুলের গন্ধ ভাসে। এই বাতাস লক্ষ্মীকে ঘরের কথা মনে পড়ায় তাই সে উন্মনা। রোদ অর্থাৎ উত্তাপ দেহ সাপ্টে ধরেছে, মাথা ঝুঁকে পড়ছে মাটির দিকে তবুও সে হাঁটে। খিদে আবার নড়াচড়া করে তার শরীরে, মাথা ঝিম্‌ মারতে চায়। সহদেব বলে, ‘আর একটু হাঁট, কাঁসাই পার হলিই পৌঁছা যাব লোয়াদা’।

সহদেব কাসাই নদীর কথা বলে। লক্ষ্মী মোহগ্রস্তের মত হাঁটে। তীব্র রোদে শরীর টাটায় তার। ক্রমে উঁচু বাঁধ দেখা যায় নদীর। সহদেব তর্জনী তোলে দূরের দিকে, ‘উই নদী দিখা যায়, চল জোরে চল এস্যা গিলাম’।

লক্ষ্মী সামনে দৃষ্টি ফেলে, উঁচু বাঁধ দেখা যায় নদীর, ঘন গাছগাছালিতে ঢাকা, নদী কত কাছে। হঠাৎ হরিধ্বনিতে তার চমক ফেরে, ছিটকে সে সহদেবের গা ঘেষে দাঁড়ায়। কোনাকুনি মাঠ ধরে বাঁশের চালিতে একটা মড়া মেয়েমানুষকে শুইয়ে কটা লোক হরিধ্বনি দিতে দিতে বাঁধের রাস্তায় ওঠে। তারা এগোয়। লক্ষ্মী জোড় হাতে প্রণাম করে। মেয়েমানুষটার পা দুটো চালি থেকে বেরিয়ে দুলছিল। লক্ষ্মী সবিস্ময়ে দেখে মরা মেয়েমানুষটার পায়ে গাঢ় আলতা মাখানো, সে নিজের পায়ের দিকে তাকায়। দুঃখে তার দুচোখ ছাপিয়ে জল আসে, ধুলোর আস্তরণে পায়ের আলতা মুছে ধুলি ধূসরিত হয়ে গেছে পা দুটো তার।

‘কোন গাঁর গো’?

‘উ নরহরিপুর’।

‘কি হইছিল’? সহদেবের দ্বিতীয় প্রশ্নে শবযাত্রীরা তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয় না, গতিবেগ বাড়ায়। একজন বলে, ‘গলায় দড়ি, সুমত্ত মেয়্যামানুষ অভাবে নষ্ট হলো, গলায় রশি বেন্ধ্যা ঝুল্যা পড়ল।’

লক্ষ্মী বাপের হাত ধরে, শবযাত্রীর দল বাঁশের চালি বয়ে এগোয়, মাঠে নামে আবার ওরা, কাঁসাই-এর বাঁকে বালিতে পোড়াবে দেহ।

সূর্যে আগুন ধরেছে তাই বাতাসেও। ক্রমে নদীর পাড়ে পৌঁছায় তারা, এইখানে রাস্তা দ্রুত উপরে উঠে আবার নেমেছে নদীর বুকে। লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করে, ‘ইখনও কদ্‌দুর মেলা’? সহদেব নিরুত্ত।

‘এট্টা ফিতা কিনা দিবা, লাল ফিতা।’ সহদেব নিরুত্তর। লক্ষ্মী দেখে বাপের চোখ মুখ কেমন রুক্ষ হয়ে আসছে। প্রতি পদক্ষেপেই ছোট্ট একটা চায়ের দোকান, সহদেব দাঁড়ায় সেখানে। পাঁচটা মানুষ বসেছিল। একজন হেসে বলে, ‘এই বুঝি তোর লক্ষ্মীরে স’দেব?’

‘হাঁ’।

‘তা দেরী হ’লো কেনে?’

‘এজ্ঞে টায়েম তো ঠিক রেখ্যাছি’, সহদেব আস্তে করে বলে।

আধঘণ্টা দেরী, একটা মানুষ কবজি উলটে ঘড়ি দেখে।

পাঁচটা মানুষ লক্ষ্মীকে দেখে। জহুরীর চোখে দেখে।

ওরা আবার এগোয়। লক্ষ্মী এবার আগে আগে, সহদেব আর পাঁচটা মানুষ পিছনে। ক্রমে নদীতে নামে। মাথায় বোশেখের পোড়া আকাশ নিয়ে নদী পড়ে আছে সটান, জল শূন্য শুষ্ক বালি উজ্জ্বল রোদে ঝক্‌ঝক্‌ করছে। নদীর উপরে আগুনে বাতাস, নিরন্ন মানুষের মত নদী আকাশ দেখে। লক্ষ্মী জোরে হাঁটার চেষ্টা করে, তাড়াতাড়ি মেলায় পৌঁছান দরকার। গরম বালির ভিতর ডুবে যাচ্ছে তার পা– হাঁটা দুষ্কর। শূন্যে ডানা ভাসিয়ে চকচকে বালির উপর গাঢ় বাদামী শকুন নামে ওই কোণে, বালির উপর আরো কয়েকটি ব’সে। ডানা বিছিয়ে ক’টা শকুন লাফিয়ে লাফিয়ে এগোয়, একটা অন্যকে ডানা বিছিয়ে তাড়া করে, কর্কশ চীৎকার বাতাসে ভাসে। লক্ষ্মী উন্মনা, এসব দেখে না– তাই সেদিকে চলে যায় অনায়াসে, বাপ তার বেশ পিছনে। সে থমকে দাঁড়ায় শকুনের চীৎকার শুনে, ঘুরে ডান দিকে তাকায়, দেখে বালির উপর, ওকী! একটা বাচ্চার দেহ বালির ভিতর থেকে রাত্রে শিয়াল টেনে তুলেছে, এখন সেখানে শকুনের পাহারা। আগুনে বালির উপর ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে লক্ষ্মী ভয়ে ছুটে পালাতে চায় আর তখনই গরম বালির ভিতর তার পা ডুবে যায়, ভয়ে পা হড়কায়। তার চীৎকার শুনে সহদেব ছুটে আসে, লক্ষ্মী বাপের দেহ আঁকড়ে ধরে, ভয়ে ওর শরীর নীল, থরথরিয়ে কাঁপে। সহদেব দেখে লক্ষ্মীর পায়ের গাঢ় আলতার দাগ মুছে গেছে– সেখানে কিছু নেই, কপালের টিপ্‌ মুছে গেছে, সযত্নে বাঁধা চুল খুলে ছড়িয়ে পড়েছে মুখময়, আঁচল লুটোয় বালিতে। বাতাসে এখন কঠিন উষ্ণতা, উপরে প্রখর রৌদ্র পায়ের নিচে তপ্ত বালি। বালির বিস্তার সামনে পিছনে, যতদূরে চোখ যায়।

‘আর মেলায় যাবনি বাপ্‌, ঘরে নিই চল।’ লক্ষ্মীর আর্তনাদে সহদেব নিরুত্তর। সহদেব কঠিন হয়ে বালির উপর দাঁড়িয়ে থাকে, কেননা কোমরে ওর এক কুড়ি টাকা আর জিহ্বায় গত রাত্রের অন্নের স্বাদ এখনো বর্তমান। সেই পাঁচটা মানুষ বালির উপর লাফায়, লাফিয়ে এগিয়ে এসে বলে, ‘অ স-হ-দেব হ’লো কী, মেয়্যা তুর কান্দে কেনে?’

:

রূপান্তর

কার্তিককে বলো ঋত্বিক রোশন কেমন ভাবে গান গায়, কেমন ভাবে হাঁটে, কার্তিক তা দেখিয়ে দেবে। কার্তিককে বলো শাহরুখ খান কীভাবে প্রেম-নিবেদন করেছিল সিনেমা সুন্দরী কাজলকে, কোন ডায়ালগ কখন কীভাবে বলেছিল, কার্তিক হুবহু দেখিয়ে দেবে। যদি বলো অমিতাভ বচ্চন ‘কোন বনেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানে কীভাবে বাতচিত চালায় টেলিভিশনের পর্দায়, তাও দেখিয়ে দেবে কার্তিক। গলার স্বরেও নিয়ে আসবে প্রায় বৃদ্ধ নায়কের যৌবনকালের সেই আশ্চর্য দার্ঢ্য, গম্ভীর মেঘের মতো ডেকে উঠবে, বোলিয়ে পুষ্পাজী, বোলিয়ে।

কার্তিক যে কী করে পারে? ইন্দ্র রায় রোড, ভূতনাথ বিশ্বাস লেন, বাইলেনের সবাই বলে কার্তিক প্রতিভাবান। ঠিক মতো লোকের চোখে পড়লে মুম্বই পর্যন্ত চলে যেতে পারত কার্তিক। হয়ে উঠত সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক কার্তিককুমার। নাহলে কার্তিক সাত নম্বর বাড়ির অজিত সাহাকে কীভাবে অনুকরণ করে দেখায়। যদি বলো ইন্দ্র রায় রোডের সাত নম্বর জাহাজ বাড়ির সাহাবাবু কীভাবে মর্ণিং ওয়াক করে দেখিয়ে দে দেখি কার্তিক, কার্তিক তা দেখাবে। স্থুলকায় সাহাবাবু হাঁটতে হাঁটতে কীভাবে দাঁড়াচ্ছেন, হাঁপিয়ে পড়ে শ্বাস নিচ্ছেন, তখন মুখের ভাব কেমন হয়ে উঠছে তার—সব। সাহাবাবুর সঙ্গে হাঁটে তার কাজের ছেলে মাধব, তোয়ালে নিয়ে পিছনে পিছনে চলে। মাধব ঘাম মুছিয়ে দেয় তার বাবুর। তখন সাহাবাবু দাঁড়িয়ে কীভাবে সুখভোগ করতে থাকেন, তাও দেখায় কার্তিক। লোকে হেসে বাঁচে না।

এখন শীতের আরম্ভ। দর্জির দোকানে কাজের কোনো চাপ নেই। সেলাই মেসিনে পায়জামা সেলাই, লুঙ্গি সেলাই–বাকি সময় কার্তিকের এইসব। এইসব না করলে কার্তিকের সময়ই বা কাটে কী করে? ভূতনাথ বিশ্বাস লেন, ইন্দ্র রায় রোডের নিষ্কর্মাদেরই বা দিন যায় কীভাবে?

কেউ কেউ বলে, চালিয়ে যা কার্তিক, ঠিক একদিন কারোর চোখে পড়ে যাবি, সিনেমার নায়ক হতে গেলে চোখে পড়তেই হবে।

তখন কারোর কারোর মনে পড়ে কার্তিকের বাবা দীনেশের কথা। দীনেশ তো শেষপর্যন্ত কারোর চোখে পড়েনি। কার্তিক তার বাবার গুণ পেয়েছে। তার বাবার কিছু হয়নি। অবিকল দেবানন্দ, অবিকল গাইড ছবির নায়ক কালাবাজার, জুয়েলথিফ ছবির নায়কের মতো হেঁটে বেড়ানোর পরেও, ডায়লগ হুবহু শুনিয়ে দেওয়ার পরেও দীনেশের কিছু হল না। তখন কার্তিকের শেষ অবধি কি কিছু হবে? দীনেশের কথা মনে পড়ে পঞ্চাশপার হওয়া মানুষজনের। দীনেশ তো ধর্মতলায় গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে পর্যন্ত চলে যেত অবিকল দেবানন্দ হয়ে, সেই চুল, সেই তাকানো, সেই রকম কথা বলা—কই কেউ তো ডেকে নেয়নি তখন দীনেশকে। তিরিশ-বত্রিশ বছর আগের দীনেশ এখন নৈহাটির কোন এক জুটমিলের কর্মী, বছরে ছ’মাস বন্ধ থাকে সেই মিল। বাকি ছ’মাস ধুঁকতে ধুঁকতে চলে। দীনেশ এখন কত বুড়ো হয়ে গেছে। কেমন বেঁকে গেছে, মাথার সব চুল পাকা। হায় দেবানন্দ! টেলিভিশনে যখন জুয়েল থিফ বা কালাবাজার দেখায়, বা ক্যাসেটের দোকানে যখন মহম্মদ রফি-র কণ্ঠে বেজে ওঠে গাইড ছবির গান, দীনেশ তখন বসে থাকে খেলার মাঠের অন্ধকারে একা একা। এই হিমবর্ষী প্রথম শীতের সন্ধ্যাতেও।

দীনেশের ছেলে কার্তিক যখন নিজেকে করে তুলছিল তার বাবার চেয়েও আরো প্রতিভাবানের মতো একজন, দর্জির দোকানে সেলাই মেসিনে পা চালিয়েও যখন সে পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে গান তুলে নেওয়ার মতো করে চেনা মানুষের চেনা অভিব্যক্তি, নানা মুদ্রাকে তুলে নেয়, তখন পাড়ার পুরনো লোকজন দীর্ঘ নিঃশ্বাসও ফেলে, এতটা এমন পেরেও কার্তিকটা দর্জিই থেকে যাবে। কই, কেউ তো ডেকে নিচ্ছে না কার্তিককে।

ডাক এল একদিন। সাত নম্বর বাড়ির সাহাবাবু এক সকালে মাধবকে পাঠাল দর্জির দোকানে, সাহাবাবু তোকে ডাকছে।

সাহাবাবু! কেন রে মাধব? ভয় পেয়ে যায় কার্তিক। সাহাবাবু কি শুনতে পেয়েছেন কার্তিক তাকে নিয়ে ক্যারিকেচার দেখায় দর্জির দোকানের সামনের অন্ধগলিতে। লোকটাকে দেখে ভয় করে কার্তিকের। কতবড় বাড়ি। একেবারে জাহাজ যেমন হয়। রেগে গেছে নাকি মাধবের বাবু? মাধব ঘাড় নাড়ায়, সে জানেনা। মাধবটা অদ্ভুত ছেলে। সাহাবাবুর খাস লোক, সাহাবাবু যখন এগারটায় দোকানে বেরোন মাধব সঙ্গে চলে। যখন তিনি ফেরেন, মাধব সঙ্গে ফেরে। সাহাবাবুর প্রাতঃভ্রমণেও সে যেমন সঙ্গে যায়, বাজারঘাটের সময়ও মাধব পিছু পিছু থলে হাতে চলে।

কোথায় তোর বাবু?

মাধব বলল, বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, তুই চল, এক্ষুনি ডাকছে।

ভয়ে ভয়ে কার্তিক যায়। তার কপালে কী আছে কে জানে? আজও তো সাহাবাবুকে দেখিয়েছে সে, থল থল দেহ নিয়ে কেমন হাঁটেন তিনি। তা দেখে পাঁচজন লোক হেসে গড়িয়ে পড়েছে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে। কার্তিকের ক্যারিকেচার দেখতে এসে কেউ কেউ চায়ের অর্ডার দেয়। বীরেনের চা-দোকান চলছে ভাল। সে ফ্রিতে চা খাওয়ায় কার্তিককে।

কার্তিক যখন মাধবের সঙ্গে যায়, বীরেন পিছু পিছু আসে দোকান ছেড়ে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছিসরে মাধব, কে ডাকছে?

কিছুটা এগিয়ে বীরেন দাঁড়িয়ে থাকে। কার্তিক না থাকলে লোকই ঢোকেনা এই ছায়া অন্ধকারে ঢাকা শীতের গলিতে। সে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে, কার্তিক যেন হাঁটছে সাহাবাবুরই মতো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে, বিড়বিড় করে বীরেন, শালা পারেও বটে, আটিস বটে, দেখে মনে হচ্ছে বাবুর পাশেই যাচ্ছে মাধব।

জাহাজ বাড়ির ভিতরে অনেকটা প্রশস্ত চাতাল। সেখানে শীতের রোদ বিছিয়ে আছে ফরাশ পাতার মতো করে। রোদের ফরাসের উপর ডেক চেয়ারে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন মাধবের বাবু, কার্তিককে দেখে তিনি দাঁড়াতে বলেন সামনে, কী করিসরে?

টেলার, দর্জি।

দীনেশের ছেলে?

হা স্যার।।

তোর বাবাও পারত, একেবারে দেবানন্দ, তুইও তো পারিস।

কার্তিক মাথা কাত করে, পারি।

চ্যাপলিন হবি?

আজ্ঞে ?

চ্যাপলিন জানিস?

কার্তিক চুপ করে থাকে। তখন সাহাবাবু জিজ্ঞেস করেন, তোর বাবা দীনেশ কী করে?

বলল কার্তিক, শুনে কোনো মন্তব্য করলেন না সাহাবাবু। বললেন, এখন সার্কাসের মরসুম, শীতকাল তো এমনিই ফুর্তির সিজন, আমার দোকান চিনিস?

চিনি। কার্তিক বলল, শ্যামবাজারে বস্ত্রকুটির, হাতিবাগানে টিভির দোকান আর টাউন স্কুলের সামনে ভ্যারাইটি স্টোর।

তোকে চ্যাপলিন সাজতে হবে, তুই চ্যাপলিনকে চিনিস না?

না আঁজ্ঞে ।

না চিনলে কী করে হবি?

আপনি দেখিয়ে দেবেন।

ধুস, ও কিছু না, প্রায় জোকারের মতো, মাথায় টুপি, কালো কোট, প্যান্ট, হাতে বাঁকানো লাঠি, বস্ত্রকুটির সাজানো হয়েছে, প্রচুর গরম কাপড়, শাল সোয়েটার তোলা হয়েছে, রিবেটও চলবে, তুই দোকানের সামনে চ্যাপলিন সেজে খদ্দের ঢোকাবি, পারবি?

কার্তিকের কেন যেন মনে হলো এই ভাবে সে এগোবে। এখন আরম্ভ হলো তার মুম্বই কি টালিগঞ্জ যাত্রা। সাহাবাবুর বস্ত্রকুটির শ্যামবাজার পাঁচরাস্তার মোড়ে, সবচেয়ে জনবহুল রাস্তার উপরে। ভূতনাথ বিশ্বাস বাইলেনের রৌদ্রবিহীন ছায়া ঢাকা শীতার্ত গলি ছেড়ে সে গিয়ে দাঁড়াবে প্রশস্ত রাজপথে। মাথায় টুপি, গায়ে কোট, প্যান্ট—চার্লি চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিনকে সে কি দ্যাখেনি? দেখেছে টিভি-তে কয়েকবার। কিন্তু সাহাবাবুর কাছে চুপ করে থাকাই ভাল।। লোকটাকে দেখলে ভয় করে। আবার তার ভয় যে অমুলক তা ধরতে পারছে কার্তিক এখন।

সাহাবাবু বললেন, তোর ডিউটি পাঁচটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত, ডেইলি। ষাট টাকা করে পাবি, টিফিন পাবি, সন্ধেয় দর্জির দোকানে ছুটি নিতে হবে।।

নেবে। দর্জির দোকানে এই সিজিনে কাজ কোথায় ? বড় বড় সেলাই কারখানা খেয়ে নিয়েছে ছোট দর্জির কাজ। এমনিই তো ঘুরে বেড়ায় সে সন্ধেবেলা। কখনো ক্যারিকেচার দেখায়, কখনো টিভি দ্যাখে ক্লাবঘরে, কখনো সিনেমা দেখতে যায় শ্যামবাজারে। মনে মনে উত্তেজিত হয়ে ওঠে কার্তিক। সন্ধের শ্যামবাজারের ফুটপাথে সে একদিন শ্যামলীকে দেখেছিল। শ্যামলী টিভি-তে খবর পড়ে। একদিন দেখেছিল রমিতাকে। সে টিভি-তে কুইজ করে। শ্যামবাজারের রাস্তায় এরা তো থাকেই, থাকে আরো বড় বড় মানুষ। টিভি-র। ডিরেক্টর, সিনেমার ডিরেক্টর। তাকে পছন্দ হলেই…।

সাহাবাবু বললেন, দোকানের সামনে ভীড় জমিয়ে দিতে হবে অ্যাকটিং করে, মাইম অ্যাকটিং, নির্বাক অভিনয় করবি, কী বুঝলি?

কার্তিক ঘাড় কাত করে। সাহাবাবুর পিছনে মাধব দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখে কার্তিককে দেখছিল। সাহাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোর কোট প্যান্ট টুপি, গোঁফ লাগবে, কই?

জানিনে তো, নেই আমার।

আমার দোকানে আছে, এই মাধবটার জন্য কেনা হয়েছিল, ও বেটা ইডিয়ট। গো-মুখ্যু। ওসব পরে চ্যাপলিন সেজে বাইরে কাঠপুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকল, ছাগল দিয়ে জমি চাষ হয়!

কার্তিক দেখল মাধব অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ সাহাবাবু রেগে গেলেন, এই গাধা, দাঁড়িয়ে কী শুনছিস, যা চা নিয়ে আয় ভিতর থেকে, তোকে নিয়ে কী করব বল দেখি। এরপর দুই লাথে ভাগিয়ে দেব।

কার্তিক একটু কুঁকড়ে গেল, সে বলে ওঠে, না না আমি চা খাব না, আমি এবার যাই স্যার।

যা, চারটের সময় দোকানে চলে যাবি, মেকাপ করতে হবে তো তোকে।

হা স্যার যাব।

সাহাবাবু তার পা নাচাতে লাগলেন, দেখি তুই কেমন পারিস, ও তল্লাটে এমন ব্যাপার আগে হয়নি, এসব বিলিতি কায়দা, বিলেতে এইভাবে খদ্দের টানে, লেডিজ গারমেন্টস এর। দোকানের সামনে মডেল দাঁড় করিয়ে দেয় টু-পিস পরিয়ে, বুঝলি?

কার্তিক হা না কিছুই বলেনা। যা বলেন সাহাবাবুই বলেন, যা শোনেন তিনিই শোনেন, কিছুটা শুনতে হয় কার্তিককে। ওই আসছে মাধব। মুখখানি কীরকম যেন। কার্তিক তার দিকে চেয়ে হাসল। মাধব হাসতে গিয়েও হাসল না। তার হাতে ট্রে। ট্রের উপরে চায়ের কাপ প্লেট। থরথর করে কেঁপে উঠল চা ভর্তি কাপ। কোনো রকমে সামলে নিল মাধব।

দুই

কার্তিকের অপেক্ষায় ছিল বীরেন। চা-দোকানের চার জন পার্মানেন্ট খদ্দেরও অপেক্ষা করছিল কার্তিকের জন্য। অজিত সাহা লোকটা টাকার কুমীর। চোখের সামনে ভাঙা একতলা বাড়িটাকে কতবড় করে তুলল। একটা ব্যবসা থেকে তিনটে ব্যবসার পত্তন করল। দু’খানি গাড়ি। সেই লোক কেন ডেকেছে কার্তিককে, কৌতূহল তো থাকবেই। বীরেনের আছে। কৌতুহল, অনিল হালদারেরও কৌতূহল আছে।

বছর পঞ্চান্নর অনিল হালদার কিছুই করেনা প্রায়। একটা আধভাঙা টাইপ রাইটারের মালিক সে। ওই যন্ত্রটি নিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে গাড়ি বারান্দার নীচে গিয়ে বসে বেলা এগারটা নাগাদ। তাতে কী হয় না হয় তা জানে অনিল নিজে, সে বলছিল, ফরাক্কা থার্মাল পাওয়ারে তার চাকরিটা হয়েই গিয়েছিল, পাকা ঘুঁটি কাঁচিয়ে দিয়েছিল ওই সাহা।

কী করে কাঁচালো? বীরেন চায়ের গেলাসে চামচ ঠুনঠুন করতে করতে বলে।

শুয়োরের বাচ্চা পোস্টাপিস চিঠিটা হারিয়েই দিল, সাহা বলে দিয়েছিল ডাকপিয়নকে, আমি জানি।

সাহা এটা করল কেন?

কেন আবার, ওর অনেক কিছু আমি জানতাম, কার পেট করেছিল, কার পেট খসাতে টাকা দিয়েছিল, কাকে ধরিয়ে দিয়েছিল পুলিশে।

চাকরিটা তাহলে হলো না?

আবার হয়নি বললেও ভুল হবে, অনিল হালদার বিড়ি ফুকফুক করতে করতে বলে, আমি তক্কে তক্কে ছিলাম, চলে গেলাম ফরাক্কায়, গিয়ে দেখি আর এক অনিল হালদার চাকরি করছে সেখানে।

আশ্চর্য! পুলিশে গেলিনা কেন?

মাথা খারাপ, পুলিশ মানে তো থানার বড়বাবু বিভূতি পাল, সে প্রত্যেকদিন একটা করে মানুষ খেত, তখন প্রত্যেকদিন লাশ পড়ত, বড়বাবু বলেছিল দুটো অনিলের একজনকে আগে মারবে, কে আগে মরবে তা আমাদেরই ঠিক করে নিতে হবে, সাহা ছিল থানার খোচড়।

তারপর কী হলো?

এখন আমি বিশ হাজার টাকা মায়না পেতাম তখন চাকরিটা হলে, আমার বড় মামা ফরাক্কার বড় অফিসার ছিল, ফ্রি ইলেকট্রিক, হিটার জ্বালাও, সারা রাত্তির আলো জ্বালাও, বিল নেই, এই তো কাত্তিক, কী হলো রে সাহার ওখানে, সাহা হইতে সাবধান, ওকে একদিন গিয়ে বললাম ইন্টারভিউ দিতে যাব, জামাপ্যান্ট দাও, চাকরি হলে শোধ দেব।

কবে বললে ?

কবে যেন, আগের মাসে নাকি আগের বছর, পুজোর আগে নাকি রথের আগে। শালা বলে কিনা দোকানের সামনের ফুটপাথটা ঝাট দিয়ে দিতে, আমি সাহাকে ছাড়ব না।

অনিল হালদার এই রকম। মাথাটা গেছে ওর। এ বেলায় সাহার শ্রাদ্ধ করছে তো ও বেলায় তার পুজো করছে পঞ্চপুষ্প দিয়ে। সাহা কবে ওকে চাউমিন খাইয়েছিল বাড়িতে ডেকে, একবার হালখাতার দিনে পয়লা বৈশাখে সাহার তিন দোকানে গিয়ে কটা কোল্ডড্রিংকস সাবাড় করেছিল সে তার ফিরিস্তি দিতে দিতে বলে, সাহা তার ন্যাংটো বেলার বন্ধু, মনে রেখেছে এখনো।

কার্তিক তার চাকরির কথা বলল চা-দোকানে এসে। তারপর সেলাই মেসিনে গিয়ে বসল। কার্তিকের কথা শুনে অনিল হালদার বলল, এইটাই তো গোলমাল, আমার বদলে আর এক অনিল ফরাক্কায় ঢুকল, করে দিল ওই সাহাই, এখন এক চাল্লি চ্যাপলিনের বদলে কাত্তিক, কেন চাল্লিকে নিয়ে আয়, দেখি তোর হিম্মত।

সবাই হাসতে লাগল। অনিল উঠল, বলল, কাত্তিক তুই বলে দিস তোর মালিককে, আমি ভুলিনি, ফরাক্কায় ঢুকলে আমার বিশহাজার টাকা মায়না হতো এখন, আমার টাকা খেত কে, আমি তো টাইপই করতাম রাস্তায় বসে, অমন চাকরিতে হিসি করে দিই।

কার্তিক সমস্ত দিন ভাবল। বিকেল বিকেল রওনা হলো। পরদিন সকালে দর্জির দোকানের মেসিনে বসল, আবার বিকেলে উধাও হলো। চা-দোকানের বীরেন খবর পেল কার্তিক এমন দাঁড়িয়েছে ফুটফাথে চার্লি সেজে যে লোক জমে গেছে বস্ত্রকুঠিরের সামনে। সাড়া পড়ে গেছে। লোকে অবাক হয়ে দেখছে কার্তিককে। কার্তিক তার বাঁকানো লাঠি দিয়ে লোক টেনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে দোকানে। কোট প্যান্ট হ্যাট পরা কার্তিককে চেনাই যায় না।

দিন পাঁচেক আসাই বন্ধ করল কার্তিক। চা দোকানি ভাবল অমন কাজ পেয়েছে, আর্টিস্টের কাজ আর্টিস্ট পেয়েছে, আর সেলাই মেসিনে বসবে কেন? এবার কার্তিক উঠবে, উঠতে উঠতে শাহরুখ খান হয়ে যাবে, অক্ষয় কুমার হয়ে যাবে। সাহাবাবু যদি প্রমোট করে। কার্তিককে আটকাবে কে?

কার্তিক ফিরল দর্জির দোকানে দিন কয় বাদে। সকালে সে করছিল কী? বলল, ক’দিন প্রাকটিস করেছে চ্যাপলিনের ভিডিও দেখে। শুনে সকলে অবাক। এই কি সেই কার্তিক? চেহারাতেও জেল্লা এসেছে যেন। কার্তিক বলল, দেখবে বীরেনকা’, দেখাব?

কী দেখাবি? অনিল হালদার বিড়ির ধোঁয়া উড়িয়ে জিজ্ঞেস করে।

সাহাবাবুকে দেখবে?

কেন চাল্লি দেখা, শালা কঞ্জুষ। আমার বদলে অন্য অনিল ঢুকে গেল ফরাক্কায়, দুর্গাপুরে, হলদিয়ায়, চাল্লির বদলে তোকে চাল্লি সাজাচ্ছে, তখন চাকরিতে আমি…।

কার্তিক বলল আবার, সাহাবাবুকে দেখ জেঠু।

পারবি দেখাতে? চা-দোকানি বীরেন জিজ্ঞেস করে।

পারব। বলতে বলতে কার্তিক গলা ভারী করে ডাক দিল, মাধব, এ্যাই শুয়োরের বাচ্চা, খানকির ছেলে এদিকে আয়।

এ কীরে, কে কাকে ডাকে ?

বুঝতে পারলে না, তাহলে কি আমি পারলাম না? হতাশ হলো যেন কার্তিক।

না, না, সাহা দোকানে বসে খিস্তি মারে?

মারে, ভিতরে সাহার একটা নিজস্ব রুম আছে, চেম্বার, সাড়ে আটটার পর দোকান বন্ধ। সাহা তখন বিলিতি খায়, পেটে পড়লেই খারাপ কথা বেরোয় মুখ থেকে।

মাধব তখন কী করে?

কার্তিক দেখায়। মাধব তখন কুঁকড়ে যায়। সাহা হ্যা হ্যা করে হাসে। সাহার হাসি দেখায় কার্তিক। তারপর বলে, এই কাত্তিক, তোর কাজটা মাধবকে দিয়ে করাবো ঠিক করেছিলাম কিন্তু শুয়োরের বাচ্চাটা পারলই না, মুখে হাসিই ফোটে না ওর। এই মাধব হাস দেখি। এই বানচোত হাস বলছি, নাহলে তোকে প্যান্ট খুলতে হবে।

হাসল মাধব? জিজ্ঞেস করে উত্তেজিত অনিল হালদার।

মাথা নাড়ে কার্তিক। তার মুখ থমথম করতে থাকে, চোখ ভার হয়ে যায়। চোখের তলে অশ্রুবিন্দু জমা হয়ে, ঠোঁটের দুইকোণ থিরথির করে কিন্তু হাসির ভাব এসেও আসে না। হাসি ফুটতে চেয়েও ফোটে না। সবাই অবাক হয়ে কার্তিককে দ্যাখে। অনিল হালদার উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, বলে উঠল, কী হলোরে কাত্তিক, কাঁদিস কেন?

কার্তিক বলল, আমি না মাধব, হয়নি?

অনিল হালদার মাথা দোলায়, হয়েছে, দেখে খুব কষ্ট হলো আমার, ইস! মাধবের খুব কষ্ট! হিসি করে দিক কাজে, আমাকে দেখুক।

মুখটা হাতের পাতা দিয়ে মুছে কার্তিক বলল, আর দেখবে?

শাহরুখ হ দেখি, ক’দ্দিন দেখিনি।

কার্তিক মাথা নাড়ে, বলে, এই দ্যাখো সাহা কীভাবে টাকা গোনে, মাধব কীভাবে বাণ্ডিল বানায় নোটের, এই দ্যাখো নোট গুণতে গুণতে সাহা কী রকম খেলা দেখে টিভিতে, মার শচীন মার, ছ-ছঅ-ক-কা। মাধব বিশ টাকার মিষ্টি নিয়ে আয়। শোন, যাবি আর আসবি, থানায় গিয়ে মেজকর্তা সিংহবাবুর হাতে টাকাটা দিবি, বলবি বস্ত্রকুটিরের সাহাবাবু পাঠিয়েছে।

থানায় টাকা দেয় ?

দেয়, শোন মাধব, এতে বেনারসি আছে দুটো, দিয়ে আসবি বড়বাবুকে, ওর মেয়ের বিয়ে, একটা মেয়ে পরবে, একটা গিন্নি পরবে।

চা-দোকানি বীরেন বলল, আরিব্বাস! একেবারে সাহাবাবু মনে হচ্ছে।

অনিল হালদার বলল, তোর হবে কাত্তিক, আমারও হতো, আমি হতে দিইনি, আমি বালিকাবধু সিনেমায় বরযাত্রী হওয়ার অফার পেয়েছিলাম, হইনি, শালা সাহা হতে দেয়নি, খবরই দিল না।

সাহাবাবু করেছিল? জিজ্ঞেস করে বীরেন।

করেছিল কিন্তু ওকে দেখায়নি। বলে হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল অনিল, আমিও গিয়ে বলে এসেছিলাম, ওর টাকা যেন কেটে দেয়।

কার্তিক বলল, দোকানের খদ্দের দেখবে?

কী রকম, দেখা দেখি কাত্তিক। চা-দোকানি বীরেন বলে। কার্তিক দেখাচ্ছে বলেই গুটিগুটি জনাদশ লোক জড়ো হয়ে গেছে এখানে। চায়ের অর্ডার পড়ছে। কার্তিক দেখাচ্ছে। নবদম্পতিরা কীভাবে কথা বলে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। সাহাবাবুর বস্ত্র কুটিরে সব পাওয়া যায়। শাল সোয়েটার থেকে শাড়ি জামা প্যান্ট, গেঞ্জি; কী না? মারুতি গাড়ি থেকে নেমে যে দম্পতিরা পরস্পরের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে করতে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়, চার্লি চ্যাপলিনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়ায় একটু, ক্ষীণ হাসির রেখা উপহার দেয়। কার্তিককে—সব অবিকল দেখাতে থাকে কার্তিক।

অনিল হালদার জিজ্ঞেস করে, কখন দোকান থেকে বেরোয় সাহা বল দেখি।

কেন, কী দরকার?

আমি ওকে ধরব, শালা ছিল পুলিশের খোচড়, তোর তখন জন্ম হয়নি কাত্তিক, শালা সাহা ধরিয়ে দিয়েছে কতজনকে, পার্টি করত যোগেন, আমার জ্যাঠতুতো ভাই, তাকে না পেয়ে আমাকে ধরাল সাহা, পুলিশ কী ক্যালানি দিয়েছিল, আচ্ছা পুলিশের মনে কি দয়া নেই?

বীরেন চায়ের গ্লাসে চামচ ঠুনঠুন করতে করতে বলল, ওসব ফালতু কথা রাখো তো, তখন ওই রকম হতো।

কার্তিক জিজ্ঞেস করল, তোমার ভাই যোগেনের কী হলো?

হারিয়েই গেল, মরে গেছে হয়ত, আবার এমন হতে পারে বিলেত আমেরিকায় গিয়ে চাকরি করছে, ওর টাইপের স্পিড কত ছিল জানিস, আশি, একেবারে নিখুঁত, বানান ভুল হতো না একটাও।

আহ, থামাও না ওসব কথা। চা দোকানি বীরেন ভয় পায় যেন। এই দোকানের জন্য তাকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়মিত টাকা দিতে হয়। এরপর যদি ওদের কানে যায় এখানে বসে পুলিশের বিপক্ষে কথা বলে কেউ কেউ, লাথি মেরে দোকান ভেঙে দেবে। ভেঙে দিয়েছেও তো কয়েকবার।

কার্তিক চুপ করে থাকে। আস্তে আস্তে তার মেসিনে গিয়ে বসে দর্জির কাজে। কাজ নেই, সেলাই মেসিনে মাথা রাখে। তারপর মেসিন রেখে দোকানের সামনের সিঁড়িতে বসে। এক ফালি রোদ আছে সিঁড়িতে। সেই রোদে বসে কার্তিক হাঁটু ভাজ করে তার উপরে থুতনি রেখে চেয়ে থাকে সামনের দিকে। এই নিঃশব্দ রূপান্তর এত সহজে ঘটে যায় কার্তিকের ভেতর, সকলে অবাক হয়ে ওর মুখখানিকে দ্যাখে, চোখদুটিকে দ্যাখে। সব অন্যরকম লাগে। অন্য কারোর চোখ, অন্য কারোর মুখ হয়ত বা। কে? নাকি কেউ না, ও আসলে কার্তিকই। কিছু মনে পড়ে গেছে হঠাৎ, তাই মন খারাপ হলো এই এখনই। নাকি কার্তিক কাউকে দেখাচ্ছে ওই ভঙ্গিমার ভেতর দিয়ে। অনিল হালদার, চা-দোকানি বীরেন, বিড়ি সিগারেটের গুমটিওয়ালা, সবাই অবাক হয়ে কার্তিককে দ্যাখে। অনিলের আচমকা মনে পড়ে যায় যেন চার্লি চ্যাপলিনের কথা। চার্লি এইভাবে বসেছিল যেন কোথায়, কোন সিনেমায়। চার্লিই এইভাবে বসতে পারে, পারত। কার্তিক হয়ত চার্লিকে দেখাচ্ছে। নাকি ও এখন অন্য কেউ হয়েছে?

অনিল জিজ্ঞেস করে, কীরে মন খারাপ?

কার্তিক মাথা নাড়ে, তারপর বলল, মাধব এইভাবে বসে।

মাধব না চাল্লি ?

কার্তিক বলে, মাধবকে দেখাতে গিয়ে চার্লিকে দেখিয়ে দিচ্ছি আমি, আসলে চার্লির ভিতরে মাধবকে দেখা যায়। বলতে বলতে কার্তিকের গলা ভারী, গর্জন করে ওঠে, এই খানকির ছেলে, থানার মেজবাবু এল বউ নিয়ে, তুই চিনতে পারিসনি?

না। মাথা নাড়ে মাধব, ডেরেস ছিল না পুলিশের।

ড্রেস ছিল না বলে মানুষটা ছিল না, এই শুয়ারের বাচ্চা, আজ তোর একদিন কি আমার। মেজবাবু ফোন করেছে, একটা শাল, দুটো সোয়েটার নিয়েছে, দাম দিতে হয়েছে, তুই দেখেও দেখিসনি।

টুপি আর ডেরেস না থাকলে পুলিশ চেনা যায় না, চিনতেই পারিনি।

চিনতে পারিসনি, যা শুয়োরের বাচ্চা, পা ধরে ক্ষমা চেয়ে আয়, টাকা ফেরত দিয়ে আয়, এক লাথিতে তোকে শেষ করে দেব, যা বলছি।।

অনিল হালদার উত্তেজিত হয়ে উঠল, মারুক দেখি লাথি, কী হলো তারপর?

কার্তিক বলল, মাধব এইভাবে বসে থাকল থানা থেকে ফিরে, ঠিক এইভাবে।

আহা! অস্ফুট উচ্চারণ করে অনিল হালদার।

অনিল আর কার্তিকের এই সমস্ত কথাবার্তা অধিকাংশর পছন্দ হয় না। চা-দোকানিরও না। এই সব কথায় আনন্দ নেই। চার্লি চ্যাপলিন শুধু হাসায়, কিন্তু কার্তিক হাসাচ্ছে কই? কার্তিক আর শাহরুখ, আমীর খানের ডায়ালগ বলছে না, মিঃ ইন্ডিয়ার মোকাম্বোর ডায়ালগ বলছে না। যে সব কথা বলছে কার্তিক তা সিনেমায় থাকে না। কার্তিক এই ভূতনাথ বিশ্বাস বাই লেন থেকে শ্যামবাজারের প্রশস্ত রাজপথে গিয়ে বদলে গেছে। এইরকম বদলে যাওয়া ঠিক পছন্দ হচ্ছে না অনেকের। কিন্তু কার্তিকের ভাবভঙ্গি না দেখেও তো থাকা যায় না। তাই তাকেই ঘিরে থাকা।

তিন

ভূতনাথ বিশ্বাস বাইলেনের শীতার্ত প্রায় রৌদ্রহীন পথে শীতের সকালে কার্তিক না এলে কেউ বড় একটা দাঁড়ায় না। চায়ের দোকানের ধূমায়িত চায়ের লোভে যদিও বা দাঁড়ায়, চা শেষ হলে দ্রুতপায়ে রৌদ্রের সন্ধানে চলে যায়। এই গলিটা সঙ্কীর্ণ, দু’পাশে জীর্ণ ঘরবাড়ি সমস্ত দিন ছায়া ফেলে রাখে এখানে। শুধু মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে সূর্য উত্তরায়ণে যেতে থাকলে বেলা সাড়ে নটা দশটা নাগাদ লম্বা একফালি রোদুর এসে পড়ে উত্তরমুখো গলিটার ওই প্রান্তে। এই শীতের গলি উষ্ণ হয়ে ওঠে শুধু কার্তিক থাকলে। কার্তিকের মুখ চেয়ে থাকে চা-দোকানি বীরেন। সন্ধে থেকে এখন তো ঝাঁপ প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে আরম্ভ করেছে। আবার একদিন সকলে দেখল কার্তিক তার দোকানের সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ভাবলেশহীন চোখমুখ। সেই আগের দিনের মতো। এই ভঙ্গিটা মাধবের কি? নাকি চার্লির? এত অন্ধকার মুখ, বসার ভঙ্গিতে চার্লিকে মনে করিয়ে দেয়।

কী হয়েছে রে, ও কার্তিক ?

কার্তিক চুপ করে থাকতে সবাই ভাবল হয়ত ওর নিজেরই মন খারাপ। ও কাউকে দেখাচ্ছে না, নিজেকে দেখাচ্ছে। কে একজন জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোর, এভাবে বসে আছিস কেন?

জবাব পায়না কেউ। জবাব না পেয়ে যায়ও না। যাবে কোথায় অনিল হালদার, দেবু রায়’রা, যাওয়ার জায়গাই বা কোথায়? তাদের কি কাজ কম্মো আছে? দেবুর জুটমিল বন্ধ, কী করে চলে তা ও নিজেই জানে না। তারা কেউ বিড়ি ধরায়, কেউ পানপরাগ মুখে নিল, কেউ চায়ের অর্ডার দিল, চা-দোকানি কাউকে বলল, আগের দিনের পয়সা মেটাতে। এর ভিতরেই বিষণ্ণ কার্তিককে দেখে কেউ কেউ আন্দাজ করতে চাইল কোন ভূমিকা নিয়ে বসে আছে সে, রাজ কাপুর কি এমন ভাবে বসেছিল কোনো এক সিনেমায়? নাকি অনেকটা এই রকম দেখেছিল উত্তমকুমারকে, কাছেই চিতায় পুড়ছিল নায়িকা, নেপথ্যে গান ছিল—প্রায় সেইরকম। ক’দিন আগে সেই ছবিটা দেখালো তো টেলিভিশনে।

অনেক সময় বাদে কার্তিক বলে ওঠে, মাধবকে পুলিশে দিয়েছে সাহাবাবু, মাধব চুরি করেছিল।

কী সব্বোনাশ! পুলিশ! কী চুরি করেছিল মাধব, জামাকাপড়, প্যান্ট পিস, বেনারসি না আন্ডারপ্যান্ট? জিজ্ঞেস করে অনিল হালদার।।

ওসব না, সাহাবাবুর মানি ব্যাগ।

মানি ব্যাগ! কত ছিল?

সব হাজার টাকার নোট, কুড়িটা।

হাজার টাকার নোট! হাজার টাকার নোট হয়? অনিল জিজ্ঞেস করে।

হয়।

তুই দেখেছিস?

না। মাথা নাড়ে কার্তিক।

কেউ দেখেছে?

উহু। সকলেই মাথা নাড়ে।

অনিল হালদার বলে, সাহার ওসব ফোর টোয়েন্টি মার্কা কথা, হাজার টাকার নোট নেই।

থাকতেও তো পারে। কেউ একজন বলল।

ছাপালে থাকবে, আড়াইশো টাকার নোট আছে? পঁচিশ টাকার নোট আছে? তিনশো টাকার?

নেই। চায়ের দোকানি বীরেনও বলল, তার কাছে তো নানা দামের নোট আসে, একবার পাঁচশো টাকার নোটও নিয়ে এসেছিল কে যেন, কিন্তু হাজার টাকা কেউ আনেনি, হাজার টাকার কথা কেউ বলেনি।

কার্তিক বলল, হাজার টাকার নোট হয়, না হলে ওই কথা ডায়েরিতে লিখবে কেন সাহাবাবু।

মাধব নিল, মানি ব্যাগ পাওয়া গেছে?

উহুঁ, মাধবকে কাল খুব পিটিয়েছে পুলিশ, আমি থানায় গিয়েছিলাম কাজ সেরে ফেরার পথে।

তারপর?

মাধবকে আমার সামনেই বুট নিয়ে লাথালো মেজবাবু। মাটিতে লুটিয়ে ছিল মাধব, লাথি খেয়ে উঠে বসল এইভাবে, আমাকে যেন চিনতেই পারল না, মুখ ঢাকল দু-হাতে।।

তারপর কী হলো? অনিল জিজ্ঞেস করল।

সত্যি কথাটা বলে দে মাধব।

কার্তিক বলল, পুলিশ বলছিল, সাহাবাবুর এত নুন খাই, তার দাম দেবনা, টাকা বের, কর মাধব।

তারপর?

পুলিশ বলল, তাহলে বল কে চোর, নইলে তুই চোর, এমন কেসে ঢোকাব যে জেলে পচবি হাত-পা ভেঙে।

তারপর কী হলো?

তুই জানিসনে তোর বাপ জানে, এরপর তোর বাপকে নুলো করে দেব, তোর বোনকে এখানে এনে ফেলব কুকুরের বাচ্চা, তার কী হাল হবে তা জানিস, ইঁদুরে খেয়ে নেবে ওকে, তোদের ভিখিরি বানিয়ে দেব বানচোত, টাকা বের কর।

কার্তিক বলে যাচ্ছিল। কেউ আর দাঁড়াচ্ছিল না। সবার ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল এইরকম হতে পারে। তাদেরও তুলে নিতে পারে পুলিশ। তখন যে কী হবে! কার্তিক এসব বলছে কেন মাধবের মতো করে? মাধব হয়ে এসব কেন বলছে কার্তিক?

শেষে অনিল হালদারও চলে যায়। কার্তিক একা বসে থাকে তার সেলাই মেসিনের উপর মাথা হেলিয়ে। কী করুণ মুখখানি তার। চোখ ভর্তি জল। মাধব ছাড়া আজ আর কিছুই হতে পারছে না কার্তিক। না শাহরুখ, না আমীর খাঁ, অক্ষয়কুমার।

চায়ের দোকানি বীরেন বলল, আজ বাড়ি যা।

কোন মুখে যাব দাদা? আমি চোর, পুলিশ ধরেছিল আমাকে, অথচ ছেড়ে দিল, মানি ব্যাগ পেয়ে গিয়েছিল সাহাবাবু স্যার।

কী বলছিস কাত্তিক, তোর কী হয়েছে, তুই এসব কেন বলছিস, যা যা বাড়ি যা।

কার্তিক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তার শ্বাস প্রশ্বাস যেন বইছিল না। গলিতে হু হু করে ঢুকছিল শীতের বাতাস। বীরেন এগিয়ে এসে কার্তিকের হাত ধরল, এসব দেখাবি না এখানে, কেউ দ্যাখে না, ভয় পেয়ে যায় সবাই।

কার্তিক হাসে। কী দুঃখের ছায়া সেই হাসিতে। মাথা নিচু করল কার্তিক। মাথা আর তুলছিল না মাধবের লজ্জায়।

পরের দিন সকালে খবর এল। কার্তিকের বাবা দীনেশ ছুটতে ছুটতে আসে ভূতনাথ বিশ্বাস বাই লেন ধরে। সব্বোনাশ হয়ে গেছে তার।

গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে কার্তিক? কী হয়েছিল তার? সমস্ত দিন মাথা নিচু করে বসেছিল, কিছুই বলেনি বাড়িতে।

পাড়া ভেঙে পড়ল কার্তিকদের ভাঙা বাড়িতে। অনিল হালদার চিৎকার করতে লাগল, সে জানে কেন মরেছে কার্তিক, কী জন্য মরেছে। ওই যে ঝুলছে কার্তিক। কার্তিক নয়, ঠিক যেন মাধব। মাধব মাধব! টাকা চোর! না মরে পারেনি মাধব। না মরে ওর উপায় ছিল না।

একজন এসে অনিলের মুখ চেপে ধরল। পুলিশে খবর গিয়েছিল। পুলিশ এবার লাশ নামাবে। লাশ নামানোয় তাদেরই অধিকার।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত